অনন্তলোকে চলে গিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’র স্রষ্টা। তিনিই এ দেশে পাঠক সৃষ্টিতে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর গড়া সেবা প্রকাশনী এবং সম্পাদিত ‘রহস্য পত্রিকা’ ও ‘কিশোর পত্রিকা’র সূত্রেই এ দেশে শতাধিক লেখক ও অনুবাদক তৈরি হয়েছেন, যারা আজ সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের বিষয়টি বেশ চিত্তাকর্ষক। পাখি শিকারের বন্দুক কিনতে টাকা সংগ্রহের জন্য তিনি লিখেন ‘কুয়াশা’ সিরিজের প্রথম দুটি বই। বইগুলো প্রকাশ করতে গেলে এক প্রকাশক জানান, ১০টি বইয়ের কমে তিনি প্রকাশ করবেন না। আরেক প্রকাশক সম্মানী দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তখন বাবা স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও দাবাড়ু কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন বইগুলো রেখে দিতে। পরে সময়-সুযোগ মতো নিজেই প্রকাশ করার পরামর্শও তিনি দিয়েছিলেন। বাবার কথা শিরোধার্য করে সেটাই করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন । ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু করেছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেগুন বাগান প্রকাশনী তথা সেবা প্রকাশনী। এই প্রকাশনী থেকেই প্রথম বের হয় কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো। কুয়াশা একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর ছদ্মনাম, ঘটনাচক্রে খুনিতে পরিণত হয় এবং ফেরারি জীবনযাপন করে। তার বোন মহুয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় বিখ্যাত গোয়েন্দা শহীদের। কুয়াশা একের পর এক কাণ্ড ঘটিয়ে চলে আর গোয়েন্দা শহীদ তাকে ধরার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। রহস্যময় ঘটনার রহস্যও সে উন্মোচন করে।
অন্যদিকে ১৯৬৬ সালের মে মাসে আত্মপ্রকাশ করে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ। এ সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’। বইটির পটভূমিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরার জন্য কাজী আনোয়ার হোসেন মোটর সাইকেলে ভ্রমণ করেছিলেন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও কাপ্তাই। ‘ধ্বংস পাহাড়’ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার। বইটিতে পাঠকদের জন্য ছিল রহস্য-রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার ও যৌনতা। তাই ‘শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য’ এ তকমা এঁটে বইটি প্রকাশ করা হয়। পরের বইগুলোর ক্ষেত্রেও তা বজায় থাকে। কিন্তু কিশোরেরাও যেহেতু এ সিরিজের পাঠক ছিল এবং তারা ‘মাসুদ রানা’ পড়ত লুকিয়ে, তাই পরে এই সিরিজে যৌনতার আভাস থাকত, ডিটেইলসে তা আর থাকে নি। এখন পর্যন্ত সেই ধারাই চলে আসছে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে হয়, মাসুদ রানায় সেক্স বা যৌনতার জন্য যারা সমালোচনা করেছেন, তারা ভুলে যান যে বিষয়টি আমাদের জীবনেরই অংশ। ওইসব সমালোচক, যারা মাসুদ রানা পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তাদের উদ্দেশে এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ‘রুটি কাটার ছুরি সব বাসাতেই আছে। সেটা দিয়ে কে রুটি কাটবে আর মানুষ কাটবে সেটা তার সিদ্ধান্ত। মাসুদ রানা বই থেকেও কে কী গ্রহণ করবে সেটা তার ব্যাপার।’
২.
গীতিকার মাসুদ করিমের নামের প্রথম অংশ এবং নিজের প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র রানা প্রতাপের অংশ নিয়ে ‘মাসুদ রানা’ নামটি সৃষ্টি করেছিলেন কাজী আনোয়ার। মাসুদ রানার বস-এর নামের ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন সাংবাদিক-লেখক রাহাত খানের নাম।
মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টিলেজেন্সের এক নম্বর স্পাই। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশে। নারীদের আকর্ষণ করে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।
মাসুদ রানার প্রথম দুটি বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ ও ‘ভারত নাট্যম’ মৌলিক গ্রন্থ। এ দুটি বইয়ের সুলতা ও মিত্রাও কাজী আনোয়ার হোসেনের অনন্য সৃষ্টি। তৃতীয় বই ‘স্বর্ণমৃগ’ থেকেই কাজী আনোয়ার হোসেন বেছে নেন এডাপ্টেশনকে। অর্থাৎ বিদেশি বইয়ের ছায়া অবলম্বনে একের পার এক মাসুদ রানা প্রকাশ করা। সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে কাজী আনোয়ার কাহিনি সংগ্রহ করেছেন ইয়ান ফ্লেমিং, অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, রবার্ট লুডলাম, ফ্রেডরিক ফোরসাইথ, উইলবার স্মিথসহ অনেক লেখকের বই থেকে। অবশ্য মাসুদ রানা সিরিজের ‘পিশাচ দ্বীপ’ও কাজী আনোয়ারের মৌলিক আরেকটি গ্রন্থ।
মাসুদ রানার একটি অভিনব বিষয় হলো, রানার বয়স বাড়ে না। সেই ত্রিশ বছরের মধ্যেই আটকে আছে সে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রের নানা নতুন দিকের সঙ্গে পাঠক পরিচিত হচ্ছে। অন্য কথায়, মাসুদ রানার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুমাত্রিকতা। রানাকে তার স্রষ্টা অসংখ্যবার ভেঙেছেন। এ প্রসঙ্গে ‘বিদায় রানা’র কথা বলা যায়। এখানে রানাকে পাঠকেরা অন্যভাবে পায়। সেখানে আইসবার্গের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা এক কথায় অসাধারণ। আবার ‘আই লাভ ইউ ম্যান’-এ রয়েছে অভিযানমূলক উপাখ্যানের ছাপ।
মাসুদ রানার একটি ভীষণ জনপ্রিয় বই ‘অগ্নিপুরুষ’। এ বইটি লেখার একটি ইতিহাস রয়েছে। কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে ‘ম্যান অন দি ফায়ার’ বইটি অনুবাদ করার জন্য দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। হুমায়ূন তখন লিখলেন ‘অমানুষ’। এটি কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত রহস্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ‘অমানুষ’ পছন্দ করেন নি কাজী আনোয়ার হোসেন। কেননা বইটি হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন নিজের মতো করে। মূল বইটির আবেদন এখানে অটুট থাকে নি, এমনটাই মনে করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি তাই লিখলেন ‘অগ্নিপুরুষ’।
‘অগ্নিপুরুষ’ প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হলো, এই বইয়ে একটি কবিতা রয়েছে। ‘অগ্নিপুরুষ’ প্রকাশের পরে বিটিভিতে প্রচারিত হয় রুনা লায়লার একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান। সেখানে একটি গান ছিল ‘যখন থামবে কোলাহল...’। এই গানের কথার সঙ্গে আশ্চর্য্য মিল দেখা গেল ‘অগ্নিপুরুষ’-এর ওই কবিতার। সঙ্গত কারণেই সেই সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, মাসুদ রানার একাদশ গ্রন্থ ‘বিস্মরণ’ অবলম্বনে ১৯৭৪ সালে ‘মাসুদ রানা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মাসুদ পারভেজ এবং নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সোহেল রানা নামে। বিটিভিতে একটি প্যাকেজ নাটক প্রচারিত হয়েছিল, সেটি নির্মিত হযেছিল মাসুদ রানার ‘পিশাচ দ্বীপ’ অবলম্বনে। আগামীতে জাজ মাল্টিমিডিয়া বড়পর্দায় আনতে চলেছে মাসুদ রানাকে, যেখানে মাসুদ রানার ভূমিকায় দেখা যাবে নতুন মুখ।
৩.
শুধু মাসুদ রানা কিংবা কুয়াশা সিরিজ নয়, বহু রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ের অনুবাদও করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। শামসুদ্দিন নওয়াব নামের আড়ালেও তিনি বহু বই লিখেছেন। বিদ্যুৎ মিত্র নামে লিখেছেন বেশ কয়েকটি আত্মউন্নয়নমূলক বই। এমনই একটি বই ‘যৌনসঙ্গম’, যা কাজী আনোয়ার হোসেন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর ছেলেকে। তাঁর বইয়ের প্রথম দিকের প্রচ্ছদ করেছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাৎ চৌধুরী।
৪.
কাজী আনোয়ার হোসেন একজন গুণী কণ্ঠশিল্পীও ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত টানা দশ বছর তিনি গান গেয়েছেন। রেডিও-টিভিতে নজরুলসংগীত, আধুনিক ও পল্লিগীতি পরিবেশন করতেন তিনি। এ দেশের বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকেও রয়েছে তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় গান। এমনই একটি গান হচ্ছে ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস’। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির এই গানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলিম।
৫.
কাজী আনোয়ার অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। বহুদিন পর আবার ফিরে আসতেন।
খুবই ভালো বাঁশি বাজাতেন কাজী আনোয়ার হোসেন। গভীর রাতে বাঁশি বাদনের বিষয়টি ছিল তাঁর একটি প্রিয় বিষয়।
তিনি মাছ ধরতে ভালোবাসতেন। অল্প বয়সে কবুতর পালনও ছিল তাঁর আরেকটি প্রিয় একটি বিষয়।
কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলা রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে একটি জ্বলজ্বলে নাম। এই নামটি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.