নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৯)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৯)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১৯তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২ 
পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮

দেশে এসেও ফাহিমকে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে।

ওর অফিসের কাজের জন্য হাই-স্পিড ইন্টারনেট কানেকশন দরকার। গ্রামীনফোনের মোডেম দিয়ে শিকাগোতে অবস্থিত অফিসের সার্ভারে যুক্ত হতে সমস্যা হচ্ছে। ওকে কেউ একজন পরামর্শ দিল, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ, শেরাটন অথবা র‌্যাডিসন হোটেলের লবিতে বসে কাজ করতে। সেখান থেকে বেটার কানেকশন পাওয়া যাবে। ফাহিমের বোনের বাসা থেকে হোটেল র‌্যাডিসন মোটামুটি কাছেই। সে তার মায়ের সঙ্গে দিনের অর্ধেকটা সময় কাটায়। এবং প্রতিদিন বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় হোটেলের লবিতে বসে অফিস ল্যাপটপ থেকে রিমোট কানেকশনের মাধ্যমে মিটিং এবং প্রজেক্টের কাজ করে। শিকাগোর সকাল ন’টা মানে বাংলাদেশে রাত ন’টা। ওদের টিম মিটিং থাকে সকাল ন’টায়। কাজেই ফাহিমকে রাত সাড়ে ন’টা-দশটা পর্যন্ত থাকতে হয় মিটিংয়ের জন্য।

সিমি তার অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে র‌্যাডিসনের লবিতে এসে ফাহিমের সঙ্গে দেখা করে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ফাহিমের পাশে বসে জীবনের গল্প শোনায়। মিটিং শেষে ফাহিম সিমিকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়।

একদিন অফিসের কাজে ঝামেলা হওয়াতে ফাহিমকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হলো। সে তার ছোট বোন লীনাকে জানাল ফিরতে দেরি হবে। লীনা অনেক করে বলে দিল, রাত বেশি হলে যেন কিছুতেই না ফেরে ফাহিম। ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে রাস্তায় বিপদ ও ছিনতাইকারীরা ওঁত পেতে থাকে। অগত্যা অধিক রাতে বাসায় না গিয়ে রাতটা হোটেলেই থেকে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ফাহিম।

লীনার সাথে কথা শেষ করে ফাহিম সিমিকে বলল, ‘চলো, তোমাকে একটা ক্যাব ঠিক করে দিই।’

সিমি ঘড়ি দেখল। ‘আমি এত রাতে একা একা যেতে পারব না।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল সে।

‘তাহলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। দেখতেই পাচ্ছ, অফিসের কাজে কেমন আটকা পড়ে আছি। আমাকে আরও কতক্ষণ এনগেজ থাকতে হবে ঠিক নেই।’

‘কতক্ষণ হতে পারে? এনি গেস?’

‘বলতে পারছি না। এক ঘণ্টাও হতে পারে। আবার সারা রাতও লেগে যেতে পারে।’

‘সমস্যা নেই, তুমি তোমার মতো কাজ করো। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করব না।’

‘কিন্তু আমি তো সারা রাত লবিতেই বসে থাকব না। টায়ার্ড হয়ে যাব। তাই তো রুমের রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছি।’

‘তো?’

‘আমাকে তো রুমে যেতে হবে।’

‘জানি।’

‘তুমি কী করবে?’

‘আমিও যাব।’

‘কোথায়?’

‘তোমার রুমে।’

‘মাথা ঠিক আছে?’

‘এখনো আছে।’

‘ভয় লাগবে না?’

‘তুমি কি বাঘ না সিংহ যে ভয় লাগবে?’

‘এতটা বিশ্বাস করছ কিসের ভরসায়?’

সিমি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে জানে ফাহিমের প্রতি কেমন যেন একধরনের বিশ্বাস চলে এসেছে তার। সেটা অন্য একরকমের বিশ্বাস। সাঁতার না জানা মানুষের নৌকার মাঝির প্রতি বিশ্বাস। সিমি নিজেও জানে না কেন—কী কারণ। কিছু ব্যাপার থাকে ব্যাখ্যার অতীত। সে বলল, ‘কিসের ভরসায় করছি তা জানি না। তবে করেছি। আর এই বিশ্বাস করেছি বলেই, তুমি এমন কিছুই করবে না যে সে বিশ্বাস ভেঙে যায়। তুমি ভালো করেই জানো, বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলেই বিপদ।’

‘ভয়টা তো সেখানেই। কারণ আমি মানুষ।’

‘তো?’ অবাক দৃষ্টিতে তাকাল সিমি।

‘মানুষের চেয়ে হিংস্র কোন প্রাণী আছে বলো পৃথিবীতে? পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর প্রাণী হলো মানুষ। যার বৈজ্ঞানিক নাম—হোমো স্যাপিয়েন্স।’

‘ভয়ংকর! কীভাবে?’

‘বলছি।’ বলেই ফাহিম গড়গড় করে কতগুলো তথ্য আওড়াল। ‘সিম্পল কয়েকটি উদাহরণ দিই। এই যেমন ধরো—

—প্রাণীরাজ্যে অন্য কোনো প্রাণী অকারণে, বিনা প্রয়োজনে বা সামান্য কারণে, রীতিমতো পরিকল্পনা করে স্বজাতিকে হত্যা করে না। মানবজাতি এ কাজটি নির্বিচারে করে।

—ধর্ষণ, একমাত্র মানবজাতির মধ্যেই শোনা যায়। আমি অন্তত অন্য প্রাণীদের মধ্যে এই অপরাধ হয় বলে শুনি নি। এর থেকে ভয়ংকর আর কী হতে পারে, বলো?

—মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কিনা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে প্রেমের মানুষকে অ্যাসিডে ঝলসিয়ে দেয়। অন্য কোনো প্রাণী যাকে ভালোবাসে তার সাথে এই নিষ্ঠুর ব্যবহার করে? করে না।

খুঁজলে এমন শত শত কারণ বের করা যাবে। তবে এইটুকু যথেষ্ট।’

 

সিমিকে বসিয়ে রেখে ফাহিম ফ্রন্ট ডেস্কে গেল রুমের ব্যবস্থা করতে।

ফাহিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সিমি ভাবে, মানুষটা কেমন সহজ। কোনো প্যাঁচঘোঁচ নেই। কোনো অহংকার নেই। নেই কোনো লুকোচুরি। যা ভালো লাগে তাই করে। অকপটে বলে দেয় মনের কথা। অথচ কী ভীষণ মার্জিত! তার কথায় যেন কেউ কষ্ট না পায়, সেদিকেও লক্ষ রাখে সচেতনভাবেই। এমনই এক সুন্দর মনের মানুষ ফাহিম। সিমি যতই ভাবে ততই ভালো লাগায় হারিয়ে যায়।

আমেরিকান পাসপোর্ট থাকায় রুম পেতে কোনো সমস্যাই হলো না ফাহিমের। এখানকার রেস্টুরেন্টে বসে তারা দুজন ডিনার সেরে ফেলেছিল আগেই। কাজেই রাতের খাবার নিয়ে আপাতত চিন্তা করতে হবে না। ফাহিমকে কত রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে কে জানে! এর আগে একদিন ভোর চারটা পর্যন্ত ওকে কাজ করতে হয়েছে। বেশি খিদে পেলে অবশ্য রুম সার্ভিস থেকে খাবার আনিয়ে নেয়া যাবে।  

ফিরে এসে ফাহিম তাকাল সিমির দিকে। গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘আরেকবার ভালো করে ভেবে দেখো সিমি।’

‘মনে হচ্ছে তোমার নিজের ওপরই কনফিডেন্স নেই।’ ভুরু কুঁচকে বলল সিমি।

ফাহিম অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সিমির দিকে। কিন্তু কিছু বলল না।

‘তোমার নিজের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আমার থাকবে কেন? তাছাড়া’— কথা শেষ না করে চুপ করে গেল সিমি।

ফাহিম তাকিয়ে রইল সিমির মুখের দিকে, শেষ না করা কথা শোনার জন্য।

সিমিও তাকাল ফাহিমের চোখের দিকে। সহজ কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভালো করেই জানো ফাহিম, আমি তোমাকে কতটা বিশ্বাস করি। আমাদের সম্পর্ক তো দাঁড়িয়েই আছে বিশ্বাসের ওপর। তাই নয় কি?’

ফাহিম কিছু বলল না। কিছুক্ষণ ভেবে তার ল্যাপটপ ব্যাকপ্যাকে ভরে উঠে দাঁড়াল।

আজ সিমির মনটা অনেক ভালো— বেশ ফুরফুরে।

চমৎকার মেজাজে আছে সে। ক্ষণে ক্ষণে সে ঘড়ি দেখছে। তার কর্মচঞ্চল দিনটি কখন শেষ হবে— সেই অপেক্ষাতেই সে আছে।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। শীতের স্নিগ্ধ বিকেলের শুরু। সিমি তার অফিসের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পড়ন্ত বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। আকাশের চারিদিকে নীল রঙের প্রলেপ দেওয়া, যেন মুগ্ধ করার মতো এক অনাবিল ধোঁয়া। এমন স্নিগ্ধ বিকেল বেলার মতো যদি সবার জীবন হতো! আহা।

ঘড়ির কাঁটার ঠিক পাঁচটায় ফাহিম এসে হাজির হলো সিমির অফিসের সামনে। মেসেজ পাঠাতেই সিমি নেমে এল দ্রুতই। ঢাকা শহরের জ্যাম ভেঙে ফাহিমের ঘড়ির কাটায় কাটায় নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টা ভীষণ অবাক হওয়ার মতো। সিমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল একদিন, ‘ক্যামনে সম্ভব ম্যান, ক্যামনে?’

‘ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব!’ ফাহিমও তার স্বভাবসুলভ বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে নিয়ে উত্তর দিল, ‘তুমি কি চাকরির ইন্টারভিউ কিংবা পরীক্ষার হলে কখনো দেরি করে যাবে? নিশ্চয়ই না।’

‘না তা যাব না। কিন্তু ঘড়ির কাটা ধরে আমার মতো একজন সামান্য মানুষের সঙ্গে দেখা করতে হবে এমন মাথার দিব্যি নিশ্চয়ই তোমাকে কেউ দেয় নি। একটু দেরি হলেই-বা কী? আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।’

‘যাচ্ছ না জানি। তবুও কাউকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক না। অপেক্ষা করা অনেক কষ্টের— আর তা যদি হয় প্রিয়জনের জন্যে।’

সিমি চকিতে তাকাল ফাহিমের দিকে। হাসল মিষ্টি করে। বলল, ‘প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষা করার মধ্যেও কিন্তু এক গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।’

‘থাকে না-কি? কী জানি?’ ফহিম হাসল দুষ্টুমির হাসি।

সিমি হাসল না। দার্শনিকের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমার কী মনে হয় জানো? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ শুধু অপেক্ষাই করে। মানুষের জন্মই হয়েছে অপেক্ষা করবার জন্য।’

ফাহিম হো হো করে হেসে ফেলল কিন্তু পরক্ষণেই সিমির গম্ভীর চেহারার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। সিমির মনের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু কী সেটা? একটু ভেবে ফাহিম বলল, ‘থাক অপেক্ষা নিয়ে আর অ্যানালাইসিস করে কাজ নেই। তারচেয়ে বরং চল, কোথাও বসে এক কাপ চা কিংবা কফি খাই।’

‘বেশ চল।’

ওরা দুজনেই উঠে বসল একটি রিকশায়। এমন স্নিগ্ধ পড়ন্ত বিকেলে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে সামান্য রিকশাভ্রমণের আনন্দও অনেকগুণ বাড়িয়ে দিল।

 

‘কাল তো তোমার বন্ধ, কী করতে চাও?’

কফিশপের ব্যালকনিতে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল ফাহিম।

‘তোমার কী ইচ্ছে?’ সিমির পাল্টা প্রশ্ন।

‘আগেই বলেছি, তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।’ বলেই ছোট করে হাসল ফাহিম।

‘চল, তোমাকে কোথাও নিয়ে যাই।’

‘কোথায় নিয়ে যেতে চাও?’

‘যে-কোনো জায়গায়।’

‘জ্যামের কথা ভাবলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছেটা মরে যায়। তখন মনে হয় ঘরেই থাকি।’

‘তাই তো আছ।’ সিমির কণ্ঠে অনুযোগ ফুটে ওঠল। ‘ভ্যাকেশনে এসেও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছ। পুরো অফিসের কাজ ব্যাকপ্যাকে ভরে নিয়ে কেউ দেশে বেড়াতে আসে?’

সিমির কথার ধরনে হো হো করে হেসে ফেলল ফাহিম। ‘উফ! আচ্ছা যাও, কাঁধে আর অফিস নিয়ে বের হব না। আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? চল, কোনো পার্কে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করি।’

‘পার্ক?’ ভুরু কুঁচকে বলল সিমি। ‘এটা কি তোমার শিকাগো শহর মিস্টার? এখানে তুমি পার্ক পাবে কোথায়?’

একটু ভেবে বলল ফাহিম, ‘উমম, তাহলে তোমাকে কাল আমি রান্না করে খাওয়াব। আমি কিন্তু বেশ মজার রান্না করতে পারি। খিচুড়ি আর ডিম ভুনা— আমার স্পেশালিটি। চলবে? চাইলে ইলিশ ফ্রাইও হতে পারে।’ সিমির জন্য নতুন প্রস্তাব দিল ফাহিম।

‘সেটা হতে পারে— আইডিয়া খারাপ না। মেনুটা তো লোভনীয়। আমার তো এখনই জিভে পানি চলে আসছে।’

‘তোমার ফ্রিজে মাছ আছে?’

‘কী জানি, না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আমি কি আর প্রতিদিন রান্না করি নাকি? একা মানুষের রান্না— কিছু একটা হলেই হয়।’

‘তাহলে?’

‘সমস্যা নেই— ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে নিয়ে নিলেই হবে।’

‘গ্রেট। তাহলে কাল আমাদের কুকিং ডেট!’ হেসে দিয়ে বলল ফাহিম।

‘কুকিং ডেট। সাউন্ডস রিয়েলি গুড।’ সিমি মিষ্টি করে একটা মন কেড়ে নেয়া দুষ্ট হাসি উপহার দিল।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.