শম্পা কী চায়? (নবম পর্ব)

শম্পা কী চায়? (নবম পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন নবম পর্ব।]

রূপবতী শম্পা আমাকে ওর অ্যাপার্টমেন্টে যেতে বলেছে। যাব নাকি যাব না?

শম্পার বাথরুমের ট্যাপে সমস্যা হয়েছে। পানি পড়ছে তো পড়ছেই। ব্যাপারটা ও রোকসানাকে প্রথম জানিয়েছে। রোকসানা আমাকে বলেছে পারলে আজই যেতে। আমি ভালোমানুষী করে রোকসানাকে বলেছি, না, না রুকিমণি, আমি শম্পার অ্যাপার্টমেন্ট একা যেতে চাই না। কে আবার কী বলবে!

ওমা, একা যাবে কেন?

মানে?

তুমি কি কল সারাতে পারো? মিস্ত্রি নিয়ে যেতে হবে না? আমি মজিদকে বলে রেখেছি। তুমি হাতিরপুল থেকে মজিদকে উঠিয়ে নেবে।

হুম।

মজিদের মোবাইল নম্বর আছে?

আছে।

ভেবেছিলাম রোকসানা বলবে, অসুবিধা নাই, তুমি একাই যাও। না পারলে মিস্ত্রি ডেকো। রোকসানা মিস্ত্রি নিয়ে যেতে বলায় মনটা একটু দমে গেল। কেন দমে গেল? আমি তো শম্পার হাত থেকে বাঁচতে চাই, নাকি?

ওইদিন বিকেলে অফিস শেষে সোজা হাতিরপুল বাজারে চলে এলাম। বাজারের মোড়ে গাড়ি পার্ক করে মজিদকে আসতে বললাম। একটু আগে এলিফ্যান্ট রোডের ট্রাফিক সিগনালে একটা খুদে ফুলওয়ালি আমাকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ গছিয়ে দিয়েছে। ওগুলো শম্পার ওখানে কোনো ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে, না হলে মরে যাবে।

মিনিট পাঁচেক পর মজিদ গাড়িতে উঠে বসল। ওর সঙ্গে একটা বড়ো টুলবক্স। মজিদ ব্যস্ত হয়ে বলল, একটু দেরি হয়ে গেল ভাইজান, দোকানে কাস্টমার ছিল।

মজিদের হার্ডওয়্যারের দোকান। দরজার লক, পানির পাইপ, টয়লেটের ট্যাপ, ইলেক্ট্রিক ক্যাবল, সবই পাওয়া যায়। ওর লোকরা ফিটিং করে দেয়। নষ্ট হলে সার্ভিস দেয়। আমি মজিদের দিকে তাকিয়ে বললাম, অসুবিধা নাই মজিদ। তোমার আপা বলেছে কী কাজ?

হ্যাঁ, ভাইজান। আমি ট্যাপ নিছি। আবার এমনও হইতে পারে যে পানির পাইপে পবলেম, ওই জন্য টুলবক্স নিছি।

বিশ মিনিটের ভেতর আমরা মগবাজার পৌঁছে গেলাম। অমরাবতী অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দোতলার কলিং বেলে চাপ দিতেই শম্পা দরজা খুলল। ও আজ ঠোঁটে স্কারলেট রঙের লিপস্টিক মেখেছে, মাথায় চুড়োখোঁপা, সাদা সালোয়ার কামিজে ওকে মোহনীয় লাগছে। কিন্তু তাতে আমার কী? আমি গোলাপের গুচ্ছ শম্পার হাতে দিয়ে বললাম, এগুলো ফুলদানিতে রাখতে পারবে?

বাহ, লাল গোলাপ? আমার জন্য?

না, একটা বাচ্চা রাস্তায় জোর করে কেনালো। পানিতে ভিজিয়ে না রাখলে মরে যাবে।

প্রেম একটি লাল গোলাপ।

কী?

উফ, প্রেম একটি লাল গোলাপ বইটা কার লেখা, প্রফেসর?

জানি না।

বাংলা উপন্যাসের গুরু রশীদ করিমের। তুমি চান্দু একটা টানেল-ভিসন পারসোনালিটি। ইংরেজি সাহিত্য ছাড়া কিছুই জানো না।

আমি মজিদকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে নিয়ে গেলাম। তা না হলে শম্পা ওর সামনেই বারবার আমাকে তুমি, চান্দু এসব বলে ইজ্জত ডুবিয়ে ছাড়বে। বাথরুমের সিঙ্কের ট্যাপটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। মজিদ বাঁধন খুলতেই জলপ্রপাতের মতো পানি পড়া আরম্ভ করল। তার মানে শম্পা ব্লাফ দেয় নি। মজিদকে ওর কাজ করতে দিয়ে আমরা ড্রইংরুমে এসে বসলাম। শম্পা বলল, চান্দু, ভাঙা ট্যাপ নিয়ে ব্রিটিশ রাজকবির একটা কবিতা আছে না?

আছে নাকি?

জি, আমি অনুবাদ করে শোনাই, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?

শিওর।

‘ছল করে ভেঙে ফেলি কল,

জল নামে, আহা নামে ঢল,

দল নিয়ে এল মহা খল,

তারে আজ পরাব শেকল।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, বাথরুমের ভাঙ্গা কল নিয়ে এই কবিতা আমি পড়িনি। তবে পোয়েট লোরিয়েটের সব কবিতা আমার পড়া নাই। উনি লিখতেও পারেন।

খুব রোমান্টিক না কবিতাটা?

আমার তো রোমান্টিক লাগল না।

আহা চান্দু, তোমার হওয়া উচিত ছিল শম্পা আর আমার প্রফেসর। রোমান্টিক তো শেষের দু’ লাইন। ওই যে হৃদয়ের শেকল পরানোর কথা বলেছেন কবি।

আসলে এটা কার লেখা?

মিস শম্পা সোহানির লেখা, হি হি। যাই কাজ কেমন হচ্ছে দেখে আসি। চান্দু, তুমি রেস্ট নাও।

শম্পা বাথরুমে গিয়ে মজিদের সঙ্গে কীসব টুকুরটাকুর কথা লাগাল। ওর কবিতাটা আমার মাথায় ঘুরছিল। মহা খলকে শেকল পরাবে মানে কী? মহা খলটা কে? আমি? কিন্তু কেন? আজ ওর সঙ্গে ব্যাপারগুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার।

একটু পর মজিদ টুলবক্স নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ভাইজান, গ্যাস্কেটে পব্লেম ছিল, পাল্টায়া দিছি।

এত তাড়াতাড়ি কল সেরে যাবে বুঝি নি। কী আর করার! উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে চলো মজিদ, বেরিয়ে যাই।

শম্পা মজিদের হাতে অনেকগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, মজিদ ভাই, আপনে রিকশা বা উবার নিয়ে যান। প্রফেসরের সঙ্গে আমার ভাড়া নিয়ে আলাপ আছে।

অতগুলো টাকা পেয়ে মজিদ খুশি হয়ে সালাম দিয়ে চলে গেল। আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম, মজিদকে বের করে দিলে কেন?

ওরে চান্দু, তুমিও তো মনে মনে এটাই চাইছিলা, চাও নাই? ইন ইওর হার্টস ডিপেস্ট ডিজায়ার?

আমি আমতা আমতা করতেই শম্পা বলল, ফুর্তি করবা অথচ রেস্পন্সিবিলিটি নিবা না। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মজা লুটাই তোমার স্বভাব। পরে ধরা খেলে যেন বউকে বলতে পারো, আমি তো কিছু বুঝি নাই, শম্পাই আমার সঙ্গে একবার এটা করল, আরেকবার ওটা করল।

শম্পা আসলে কথাটা ভুল বলে নাই। আমি সব সময়ই পা না ভিজিয়ে জলে নামতে চেয়েছি। ছোঁব অথচ ধরা দিব না। কিন্তু শম্পার সামনে এই দুর্বলতা আমি কেন স্বীকার করব? বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, দেখো, এক সন্ধ্যায় অ্যালকোহলের ঘোরে আমি কী করেছি না করেছি, তুমি সেটা নিয়ে বেশি ত্যানা প্যাঁচাচ্ছো। আমি কিন্তু পুরো ব্যাপারটা পুলিশে রিপোর্ট করব।

সত্যি? সবাই জানবে সেলেব্রেটি প্রফেসর খারাপ মেয়েদের সঙ্গে শোয়? মিলি কী চোখে দেখবে তোমাকে?

তুমি কী চাও একজ্যাক্টলি?

চান্দু, আজ সারা দিন আউটডোরে ছিলাম। গায়ে অনেক ধুলোবালি লেগেছে। একটা কুইক শাওয়ার নিয়ে আসছি। মাইন্ড করবা?

না, আমাকেও উঠতে হবে।

ওই ছবিগুলা দেখবা বললা না? তোমার আমার রহস্যলীলা? তুমি না মনে মনে কনফার্ম হইতে চাও আদৌ আমার কাছে কোনো এভিডেন্স আছে কি না?

আচ্ছা আমি ওয়েট করছি।

শম্পা আমাকে এক কাপ কফি দিয়ে বাথরুমে গেল। আমি কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলাম ও আমার মনের কথা কীভাবে পড়ে? আসলেই আমাকে আজ নিশ্চিত হতে হবে শম্পার কাছে ছবি ভিডিও এসব আছে নাকি সে ভাও দিচ্ছে! এমনকি যদি জেনুইন ছবি কিম্বা ভিডিও থাকেও, দেখতে হবে ওগুলোকে ম্যানিপুলেটেড বলে চালিয়ে দেওয়া যায় কিনা।

শম্পা এই মাত্র বাথরুমে শাওয়ার ছাড়ল। আমি টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। ও গুনগুন করে গাইছে, আজ খেলা ভাঙার খেলা...।

আমি এই ফাঁকে রোকসানাকে ফোন করে আপডেট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম, উল্টো ওরই ফোন এল, কী অবস্থা তোমার? বাথরুমের ট্যাপ ঠিক হয়েছে?

হ্যাঁ, এই মাত্র ঠিক হলো। বেশি ঝামেলা ছিল না, গ্যাস্কেট পাল্টাতে হয়েছে। এখানে আর কোনো কাজ করা লাগবে কিনা একবার চেক করে দেখছি।

ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি এসো। আমরা কিন্তু না খেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি মিস্টার নব্য সেলেব্রিটি।

অফকোর্স, রুকিমণি।

আমার কি বলা উচিত ছিল যে মজিদ আমার সঙ্গে নাই? কিন্তু রুকিমণি তো জিজ্ঞেস করে নি, জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় বলতাম। তাছাড়া এগুলো বলা আরও ঝামেলা। এক শ’ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কেন মজিদ সাথে নাই, মজিদ কখন গেল। আরে বাবা আমি কি এখানে নিজে আসতে চেয়েছি? রুকিমণিই তো জোর করে আমাকে পাঠাল।

মিনিট দশেক পর শম্পা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। শম্পা কাপড় পাল্টে যে এ রকম সি-থ্রু নাইট গাউন পরবে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। এই মুহূর্তে ওর উদ্ভিন্ন দেহবল্লরী থেকে চোখ সরানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। এর চেয়ে পাহাড় ডিঙানো সহজ।

আমার মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি ওর শরীরের খামে ডাকটিকেটের মতো সেঁটে রইল। শম্পা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এল। এক হাত ধরে আমাকে টেনে নিল ওর বেডরুমে।

তারপর আমার বিস্ময়ে হা হয়ে থাকা ঠোঁটে শম্পা ওর ঠোঁট জোড়া চেপে ধরল। কত সময় ধরে অধর-স্তব্ধ ছিলাম জানি না, শুধু জানি শম্পা এরপর আমাকে আলতো করে ঠেলে পেছনের বিছানায় ফেলল।

শম্পা ওর স্যান্ডেল খুলে মেঝের একপাশে রেখেছে। ও এখন চিতার মতো নিঃশব্দে আমার শরীরের উপর উঠে আসছে।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.