অশোক কুমার: ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার

অশোক কুমার: ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার

 

বলিউডের প্রথিতযশা অভিনেতা অশোক কুমারের জন্ম ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর বিহারের ভাগলপুরে। তাঁকে বলা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম বড় তারকা। ১০ ডিসেম্বর তাঁর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।

অশোক কুমারের আসল নাম কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়। জব্বলপুরের রবার্টসন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন। কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে বোম্বেতে যান ও শশধর মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বোম্বে টকীজের রসায়নাগারে সহকারি হিসেবে যোগ দেন।

প্রধানত হিন্দি ছবির অভিনেতা অশোক কুমারের বাংলা ছবিতে প্রথম অভিনয় দেবকী বসু পরিচালিত ‘চন্দ্রশেখর’ (১৯৪৭) ছবিতে। সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে মাত্র পাঁচটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।

আজীবন চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার ১৯৮৮ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানায়। ১৯৯৯ সালে তিনি লাভ করেন পদ্মভূষণ পদক। এ ছাড়া বহুবার তিনি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন।

সিনেমা জগতের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অভিনেতা অশোক কুমার, যিনি সেই সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রে অভিনয়শৈলীর ক্ষেত্রে একটা চূড়ান্ত পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর হিন্দি সিনেমায় পদার্পণের আগে পর্যন্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়শৈলী ছিল যাত্রাধর্মী অতিনাটুকে। অশোক কুমারই প্রথম অভিনেতা যিনি পর্দায় প্রথম বাস্তবধর্মী অভিনয়ের ধারা বয়ে এনেছিলেন। তিনি নিজের উদ্যোগে চলচ্চিত্রের বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে চার্মিং অ্যান্টি হিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘কিসমত’ ছবিতে তাঁর সিগারেট ধরার ভঙ্গিমা ধূমপানে আসক্ত ব্যক্তিদের এতটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে বিখ্যাত মার্লবোরোর বিজ্ঞাপনকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।

ক্যামেরার সামনে অশোক কুমারের একটা নির্দিষ্ট স্টাইল ছিল। শট দেওয়ার সময় তিনি পিছন ফিরে থেকে শুরু করতেন, তারপর আস্তে আস্তে ঘুরতেন এবং ক্যামেরার সামনে পায়চারি করতেন। থামতেন শুধু সিগারেট টানার সময়। তাঁর এই ভঙ্গিমা ও হাসি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দুই তারকা হামফ্রে বোগার্টস এবং ক্যারি গ্রান্টের হাসির সঙ্গে তুলনা করা হতো। অশোক কুমার বম্বে টকিজের ল্যাবরেটরিতে শশধর মুখার্জির সহকারী হিসাবে কাজ করেন, যিনি পরবর্তীকালে তাঁর ভবিষ্যতের ভগ্নিপতি। বিষয়টি শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। যা হোক, অশোক কুমারের জীবনে প্রথম ব্রেক আসে ১৯৩৬ সালে। দেবিকা রানীর বিপরীতে অভিনয় করেন ‘জীবন নাইয়া’ ছবিতে। এরপরই ‘অচ্ছ্যুত কন্যা’। এই দুটি ছবিতেই তাঁর স্বাভাবিক এবং বাস্তবধর্মী অভিনয়শৈলী সকলের মনে একটা জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু পর্দার বাইরে নায়িকার সঙ্গে অশোক কুমারের সম্পর্ক পর্দার থেকেও অনেকদিন নাটকীয় ছিল।

অশোক কুমারের অভিনয়শৈলীকে দেবিকা রানী জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এবং বম্বে টকিজের কর্ণধার হিসেবে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে অশোক কুমারকে নায়ক থেকে একজন শিক্ষানবিশ সম্পাদকের জায়গায় নামিয়ে এনেছিলেন। দেবিকা রানীর স্বামী হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর দেবিকা রানীর কো ম্যানেজার হিসেবে শশধর মুখার্জি যখন আবার বম্বে টকিজের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন নতুন করে আবার সুযোগ আসে অশোক কুমারের সামনে। সেই সময় তাঁর নায়িকা লীলা চিটনিস অশোক কুমারের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। তখন ‘নয়া সংসার’ ছবিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে অশোক কুমার এক সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ‘মহল’ ছবিতে তাঁর স্বাভাবিকধর্মী অভিনয় একটা অপরিমাপযোগ্য আকাক্সক্ষা, উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ক্লাসিক চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘মেহেবুব’-এর হুমায়ুন, ‘আফসানা’র স্মরণীয় ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্লেবয়ের দ্বৈত ভূমিকা এবং ‘কিসমত’-এর আলোচিত চরিত্র হিন্দি সিনেমায় তাঁকে আইকন করে তুলেছিল।

১৯৪৩ সালে অশোক কুমার ‘ফিল্মিস্তান’ নামে নিজস্ব এক স্টুডিও স্থাপন করেন, ভগ্নীপতি জ্ঞান মুখার্জি এবং রায় বাহাদুর চুনীলালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। কিন্তু সফল হন নি। কারণ পার্টনার বিভাজন তাঁকে আবার বম্বে টকিজে ফিরিয়ে এনেছিল প্রোডাকশন চিফ হয়ে। পরিচালক হিসেবে আসার পর অশোক কুমার অনেকগুলো ছবিতে হাত দেন। যার মধ্যে হিট ‘এইট ডেজ’। যেখানে পরিচালক হিসেবে অবশ্য নিজের ক্রেডিট নেন নি তিনি। এরপর তিনি তাঁর অতি প্রতিভাসম্পন্ন ভাই কিশোর কুমার ও অনুপ গাঙ্গুলিদের নিয়ে দুটি ছবি করেন ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ এবং ‘চলতি কা নাম জিন্দেগি’, যেখানে কমেডি চরিত্রে নিজের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি আবার দেব আনন্দের ‘জুয়েল থিপ’-এ ভিলেন।

কখনো ইগোকে প্রাধান্য দেন নি অশোক কুমার। এবং যে-কোনো চরিত্রাভিনয়ে তিনি ছিলেন সাবলীল। পরবর্তীকালে অন্য তারকাদের কাছেও যা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ‘মিলি’ এবং ‘গুড্ডি’ ছবিতে বাবার ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয় বা ‘গুমরাহ’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও দর্শকদের মনে উজ্জ্বল। ‘ছোটিসি বাত’ এবং ‘শৌখিন’-এও তিনি ছিলেন অনবদ্য।

অশোক কুমারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে সমাধি, দিদার, বেওয়াফা, পরিণীতা, এক হি রাস্তা, ভাই ভাই, হাওড়া ব্রিজ, দুল কা ফুল, কানুন, ধরমপুত্র, বন্দিনী, মেরা মেহবুব, মমতা, মেহেরবান।

হিন্দি চলচ্চিত্রের আইকন অশোক কুমার। তৎকালীন ভারতীয় আধুনিক ছবি থেকে শুরু করে সমসাময়িক পারিবারিক মার্জিত বিনোদন ছবিও তিনি করেছিলেন। তাঁর এই সামাজিক অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতবর্ষের প্রথম সারির টেলিভিশন প্রোডাকশন ‘হোম লোগ’-এর উপস্থাপক হিসেবে। তারপর বিভিন্ন ছবি এবং সিরিয়ালেও একইভাবে দেখা গেছে। যে ভালোবাসার দৌলতে গোটা ভারতের লোক তাঁকে ‘দাদামণি’ বলে ডাকত।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.