নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১২)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১২)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১২ তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১

অফিস থেকে ফিরে রাতে মেইল চেক করল ফাহিম। সিমির কোনো মেইল নেই। কী মনে করে সে ইয়াহু চ্যাট রুমে লগইন করল এবং দেখল, বেশ কয়েকটা এসএমএস লিখে রেখেছে সিমি। ফাহিম খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ল।

আমি তোমার মেইল পেয়েছি কিন্তু রিপ্লাই দিতে পারি নি। আমি খুবই দুঃখিত ফাহিম। আসলে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল না। তোমার মেইল পড়ার পরে আমি অনেক ভেবেছি। সাথে সাথেই ভাবছিলাম কিছু লিখব কিন্তু কেন যেন আর ইচ্ছে করল না উত্তর লিখতে। জানি না আমার কী হয়েছে। মনে হচ্ছে আমি একটা গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেছি। বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। আমি যেন আর নিজের মধ্যে নেই। না, এসবের কোনো কিছুর সাথেই তুমি নেই। ইটস জাস্ট ওয়ান অফ দোজ ডে’জ। তেমনই একটা দিন।

তুমি কিন্তু আবার ভেবো না তোমার মেইল পেয়ে আমি আপসেট হয়েছি। আর আপসেট হবোই বা কেন? তুমি বিবাহিত, পৃথিবীর অন্যতম সুন্দরী একজন রূপসী তোমার বউ- এ কথা তো আমি জানিই। আমি বরং খুশি হয়েছি, দেরিতে হলেও তার কথা লিখেছ নিজ থেকে। তুমি স্বস্তিবোধ করছ, আমিও।

তবে এই মুহূর্তে আমার কারও সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।

আমাকে ২/৩ দিন সময় দাও। অ্যান্ড ফর গডস সেক- আমাকে নিয়ে ভেবো না। বিভ্রান্ত হয়ো না। আমি ঠিক আছি। তুমি যেখানে আছো, সেখানেই থাকবে, আমার প্রাণের বন্ধু, সত্যিকার অর্থেই অসম্ভব একজন ভালো বন্ধু হয়ে।

আমার একটু সময় চাই- কিছু নির্মম সত্যকে ধারণ করবার জন্য। এ সময়টুকু আমার দরকার। প্লিজ।

আর আমাকে ছেড়ে যেয়ো না কোথাও। তোমার রহস্যময়ী সিমি যে-কোনো মুহূর্তে রহস্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। কাজেই, থেকো আশপাশেই।

আল্লাহ হাফেজ।

সিমির মেসেজগুলো পড়ে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেল ফাহিম। হঠাৎ কী এমন হলো যে তার কোনো কিছুই লিখতে ইচ্ছে করল না? ২/৩ দিন সময় চেয়েছে সিমি। তার মানে একদিন সে যোগাযোগ করবে না। ফাহিমের কোনো কথায় কি সে কষ্ট পেয়েছে? কী জানি হতেও পারে। ফাহিম অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।

আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে ফাহিম তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে যা কিছু লিখেছে তা শোনার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না সে। কিন্তু তাই-ই বা হবে কেন? অবশ্য অনেক সময় সত্যি জেনেও আমরা বাস্তবতাটা ঠিক মেনে নিতে পারি না— মেনে নিতে কষ্ট হয়। মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমস্ত নক্ষত্রপূঞ্জে যে জটিলতা ও রহস্য আছে, তার থেকেও রহস্যময় মানুষের মন। সিমির মনের মধ্যে কী কাজ করছে একমাত্র সেই জানে।

আরও একদিন পরে হঠাৎ করেই ফাহিম আবিষ্কার করল সিমিকে— চ্যাট রুমে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে দেখতে চাইল, সিমি ওকে হাই-হ্যালো কিছু বলে কি না। কিন্তু না সে কিছুই বলল না। ফাহিম আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিছু না বলে চ্যাট রুম থেকে চলে গেল, কিছুটা হতাশ হয়ে।

মাঝে দু’দিন কেটে গেল। ফাহিমের কী যেন নেই, কী যেন নেই টাইপের অনুভূতি হতে লাগল। সেদিন সকালে অফিসে এসেই সে ছোট্ট একটা মেইল লিখল সিমিকে।

এই যে রহস্যময়ী মেয়ে,

আপনার কোনো খোঁজ নেই কেন? ভালো আছেন তো?

কেউ কি জানে, কারও একটা মেইলের জন্য কেউ একজন কত অপেক্ষায় থাকে?

কারও সময় হলে যেন ইমেইল করে।

কেউ যেন ভালো থাকে। খুব ভালো।

কারও মেইলের অপেক্ষায় কেউ।

মেইলটি পাঠিয়ে দিয়ে ফাহিম সকালের টিম মিটিংয়ে চলে গেল। মিটিংয়ে কিছুতেই মন বসল না তার। সিমির কথা আজ খুব মনে পড়ছে। কিন্তু এমন চুপ করে গেল কেন মেয়েটা? ফাহিমের একটু অভিমানের মতো হলো। ছেলেরা কি অভিমান করে? হঠাৎ ফাহিম অভিমানের ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল কিছুক্ষণ। অভিমান ভীষণ অন্যরকম একটা জিনিস। সবার উপর অভিমান করা যায় না, শুধু ভালবাসার মানুষগুলোর উপরই অভিমান হয়, তাহলে সিমির প্রতি তাঁর এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন?

সিমির তো এখন অফিস থেকে ফিরে আসার কথা। সে কী করছে এখন? ফাহিমের মেইলটি কি সে দেখেছে?

মিটিং শেষ করে এসে ফাইম চ্যাট রুমে ঢুঁ মারার জন্য এল কিন্তু তার দেখা মিলল না। তবু সে লিখল, ‘হাই, সিমি, কেমন আছ তুমি? মিসিং ইউ।’

এটুকু লিখে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল সে। তারপর লগ অফ করে কাজে ফিরে গেল।

দিন শেষে বাসায় ফিরে যাওয়ার আগে ফাহিম আরেকবার চ্যাট রুমে এল এবং দেখতে পেল সিমির রিপ্লাই। মাত্র দু’লাইনের একটা মেসেজ। সে লিখেছে-

‘আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। সত্যি যদি বলতে হয়, তাহলে বলব, এর চেয়ে বেশি ভালো আসলে থাকা যায় না। নিজেকে মনে হচ্ছে একজন প্রিন্সেস!’

ব্যস এটুকুই। আর কিছু না।

ফাহিম আবারও দ্বিধায় পড়ে গেল। দুদিন আগেই না সিমি লিখল সে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে আর আজকে নিজেকে প্রিন্সেসের মতো লাগছে। এর চেয়ে বেশি ভালো থাকা যায় না! ওয়াও— হোয়াট অ্যা কন্ট্রাডিকশন! কেমন বৈপরীত্য এবং দ্বন্দ্ব, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত- একেবারেই যেন শিকাগোর ওয়েদার! প্রতি মিনিটেই বদলে যায়— কারণে অকারণে। আবহাওয়াবিদদের দেওয়া পূর্বাভাস কখনোই ঠিক হয় না এই শহরে। তাদের আর কী দোষ?

সিমির সঙ্গে তার প্রাণের এই শহরের অনেক মিল। সবকিছুই কেমন রহস্যে ঘেরা।

এর মধ্যে সিমির একটি রেকর্ড করে পাঠানো গান পেল ফাহিম। সম্পূর্ণ গান নয়, গানের কয়েকটি লাইন। সেই সাথে সে লিখেছে-

তোমার জন্য একটা গান পাঠালাম ফাহিম। জানি না, তোমার ভালো লাগবে কি না, তবুও ইচ্ছে হলো পাঠাতে। শুনে দেখো।

ভালোবাসা জেনো।

সিমি।

তাহলে কি সিমির মনের মেঘ কিছুটা কমতে শুরু করেছে? হয়তো তাই। না হলে হুট করে একটা গান পাঠানোর কথা না। ফাহিম গানটি শুনল। এবং যারপর নাই মুগ্ধ হলো। সত্যিই সুন্দর গায় সিমি। হয়তো ছোটবেলায় গান শিখেছে, একসময় চর্চা ছিল বোঝা যায়। কণ্ঠের কারুকাজ বেশ ভালো— মানুষের মনের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার মতোই। ফাহিম আবারও মুগ্ধ হলো।

সুযোগ পেয়ে সে দ্রুত ছোট করে উত্তর লিখল।

সিমি,

তুমি যে কত ভালো গান করো, তা কি তুমি জানো? আমি জানি না, তুমি গানের চর্চাটা চালিয়ে যাও কি-না, তবে চর্চাটা রাখলে ভালো করবে। ছোটবেলায় গান শিখতে কি-না জিজ্ঞেস করি নি, তবে তোমার দু’ তিনটি গান শুনেই আমি বলে দিতে পারি, ইউ হ্যাভ অ্যা স্ট্রং বেজ।

তোমার আরও গান শোনার অপেক্ষায় রইলাম। 

আমি।

ইতোমধ্যে শিকাগোর আবহাওয়া বদলে গেল আরো কয়েকবার। লেক মিশিগানের পানিও গড়াল অনেক। অবশেষে সিমি একটা নাতিদীর্ঘ মেইল লিখল ফাহিমকে।

ফাহিম, প্রাণের বন্ধু আমার-

কেমন আছো তুমি?

যখন এই লেখাটি আমি লিখছি তোমার জন্য, তখন তোমার ঘুমিয়ে থাকার কথা। তুমি হয়তো ঘুমুচ্ছো। আমার এখানে এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। অত্যন্ত দুঃখিত, তোমাকে এভাবে অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য। 

জানি অপেক্ষায় ছিলে। খুব কষ্ট হয়েছে বুঝি? আচ্ছা কথা দিচ্ছি, কেউ যদি খুব বেশি দুঃখিত হয়ে থাকে, তবে কখনো দেখা হলে তাকে সুখী করে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। চলবে?

তোমাকে দেখে কিন্তু কখনো মনে হয় না, যে তোমারও মন খারাপ হতে পারে! আমি প্রায়ই ভাবি, একজন মানুষ সবসময় এমন হাসিখুশি থাকে কী করে? তোমাকে আমার হিংসেই হয়!

কথা দিয়েছিলাম, তাই ফিরে এলাম আমার নতুন মেইল নিয়ে, পাওনা মিটিয়ে দিতে। চিঠির বিনিময়ে চিঠি।

কিন্তু কী লিখি তোমায় বলো তো? মাথাটা সত্যিই কেমন যেন শূন্য হয়ে আছে। অথচ তোমাকে কত কিছু বলার ছিল, বলার আছে, বলতে চাই। কিন্তু কোথায় শুরু করি? এমন ভাষা কি আছে যা দিয়ে এই তিরিশ বছরের জমানো ব্যথা বন্দি করা যায় চিঠির পাতায়? এমন শব্দ কি আছে যা দিয়ে হতভাগ্য এক হৃদয়ের স্পন্দন আঁকা যায়?

জানো ফাহিম, একটা সময় ছিল যখন চাইলেই আমি লিখতে পারতাম, বিরতিহীন। এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলাম তখন যে আমাকে কখনো ভাবতেও হতো না কী লিখব, কী নিয়ে লিখব? কিন্তু সে সময়গুলি এখন শুধুই এক অতীত ইতিহাস।

তবুও চেষ্টা করি কিছু লিখতে। আমার ফেলে আসা সময় থেকে। কথাগুলো কিছুটা ফিলসফিক্যাল, কেন জানি মেমরি ব্যাংক থেকে এগুলোই সামনে আসছে।

আমার মা কখনোই কোনো আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করতেন না। আমার বাবা আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে, এমন কী তারা অপরিচিত হলেও। তারা দুজনেই চাইতেন, আমাদের অনেক বন্ধু হোক, তাঁদের মনোভাব বুঝি এবং পৃথিবীটাকে জানি। মানুষের সঙ্গে মিশলেই চেনা যাবে মানুষ।

আমার মা সবসময় বলতেন, সত্যিকারের বন্ধুরা তোমার জীবন থেকে চলে গেলেও তোমার হৃদয় থেকে কখনোই যাবে না। কাজেই বন্ধু বানাবে। বন্ধু হচ্ছে আল্লাহর আশীর্বাদ। একজন বন্ধু তোমার জীবনে অনেক সুখের সময় এনে দিতে পারে। কাজেই কথা বলবে, তাকে যদি তুমি নাও চেনো। পৃথিবীটাকে নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখার সুযোগ পাবে প্রতিদিন।

আমার মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল আমার। আমার এই তিরিশ বছরের জীবনে চলার পথে আমি অনেক বন্ধু বানিয়েছি। অনেক বন্ধু পেয়েছি, বন্ধু হয়েছি। আমি জানি, একমাত্র একজন বন্ধুকেই আমি পাবো যখন আমার দরকার পড়বে কারও কাঁধে মাথা রেখে যেন একটু কাঁদতে পারি।

আমি ছোটবেলায় খুব অল্পতেই মন খারাপ করে ফেলতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখলাম, তখনই আমার মায়ের কথা মনে পড়ত। আমার জীবনে তাঁর প্রভাব, তাঁর ভূমিকা। আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে আমার মা। বেঁচে থাকতে যিনি সব সময় আমার চোখের পানি মুছে দিতেন। মহান আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ সেজন্য।

আমার মনে হয় অনেক কথাই লিখে ফেলেছি আজকে। তবুও যা বলতে চেয়েছিলাম তার কিছুই বলা হয় নি। তুমি হয়তো ভুরু কুঁচকে ভাবছ, এসব কী?

দৈবক্রমে তোমার সাথে আমার পরিচয়, তাও আবার ইমেলের মাধ্যমে, কিন্তু সেদিন যদি একজন অপরিচিত মানুষের মেইল মনে করে ডিলিট করে দিতাম, তা হয়তো ট্র্যাশ কিংবা রিসাইকেল বিনেই পড়ে থাকত এতদিন। অথচ দ্যাখো, তুমি এখন জায়গা করে নিয়েছ সিমির স্পেশাল সিক্রেট লকারে। এখন আমি জানি, আমার একজন কেউ আছে যার কাঁধে মাথা রেখে আমি কাঁদতে পারব!

ভাবতেই পারছি না, অবশেষে তোমার সাথে দেখা হবে আমার। ২২ তারিখ কবে আসবে? আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছি না ফাহিম! আমার ধৈর্য এত কম কেন?

অনেক ভালোবাসা আর শুভকামনা রইল।

সিমি।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.