আমার কৃতী ছাত্রদের অন্যতম সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। মনজুর সরাসরি আমার ছাত্র ছিলেন, প্রখর মেধাবী ছাত্র। পরবর্তী সময়ে আমার সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমরা কয়েক দশক সহকর্মী ছিলাম।
দুক্ষেত্রেই মনজুরকে আমি দেখেছি একই রকম—পরিচ্ছন্ন, স্নিগ্ধ। যে-কোনো কাজ দিলেই তাতে তিনি মনোযোগী, কর্তব্যপরায়ণ। কোনো কাজে তার অমনোযোগ ছিল না। বিরক্তি ছিল না।
ছাত্রদের ভালোবাসতেন মনজুর, ছাত্ররাও তাকে। তার মতো প্রবল জনপ্রিয় শিক্ষক কমই মেলে। সৈয়দ মনজুরের ক্ষমতা ছিল, যে-কোনো বিষয় তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতে পারতেন, অহেতুক জটিলতা তিনি এড়িয়ে চলেছেন। নিজে তিনি বিষয় সহজে বুঝতে পারতেন, পাশাপাশি সবার বোধগম্য করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হতেন। শ্রেণিকক্ষে তার এই অসাধারণ পারঙ্গমতাই তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। কিন্তু একমাত্র কারণ অবশ্যই নয়। শিক্ষার্থীদের তিনি উৎসাহ দিতেন। তাদের অন্তর্গত প্রতিশ্রুতিকে বিকশিত করবার কাজে মনজুরের ক্লান্তি ছিল না। তাঁর স্নেহ ও বাৎসল্যও ছিল অসামান্য। যুক্তিনিষ্ঠ ছিলেন তিনি, অহেতুক আক্রমণ বা অযৌক্তিক কথায় তার কখনোই আগ্রহ ছিল না।
শিক্ষকতার পাশাপাশি মনজুর সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তার ছোটগল্প অসামান্য, উপন্যাস দীপ্তিময়, তার প্রবন্ধ চিন্তা ও ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ। বিশ্বসাহিত্যের আমগ্ন পাঠক মনজুর অনুবাদ ও বিশ্লেষণে সমান দক্ষ। আশির দশকে ‘সংবাদ’ পত্রিকায় তার ধারাবাহিক ‘অলস দিনের হাওয়া’ বিখ্যাত হয়; মনজুরের সেই লেখার সুখ্যাতির কারণ তার অনুসন্ধিৎসা, বিশ্বসাহিত্যের অতলে ডুব দিয়ে তার হিরে-রত্ন পাঠকের সামনে উপস্থাপনের ক্ষমতা। চিত্রকলার নিরবচ্ছিন্ন ব্যাখ্যাকার ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় চিত্রকলা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধের সেরা লিখিয়ে হিসেবে তাকেই চিহ্নিত করতে হবে। একাধারে শিক্ষকতা, সাহিত্য রচনা ও শিল্পকলায় মনোনিবেশ—এত বহুমুখী ক্ষেত্রে সমন্বয় সমসাময়িককালে বেশি দেখা মেলে না। সৈয়দ মনজুর এর ব্যতিক্রমী উদাহরণ।
সাহিত্যিক হিসেবে বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ সব বড় পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন। ওগুলো তার প্রাপ্য ছিল। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন তার লেখক ও পাঠকদের ভালোবাসা। পাঠক তার লেখার জন্য সৈয়দ মনজুরকে ভালোবেসেছে; অপরাপর লেখকরা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে ভালোবেসেছেন তার নিমগ্ন পাঠের জন্য, নিখুঁত বিশ্লেষণের জন্য। অনুজ লেখকদের লেখায় সৈয়দ মনজুরের আগ্রহ ও উৎসাহদান ছিল, অনুজদের অনুপ্রেরণা জানাতে তিনি কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
শিক্ষকতার বাইরে নানা সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণের আহ্বান ও অনুরোধ তার কাছে এসেছে। চাইলে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারতেন। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের পদ গ্রহণের জন্য তাকে যে অনুরোধ করা হয়েছিল সেটা ব্যক্তিগতভাবেই আমি জানি। এসব পদের জন্য তিনি সম্পূর্ণ উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু মনজুর সেসব পদ গ্রহণ করেননি। শিক্ষকতার বাইরে কোনো পেশায় তার আগ্রহ ছিল না। এটি আমাদের সমাজে অনুকরণীয় উদাহরণ; নিজের কাজে শতভাগ মনোযোগ দেওয়ার অনন্য উদাহরণ মনজুর। তাঁর পিতাও একজন সুখ্যাত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মনজুরু পিতার কর্মধারাকেই প্রসারিত ও অগ্রসর করে নিয়ে গেছেন। সাহিত্যে অনুরাগ ছিল বলে সম্পাদনাতেও মন দিয়েছিলেন তিনি। ‘কালি ও কলম’ এবং ‘অন্যদিন’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। নিজেও একবার একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতা, পরিমিতি ও রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ব্যক্তিগত জীবনে স্মিতহাস্যময় ও প্রাণবন্ত আড্ডামুখর মানুষ। তাকে দেখেছি সব সময় স্বচ্ছন্দ গতিতে হেঁটে চলেছেন। দেখলেই মনে হয়েছে, একের পর এক কাজ সেরে আরেকটি কাজে যাচ্ছেন। এবং ভাবতে ভাবতেই চলেছেন। পরিচ্ছন্ন ছিল তার হাঁটার ভঙ্গি, কাজ করার প্রতি দুর্নিবার আগ্রহ। তবে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সংকট ও বিপর্যয়ের কথা তেমন বলতেন না কখনও। তার স্ত্রীও আমার ছাত্রী; তিনি দীর্ঘকাল ক্যানসারে আক্রান্ত। মনজুর কখনও সেসব নিয়ে কথা বলে ভারাক্রান্ত হতেন না; বা কাউকে কাতর করতে চাইতেন না। তার শরীর এত খারাপ ছিল, কখনোই আমি জানতে পারিনি।
তার সঙ্গে আমি দেশে ও বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি, এবং দেখেছি যে-কোনো সমস্যা সমাধানে তার সক্ষমতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আসলে এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের মতো করে পরিশীলিত ও স্নিগ্ধ একটি মেধাবী জীবন যাপন করেছেন। এমন কোনো কাজে তিনি যুক্ত হননি, যা তার শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি মার্জিত, বিবেকী, সংযত ও যুক্তিনিষ্ঠ। শিক্ষাবিদ হিসেবে তার বক্তব্য, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি উপস্থিত থাকতেন। শেকস্পীয়দের নাটক অনুবাদ করেছেন এবং তা মঞ্চস্থও হয়েছে। তার শিল্পকলার সমালোচনাও উল্লেখযোগ্য। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতেন। যেমন জরুরি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার রচনাবলি। তার প্রাণবন্ত কথোপকথন, হৃদয়স্পর্শী মার্জিত আচরণ তার সঙ্গে যারা পরিচিত ছিলেন, তাদের সবার অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ তার যেসকল ছাত্রছাত্রী নিয়ে গৌরব করে মনজুর যে তাদেরই একজন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সৈয়দ মনজুর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কর্মচঞ্চল ও সৃজনশীল ছিলেন। তার মৃত্যুকে আমি অকাল প্রয়াণ বলব। আমাদের সবার স্মৃতিতে রয়ে যাবে স্নিগ্ধ ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বহুমুখী প্রতিভার স্মারক। তার প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালোবাসা।
স্মৃতিতে রয়ে যাবে স্নিগ্ধ মনজুর
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০ টি মন্তব্য
Related Articles
নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৬)
ফরহাদ হোসেন২১ জুলাই ২০২২সিমি একটা রিকশা ডেকে ফাহিমকে নিয়ে ঝটপট উঠে পড়ল। একটা মিষ্টি হালকা গন্ধ ভেসে এল। ফাহিম কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বসল। সিমি খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘এমন শক্ত হয়ে আছ কেন? রিল্যাক্স হয়ে বসো। আচ্ছা, তোমার কি ভয় লাগছে?’
মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী কবি ফররুখ আহমদ
জোবায়দা লাবণী২০ জানুয়ারি ২০২৫অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ ফররুখ আহমদকে নিয়ে রচনা-
মালাকর যেভাবে হারায়: কিযী তাহনিন
কিযী তাহনিন২৫ জুন ২০২৩এই যেমন মেহেন্দি মালাকর। সংক্ষেপে মেন্দি হুজুর। মেহেন্দি ওরফে মেন্দি হুজুর আসলে কোনো হুজুর না। একজন তাবিজবিক্রেতা। তার নামের শেষের ‘মালাকর’ লেজটুকু ধরে লোকজন বড্ড টানাটানি করে। হিন্দু নাকি মুসলমান?
পাপ
হুমায়ূন আহমেদ১৬ ডিসেম্বর ২০২০আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এত কাছ থেকে আগে কোনোদিন মিলিটারি দেখি নি। এই প্রথম দেখছি। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা বলেই বোধহয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙালির মতো। শুধু রঙটা বেশি ফর্সা আর নাক-মুখ কাটা কাটা।
Leave a Reply
Your identity will not be published.