মা আমার সত্তা, মা আমার পৃথিবী

মা আমার সত্তা, মা আমার পৃথিবী

‘বৃদ্ধাশ্রম থেকে একজন মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি কিছু চাই না শুধু আমার ছেলের মুখটা  একবার দেখতে চাই’। মায়ের জরাজীর্ণ শরীর। কখন যে পৃথিবী থেকে না-ফেরার দেশে চলে যেতে হয়! তাই তার শেষ আর্তিÑ‘আমি দুচোখভরে আমার বাচ্চাটাকে একবার দেখতে চাই।’ ছেলে তখন বার্মিংহাম শহরে বাড়িঘর বানিয়ে চুটিয়ে সংসার করছে। ফেরার নাম গন্ধ নেই। মায়ের সাথে কোনো সম্পর্কও নেই। যাওয়ার আগে বাবার বাড়িটা বিক্রি করে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে চলে গেছে। এইতো দায়িত্ব-কর্তব্য ছেলের। সে জানে না তাকেও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে। কোনো না কোনোভাবে সন্তানের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটাতে হবে। হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করে আছে আরও কোনো বৃদ্ধাশ্রম।

অতীনবাবু কোটি কোটি টাকার মালিক। সুরম্য অট্টালিকা। বাড়ির একটা ছোট্ট অন্ধকার ঘর মায়ের জন্য বরাদ্দ। অতীন বড় ব্যবসায়ী। মায়ের খোঁজখবর নেওয়ার মতো সময় তার নেই। বউ তমালিকা দেখল, কত লোকের আসা-যাওয়া বাড়িতে কত বড় বড় মানুষজন আসবে, এর মধ্যে এমন একজন বৃদ্ধা শাশুড়িকে কোথায় লুকাবে ? একদিন দারোয়ান দিয়ে ঘর থেকে বাড়ির বের করে দিল তাকে। ফুটপাতে পড়ে থেকে না খেয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় অবশেষে একটা মায়ের মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিল মা। পুজোর প্রসাদ খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে রইল মা। এদিকে ছেলে অতীনের জন্মদিন। মা আবার জানবে না! মন্দিরে উপবাস থেকে সারা দিন পড়ে রইল। মনে মনে বলল, ‘মা মা, তুমি তো জগন্মাতা, আমিও সন্তানের জননী। আর আজকের দিনে আমি মা হয়েছিলাম। তুমি আমার অতীনকে দেখো। ও বোঝে না। ওরা অবুঝ। তুমি ক্ষমা করে দিয়ো মা।’

সেদিন ছিল মন্দিরে কাঙালি ভোজের দিন। দুপুর থেকে শত শত ভিখারি কাঙালি এসে অপেক্ষায় রইল প্রসাদ পাওয়ার জন্যে। সন্ধ্যা হয়ে এলো, অভুক্ত মা উপবাসী মা, মন্দিরে যেটুকু খাবার পেল খিচুড়ি পায়েস পাতার থালায় জড়িয়ে নিয়ে চলল ছেলের বাড়িতে। মায়ের প্রসাদ। যদি অতীনকে দিতে পারে অতীনের কল্যাণ হবে।

বাড়ির বিশাল গেটে গেটম্যান বৃদ্ধাকে ঢুকতে দিল না। এদিকে ভেতরে হইহুল্লোড়, আনন্দ-উল্লাস আর ডিজের শব্দে উদ্দাম উল্লাস চলছে।

গেটম্যান ভিখারিকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না ভিখারি মা বলেছিল, ‘আমি কিছু খেতে আসি নি বাবা। কিছু চাই না’ শুধু আমার অতীনকে এই খাবারটা পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাব। আমি কিছু খেতে চাইব না। গেটম্যান বলল, ‘ও ভিতরে যাওয়ার বাহানা দেখাচ্ছি মজা!’ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। পরদিন সাফাই কর্মীরা মায়ের দেহটাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।

না, মায়ের কোনো অভিমান নেই!

এই ছোট্ট দুটো বাস্তব কাহিনির মধ্য দিয়ে মায়ের অবস্থান  বুঝিয়ে দিলাম। বৃদ্ধা মা কতটুকু মূল্য পায় সংসারে?

যে মা সংসারের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাল, শরীরের অমৃত সুধা পান করিয়ে বড় করে তুলল, সেই মায়ের আজও কোনো অভিমান নেই, অত্যাচারের প্রতিবাদ নেই! অবশেষে জীবন প্রাণপাত করে জগৎসংসার থেকে বিদায় নিল।

একজন বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন, ‘মায়ের একধার দুধের দাম/ কাটিয়া গায়ের চাম। দিলেও তো শোধ হবে না’ এই চেতনা টুকু তবুও ফিরে না মানুষের। বৈভব ঐশ্বর্যে আমরা ভুলে থাকি, ভুলে যাই বা-মাকে!

সংসারে নারীর অবস্থান বলতে গিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত নোবেল জয়ী ব্রিটিশ সাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছিলেন, মেয়েরা বোকা বলেই তারা পুরুষের সমান অধিকার দাবি করে। কারণ ওরা জানে না পুরুষের চাইতে অনেক বেশি উচ্চতর স্থান তাদের! আপনি যাই দেন না কেন, সে সেটাকে আরও উচ্চতর সম্পদ বানিয়ে দেবে। আপনি মেয়েদেরকে শুক্রাণু দান করুন, সে আপনাকে সন্তান বানিয়ে দেবে। আপনি তাকে একটি সাধারণ ঘর দিবেন, সে সেটাকে ঝকঝকে সুন্দর বাড়ি বানিয়ে দেবে। আপনি তাকে বাজার এনে দেবেন, সে আপনাকে রান্না করে সুস্বাদু খাবার বানিয়ে দেবে। আপনি তাকে হাসি দেবেন, সে আপনাকে হৃদয় দিয়ে দেবে। আপনি যাই দেবেন, সে তার কয়েক গুণ মহৎ করে ফেরত দেবে। আর আপনি যদি তাকে যন্ত্রণা দেন তবে তৈরি থাকুন, সে আপনার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে দেবে।

আমার যতটুকু মনে পড়ে, মা আমাকে কোলে নিয়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ‘ওই দেখ বাবা, আকাশ। ওই যে দেখো কতদূর, আর ওই যে পুকুরে হাঁসেরা সাঁতার কাটছে। ওরা আমাদের ডিম দেবে। তুমি ডিম  খাবে না বাবা ? পুকুরে মাছ আছে, তুমি মাছ খাবে না ?’

মায়ের কোলে বসে পৃথিবীর প্রথম পাঠ, আকাশে দেখতে শিখেছি, পাখি ফল ফুল মাছ হাঁস ডিম সবকিছু চিনতে শিখেছিÑ মায়ের কোলে বসেই। রাতের আকাশে চাঁদ উঠলে বলতে শুনেছি ঃ ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/ চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।’ আমার প্রথম শিক্ষক আমার মা।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যায়ে পড়ার সময় মা বলেছিলেন, ‘তুমি মহাকাশে যাও, নক্ষত্রলোকে যাও না কেন, মনে রেখো তোমার খুঁটো দড়ি আমার হাতে।’ কথাটার অর্থ আমি সেদিন বুঝি নি, বুঝেছি সেদিন যেদিন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ‘ওয়াস্ট ল্যান্ড’-এর কবি এবং দার্শনিক টি এস  এলিয়টের Tradition in the individual talent গ্রন্থের শেষ কথাটি পড়লামÑTradition in the individual act Ñসেদিন উপলব্ধি করতে পারলাম মায়ের এই কথাটার অর্থ আসলে কী।

মা আমার সারা জীবনের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর চাকরি জীবনে একটা চরম বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় মাকে কথাটি জানালাম। মা বললেন, ‘ও সামনে দেয়াল দেখে ভয় পেয়ে গেলি ? দৌড়া তোর সামনের দেয়াল পর্যন্ত। তারপর দেওয়াল ভাঙবি না টপকাবি তোর ব্যাপার।’ সেদিন মায়ের দেওয়া আত্মশক্তি আমি হৃদয়ে উপলব্ধি করেছিলাম।

মনে করা হয় মায়েরা অশিক্ষিতা, অবুঝ, কিছুই বোঝেন না। আসলে মায়েরা সন্তানের জন্য পরম সুশিক্ষিতা। তাকে আবিষ্কার করে নিতে হয় নিজের অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে। যিনি সমস্ত অন্তরের শক্তি দিয়ে সন্তানকে লালন করেন, তিনি বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সেখানে শিক্ষার মানদণ্ডে তাকে বিচার করা চলে না।

মাতৃ দিবসের পরম অঙ্গীকার হওয়া উচিত, মা মানেই শুধু একজন শুধু রমণী নন। তিনি আমার দেশ, তিনি আমার সত্তা, দেহের রক্ত কণিকায় যার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি, তিনি আমার মা। আমার সাম্রাজ্য।

আবার ফিরে আসি নোবেল জয়ী ব্রিটিশ সাহিত্যিক উইলিয়াম গোলডিং-এর ভাষায়, তুমি নারীকে খুব সাধারণ ভেবো না। কারণ তুমি যা দেবে তার উচ্চতর প্রতিদান সে দেবে। নারী সংসারের স্বপ্ন দেখায়।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে যাযাবর জাতি শিকারজীবী মানুষ আলবেনিয়াম জাতি গোষ্ঠী আলাস্কা ক্যানডি নিভিয়া সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা উপকূল থেকে শিকারের সন্ধানে উষ্ণ মণ্ডলীয় দেশের দিকে রওনা হয়। হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করতে গিয়ে পথে একজন নারী অসুস্থ হয়ে পড়লেন সন্তান পেটে ধারণ করে। আর পথ চলতে পারলেন না। তার প্রিয়তম পুরুষকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হলো। আর সেখানেই গড়ে উঠল সংসার। এভাবেই নারী নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠা সংসারের।Ñ(ভলগা থেকে গঙ্গা, রাহুল সাংকৃত্যায়ন)

নারীকে যারা মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন তারাই আবার অবহেলায় ঘৃণায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দেন। অথবা রাস্তায় পড়ে থাকে অসহায় মা। সন্তানের প্রতি মায়ের কোনো অভিমান হয় না। কারণ মা এই ধরিত্রী এই প্রকৃতির প্রতিনিধি।

[আগামীকাল ১১ মে, বিশ্ব মা দিবস, এই উপলক্ষে এই বিশেষ রচনাটি পত্রস্থ হলো।]

Leave a Reply

Your identity will not be published.