খেলাঘরের স্বামী

খেলাঘরের স্বামী

জানালা খুললে দেখা যায় একটা পানা পুকুর, তাতে শালুক কিংবা পদ্মফুল ফোটে না, ফ্ল্যাটবাড়ির যাবতীয় আবর্জনা সবাই ছুড়ে ছুড়ে ফেলে। বিশ্রী, নোংরা দুর্গন্ধময়। একদিন ঐ পুকুরে একটা মরা বেড়াল ভাসছিল। জানালাটা খুলতেই ইচ্ছে করে না। 

দু’খানা ঘরের ফ্ল্যাট, দেয়ালগুলো এত পাতলা যে রান্নাঘরে দাঁড়ালে পাশের ফ্ল্যাটের সব কথা শুনতে পাওয়া যায়। বাথরুম থেকে শোনা যায় ওপাশের বাথরুমের হেঁড়ে গলার গান। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। জয়ার যখন-তখন কান্না পায়। এ রকম জায়গায় থাকতে হবে, কখনো সে দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি।

জয়ার কান্না দেখলেই প্রতুল খবরের কাগজে মুখ ঢাকে। তার অসহায় মুখে ফুটে ওঠে ব্যর্থ ক্রোধ। নিজেদের চমৎকার দোতলা বাড়ি, সামনে পেছনে বাগান, সে বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছে। প্রতুলের টাকার অভাব নেই, একটা তের লাখ টাকার চেক তো এখনো ভাঙানোই হয় নি, তবু তাদের বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে এই সস্তার সরকারি ফ্ল্যাটে।

আগে তিনজন কাজের লোক ছিল, একজন মালি-কাম-দারোয়ান, একজন বাড়ির সব কাজের জন্য, আর একজন রাঁধুনি। এত ছোট ফ্ল্যাটে সে সব লোক রাখার প্রশ্নই নেই। একজন ঠিকে লোক ঘর মোছা, কাপড় কাচার কাজ করে যায়, একটি মেয়ে দুবেলা রান্না করে দেয়। 

বিকেলবেলা ওরা কেউ থাকে না, জয়াকে নিজের হাতে চা বানাতে হয়। এটুকু কাজ যে সে পারে না তা নয়। কিন্তু বিকেলবেলা রকিং চেয়ারে বসে টিভি দেখবে, বাড়ির কাজের লোক ঠিক ঘড়ি ধরে পাঁচটার সময় চা বানিয়ে এনে হাতে তুলে দেবে, সেটুকু বিলাসিতা করার আর উপায় নেই। 

প্রতুলকেও ভোরবেলা উঠে মেয়েকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে যেতে হয়। আর কে দেবে? বরাবর তার অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো অভ্যেস, এখন বাধ্য হয়ে সূর্যোদয় দেখতে হয় তাকে। আর একটা কাজ করতে হয়, নিজের হাতে বাজার। ঠিকে লোক দিয়ে ও কাজ হয় না। প্রতুল আগে কখনো প্যাচপেচে কাদা ভর্তি মাছের বাজারে ঢোকে নি, আলু-পেঁয়াজের দরের ওঠা-নামার কোনো খবরই রাখত না। 

গাড়িটা আছে অবশ্য। গাড়িটা বেচে দিলে তো মান-সম্মানের আর কিছুই থাকে না। এই ব্লকে আর কারোর গাড়ি নেই। সাড়ে ছ’টায় সময় টুলটুলের স্কুল, প্রতুল ঘুমমাখা চোখ নিয়ে বেরুবার সময় বাজারের থলিও সঙ্গে নিয়ে নেয়। তাদের ফ্ল্যাট দোতলায়, লম্বা টানা বারান্দার শেষে সিঁড়ি। সাত বছর বয়েসী টুলটুল এই বারান্দাটা এক্কা দোক্কা খেলার ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। ঘোষাল পরিবারের একমাত্র টুলটুলই এই ফ্ল্যাট বাড়িতে এসে খুশি হয়েছে। কারণ সে অনেক খেলার সঙ্গী পেয়েছে। নিজেদের বাড়িটার কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি ছিল না, পরপর দুটো কারখানা, টুলটুলকেও বেরুতে দেওয়া হতো না বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে।

এখানে তিনটি ব্লকে ভাগ করা একশো দু’খানা ফ্ল্যাট, অন্তত তিন-চারশো জন মানুষ তো থাকেই।

নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য সরকার এই ফ্ল্যাট বানিয়েছে, পরিকল্পনার কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু যথারীতি কন্ট্রাক্টররা বহু টাকা সরিয়ে সস্তার তিন অবস্থা করে ছেড়েছে। এক বছর আগে তৈরি, নতুনই বলা যায়, এরই মধ্যে দেয়ালে ড্যাম্প লেগেছে, সিঁড়ির ধারগুলো ভাঙা ভাঙা। সামনের চত্বরে বাচ্চাদের জন্য একটা পার্কেরও ব্যবস্থা আছে, যদিও সেখানে এক চিলতে ঘাস নেই, অনেক জায়গায় রেলিং উধাও। তবু সকালে ও বিকেলে সেখানে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের কলকলানি শোনা যায়। 

টুলটুলকে স্কুলে নামিয়ে বাজারের দিকে গাড়ি ফেরায় প্রতুল। এখান থেকে বাজারে যাওয়ার দুটো ব্লাস্তা আছে, একটা একটু ঘোরা পথ, তবু সে সেই পথ দিয়েই যায়। কিছুটা গেলেই তাদের বাড়িটা চোখে পড়ে। তিন পুরুষের পৈতৃক বাড়ি। প্রতুলের ঠাকুর্দা এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে হাওড়ায় একটা রঙের কারখানা খুলেছিলেন। কারখানায় যাওয়া-আসার সবিধের জন্য বসত বাড়ি বানালেন হাওড়াতেই। এখানেই প্রতুলের জন্মকর্ম ও লেখাপড়া। শুধু বিএসসি পড়ার দু’বছর কলকাতায় একটা কলেজে যাতায়াত করেছিল। কলকাতার লোকদের হাওড়া সম্পর্কে খানিকটা অবজ্ঞার ভাব আছে। হাওড়ায় তো শুধু বস্তি আর কলকারখানার ধোঁয়া আর ধুলোবালি, এখানে কি ভদ্দরলোক থাকতে পারে? কলেজের একজন বন্ধু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, হাওড়া হচ্ছে কলকাতা শহরের ডাস্টবিন! এই হাওড়ার কল-কারখানার পরেই যে পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি অনেকটা নির্ভর করে, তা ওরা জানে না! প্রতুলদের মতন এ রকম বাগানওয়ালা বাড়ি কলকাতায় ক’জনের আছে? সেই বাড়ি এখন ভাঙ্গা হচ্ছে। প্রতিদিন এদিক দিয়ে যাবার পথে নিজেদের প্রিয় বাড়িটা একটু একটু করে ভাঙ্গার দৃশ্য দেখে প্রতুলের বুকে হাতুড়ির আঘাত লাগে। তবু না এসে পারে না। জানালা-দরজা সব আগেই খুলে নিয়েছে, দোতলায় তাদের যেটা শোবার ঘর ছিল, তার একদিকের দেয়াল নেই। ভেতরের দিকের দেয়ালে একটা চৌকো সাদা দাগ, গাড়িতে বসেই প্রতুল দেখতে পায়। ঐখানে মায়ের ছবি টাঙানো ছিল। ভাগ্যিস মা আর বাবা দুজনেই আগে স্বর্গে চলে গেছেন! এঁরা বেঁচে থাকলে আরো বেশি আঘাত পেতেন। 

গঙ্গার ওপর নতুন সেতু তৈরি হচ্ছে। হচ্ছে কি, হয়েই গেছে, সেই বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে এখন গাড়ি চলাচল করে। সেতু থেকে নেমে হাওড়ার দিকে একটা নতুন রাস্তা হবে, সেটা গিয়ে জুড়বে বম্বে-দিল্লি- হাইওয়ের সঙ্গে। নতুন রাস্তাটির নাম দেওয়া হয়েছে কোনো এক্সপ্রেস ওয়ে। এই রাস্তাটা বানাবার জন্য সরকার প্রতুলদের বাড়িটা চেয়ে বসল। রাস্তাটা একটুখানি সরিয়ে দিলে প্রতুলদের বাড়িটা বেঁচে যেত, সে বুদ্ধি কারুর হলো না? সরকার চাইলেই দিতে হবে নাকি, মামার বাড়ির আবদার? প্রতুল ভালো উকিল লাগিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। ইঞ্জাংশান আদায় করে উকিল বলেছিল, এ মামলা অন্তত কুড়ি বছর চলবে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! 
দু’বছর বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল প্রতুল, হঠাৎ হাইকোর্ট রায় দিয়ে দিল, জনগণের স্বার্থে এই ধরনের মামলায় আর ইঞ্জাংশান কার্যকর হবে না। সরকার দাম দিয়ে দেবে, প্রতুলকে বাড়ি ছেড়ে দিতেই হবে। আদালতের পেয়াদা এসে ধরিয়ে দিয়ে গেল এক মাসের নোটিশ। এত কম সময়ের মধ্যে সপরিবারে প্রতুল যাবে কোথায়? সে দায়িত্ব সরকারের নয়, সরকার পুরো টাকার চেক দিয়ে দিয়েছে। টাকা থাকলে কি এক মাসের মধ্যে বাড়ি পাওয়া যায়? পূর্ত বিভাগ দয়া পরবশ হয়ে সেজন্য ঐ ফ্ল্যাট বাড়িতে প্রতুলদের থাকতে দিয়েছে। 

প্রতুল জানে, চেনাশুনা কারুর কাছ থেকে সহানুভূতি পাবে না। সবাই বলবে, দেশের কাজের জন্য, জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য রাস্তা বসাতে গেলে কিছু বাড়ি টাড়ি ভাঙতেই হবে। কিন্তু যার নিজের জিনিস যায়, তার দুঃখ কেউ বুঝবে না। পিতৃপুরুষের বাড়ি, যেখানে প্রতুল জন্মেছে, তার ছেলেমেয়ে জন্মেছে, সে বাড়ির মায়া ত্যাগ করা সহজ? ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার দিয়েছে বারো লক্ষ আটানব্বই হাজার পাঁচশ সাতাশ টাকা। সরকারি হিসেবের মাথামুণ্ডু বোঝা অসাধ্য ব্যাপার। সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়ি, বাজার দর অন্তত তেইশ চব্বিশ লাখ টাকা, বেশ কিছু ব্ল্যাক মানিও পাওয়া যেত। বিদ্যাসাগর সেতু তৈরি হওয়ার শুরুতেই প্রতুল যদি বাড়িটা অন্য লোককে বেচে দিতে পারত, তাহলে তার কত লাভ হতো। পোড়া কপাল একেই বলে! 

জয়াদের পরিবার এক সময় একটা ছোটখাটো জমিদারির মালিক ছিল। সেই জমিদারি রক্ত রয়ে গেছে তার শরীরে। ফ্ল্যাট বাড়িকে সে মনে করে ব্যারাক বা বস্তি। পাঁচ জাতের লোকের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা তার কাছে এমনই অসহায় যেন এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। প্রতুল অবশ্যই এ ফ্ল্যাটে বেশিদিন থাকবে না। জমি কিংবা বাড়ি খোঁজাখুজি চলছে। পছন্দমতন কি সহজে পাওয়া যায়? তাছাড়া চেকটাও ভাঙানো যাচ্ছে না, একটু অসুবিধে আছে। প্রতুলের এক ভাই বেশিদিন বাঁচে নি, এক দিদি আছে, সে ঐ বাড়ির এক-তৃতীয়াংশের মালিক। সরকার দু’জনের নামে যৌথ চেক দিয়েছে। দিদি জামাইবাবু থাকে সিঙ্গাপুরে, শীতকালের আগে আসতে পারবে না। দিদি এলে ব্যাংকে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। দিদি অবশ্য টাকা চায় না, পুরো টাকা দিয়ে সে অন্য বাড়ি কেনার অনুমতি দিয়েছে, সেই বাড়িতেও তার মালিকানার অংশ থাকবে। 

বাজার করে বাড়ি ফেরার পর কাণ্ড হলো। প্রতুল গাড়ি থেকে সবে নেমেছে, পেছন থেকে একজন বলল, ভালো আছেন স্যার? 

মুখ ফিরিয়ে প্রতুল দারুণ চমকে উঠল। হারান? 
মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল প্রতুলের। শুকিয়ে গেল গলা। হারান দিব্যি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা। 
প্রতুল আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি এখানে...  মানে, কাজ করতে এসেছ? 
হারান বলল, না, আমি তো এখানেই থাকি। আমাদের বস্তি ভেঙে দিল, তাই সরকার ফ্ল্যাট দিয়েছে, এই তো দু’নম্বর ব্লক, তিনতলার ঐ কোণেরটা। ঐ যে একটা লাল রঙের শাড়ি শুকোচ্ছে। 
আর কথা না বাড়িয়ে প্রতুল ভেতরে ঢুকে গেল। তার হাতে বাজারের থলি। এরকম দৃশ্য হারান আগে দেখে নি। সে অবাক হয়েছে, না বিদ্রূপের হাসি হাসছে? 

হারান ছুতোর মিস্ত্রি, প্রতুলদের বসত বাড়িতে তার বাঁধা কাজ ছিল। কখনো সারাদিন পার করলে তাকে চা-মুড়ি খেতে দেওয়া হতো। একটা ভাঙা কাপ ছিল তার জন্য আলাদা, টিনের বাটিতে দেওয়া হতো মুড়ি। বারান্দার এক কোণে উঁচু হয়ে বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে খেত। ওদের বস্তিটাও ঐ রাস্তা বানাবার জন্য ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাতে লাভই হয়েছে হারানদের। বস্তির বদলে বস্তি না, পেয়েছে পাকা বাড়ি। প্রতুল আর হারানদের সমান সমান ফ্ল্যাট, বা বা বা বা, সরকারের কী সুবিচার! ঘরে ঢুকে থলিটা নামিয়ে রেখেই প্রতুল তার স্ত্রীকে বলল, জানো, ঐ যে হারান, আমাদের কাঠের মিস্ত্রি ছিল, সে দু’নম্বর ব্লকে থাকে। 
বলার পরই প্রতুল বুঝতে পারল, এক্ষুনি বলাটা তার ঠিক হয় নি। 

জয়া স্থির দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে, জিভে বিষ মিশিয়ে বলল, আর আমাদের মেথরটা, সে এই বাড়িতে থাকে না? রাস্তার ভিখিরিগুলো এখানে ফ্ল্যাট পায় নি? তুমি আমাকে এই নরককুণ্ডে রেখেছ! প্রতি মুহূর্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। তারপর জয়া এমন দাপাদাপি শুরু করে দিল যে প্রতুলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হলো, আজ থেকে সে দ্বিগুণ উদ্যমে বাড়ি বা জমি খোঁজা শুরু করবে। একমাসের বেশি এখানে তারা আর থাকবে না। 
হারানকে দেখে প্রতুল ঘৃণা বোধ করে নি, ভয় পেয়েছে। সেই আসল কারণটা জয়া বুঝল না। আজকাল এত জাত পাতের বিচার করলে চলে না। আমরা যখন ট্রেনে কোথাও যাই, কিংবা সিনেমাহলে গিয়ে বলি, তখন পাশের লোকটা ছুতোর মিস্ত্রিরি, না মেথর, না ডোম তা বোঝার কি কোনো উপায় আছে? আজকাল ওরা সবাই এক প্রস্থ ভালো পোশাক রাখে। এক ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকলেই কি হারান তাদের সমান হয়ে গেল? প্রতুলের গাড়ি আছে, এ বাড়ির সবাই জানে, প্রতুলরা এ বাড়িতে থাকার যোগ্য নয়, নেহাৎ বিপদে পড়েই কিছুদিনের জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ভয়ের কারণটা অন্য। হারান সম্পর্কে তার একটা অপরাধবোধ আছে। গত বছর হারান বাড়িতে যখন দোতলার ঘরের বড় আলমারিটা সারাচ্ছিল, তখন একদিন জয়ার হাতঘড়িটা উধাও হয়ে গেল। অনেক খুঁজে পাওয়া যায় নি। স্বাভাবিকভাবেই সব সন্দেহ পড়েছিল হারানের ওপর। অন্য কাজের লোকেরা ঐ ঘরে বিশেষ আসে না, জুতোর মিস্ত্রি সারাদিন ওখানে বসে কাজ করে, কে তার ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখে? হারান অনেক বছর ধরে আসছে, আর কখনো এরকম ঘটে নি। কিন্তু মানুষ তো বদলাতেও পারে।। 
ঘড়িটা এমন কিছু দামি নয়, কিন্তু বিয়ের সময় জয়ার মা এটা নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। জয়া রাগে-দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে হারানকে বলতে শুরু করে দিল, তুই চুরি করেছিল, শিগগির ফেরত দে, নইলে তোকে পুলিশে দেব। প্রতুলও হারানকে অনেক জেরা করার পর এক সময় খুব রেগে গিয়ে ওকে মারতে উদ্যত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মারে নি অবশ্য। মেয়েরা অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় তাদের জিনিসপত্র রাখে।


ঘড়িটা পরে দিন আবিষ্কার করা গেল, ধোপার হিসেবের খাতার মধ্যে। হারানের যন্ত্রপাতি সমেত থলি আটক করা হয়েছিল, দারোয়ান গিয়ে সেটা ওদের বস্তিতে ফেরত দিয়ে এলো, কিন্তু হারান আর আসে নি। 
হারান নিশ্চয়ই সে ঘটনা ভুলে যায় নি। মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে। এবার এ কাছাকাছি পেলে যদি সে প্রতিশোধ নেয়? সবার সামনে প্রতুলকে একদিন দারুণ অপমান করবে কিংবা পেছন থেকে হঠাৎ হাতুড়ি দিয়ে মাথায় মারবে? 

এরপর হারানের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হতে লাগল। হারান নমস্কার করে, কেমন আছেন জিজ্ঞেস করে, তার মতলবটা বোঝা যায় না। সে কি সুযোগের অপেক্ষায় আছে? তার মুখের হাসিটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপের? এক এক সময় প্রতুলের মনে হয়, হারানের হাত জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাই হারান, তোমাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছিলাম, তুমি চোর নও জানি, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও।’ কিন্তু ইচ্ছে হলেও এ রকম নাটকীয় ব্যবহার করা সহজ নয়! তাছাড়া জয়ার মতে, হারানই ঘড়িটা ধোপার হিসেবের খাতার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, পরে কোনো এক সুযোগে... 

দু’দিন পরেই প্রতুল টের পেল, টুলটুল নিচের পার্কে যাদের সঙ্গে খেলতে যায়, তাদের মধ্যে হারানের ছেলেও রয়েছে। হারান একদিন তার ছেলেকে ডাকছিল। হারানের ছেলের নাম বাবু, আট-ন’বছর বয়েস। ছুতোর মিস্ত্রিরির ছেলের নাম বাবু, ফ্ল্যাট বাড়িতে এসে হারান ভদ্রলোক শ্রেণীতে উঠতে চাইছে।
টুলটুল প্রায়ই তার মায়ের কাছে তার খেলার বন্ধুদের গল্প করে। তার প্রিয় বন্ধুদের নাম তপু, টিয়া, বাবু, সোনাই। ঐ বাবুটি যে কে, তা প্রতুল জয়াকে জানায় না। শুনলেই সে আবার লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে। টুলটুলকেও বারণ করার কোনো মানে হয় না। বাবুর চেহারাটি বেশ, টানা টানা চোখ। ছুতোর মিস্ত্রিরির ছেলে দেখতে সুন্দর হতে পারে না? প্রতুলদের রঙের কারখানায় এক ছোকরা শ্রমিকের মুখখানা অবিকল ফিল্মস্টার মিঠুন চক্রবর্তীর মতন। 

শরৎকাল প্রায় শেষ, তবু একদিন এর মধ্যে খুব জোর বৃষ্টি নামল। 

বেহালার দিকে একটা একতলা বাড়ি, মোটামুটি পছন্দ হয়েছে, প্রতুল আর জয়া তা নিয়ে আলোচনা করছিল। অনেকদিন পর আজ জয়ার মেজাজ বেশ ভালো আছে। স্বামীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। একটা বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে সে কাজে লোকটিকে ডেকে বলল, এই, শিগগির টুলটুলকে নিচ থেকে ডেকে নিয়ে আয়। 
টুলটুল নিজেই ফিরে এলো, তার মুখে, কপালে চন্দনের মতন ফোঁটা, গলায় একটা ফুলের মালা। 
প্রতুল জিজ্ঞেস করল, এ কী সেজেছিস রে, আজ কী খেলছিলি? 
টুলটুল এক গাল হেসে বলল, বর-বউ খেলা হচ্ছে। আমি বউ সেজেছি। সোনাই আমার শাশুড়ি। 
মুখের চেহারা বদলে গেল জয়ার। স্বামীর দিকে রক্তচক্ষে তাকিয়ে বলল, ছোটলোকদের সঙ্গে মিশে মিশে কী অবস্থা হচ্ছে দেখো! নোংরা, বস্তির ছেলেমেয়েদের মন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুকে তুমি শিগগির হোস্টেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
তারপর মেয়ের দিকে ফিরে বলল, খবরদার তুই আর নিচে খেলতে যাবি না। মালাটা খুলে ফ্যাল, মুখ ধুয়ে আয়।
টুলটুল বলল, না, আজ ছুটি, আজ দুপুরে আমাদের রান্নাবাড়ি হবে। বরযাত্রীর লোকদের খাওয়াব। 
এত আদরের মেয়ে, কোনোদিন তার গায়ে হাত তোলে নি জয়া, আজ তার গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, খুব পাকা হয়েছিস তাই না? ঘর থেকে এক পা বেরুতে পারবি না। 

হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে গেল প্রতুলের। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তোর বর কে সেজেছিল, বাবু, তাই না? 

জল ভরা চোখে টুলটুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। বোঝা গেল, খেলাঘরের স্বামীটিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.