মন্ত্র

মন্ত্র

আমার বাবা শহরের ধনী- ব্যাক্তিদের মধ্যে একজন। প্রতিমাসেই তাকে ব্যাবসার কাজে দেশের বাইরে যেতে হয়। দিন দিন তার অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। সেটা শেষপর্‍যন্ত কোথায় গিয়ে রহামবে কেউ জানে না। আমার আর কোনো ভাইবোন নেই যে তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাব। প্রতিদিন স্কুল, টিচার বাদে বাকিটা সময় কাটে জানালার পাশে।

আমার রেজাল্ট বরাবরই ভালো। প্রকৃতি হয়তো অনেক অপূর্ণতাকে ভিন্নভাবে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিচিত্র কোনো কারণে আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো । আমার ব্রেনও চট করে সব ধরতে পারে। ক্রমাগত একা থাকতে থাকতে একটা বিষয় ভালো হয়েছে। আমার চিন্তা করার শক্তি বেড়ে যাচ্ছে।

আমার তিনজন টিচার। তারা সপ্তাহে তিনদিন আসেন। এর মধ্যে আমার অপছন্দের হচ্ছেন আশরাফ স্যার। তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। পড়ানোর সময় তার অন্যতম কাজ হচ্ছে হাত দিয়ে নাকের লোম ছিঁড়া। এবং এ কাজ তিনি করেন নিয়মিত এবং আগ্রহ সহকারে।তাও আমি সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু একটা বিষয় সহ্য করা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। আমার ঘর থেকে প্রায়ই শিউলিকে দেখা যায়। ও বাসায় কাজ করে। ওর বয়স আমারই মতো। এই বয়সেই ওর শরীরে নারীত্বের পূর্ণ লক্ষণ ফুটে উঠেছে। ফলে ওকে দেখে মনে হয় বাইশ-তেইশ বছর বয়সি মেয়েদের মতো। আমি আগে থেকেই লক্ষ করেছি, পড়াতে বসলেই আশরাফ স্যারের চোখ থাকে দরজার দিকে কখন শিউলিকে দেখা যাবে। আশরাফ স্যার শিউলিকে দেখলে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। তার মুখ দিয়ে যেন লালা ঝরে। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেই আমি। অন্যু দুজন টিচারের এসব দিকে খেয়াল নেই। তারা দুজনই তরুণ। মানুষ বুড়ো হলে হয়তো যৌ ন কামনায় পাগল হয়ে উঠে। গল্প – উপন্যাসে পড়েছি, মধ্যবয়সী পুরুষরাই নাকি বেশি বাসে মেয়ের বয়সি মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে আশরাফ স্যারকে না দেখলে জানতাম না। আমি কিছুদিন আগে “লুচ্চা” শব্দটা পরশের কাছ থেকে শিখছি। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও সব শ্রেণীর লোকের সঙ্গে যোগাযোগ। নানারকম অপিরিচ অসাধারণ শব্দ ওর কাছ থেকেই শেখা যায়।

আমি নিজেকে সাধু বলে মনে করি না। মাসে দু – একবার ব্লুফিল্ম দেখি। অনেকেই শুনলে বলবে, এসব চরিত্রহীনতার লক্ষণ। একটা সময় মনে হতো, আমি কি চরিত্রহীন? একদিন পরশকে বলতেই ও হো হো করে হেসে উঠলো এবং আমাকে “স্টুপিড” বলে গালি দিল। আমি জানি, পরশ ইতিমধ্যেই বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় গিয়েছে এবং এটা ও বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে। পরশের সে সব কাহিনি শুনলে কান গরম হয়ে উঠে এবং কেন যেন প্রবল ঘৃণা হয় আমার। মানুষ হিসেবে কিছু জৈবিক চেতনা থাকতেই পারে আমার কিন্তু ব্লুফিল্ম দেখার পর ঘৃণাই হয় আমার। তারপরও মাসে একবার দেখি আর ঘৃণা হয়। ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন এসব সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার খমতা থাকলে ইন্টারনেট থেকে অইসব সাইট ব্লক করে দিতাম। নিজের ভেতর থেকেই বুঝতে পারি, ব্লুফিল্ম মানুষের ঘৃণাবোধ নিম্নস্তরে নামিয়ে দেয়। তখন ঘৃণা হয় নিজের ওপর। যদিও মেয়েদের থেকে পরীক্ষার নোট বাদে অন্যসময় দূরে থাকার চেষ্টাই করি আমি। আর আমার মতো পঙ্গুকে কেইবা পাত্তা দিবে ! যদিও পাত্তা দেয় তা হয়তোবা বাবার টাকার জন্য। দুনিয়াতে অনেক লোভী মেয়ে আছে। যারা খুবই ভয়ংকর। লোভী মেয়েরা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শিকারী। ওদের কাছে ছোত মাছ ঘাই দিলে ওরা লাথি মেরে দূরে ফেলে দেয় আর বড় মাছ দেখলে বরশি দিয়ে টোপ ফেলে তা ধরার জন্য চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে ধরেও ফেলে।

আমার মা একজন সমাজসেবিকা। মানুষের যখন টাকা হয়, তখন তাদের মধ্যে নানারকম খেয়াল চাপে। আমার মনে হয়, টাকা থাকলে দুনিয়ার পচানব্বই ভাগ জিনিসই পাওয়া যায়। পাঁচ ভাগ জিনিস পাওয়া যায় না এবং ওই পাঁচ ভাগ জিনিসই মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়। এত টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি যেমন জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মায়ের ভালোবাসা পাই নি। আমার মা সমাজসেবায় এতই ব্যাস্ত যে তার নিজের সংসার-স্বামী-সন্তানকে সময় দেওয়ার মতো সময় নেই। মাসে দু-একবার হয়তো মাকে দেখি। ফলে আমাদের মধ্যে সম্পর্কের টান নিতান্তই কম। বাবার ব্যাবসা নিয়ে ভীষণ রকম ব্যাস্ত। তাই আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে কারো সখ্যতা নেই। সবাই  আছে যার যার নিজের মতো। আমাদের পরিবারের অর্থের অভাব নেই। কিন্তু ভালোবাসার বড়ই অভাব।

আমি জানালা দিয়ে মানুষ দেখি। অচেনা মানুষ। মাঝে মাঝে দেখা যায় ঝগড়া- মারামারি। বেশিরভাগ সময়ই দুর্বল আর গরিবই মার খায়। এ জগতে গরিবরা বোধহয় মানুষের স্তর থেকে ভিন্ন। তারা দোষ করলেও মার খায়, না করলেও মার খায়। গরিব হওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপ। আগে মানুষ গোনার চেষ্টা করতাম। প্রতিদিন কয়জন নতুন মানুষ দেখলাম তা হিসাব করতাম। এতে কময় কেটে যেত। এরপর রাতে ডায়রিতে সংখ্যাটা লিখে রাখতাম। একসময় নিজেই তা বন্ধ করে দিলাম। কারণ ততদিনে বুঝে গেছি, এসব অর্থহীন কাজকর্মের কোনো মানেই হয় না।

অর্শিয়া গতকাল এসেছিল। অর্শিয়া আমার ক্লাসমেট। ও দেখতে সুন্দরী। শুধু সুন্দরী বললে ভুল হবে, মহাসুন্দরী। আমি অর্শিয়াকে দেখে খুশি হই নি।অর্শিয়ার এ বাড়িতে আসা মানে স্বার্থের খেলা আর অপবিত্র কিছু সংঘটিত হওয়া। অর্শিয়ার বাবা একজন উঠতি ব্যাবসায়ী।উঠতি ব্যাবসায়ীরা উপরে উঠার জন্য নানারকম ব্যাবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু অর্শিয়ার বাবা যা করেছেন, তা অত্যন্ত জঘন্য। তিনি তার মেয়েকে দিয়ে আমার পঞ্চান্ন বছরের বাবাকে টার্গেট করেছেন। বাবা দিনের বেলায় বাসায় থাকলে তাই অর্শিয়ার দেখা পাওয়া যায়। এরপর তাদের আদিম কর্মকান্ড চলে। আমি জানালা দিয়ে বারবার থুতু ফেলি। এভাবে মেয়েকে ব্যাবহার করে কোটি কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট পাচ্ছে বাপ।

অর্শিয়া বাসায় এসে আমার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। আমি নির্বিকার থাকি। তখন কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। ক্লাসে ওর বয়ফ্রেন্ডও আছে। ওর বাপও বেশ বড়লোক। অর্শিয়া চালাক মেয়ে। ধরেছে তো বিগফিসই ধরেছে। ওর চাইতে বড় কাউকে পেলে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে একমুহূর্তও দেরি করবে না।

আমার সময় প্রতিদিন একইভাবে কাটে। স্কুল, টিউশনি এবং জানালা দিয়ে মানুষ দেখা। বড়লোকের ছেলে হওয়ার অসুবিধা হচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষই নানা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। আমার বন্ধুরাও তার ব্যাতিক্রম নয়। তাদের অনেকেরই লক্ষ্য আমাকে ফুলিয়ে সুবিধা আদায় করা যায় কি না। দু – একজন অবশ্য ব্যাতিক্রম। যেমন নাজিব। একমাত্র সে –ই ক্লাসে আমার একমাত্র নিঃস্বার্থ বন্ধু। সে মানুষ হিসেবে সাধারণ এবং সৎ। ওদের অবস্থা ভালো নয়। নাজিব মানুষের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারে না। দরিদ্র হওয়ায় মনে হয় ওর মধ্যে কিছুটা হীনমন্যতা কাজ করে। টিফিন ছাড়া ওকে তেমন কোনো খরচ করতে দেখা যায় না। হয়তোবা খরচ করার মতো তেমন টাকাই আসলে নেই। বেশির ভাগ সময়মতো বাসা থেকেই খাবার আনে। আমাকে প্রতিদিন হাত খরচ হিসেবে দেওয়া হয় এক হাজার টাকা। অথচ তেমন কিছুই খরচ হয় না। মাঝে মাঝে গল্পের বই কিনি। আমার এতদিনে ব্যাংকে লাখ তিনেকের মতো জমে গেছে। যদি টিউশনি করতাম তাহলে এতদিনে দশলাখ জমে যেত কিন্তু আমার টিউশনি করা বাবা-মা ভালোভাবে নেবে না। তারা বলবে  - যদি এক হাজার টাকা কম মনে হয়, আরও টাকা নাও। টিউশনির কী দরকার? যার বাবা দেশের সেরা ধনীদের একজন, তার টিউশনির কোনো প্রয়োজন নেই। বলাই বাহুল্য, আমাকে টিউশনি করতে দেওয়া হয় নি। কাজের ছেলে মবিনকে কিছুদিন পড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। দু – একদিন পরই দেখলাম, ও আমার ধারে কাছে আসছে না। যার ইচ্ছে নেই, তাকে জোর করে কি লাভ? মবিন পড়ালেখার চেয়ে বাসায় কাজ করতেই বেশি আগ্রহী। আমি আর জোরাজুরি করি নি।

মাঝে মাঝে মনটা একটু বেশিই খারাপ হয়ে যায়। জীবনটাকে বড় পানসে লাগে। দু-একজন যে আমাকে কৃপণ বলে উপহাস করে তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। অথচ নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে এটাই যে, আমার বাবার হাজার কোটি টাকা থাকা সত্বেও আমাকে সারাজীবন পঙ্গু হয়েই বেচে থাকতে হবে। বাবা দেশে ব্যর্থ হয়ে বিদেশেও নিয়ে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফলাফল একই। আমার পা ঠিক করা সম্ভব নয়। এ কথা শুনে তখন আমার মনে হয়েছিল, জীবনটা অনেকটাই অন্ধকারে তলিয়ে গেল। তাই নিজেই নিজেকে বন্দি করলাম। পারিবারিক বন্ধন শক্ত হলে হয়তো এ সমস্যা সৃষ্টি হতো না। তখন জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। ভালোবাসাহীন জীবন মানুষকে সুখী করে না। মানুষের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সুখী হওয়া।

গতকাল আমি স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলের সঙ্গে অন্য একটি স্কুলের খেলা। আমি হুইল চেয়ারে বরাবরের মতোই বসে আছি। আমার ক্লাসমেটরা বসে আছে চারদিকে। ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা। প্রতিবারই এ খেলা দেখলে আমার আফসোস হয়। কেননা এটি পায়ের ব্যাবহার ছাড়া খেলা অসম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা দাবা বাদে আর প্রায় সব খেলায় বোধহয় পায়ের ব্যাবহার আছে। অবশ্য কম্পিউটার গেম পা ছাড়াই খেলা সম্ভব।

কিন্তু ভালো লাগে না আমার। অবশ্য কার্টুন এনিমি মারতে এক সময় ভালোই লাগত। আমি ভয়াবহ ধরণের পঙ্গু। হুইল চেয়ার ছাড়া একদম অসহায়। যদি ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারতাম তাহলেও হয়তো আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষদের একজন হতে পারতাম। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় আমাকে এতটুকু সুখীও দেখতে চান নি। পঙ্গু হওয়াতেই বোধহয় আমার বোধশক্তি এত বেশি তীব্র হয়েছে যে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে ভাবতে নিজের উপলব্ধিতে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। একদিন একজন বল, এ নাকি আমার পরীক্ষা। লোকটাকে কষে তখন একটা চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছিল।

আমার বাবার অনেক টাকা। কোটি কোটি টাকা। আফসোস এ কোটি কোটি টাকাও আমাকে সুস্থ-সবল দুটি পা উপহার দিতে পারবে না।

আমাদের বাড়ির সামনে একটুখানি খালি জায়গা আছে। সেখানে বাগানের মতো করা হয়েছে। গোলাপ-রজনীগন্ধাসহ আরো কত ধরণের ফুল। আমি হুইল চেয়ারে সেখানে বসে থাকি। মাঝে মাঝে ফুল স্পর্শ করি। হাতে গোলাপের গন্ধ লেগে থাকে। হারুন মিয়া আমাদের বাগানের মালি। তাকে এ কাজ করার জন্য মাসে পনের টাকা দেওয়া হয়। লোকটা মালির কাজ ভালো বুঝলেও ফাঁকিবাজ হয়ে যায়। হারুন মিয়ার আরও দুটা সংসার গ্রামে আছে। বড়লোকরা একটা বিয়ে করলে পরকীয়া করে আর গরিবরা টাকা হলে আবার বিয়ে করে। আজ হারুন মিয়াকে বকা দিতে হবে। বকা দিলে অবশ্য সে মাথা নিচু করে থাকে। আমি নিশ্চিত বেতন বাড়ালে হারুন মিয়া আরেকটা বিয়ে করবে।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কোনো নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখি ছোটবেলায় একবার পদ্মার পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। এখন আমন দৃশ্য দেখা আমার জন্য কঠিন। বড়লোকের ছেলে হওয়ার সমস্যা আছে। তাদের যে-কোন সময় কিডন্যাপের ভয় থাকে।

আর আমার মতো পঙ্গু হলে তো কিডন্যাপারদের আরও সুবিধা। আমার সঙ্গে সবসময় দুজন বডিগার্ড থাকে। তাদের সঙ্গে থাকে লোড করা আগ্নেয়াস্ত্র। এই দুইজন খুবই বিশ্বস্ত। ওরা প্রয়োজনে আমাকে বাঁচানোর জন্যে গুলী খেতেও দ্বিধা করবে না। কিন্তু জীবনের বিশেষ কিছু মুহুর্ত আছে যা একা উপভোগ করতে হয়।

জীবনের বড় একঘেয়ে। সকাল দুপুর বিকাল সন্ধ্যা রাত। এ ছাড়া আর কিছুই নেই। সব কিছুই েকরকম। শুধু যেন বেচে থাকার জন্য বেচে থাকা। এই বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। ক্লান্তিকর।

আমি যে গাড়িতে চড়ি সেটীর দাম পঁচানব্বই লাখ টাকারও বেশি। অভাব আমাকে স্পর্শ করে না। আমি গাড়িতে থাকার সময় ট্যাবে বই পড়ি। মুভি-গেমসের চেয়ে বই পড়ার প্রতিই আমার বিশেষ আগ্রহ। ইংলিশ মিডিয়ামের হলেও আমি বাংলা ভালো পারি। অন্তত আমার তা বিশ্বাস। হুমায়ুন আহমেদ পড়া প্রায় শেষ, এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পালা। অবশ্য এখন এরিখ-মারিয়া রেমার্কের একটা বই পড়ছি। বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে হয়তো এতদিনে যন্ত্রণায় আমি পাগল হয়ে যেতাম। বই আমাকে আনন্দ দেয়। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। বই তোমাকে ধন্যবাদ।

এরপর যা ঘটল তা আমার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিল। মাঝে মাঝে জীবনে মিরাকল জাতীয় কিছু ঘটে যায়। যার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না কিন্তু মনে মনে আশা করে। কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

গাড়ির কাচ দিয়ে আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। জানালার কাচ খোলা। সিগন্যালের কারণে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাত বাইরে থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে দিল। আমি সেই হাতের দিকে চেয়ে চমকে গেলাম। হাতটার তিনটা আঙুলই নেই। বয়স দশ-বারো হবে। ওর একটি পা নেই। এক পা নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ভিক্ষা করছে। ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠলাম আমি। বত্রিশটা দাত বের করে হাসছে। মুখে উজ্জ্বল আভা। সেই আভা দেখে মনে হলো সেখানে যেন হাজারটা সূর্য জ্বলজ্বল করছে। আমি কিছু বলার আগেই ছেলেটা বলে উঠল, “এত দুঃখ কিসের তোমার, দেখ না জীবন কেমন আনন্দময়। আমি কেমন করে হাসি এত কষ্টেও। তুমি কেন পার না … আমি কিছু বলার আগে ছেলেটি নেই। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে (বডিগার্ডের সাহায্যে) ছেলেটিকে আর দেখতে পেলাম না, যেন হাওয়ায় মিলিয় গেছে। বুঝতে দেরি হলো না আমার অবচেতন মন আমাকে বেঁচে থাকার মন্ত্র দিয়ে গেল। নাকি এটা ঈশ্বরের সংকেত! আমার মতো অবিশ্বাসীকেও কি ঈশ্বর দয়া করেন ?

সিগন্যাল সরাতেই ড্রাইইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বললাম। ওকে জানালাম, ড্রাইভার পদ্মার পাড়ে যাব। মাওয়ার দিকে চলো। ড্রাইভার কিছু না বলে গাড়ি ঘুরাল। স্পষ্টই বুঝতে পারলাম ও অবাক হয়েছে।

পদ্মার পাড়ে এসে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। বালিতে হাত রাখলাম  কী উষ্ণ । হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলাম আমি। আশেপাশের লোকজন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তবে সঙ্গে অস্ত্রধারী দুজনকে দেখে ভয়ে কিছু বলতে সাহস করছে না। ওরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই সেই ছেলেটিকে দেখতে পেলাম। ও হাসছে আমার পাশে বসে। আমিও হাসছি। সেই হাসিতে মনে হচ্ছে মনের যন্ত্রণাগুলো কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে। নতুনভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আমি বেঁচে থাকার মন্ত্র পেয়ে গেছি। আহা জীবন কত আনন্দময়…! 

Leave a Reply

Your identity will not be published.