১৭ অক্টোবর ২০১১ নিউইয়র্ক। আমরা আজকে যাব আটলান্টিক সিটিতে। আমাদের দলনেতা হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে আছেন পত্নী মেহের আফরোজ শাওন, শাশুড়ি তহুরা আলি, প্রকাশক এবং ছায়া সঙ্গী মাজহারুল ইসলাম, দুই পুত্র এবং আমি। দুপুর তিনটায় নিউইয়র্কের ৮ এভিনিউ থেকে গ্রেহন্ডের বাস ছেড়ে যাবে।
নিউইয়র্কে এবার খুব জাঁকিয়ে শীত নেমেছে, শীতের ভয়ে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। অনেক রাত অব্দি আড্ডা হয়েছে। আমরা বেশ ঢিলে তালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ যাকে ইংরেজিতে বলা ব্রাঞ্চ, সেই ব্রাঞ্চ সেরে আমরা বাস স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন- বাঃ নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ। অনেক দিন পর আউটিং হচ্ছে। ইটস এ ওয়ান্ডারফুল ডে।
আমরা ষ্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই আমাদের চোখের সামনে আমাদের নির্ধারিত গ্রেহন্ডের বাস ছেড়ে গেল। মাজহার ভাই লম্ফ-ঝম্প করে ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন লাভ হল না। আমাদের বেশ মন খারাপ হল। মাত্র এক মিনিটের জন্য আমরা বাস মিস করলাম। মাজহার ভাই আমেরিকানদের সময় জ্ঞান নিয়ে বেশ গালমন্দ করলেন- এক মিনিট কি এমন সময়! দু-চার মিনিট ওয়েট করলে ক্ষতি কি?
শাওন ভাবী অফিসারের সঙ্গে কথা বললেন- আমাদের সঙ্গে কিডস এবং সিনিয়ন সিটিজেন আছেন, আমরা সময়মতো বাস ধরতে পারিনি এখন কি হবে?
অফিসার বলল- কোন সমস্যা নেই, আধ ঘণ্টা পর আরেকটা বাস ছেড়ে যাবে, তোমরা ইচ্ছা করলে ওটাতে যেতে পার। একবার টিকেট কাটলে তুমি নির্ধারিত ডে’ তে যে কোন বাসেই যেতে পার।
মাজহার ভাই এ কথা শোনার পর সুর পাল্টে বললেন- এ না হলে কি আমেরিকা! ওদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। অন্য দেশ হলে বলত- সময় মতো আসনি কেন, এখন নতুন টিকেট কিনে নাও। আমেরিকা আসলেই মহান এক দেশ।
আধ ঘণ্টা সময় পাওয়াতে ভালই হয়েছে, লাঞ্চ করার সময় পাওয়া গেছে। বাসের টেনশন আমাদের ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে। সবার জন্য টুনা স্যান্ডুইচ নেয়া হল। স্যান্ডুইচ মুখে দেবার আগেই এক ভিখারি এসে হাত পেতে দাঁড়াল। হুমায়ূন আহমেদ মাজহার ভাইকে দেখিয়ে বললেন- মাজহার তোমার মহান দেশে দেখছি ভিক্ষুকও আছে। ভিক্ষুক বিদায় কর। বল আল্লারওয়াস্তে মাফ কর।
মাজহার ভাই ভিক্ষুককে টুনা স্যান্ডুইচ এগিয়ে দিল। আমেরিকান ভিক্ষুক মাজহার ভাইয়ের দিকে এমন ভাবে কটমটিয়ে তাকাল- যেন এ রকম অপমান তাকে এ জীবনে আর কেউ করেনি। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ভিক্ষুকটি চেঁচামেচি শুরু করল।
হুমায়ুন আহমেদ বললেন- মাজহার এটা বাংলাদেশ না। তোমার মহান আমেরিকান ভিক্ষুকরা খাবার নেবে না, ওরা চেনে ডলার। বাচ্চারা ভয় পাচ্ছে, কিছু ডলার দিয়ে তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় কর।
নিষাদ-নিনিতের চেয়ে মনে হল মাজহার ভাই ভয় পেয়েছেন বেশি। তিনি দ্রুত একটা দশ ডলারের নোট এগিয়ে দিলেন। ভিক্ষুক ডলার হাতে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগিয়ে গেল। এর পর যে দৃশ্য দেখলাম সেটার জন্য আমরা কেউ মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, তিনজন পুলিশ এসে মাজহার ভাইয়ের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো এক কালো মেয়েকে মাটিতে ফেলে হ্যান্ডকাফ পরাতে লাগলো। ভয়ে মাজহার ভাইয়ের কালো মুখ বেগুনি হয়ে গেল। একটু আগেই তিনি মেয়েটির সাথে হেসে হেসে গল্প করছিলেন যেন অনেক দিনের চেনা। একজন এশিয়ান পুলিশ মাজহার ভাইয়ের ভয়ার্ত মুখ দেখে অভয় দিয়ে বলল- ড্রাগ এবিউজার, নট টু ওরিস।
একের পর এক মহান দেশের মহান এবিউজারদের পাল্লায় পড়ে আমরা অতিষ্ঠ। এখন প্রাণ নিয়ে বাসে উঠতে পারলেই বাঁচি। নির্দিষ্ট সময়ে বাস এসে গেল। আমরা সবাই বাসে উঠে বসলাম। নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সি তিন ঘণ্টার জার্নি। হাইওয়ে দিয়ে পিপীলিকার মতো সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে, বিশাল বিশাল সব গাড়ি। সেলুন কারের চেয়ে এমভিপি কারের সংখ্যাই বেশি এ জন্যেই তেলের জন্যে আমেরিকানরা মরিয়া। গণতন্ত্র রক্ষার নামে বেছে বেছে তারা তেল অধ্যুষিত দেশগুলোতে হামলা চালাচ্ছে।
আমরা উঠবো আটলান্টিক সিটির শো-বোট হোটেলে। শাওন ভাবী আগেই চারটা রুম বুকিং করে রেখেছেন। খরচ বাঁচাতে মাজহার ভাই আমার সাথে রুম শেয়ার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন- তোমরা দুজন রাতে যথেষ্ট নাক ডাকো, তোমাদের দুজনের বউ কি করে টিকে আছে সেটা আমি ভেবে অবাক হচ্ছি। তোমাদের নাক ডাকার ব্যাঘাত হোক এটা আমি চাই না। দুজন দু’রুমে আরাম করে নাক ডেকে ঘুমাবে, পুরো হোটেল যেন গমগম করে।
শো-বোট হোটেলে আমরা দু’রাত থাকব। হুমায়ূন আহমেদের খাবার দাবার নিয়ে মাজহার ভাই বেশ চিন্তিত, হুমায়ূন আহমেদ হোটেলের খাবার খেতে পারেন না, ওসব তাঁর কাছে অখাদ্য। হোম মেইড খাবারই তাঁর প্রিয়। এখানে এক বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে মাজহার ভাই ফোনে কথা বলে রেখেছেন। উনি আটলান্টিক সিটিতেই সেটেল্ড, হুমায়ূন আহমেদের খাবার-দাবারের ব্যাপারটা দেখভাল করবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
আমাদের নির্ধারিত হোটেলে বাস এসে থামল। বাস থেকে নামতেই দেখি বেসবল টুপি পরা এক বাঙলি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবকের নাম নাসিম। হুমায়ূন আহমেদ আসবেন শুনে উনি দু’দিন ছুটি নিয়েছেন। নাসিম ভাই এখনই আমাদেরকে তাঁর বাসায় নিয়ে যেতে চান। আমরা যতই বলি হোটেলে চেকইন করার পর আমরা তার বাসায় যাব। কিন্তু উনি কিছুতেই আমাদের কথা শুনবেন না, বলেন- এখনই যেতে হবে, সেই কতক্ষণ ধরে সবাই না খেয়ে আছে, আহারে বাচ্চদের মুখগুলো একেবারে শুকিয়ে গেছে। আমাদের বাসায় খেয়ে দেয়ে এসে হোটেলে চেকইন করে তারপর বিশ্রাম নেবেন।
অবশেষে নাসিম ভাইকে হুমায়ূন আহমেদ কনভিন্স করলেন- নাসিম শোন, বাচ্চাদের ন্যাপি চেঞ্জ করতে হবে, এদিকে টুনা স্যান্ডুইচ খেয়ে মাজহারের পেটের অবস্থাও কাহিল। তারপর শাওন ম্যাডাম একটু সাজুগুজু করবে। আমরা বরং হোটেলে চেক-ইন করে ফ্রেশ হয়ে তোমার বাসায় যাই। আমাদের আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না।
নাসিম ভাইয়ের স্ত্রী পুরো ডাইনিং টেবিল খাবার দিয়ে ভরে ফেলেছেন, প্লেট রাখার জায়গা নেই। তাদের ব্যাকইয়ার্ডে চাষ করা ঢেঁড়স, কালো বেগুন আর করলা ভাজি করা হয়েছে। কচুর লতি রান্না করা হয়েছে চিংড়ি মাছ দিয়ে। ভর্তা হয়েছে তিন ধরনের- শুঁটকি ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা আর সরিষার তেল দিয়ে আলু ভর্তা। বিরিয়ানি তিন রকমের— চিকেন, মাটন আর ফিশ বিরিয়ানি। তারপর আছে কাবাব, রোষ্ট আর ডাল।
এতো খাবার দেখে হুমায়ূন আহমেদ নাসিম ভাইয়ের স্ত্রীকে বললেন- মাই গুডনেস! এ তো দেখছি এলাহি ব্যাপার! এত খাবার কে খাবে! এসব আয়োজন করতে তো তোমাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। খাবার শেষে তো মিস্টি পান লাগবে, পানের ব্যাবস্থা কি আছে?
আমরা সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলাম, জার্নি করলে ক্ষুধা-তৃষ্ণা বেড়ে যায়। নাসিম ভাই ও তার স্ত্রীর আতিথেয়তায় আমরা সবাই মুগ্ধ। স্যার বললেন- এই বিদেশ-বিভুয়ে তোমরা আমাদের জন্যে এত ভালবাসা জড়ো করে রেখেছিলে এটা আমার ধারনাতে ছিল না। আমি তোমাদের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করছি- তোমার ছেলে মেয়েরা যেন দুধে ভাতে থাকে।
খাবার শেষ করতেই আমাদের মিষ্টি সুপারি আর চমন বাহার দিয়ে পান দেয়া হল। পান মাজহার ভাইয়ের কাছে বিষবৎ, কিন্তু এবার আমাদের দেখাদেখি ডাবল ডাবল চমন বাহার দিয়ে তিনি পান নিলেন, একটা না, পর পর দুইটা। নাসিম ভাইয়ের শাশুড়ি বাংলাদেশ থেকে সদ্য বেড়াতে এসেছেন। তিনি সঙ্গে করে দু’মাসের পান-সুপারি এবং পান সাজানোর অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে এসেছেন। পানের স্টক দেখে মনে হল, অনায়াসেই পানের একটা মিনি স্টল খোলা যায়।
রাতে হোটেলে ফিরে হুমায়ূন আহমেদ বললেন- মাজহার ক্যাসিনোতে যাবে নাকি?
ক্যাসিনোর কথা শুনে মাজহার ভাইয়ের চোখ-মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। শাওন ভাবী চোখ পাকিয়ে বললেন- নো, নেভার। কেউ ক্যাসিনোতে যাবে না।
হুমায়ূন আহমেদ বললেন- শোন কুসুম (কোন কিছুর জন্যে আবদার করার সময় তিনি শাওন ভাবীকে ‘কুসুম’ নামে ডাকেন) আটলান্টিক সিটি হল ক্যাসিনোর শহর, গরিবের লাস ভেগাস। ক্যাসিনো ছাড়া আর এ সিটিতে দেখার কিছু নেই। আটলান্টিক সিটিতে এলাম অথচ ক্যাসিনোতে যাব না- এটা কেমন কথা। এবার তো প্রথম না, আমরা আগেও এখানে এসেছি!
শাওন ভাবী বললেন- আগের ট্রিপ ছিল অন্যরকম। তখন তুমি সুস্থ ছিলে। এখন তুমি একটা ট্রিটমেন্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কত রকমের মানুষ এখানে, ইনফেকশনের ভয় আছে।
আমার কথা থাক, মাজহারের কথা চিন্তা কর! বেচারা তার ব্যবসাপাতি, বাচ্চাকাচ্চা ফেলে আমার কারণে আমেরিকায় পড়ে আছে। তার আর্থিক ক্ষতি সীমাহীন। তুমি তো জান মাজহারের ক্যাসিনো ভাগ্য খুব ভাল। গতবার সে তাজমহল ক্যাসিনোতে পর পর দু’বার জ্যাকপট পেয়েছে। ১৪ হাজার ডলার, প্রায় ১২ লাখ টাকা। মানুষের ভাগ্যের কথা বলা যায় না। এবার হয়তো দেখা গেল মাজহার আজকে ১২ লাখ ডলারের জ্যাকপট পেয়ে গেছে, টাকার অংকে ১০ কোটি। ভেবে দেখ রাতারাতি সে কোটিপতি।
হুমায়ূন আহমেদের কথা শুনে মাজহার ভাই পারলে এখনই ক্যাসিনোতে ঢুকে যান। কিন্তু শাওন ভাবী বললেন- অনেক রাত হয়েছে, এখন সবাই ঘুমাবে।
আমি, মাজহার আর হুমায়ুন আহমেদ ভোতা মুখ করে ঘুমাতে গেলাম। আমি কখনো ক্যাসিনোতে যাইনি। ক্ষীণ আশা ছিল মাজহার ভাইয়ের কাছ থেকে তালিম নেব কি করে জ্যাকপট পেতে হয়। আমার সে আশা পূরণ হল না।
আমি আর্লি রাইজার। সূর্যদেব আকাশে উঠে গেছেন আর আমি বেয়াদবের মতো বিছানায় পড়ে আছি এটা কখনো হবে না। হয়তো সূর্যদেবকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্যই আমার বডি ক্লকে এক ধরণের সেলফ অ্যালরাম প্রকৃতি ঠিক করে দিয়েছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে বের হলাম। চারিদিকে একেবারে সুনসান। রাতভর ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে এখন সবাই ঘুমে কাদা। বারোটার আগে কারো ঘুম ভাঙবে না। ৪ কিলোমিটার জুড়ে অ্যাটলান্টিকের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদসম সব হোটেল কাম ক্যাসিনো। আমাদের পাশের হোটেলটির নাম তাজমহল, খুবই দৃষ্টিনন্দন। মুঘল স্থাপত্যের একটা আবহ আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যতদূর চোখ যায় কেবল অসীম জলরাশি। সমুদ্র এখানে বেশ শান্ত। ছোট ছোট ঢেউয়ের সারি এসে আছড়ে পড়ছে তটে।
অ্যাটলান্টিক সিটির আয়তন ১১ স্কয়ার কিলোমিটারের কিছু বেশি এবং মাত্র ৪০ হাজার লোকের বসবাস। টুরিস্টনির্ভর অর্থনীতি। প্রতি বছর ৩৪ মিলিয়ন টুরিস্ট মানে জুয়ারি এ শহরে জুয়া খেলতে আসে। আমার ধারনা ৯০% টুরিস্ট ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বশ্রান্ত হয় এবং ফিরে যাবার সময় তওবা করে যায় এ সিটিতে আর কখনো পা বাড়াবে না। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার এখানে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল হয়।
প্রাতঃভ্রমণ শেষে লবিতে ফিরে দেখি নাসিম ভাই এবং তার স্ত্রী, হাতে এক গাদা নাস্তার প্যাকেট। হোটেলের নাস্তা হুমায়ূন আহমেদ আদৌ খেতে পারেন কি না সেটা ভেবে এ দম্পতি ভোরে উঠে নাস্তা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। মানুষের এ রকম ভালবাসা দেখলে অকারণেই চোখে জল আসে। আমি ওদেরকে আমার রুমে নিয়ে বসালাম। তারপর নাস্তা সাজিয়ে সাবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল।
মজা করে নাস্তা খেতে খেতে প্ল্যান করে হচ্ছে আজকের দিনটা কি করে কাটানো যায়। সিদ্ধান্ত হল, নাস্তা শেষে আমরা বোর্ডওয়াকে বেড়াব। তারপর দুপুরে বীচের পাশে কোন এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবো। আর বিকেলে হবে শপিং।
বাইরে লাঞ্চ করার কথা শুনে নাসিম ভাই এবং তার ওয়াইফ আঁতকে ওঠেন। আমাদেরকে দুপুরে এবং রাতে দু’বেলাই তাদের বাসায় খেতে হবে। আর কোন কথা চলবে না।
তর্কবিতর্ক শেষে হুমায়ূন আহমেদ বললেন- নাসিম পাগলামো করো না। আমি ছ’ বছর আমেরিকায় ছিলাম, বাসার বাইরে খেয়ে আমি অভ্যস্থ। তা ছাড়া তোমারা সব কাজ কর্ম ফেলে আমাদের কেবল রান্না করে খাওয়াবে, এটা কোন কাজের কথা না। আজ থেকে তোমরা আমার গেস্ট- দুপুরে এবং রাতে তোমরা আমাদের সাথে খাবে, এর অন্যথা হবে না। শেষপর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কথাই বহাল রইল।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম বোর্ডওয়াক হল এই অ্যাটলান্টিক সিটিতে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে প্রচুর টুরিস্ট হাঁটাহাঁটি করছে। আজকের ওয়েদার খুব ভাল, আকাশ ঘন নীল। সিগালগুলোর কোন ভয়-ডর নেই, খাবারের আশায় আমাদের পায়ে পায়ে ঘুরছে। সিগাল দেখে নিনিত বেশ আনন্দ পাচ্ছে। সারাক্ষণ সে বেশ চুপচাপ থাকে, কিন্তু এখন কিছুতেই তাকে আর স্টলারে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সিগালগুলো ধরার জন্য সে নামতে চায়। হুমায়ূন আহমেদ নিনিতকে স্টলার থেকে নামিয়ে দিতেই নিষাদ-নিনিত দু’ভাই পাখিদের নিয়ে কি হুটোপুটি! সে দৃশ্য দেখে তিনি দুই ছেলের দিকে ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
দু’দিন বেড়িয়ে আমরা অ্যাটলান্টিক সিটি থেকে নিউইয়র্কে ফিরছি। নাসিম ভাই আমদের বাসে তুলে দিতে এসেছেন। আমরা কেউ প্রথমে তাকে চিনতেই পারিনি। এ দু’দিন তিনি ছিলেন ক্যাজুয়েল পোশাকে। লংস্লিভ টি-শার্ট, জিন্স আর মাথায় বেসবল টুপিতে তাকে দেখাত টগবগে যুবক। কিন্তু আজ অফিসে জয়েন করছেন বলে স্যুট-টাই পরে একবারে আমেরিকান সাহেব। মাথায় তার বিশাল টাক দেখে চেনার কোন উপায় নেই ইনি আমাদের নাসিম ভাই। মূলত টাক ঢাকতেই তিনি সর্বক্ষণ মাথায় টুপি পরতেন। এখন নাসিম সাহেবকে দেখাচ্ছে পৌঢ় এক ভদ্রলোক।
হুমায়ূন আহমেদ বললেন- নাসিম তোমার স্যুট-বুট আর মাথায় মস্ত টাক দেখে তোমাকে আর ‘তুমি’ করে বলতে সাহস হচ্ছে না। যুবক থেকে বৃদ্ধ হতে মানুষের সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ বছর। তুমি তো দেখছি রাতারাতি বৃদ্ধ বনে গেছ। যাবার বেলায় ভালই কারিশমা দেখালে আমাদের। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে, নয়তো এখানেই বিদায়। আস আমরা বৃদ্ধরা একটু কোলাকুলি করি।
আমরা বাসে উঠছি নাসিম সাহেবের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অপেক্ষমান যাত্রীরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হুহু করে কাঁদছে। বাস ছেড়ে দিল। আমরা অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলাম না…
Leave a Reply
Your identity will not be published.