প্রিয় আঙিনাতেই সমাহিত হাসান আজিজুল হক

প্রিয় আঙিনাতেই সমাহিত হাসান আজিজুল হক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হাসান আজিজুল হকের প্রিয় স্থান, সেখানকার কবরস্থানেই এখন ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তাঁর এই ঘুম আর কখনো ভাঙবে না।

হ্যাঁ, প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ হাসান আজিজুল হক না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ১৫ নভেম্বর রাত সাড়ে নয়টায়।

হাসান আজিজুল হকের জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ সালে। জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখ্শ। মা জোহরা খাতুন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন-এ এমএ।

কর্মজীবনে হাসান আজিজুল হক বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে একটানা অধ্যাপনা শেষে অবসর গ্রহণ করেন ২০০৪ সালে। এরপর থেকে রাজশাহী শহরের চৌদ্দপাইয়ের বিহাসের নিজ বাসভবনে বাস করে আসছিলেন তিনি।

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে আমরা বলতে পারি, সমাজ-বাস্তবতার রূপকার ছিলেন তিনি। তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলার বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস। যেমন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংঘাত, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, সামরিকতন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ ইত্যাদি। গল্প-উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতাকে রূপায়িত করতে গিয়ে যে ধরনের আখ্যান ও গল্পভাষার প্রয়োজন, হাসান আজিজুল হক সেটিকেই নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। অন্য কথায়, তাঁর গল্প-উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গ স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।

রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় মিসবাহুল আজীম সম্পাদিত ‘চার পাতা’য় হাসান আজিজুল হকের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য।

হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’। অন্য গল্পগ্রন্থগুলো হলো: আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।

প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’। এটির অংশবিশেষ একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ (২০০৬)। অন্য আরেকটি উপন্যাস হলোÑসাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩)। উপন্যাসিকা: বৃত্তায়ন, শিউলি।

প্রথম প্রবন্ধের বই ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ (১৯৮১)। অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থ: অপ্রকাশের ভার, অতলের আঁখি, চালচিত্রের খুঁটিনাটি।

প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী গ্রন্থ: একাত্তর, করতলে ছিন্নমাথা, টান। দিনপঞ্জি: লন্ডন ডায়েরি। অনূদিত নাটক: চন্দর কোথায় (জর্জ শেহাদের নাটকের রূপান্তর)। কিশোর উপন্যাস: লালঘোড়া আমি (১৯৮৪)। শিশুতোষ গ্রন্থ: ফুটবল থেকে সাবধান (১৯৯৮)। গবেষণামূলক গ্রন্থ: সক্রেটিস। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ: ফিরে ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, এই পুরাতন আখরগুলি।

সাহিত্যে তাৎপর্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে হাসান আজিজুল হক পেয়েছেন বহু পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলোÑআদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); লেখক শিবির পুরস্কার (১০৭৩); আলাওল পুরস্কার (১৯৭৩); অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪); ফিলিপ্স পুরস্কার (১৯৮৮), একুশে পদক (১৯৯৯), প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার (২০০৭), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৭)। ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি লাভ করেন।

২০১৬ সালে হাসান আজিজুল হক ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং পুরস্কারের জন্য গঠিত বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘প্রবীণ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আমাদের যা দিয়েছেন, তাতে আমরা তাঁর কাছে ঋণী। এ পুরস্কার তাঁকে প্রদান করে আমরা নিজেরাই সম্মানিত বোধ করছি।’   

Leave a Reply

Your identity will not be published.