উত্তমকুমারঃ চিরদিনের চিরকালের

উত্তমকুমারঃ চিরদিনের চিরকালের

বাংলা চলচ্চিত্রের দিগন্তে ধ্রুবতারার মতোই জ্বলজ্বল করছেন উত্তমকুমার। মৃত্যুর পরেও দর্শক-হৃদয়ে তাঁর স্থান আজও অটুট। অমলিন। দুই বাংলার চলচ্চিত্রে এযাবৎকালের সেরা অভিনেতা হয়তো তাঁকে বলা যাবে না, কিন্তু তিনি যে সর্বযুগের সেরা রোমান্টিক নায়ক- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অন্যদিন-এর নতুন ঈদ ম্যাগাজিন পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

উত্তমের জন্ম কলকাতায়, সেপ্টেম্বর ১৯২৬, আহেরিটোলা স্ট্রিটে, মামার বাড়িতে। পোশাকি নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। ২৪ জুলাই তাঁর ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ এই লেখাটি পত্রস্থ হলো।

বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে অনেক নায়কই পা রেখেছেন, রাখছেন। কিন্তু মহানায়ক একজনই— উত্তমকুমার। কিন্তু এলাম, দেখলাম, জয় করলাম- এই দলের নায়ক নন তিনি। ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ থেকে সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা তাঁর জীবন যেন এক রোমাঞ্চকর উপন্যাস, যার পাতায় পাতায় বৈচিত্র্যের ছোঁয়া।

উত্তম প্রথম অভিনয় করেন হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’-এ। নায়ক হিসেবে প্রথম ছবি ‘কামনা’। তারপর একর পর এক ছবিতে ফ্লপের ধাক্কা সামলানোর পরে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর ‘সহযাত্রী’-তে উত্তমকুমারের জন্ম হলো। অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান প্রথম ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। তবে সত্যিকার অর্থে উত্তমকুমারের জয়যাত্রা শুরু হয় ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির মাধ্যমে। আম-জনতার কাছে উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে প্রতিষ্ঠিতও করে এ ছবিটি।

এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, উত্তম হচ্ছে মহানায়ক। কেন তাঁকে এই অভিধায় চিহ্নিত করার চেষ্টা? কারণ তিনি সব ধরনের চরিত্রেই ছিলেন সমান পারদর্শী। সেটা ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ভূতনাথ হোক, বা ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’র এন্টনি হোক, ‘বিচারক’-এর অপরাধী মন বিচারক, ‘ধন্যি মেয়ে’র কৌতুক চরিত্র হোক, কলঙ্কিত নায়ক চরিত্র হোক ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এর, ‘নিশিপদ্ম’র সুর বিলাসী নায়ক হোক বা ‘স্ত্রী’র নারী বিলাসী সামন্ততন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু প্রতীক হোক।

উত্তমের বিপরীতে পঁয়তাল্লিশ জন নায়িকা অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের নায়িকা অলিভিয়াও রয়েছেন। কিন্তু উত্তমের বিপরীতে সুচিত্রাকেই দর্শক পছন্দ করেছেন বেশি। বলা যায়, প্রণয়ী যুগল হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা পঞ্চাশ ও ষাট দশকে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রে গায়ক-নায়কের এক সোনালি মেলবন্ধন গড়ে উঠেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উত্তমকুমারের মাঝে। হেমন্তের কণ্ঠে উত্তমের ঠোঁট মেলানোর যে খেলা তা অপূর্ব।

উত্তমের প্রধান পরিচয় অভিনেতা হলেও গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক, প্রযোজক এবং পরিচালক হিসেবেও দেখা গেছে তাঁকে।

উত্তম ছিলেন এক প্রেমিক পুরুষ। তাঁর জীবনে প্রথম প্রেম আসে ১৯৪৬ সালে। তখন তিনি পোর্ট কমিশনারস অফিসে চাকরি করেন। এই সময়ে এক ছুটির দিনে কাজিন অন্নপূর্ণার বান্ধবী গৌরীরাণী গাঙ্গুলীকে প্রথম দেখে প্রেমে পড়ে যান। তার উদ্দেশে একের পর এক গান গেয়ে ওঠেন। পরে এই প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়, যার উপসংহার বিয়েতে। দাম্পত্যজীবনের কয়েকটি বছর তারা কাটিয়ে দেন অদ্ভুত রোমান্সের জগতে। একমাত্র পুত্র গৌতমের জন্ম হয় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫১)। তারপর ঘটে ছন্দপতন। উত্তমের জীবনে আসে দ্বিতীয় নারী। সুপ্রিয়া দেবী। উত্তম সুপ্রিয়াকে বিয়ে করেন ১৯৬৩ সালে, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর উত্তমের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দীর্ঘ সতেরটি বছর তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন।

গৌরী ও সুপ্রিয়া দেবী ছাড়াও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট’ হয়েছিল। এই দুজনকে তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু উত্তমের ভাষায়, ‘সে ভালোবাসা অন্য জগতের, অন্য ধরনের। কামগন্ধ নাহি তায়।’ এ ছাড়া উত্তমের জীবনে আরও নারী এসেছে। কিন্তু সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

‘সমাধান’ ছবিতে হেমন্তের একটি গান ছিল, ‘তোমরা সবাই শোনো, এই আমার গান না/ ঝড়ে ভাঙা এ আমার বুকফাটা কান্না’। এ গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন উত্তম এবং মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, এই গানটির কথা ও সুরের মধ্যে ধ্বনিত হয়েছিল উত্তমের ব্যথা ও যন্ত্রণা। এই ম্যাটিনি আইডলের জনপ্রিয়তাই তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবনের শেষ পর্যায়ে ঘরে-বাইরে কোথাও উত্তমের শান্তি ছিল না।

উত্তম ছিলেন একজন জাত অভিনেতা। বহুধর্মী অভিনেতা। তাঁর অভিনয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্বাভাবিকতা। এছাড়া তাঁর কণ্ঠস্বর, এক-একটা সিয়োয়েন্সকে হোল্ড করে রাখার ক্ষমতা বা স্ক্রিন পার্সোনালিটি ছিল অসামান্য। কিন্তু বাংলা ছবির চলচ্চিত্রকাররা উত্তমের অভিনয় ক্ষমতাকে খুব কমই ব্যবহার করতে পেরেছেন। ন্যাকা ন্যাকা তথা ভেজা ভেজা আবেগ আর মন মাতানো গান সমৃদ্ধ বেশির ভাগ ছবিতেই উত্তমের অভিনয়ের প্রয়োগ ঘটেছে। পাশাপাশি আবার এটাও সত্যি, যতটুকু তাঁর দেবার ক্ষমতা ছিল ততটুকু সদ্ব্যবহারে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। অর্থাৎ উত্তম ডি-গ্ল্যামারাইজড হতে চান নি এবং সেই কারণেই তিনি তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’-এর প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হন নি।

উত্তম ছিলেন হৃদরোগী। ১৯৬৭ সালে তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপর মাঝখানে আরেকবার এবং সব শেষের অ্যাটাকে এই মহানায়কের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। সময়টি ছিল ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার, রাত সাড়ে নয়টা। কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে। পরদিন কেওড়াতলার শ্মশানে সাজানো চিতায় অগ্নিতে জ্বলে ভস্মিভূত হয় উত্তমের দেহ। তিনি পঞ্চভূতে বিলীন হন।

উত্তমের দেহ লীন হলেও দেহী লীন হয় নি। আজও তিনি বেঁচে আছেন অগণিত দর্শক-হৃদয়ে।  

Leave a Reply

Your identity will not be published.