ফকির আলমগীরঃ গণমানুষের শিল্পী

ফকির আলমগীরঃ গণমানুষের শিল্পী

ফকির আলমগীর এখন এই পৃথিবীর ঘাসের ওপর নেই। তিনি আকাশের মেঘের মাঝে বাসা বেঁধেছেন। গত ২৩ জুলাই রাত এগারোটায় অসীমের দিকে যাত্রা করেন এই শিল্পী।

ফকির আলমগীর ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং নব্বই দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন গানের মাধ্যমে। এদেশের মানুষকে এই গণসংগীত শিল্পী উজ্জীবিত করেছেন গান দিয়েই। এই ক্ষেত্রে তাঁর যে ভূমিকা ও অবদান তা অনন্য। এই প্রসঙ্গে স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক আলম খানের ভাষ্য হচ্ছে, ‘অসাধারণ একজন গণসংগীতশিল্পী হারালাম আমরা। একদম আলাদা ধরনের সংগীতের চর্চা করত। ওর আর দ্বিতীয় কেউ নেই। ফকির আলমগীর একজনই ছিল, সে নিজেই শুধু তার তুলনা।...গণসংগীতে তার বিকল্প তৈরি হয় নি। ফকিরের জায়গায় আমি আর কাউকে দেখি না। গানে নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেছিল ফকির আলমগীর। গানে গানে অন্যায়-অনিয়মের কথা বলতে কখনো পিছপা হতো না। যে-কোনো ইস্যুতে তাকে পাওয়া যেত, একদম সামনের সারিতে। সব সময় দেখেছি, পয়লা মে-তে শ্রমিকদের জন্য বড় আয়োজনে অনুষ্ঠান করতে। গানের মাধ্যমে শ্রমিকদের মাঝে মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরত। আর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে জাগানোর জন্য গণসংগীত করত।”

অন্যদিকে প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘ফকির আলমগীরের পরিচিতি গণসংগীতে হলেও বাংলা পপ গানের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর যে ক’জন মানুষের হাত ধরে পপ সংগীতের উত্থান, জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সেই তালিকায় রয়েছেন ফকির আলমগীর।’

হ্যাঁ, স্বাধীনতার পরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন যে কয়েকজন শিল্পী, তাদের অন্যতম ফকির আলমগীর। আর পপ গানেও তিনি স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার একটি নিজস্ব স্টাইল ছিল। বলা যায়, অন্য ধরনের পপ গান গাইতেন ফকির আলমগীর। উল্লেখ্য, ফকির আলমগীর ছাড়াও এদেশে পপ গানের উত্থানে অবদান রয়েছে আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই এবং পিলু মম­তাজের। এই পাঁচজন শিল্পী একসঙ্গে মঞ্চে পারফরম করেছিলেন জীবনে একবারই, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

ফকির আলমগীর সম্পর্কে তার বন্ধু স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের ভাষ্য হলো, ‘শিল্পী সত্তার বাইরে মানুষ হিসেবে ও খুব ভালো ছিল। যে-কোনো মানুষের বিপদ-আপদে ছুটে যেত।’

কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা বলেছেন, ‘যুদ্ধ করতে করতে নিজের একটা অটল পাহাড় সমান দুর্গম দুর্গ তৈরি করেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের মুখপাত্র।’

সামিনা চৌধুরী বলেছেন, ‘ফকির আলমগীর ছিলেন সংগীত জগতের এক মহীরুহ। একই সঙ্গে ছিলেন সাদাসিধে নিখাদ ভালো মানুষ।’

ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে। বাবা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেসা। ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

গত শতকের ষাট দশকে ফকির আলমগীরের শিল্পীজীবনের সূচনা। তিনি বাঁশিও বাজাতেন। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী এবং গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশন করে মানুষকে উজ্জীবিত করেন ফকির আলমগীর। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেলডাঙ্গার শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছেন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার জন্য পরিবেশিত গীতিনাট্যে বাজিয়েছেন বাঁশি।

ফকির আলমগীর একজন লেখকও ছিলেন। তার প্রথম গ্রন্থ ‘চেনা চায়না’ (১৯৮৪)। এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যারা আছেন হৃদয়পটে’, ‘স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থগুলোরও লেখক তিনি। মোট নয়টি গ্রন্থ লিখেছেন ফকির আলমগীর।

ফকির আলমগীর ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনটি নানা সময়ে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষত বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসে। আর পহেলা বৈশাখের সকালে শাহবাগের শিশু পার্কের সামনে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর পরিবেশনা তো ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও নানা দায়িত্ব পালন করেছেন ফকির আলমগীর। যেমন গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি, জনসংযোগ সমিতির সদস্যসহ নানা সংগঠনে  নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

সংগীতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফকির আলমগীর বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। যেমন একুশে পদক, ভাসানী পদক, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার, তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক, জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক, কান্তকবি পদক, গণনাট্য পুরস্কার, ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র, চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা, বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা, ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার ইত্যাদি।

ফকির আলমগীরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে: ঘর করলাম না রে আমি সংসার করলাম না, ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে, মায়ের একধার দুধের দাম, সান্তাহার জংশনে দেখা, কালো কালো মানুষের দেশে, নাম তার ছিল জন হেনরি, আহারে কালু মাদবর, হঠাৎ কোন পথে, তোমার সন্তান থাকে থাকে যেন দুধে-ভাতে, মন আমার দেহঘড়ি, বনমালী তুমি, সখিনার সংসার ভাইঙ্গা হইলো চুরমার...।

গানের ভেতর দিয়েই শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে শিল্পী ফকির আলমগীরের।       

Leave a Reply

Your identity will not be published.