আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেকদিন পরে আবার গল্প লেখায় অবতীর্ণ হলেন নাকি? সম্প্রতি তাঁর কয়েকটি গল্প পড়লাম। বিভিন্ন পত্রিকায়। কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনকেন্দ্রিক একটি গল্প; তরুণ একজন চিত্রকরকে নিয়ে একটি গল্প; আর প্রেমের গল্প বেশ কয়েকটি।
যতদূর জানি, তাঁর বয়েস ৭২-এ পৌঁছেছে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সত্যের মতো বদমাশ আমি স্টেডিয়ামের একটি বইয়ের দোকান থেকে তিনগুণ দাম দিয়ে কিনেছিলাম। দোকানের নাম ছিল ‘আইডিয়াজ’। দাম বেশি দিতে হয়েছিল, কেননা বইটি তখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। সেলসম্যান শেলফের লুকোনো জায়গা থেকে বইটি বের করে দিয়েছিল। মনে হয়, অশ্লীলতার দায়ে বাজেয়াপ্ত বইটি এভাবে বিক্রি হয়েছিল কিছু কপি। প্রথম সংস্করণের লাল-কালো প্রচ্ছদের দুর্লভ সেই বইটি আজো সংগ্রহে আছে আমার।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বইটি বেরিয়েছিল। তখনকার পত্রপত্রিকায়ও তাঁর গল্প পড়েছি। নাগরিক নামে সেকালে একটি পত্রিকা ছিল। ঢাকা শহর তখন সদ্য নাগরিকতাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে, পত্রিকার নামের মধ্য দিয়ে হয়তো ওই ঘোষণা। যাই হোক, ওই নাগরিক পত্রিকায় ‘অভিভূত চাষা’ নামে তাঁর একটি গল্প পড়েছিলাম। সাম্প্রতিক নামে আরেকটি পত্রিকায় পড়েছিলাম মান্নান সৈয়দের আশ্চর্য একটি গল্প। সুররিয়ালিস্ট বলব কি? ‘আত্মতাড়িতেরা’ তিনটি স্তনের একটি নারীর অমানুষী গল্প। তখন তাঁর গল্পে ভাষাবুনোটের পরীক্ষা-সমীক্ষা ছিল ঢের। সেসব পরীক্ষা সমালোচনার নিকষে বিচারিত হয় নি। তাঁর গল্প ছিল নতুন। মনে হয়েছিল, কোথায় একটি চমকের প্রবণতা ছিল। লেখকের বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিষয়ের যেমন, তেমনি ভাষার বা আঙ্গিকের বিদ্যুচ্চমক কমে আসে। কিছুকাল আগে তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প বইটি পড়েছিলাম। এই গ্রন্থে দেখা গেল, তাঁর গল্পে আরো কিছু স্বর যোজিত হয়েছে বা স্বরান্তর ঘটে গেছে। তবে আমার প্রিয় দু’একটি গল্প ওই গ্রন্থে অলভ্য থেকে গেছে। তার পরেও যে-কটি গল্প পড়া গেল, তার সঙ্গে এটুকু যোগ করতে পারি, মান্নান সৈয়দের সেকালীন গল্প পাঠের অভিজ্ঞতার নির্যাসে, তাঁর আদি গল্পের নায়কেরা হতো আত্মহত্যাপ্রবণ বা বেশ্যাগামী কিংবা উভয়তই।
অতীতে মান্নান সৈয়দের দু’ একটি প্রেমের গল্প পড়েছি।
কিন্তু তাঁর এখনকার প্রেমকেন্দ্রী গল্পগুচ্ছ ভিন্নধর্মী বলে আমার কাছে প্রতিভাত হচ্ছে।
সংলাপপ্রধান একটি গল্প পড়লাম। নারী-পুরুষের নামের কোনো উল্লেখ নেই এখানে। এই নিরুল্লেখ কি গল্পের নিহিত সামান্যীকরণের জন্যে? এর মধ্যে আমাদের সমাজ কি পরিবর্তিত হয়েছে, তারই একটি চিত্রণ? বছর তিরিশ আগেও এরকম গল্প অবাস্তব মনে হতো। এখন আর হয় না। ভেতরে ভেতরে বিরাটভাবে সামাজিক রূপান্তর ঘটে গেছে। সেই রূপান্তরের প্রভাব কি পড়েছে মান্নান সৈয়দের সাম্প্রতিক গল্পে? তাঁরই নিজস্ব রূপকল্পে? আবার তাঁর গল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঈষদ্দূরে সরে সরে যাচ্ছে নাকি? এত ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করতে দেখি নি আগে তাঁকে। অনেক সময় একটি শব্দই একটি বাক্য। সংযমনের দৃষ্টান্ত?
হ্যাঁ, গল্প তো আসলে সংক্ষেপীকরণের এক তুঙ্গস্পর্শী শিল্পমাধ্যম। সে কারণে ছোটগল্পে বিন্দুতে সিন্দুর স্বাদ পাওয়া যায়। ছোটগল্পের রাজা প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর সম্পাদিত একটি গল্পসংকলনের নাম রেখেছিলেন সিন্ধুর স্বাদ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্প ছোটগল্পের আত্মিক অর্থকেও যেন ধারণ করেছে।
তবে সমাজচেতনা মান্নান সৈয়দের গল্পে কখনোই খুব পরিস্ফুট নয়। ব্যক্তিরই প্রাধান্য যেন। যে-সমাজের অধিবাসী তিনি, তার ছাপ আজো তাঁর গল্পে দেখা যায় না কেন- এই প্রশ্ন সমালোচক মাত্রেরই মনে উত্থিত হতে পারে।
‘শুয়োরের বাচ্চা! বুড়ো ভাম হয়েছ, কিন্তু তোমার অভ্যাস গেল না আজো। এখনো মেয়েমানুষের গন্ধ পেলে তোমার নোলা সপসপ করে। হারামজাদা!’ রাগে থরথর করে কাঁপছে মিনু। আবুল কাসেম নাশতা খেতে বসেছে সকালে। সকাল ন'টায় অফিস। আটটায় গোসল। সাড়ে আটটায় নাশতা। ন-টা সাড়ে-ন-টার মধ্যে অফিসে চলে যায় আবুল কাসেম।
এক বছরও হয় নি আবুল কাসেম সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে। তারপরেই হঠাৎ এই চাকরির অফার। দাড়ি ঠিকমতো কাটা হতো না, খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। যেদিন বাইরে কাজে বেরোয়, সেদিনই দাড়ি-টাড়ি কাটত। যে আবুল কাসেম ফিটফাট থাকত সবসময়, সে এই অফার পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। মিনু তো অসম্ভব খুশি। রোজ ঘ্যানঘ্যান করে, ‘রাজি হয়ে যাও। রাজি হয়ে যাও।’ কী দেখে তাকে এ রকম অফার করা হলো, কে জানে! ইংরেজির অধ্যাপক ছিল, ইংরেজিচর্চাটাও রেখেছিল, বাংলা গল্প লেখে, তিন-চারটি গল্পের বই বেরিয়েছে, এখনো মাঝে মাঝে গল্প লেখে পত্রপত্রিকায়, গল্প বিষয়েও লেখালেখি করে, ডি. এইচ. লরেন্সের ছোটগল্প নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখেছে বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায়। এ ছাড়া পত্র-পত্রিকায় কিছু কিছু গল্পবিষয়ক প্রবন্ধ বেরিয়েছে। রিভিয়্যু লেখে না। কেউ কেউ গল্পের বই দ্যায় তাকে সমালোচনার জন্যে। কিন্তু আবুল কাসেম নীতিগতভাবেই বাংলাদেশের গল্পকারদের নিয়ে কোনো আলোচনা করে না বা বইরিভিয়্যু লেখে না। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশের গল্প সে পড়ে না। পড়ে। কিন্তু লিখিত মন্তব্য করতে রাজি নয়। যাই হোক, আবুল কাসেম এখন ডাইরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। এক বছর চলে গেছে। এখন দ্বিতীয় বছর চলেছে। আবুল কাসেম আবার ফিটফাট। নতুন স্যুট,প্যান্ট, শার্ট বানিয়ে নিয়েছে। জুতো কিনেছে। সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমোত যে, সে এখন রাত দশটা-এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে ঘুম থেকে ওঠে সকালে ওঠে ছটা-সাতটার মধ্যে। নটা-সাড়ে ন-টার মধ্যে অফিসে যাওয়া আবুল কাসেমের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এভাবেই চলছিল। এখন এই চাকরির প্রস্তাব শুনে মিনুর খুশি দ্যাখে কে? মোটাই হয়ে গেছে বেশ খানিকটা।
কিন্তু আজ এ কী মূর্তি তার!
মুখের কাছে মুখ এনে একছুটে আবার ঘরে গিয়ে আবুল কাসেমের ডায়েরিটা নিয়ে এল মিনু। শোবার খাটের ওপর ব্রিফকেস। অফিসে যাবার প্রস্তুতি। ডায়েরিটা ভেতরেই ছিল ব্রিফকেসের।
আবুল কাসেমের মুখের সামনে ডায়েরিটা এনে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল ভেতরের কয়েকটা পৃষ্ঠা। আর আবুল কাসেমের মুখের সামনে হাত-মুখ নেড়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলল। খাবার টেবিলে, মেজেয় ছেঁড়া পৃষ্ঠার কুটি কুটি করা কাগজগুলো ছড়িয়ে পড়ল। আবুল কাসেমের প্রিয় সবজির ওপর টুকরো কাগজ পড়ল কয়েকটা।
চিৎকার করে বলছিল মিনু, ‘কে এই মাগি? পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা- বুলবুলি! বুলবুলি! বুলবুলি! আ-হা! বুলবুলি পাখি, তাই না? এতই যদি বুলবুলি পাখি নিয়ে থাকিস, আমাকে বিদায় করে দে না, শুয়োর!’ বলে টেবিলের ওপর এক ঘুসি মারল মিনু। টেবিলের ওপর পানির জগ, পানির গেলাস, খালি গেলাস, নাশতার প্লেট, চায়ের কাপ, বাটি কয়েকটি- সব চমকে উঠল।
আবুল কাসেম বলতে যাচ্ছিল, বিশ্বাস করো, মিনু...
তোকে আর একরত্তিও বিশ্বাস করি না, হারামাজাদা- বলে মিনু খাবার টেবিলে যে চায়ের কাপে চা খাচ্ছিল বেশ তারিয়ে তারিয়ে, সেটা ছুড়ে ফেলল মেঝেয়। টুকরো টুকরো হয়ে গেল চায়ের কাপ। চা মেঝেময় ছড়িয়ে পড়ল।
সকালবেলা এ কী!
ডোর-বেল বেজে উঠল।
রান্নাঘর থেকে পারভিন উঁকি মারল।
মানে, দরজা খুলবে কিনা !
খো-ল্, মিনু ওর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। ‘টিফিন ক্যারিয়ারটা দিয়ে দে- গুষ্টির পিন্ডি খাক’- টিফিন ক্যারিয়ারটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে দরজা খুলতে গেল পারভিন। দরোজা খুলে দ্যাখে ড্রাইভার না, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ভেবে পেল না।
‘কে?’ বলে মিনু দরোজার দিকে এল।
দ্যাখে, রাবেয়া। আবুল কাসেমের দূরসম্পর্কের আত্মীয়া একটি। প্রত্যেক বছর ঈদের আগে আসে। গার্মেন্টসে কাজ করে। অন্য সময় খাইয়েদাইয়ে, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে, বকরি ঈদের রাত হলে গরুর গোশত ভালোরকম দিয়ে বিদায় করে। আজ কিন্তু সমানে হাত-মুখ নেড়ে রাবেয়াকে বলল, বেরোও! বেরোও! শ্বশুরবাড়ির গুষ্টির মুখ দেখতে চাই না আমি, বলতে বলতে দরোজা দড়াম করে বন্ধ করে দিল।
তারপর আবার ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আবুল কাসেমের ওপর, ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তবু বদমাশি গেল না। শুয়ারের বাচ্চা!- বলে মিনু যেন ছুটে চলে গেল সামনে থেকে।
স্তম্ভিতের মতো বসে থাকল আবুল কাসেম। চোখমুখ ঝাঁ ঝাঁ করছে। লাল। গরম।
একটু পরেই ডোর-বেল বেজে উঠল আবার।
মিনু রাবেয়া ফের এসেছে ভেবে রেগে ড্রয়িংরুমে এলো। পারভিন দরোজা খুলে দিয়েছে। না, রাবেয়া না। অফিসের ড্রাইভার হাসনাত। এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
কোনোরকমে রাগ কমিয়ে মিনু বলল- পারভিন, টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে দে।-বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ফের।
পারভিন গিয়ে হাসনাতের হাতে ছোট টিফিন ক্যারিয়ারটা দিল। ড্রাইভার নিঃশব্দে চলে গেলে পারভিন দরোজা বন্ধ করে দিল।
এই বাড়িতে বেশ কয়েক বছর আছে পারভিন। একেবারে ছেলেবেলা থেকে। এখন বড় হয়েছে। মাঝে মাঝে বাপ আসে তার। কয়েক মাসের টাকা একসঙ্গে নিয়ে যায়। ময়মনসিংহের শেরপুরে ওদের বাড়ি। রিটায়ার করার পরে আবুল কাসেম মাঝে মাঝে পারভিনের বাপ এলে গল্প করত। গ্রামের লোক হলে কী হবে, পারভিনের বাপ বেশ বুদ্ধি রাখে। বলে রেখেছে, পারভিনের বিয়ের ব্যবস্থা কাসেম সাহেবরাই করবেন। ওদের আহবান করে ওদের দেশে যেতে। বলে- দেশে গেলেন না, দেখলেন না দেশটাই, তবে কী করে চলবে? নিজের দেশটা তো দেখা চাই। গ্রামের ভাষায় চমৎকার করে বলে। ভাষা যা-ই হোক, আবুল কাসেম তার গভীরতা দেখে চমৎকৃত হয়। ইনস্টিটিউটে চাকরি করার পর পারভিনের বাপের সঙ্গে কথা বলার সময় পায় না আবুল কাসেম।
আবুল কাসেম কোনোক্রমে উঠল। শার্ট-প্যান্ট-কোট-টাই-জুতো পরে ব্রিফকেসে ডায়েরিটা ভরে আস্তে আস্তে দরোজা খুলে বেরোল।
মলিন অপমানিত গলায় বলল- পারভিন, দরোজাটা বন্ধ করে দে।
অন্যদিন মিনুই তাকে বিদায় দ্যায়। অফিস থেকে কোনোদিনই সন্ধের আগে ফিরতে পারে না আবুল কাসেম। কোনো কোনো দিন রাত্রি হয়ে যায়। দু-এক ঘণ্টা পর পর বাড়িতে ফোন করে। ল্যান্ডফোনে বা সেলফোনে।
পারভিন এ বাড়িতে আছে অনেকদিন হয়ে গেল। আগে কোনোদিন শোনে নি। এখন প্রায়ই একটি নাম শুনছে- ‘বুলবুলি’। আর সব সময়ই শুনছে মিনুর রাগে ফেটে-পড়া গলায় কিংবা কান্নার মধ্যে। কে এই মেয়েটি?
কথাসাহিত্যিক বশীর আলহেলাল বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের একটি গল্পসংগ্রহের ভূমিকায় নিঃসক্তভাবেই ছোটগল্পে আবদুল মান্নান সৈয়দকে ‘শূন্যবাদী’, ‘শূন্যসন্ধানী’ এ রকম অভিধা দিয়েছিলেন। এই অভিধা পরবর্তী গল্পধারায় হয়তো পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। তবে তাঁর সাম্প্রতিক গল্পগুচ্ছে তা থেকে তিনি একটু দূরবর্তী অবস্থানেই চলে আসছেন বলে মনে হয়। তাঁর নিকষ অন্ধকারে কোথাও এককণা আলো জ্বলে উঠেছে এখন। তবে মান্নান সৈয়দের গল্প সম্পর্কে সমগ্রভাবে সম্ভবত বশীর আলহেলালের মন্তব্যকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
হাসনাত, এখানে রাখো গাড়ি। তোমার দুপুরের খাবার খেয়ে নেবে। চা-টা খাবে। রাখো এই টাকাটা।
হাসনাত কোনো কথা বলে না। নীরবে ঘাড় কাত করে। টাকাটা হাত পেতে নিয়ে কোথায় লুকিয়ে দ্যাখে।
ড্রাইভারটাকে বুঝতে পারে না আবুল কাসেম। অফিসের মাইক্রোবাসটা চালায় যে, সেলিম, সেটা ধাড়ি। আগের ডাইরেক্টারদের বদনাম করে। আবুল কাসেম নিশ্চিত সে যখন অফিস ছেড়ে যাবে, তখন তারও গিবত গাইবে লোকটা। কিন্তু হাসনাত গভীর জলের মাছ...।
অফিসে একদিন খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।
মিনুকে ফোন করল। মিনু বলল উদ্বিগ্ন গলায়, সকালে তো প্রেশারের ওষুধটা ঠিকই খেয়েছ। আমি নিজে দিয়েছি। পরিষ্কার মনে আছে। একটুও দেরি কোরো না তুমি। অফিসের কাউকে নিয়ে সোজা চলে যাও সরওয়ার্দিতে। আমি একটু পরে তোমাকে মোবাইলে খবর নিচ্ছি। কোনো অসুবিধে হলে জানাবে আমাকে। আমি কি চলে আসব?
না। দরকার নেই। আমি রশিদকে নিয়ে যাচ্ছি। ওর ফোনে খবর নিও।
রশিদ ধরে আবুল কাসেমকে নিয়ে গেল।
সরওয়ার্দি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেল। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল গাড়ির পাশে হাসনাত। মিনু তাকে কতদিন খেতে দিয়েছে। আবুল কাসেম মাঝে মাঝে তাকে একটু-আধটু টাকাপয়সাও দ্যায়। সেদিন অবাক হয়ে দেখল, হাসনাত চুপ করে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। কোনো সাহায্য-সহযোগিতা নেই। নড়াও নেই। নির্বিকার।
একদিন আবুল কাসেম জিজ্ঞেস করেছিল তেল-টেলের হিসেবপত্রে বেশি হেরফের করে কিনা। হাসনাত বলেছিল, না। স্যার। একটু-আধটু করি।
আবুল কাসেম বলেছিল, ঠিক আছে। একটু-আধটু করবে। কিন্তু সীমা ছাড়াবে না।
আবুল কাসেমকে রশিদই একদিন জানিয়েছিল, হাসনাতের আপন বড় ভাই ডেপুটি সেক্রেটারি।
হাসনাতকে যখন জিজ্ঞেস করে, হাসনাত ‘হুঁ’ বলে জবাব দ্যায় শুধু। মন্ত্রণালয়েই একদিন ডেপুটি সেক্রেটারি খায়রাত সাহেবের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হয়ে গিয়েছিল এক মিটিং-এ। চেহারার মিলও আছে দুই ভাইয়ের।
আবুল কাসেম আলাপ হওয়ার পরে একটু ইতস্তত করে জানিয়েছিল, আচ্ছা, হাসনাত, আমাদের অফিসের ড্রাইভারÑ ও কি আপনার ছোট ভাই?
চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল খায়রাত সাহেবের। বললেন, ‘স্যার, ওর কথা বলবেন না। আমরা তিন ভাই। বংশের কুলাঙ্গার ও। আমাদের পৈতৃক বাড়িটা একা দখল করে নিয়েছে। আমি সরকারি ফ্ল্যাটে থাকি, আজিমপুর কলোনিতে। আমাদের মেজো যে সে আছে জার্মানিতে। ভাইবোনদের সব ঠকিয়ে একা বাড়িটা দখল করে নিয়েছে। বিশ্বাস করবেন? তারপর জাল দলিল করে আমাদের বাড়িটা বিক্রি পর্যন্ত করে দিয়েছে।
সেদিন থেকে হাসনাতকে আর বিশ্বাস করে না আবুল কাসেম। মিনুকেও বলেছে। মিনু বলেছে- দেখে তো মনে হয় না এত বড় শয়তান- যাক গে, সাবধান থেকো তুমিÑ
তারপর থেকে হাসনাতের সঙ্গে বাক্যালাপে আচরণে একটু সতর্ক হয়ে গেছে আবুল কাসেম। এর চেয়ে তো সেলিমই ভালো।
... তবু উপায় কী! আবুল কাসেমের তো আলাদা গাড়ি নেই। বুলবুলিকে নিয়ে এই-যে ঢাকার অদূরে একটা জাহাজমার্কা হোটেলে এসেছে, এখন গাড়ি ছাড়া হাসনাতকে ছাড়া আসবে কী করে!
বুলবুলি আর আবুল কাসেম কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দুপুরে একসঙ্গে খায়।
অফিসে দিনের অর্ধেক সময় যায় মন্ত্রণালয়ের মিটিং-এ। লাঞ্চের আগে প্রায় রোজই ঢুকতে হয় অফিসে। আবুল কাসেম, রশিদ, কম্পিউটারে আখতার, ওর ব্যক্তিগত পিয়ন জামান আর নিচে দারোয়ানরা থাকে কেউ কেউ। পাঁচটা-ছটা-সাতটা-আটটা বেজে যায়। সেলফোনে ফ্রি হলেই মিনুকে ফোন। মিনুও কোনোদিন দুটো-তিনটের আগে ফোন করে না।
আজ একটু চেষ্টা করে আবুল কাসেম তার স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখে।
বুলবুলির চোখে-মুখে খুশি জ্বলজ্বল করছে।
জানো, কতদিন পরে এরকম বেরোলাম। কত ভালো যে লাগছে!
কফির পেয়ালায় চুমুক দ্যায় আবুল কাসেম।
কী করে কথাগুলো বলবে ভেবে পায় না।
মুখ ম্লান বলে- বুলবুলি, কী করে বলি তোমাকে? দ্যাখো, আমি কী বোকা! কোন আবেগের বশে ডায়েরিতে তোমার নাম লিখেছিলাম। একটা পৃষ্ঠায় বারবার। তার আগে থেকেই বুঝেছি, ও একটা কিছু আঁচ করে। একদিন রাত্রিবেলায় বোধহয় স্বপ্নের ঘোরে তোমার নাম বলে ফেলেছিলাম। সকালবেলা উঠে দেখি গম্ভীর। নাশতা-টাশতা খাবার পরে বলল- বুলবুলি মেয়েটি কে? আমি বলেছিলাম, মানে? হেসে বলেছিল, তুমি কাল রাতে ঘুমের ঘোরে নামটা বলছিলে। আমি বলেছিলাম হেসে, আরে, ও কিছু না। একটা গল্পের জন্যে খুব ধরেছে আমাকে। আমার গল্পের একটি চরিত্র। লেখা আরম্ভ করেছি। চরিত্রটা ঘুরছে মাথায়- মিনু হেসে বলেছিল- দেখো বাবা, গল্পের নায়িকা আবার জীবন-নায়িকা না হয়ে যায়। তারপর থেকে লক্ষ করেছি, তুমি ফোন করলে মোবাইলে বা ল্যান্ডফোনে কোনো-না-কোনো ছুতোয় ঘরে এসে দাঁড়ায়। তারপর তো-
বুলবুলি রাগ করল না। হাসল। ম্লান হেসে বলল- তুমি কি আমাকে কচিখুকি মনে করো? আমি কি কিছু বুঝি না? আমিও কি একজনের ঘর-সংসার করি না? সেও কি কিছু আঁচ করে না? উঠে দাঁড়াল আবুল কাসেম। বলে, ধুৎ, আমরা এ্যাদ্দুরে একদিনের জন্যে বেড়াতে এলাম। কোথায় হাসি-গল্প করব। তা না মাটি করতে বসেছি সব। চলো, চলো ঘুরি আমরা। স্টিমারটা দেখি। নদী দেখি। এদিকের মানুষজন।
বুলবুলি বলল- হ্যাঁ, তা-ই চলো।
ফিরতে ফিরতে সেদিন রাত্রি হয়ে গেল ওদের।
আবুল কাসেমের তখন মনে হচ্ছে জীবনটা যেন ভরে উঠেছে। বুলবুলির সঙ্গে মেলামেশার আগে সে যেন বুঝতেই পারে নি, তার জীবনে এতখানি শূন্যতা ছিল। যেন একটা জীবনে সে শুধু চাকরি করে গেছে, সংসার করে গেছে, মৈথুন-ঘুম-নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে জেগে উঠেছে যেন আবুল কাসেম। অথচ কিছু না, কোনো শারীরিকতা না, হঠাৎ হয়তো একটু আঙুলে আঙুল ছোঁয়া, তাই নিয়েই মনে মনে ফাল্গুন রচিত হয়ে যায়। হৃদয়! হৃদয়! হৃদয় এত মহার্ঘ! মনিরত্নের চেয়ে দামি!
বুলবুলিকে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেল।
দরোজা খুলে দিয়ে দাঁড়াল হাসনাত। অফিসে গাড়ির গ্যারেজ আছে। অফিসের গাড়ি সেখানেই থাকে। অফিসে গাড়ি রেখে হাসনাত তার বাড়িতে চলে যায়। একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে সে। সপরিবারে।
অন্যদিন গাড়ি থেকে নামলে, ব্রিফকেস-ফাইল-টাইল বাড়িতে দিয়ে যায় হাসনাত। আজ যেন কিছু বলবে মনে হলো।
ওর ভঙ্গি দেখে আবুল কাসেম বলল, কিছু বলবে?
হাসনাত কাঁচুমাচু করে বলে, একটু টাকা দরকার ছিল, স্যার। শ’-পাঁচেক হলেই চলবে।
নাও। একটু অবাক হয়ে হাসনাতকে প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটি নোট বের করে দ্যায় আবুল কাসেম। সালাম দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় হাসনাত অফিসের দিকে। ওর ভক্তি দেখে আবুল কাসেম সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবে- একেই কী বলে ব্ল্যাকমেল?
মিনুই দরোজা খুলে দ্যায়।
বলে, টায়ার্ড মনে হচ্ছে খুব।
মিনুর গলায় কি একটু বিদ্রুপের সুর?
পরদিন বুলবুলির ফোন বেজে উঠল। বকবক করে যাচ্ছিল আবুল কাসেম। বুলবুলি একবার যেন বলল, তুমি খুব নিষ্ঠুর! আবুল কাসেম তখন কথাটি বোঝে নি, কে যেন এল ঘরে, বলল, তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি। সেদিনই আবার কথা হয়েছে, কিন্তু পরে আর কেন বুলবুলি ও-কথা বলেছে, তা আর জিজ্ঞেস করা হয় নি।
মান্নান সৈয়দের গল্প সম্পর্কে লেখকের একটি সাক্ষাৎকারের অংশ এখানে উদ্ধৃত করতে চাই। এই উক্তি তাঁর গল্পের ভেতরে আলোকসম্পাতও করে।
সাংবাদিক এক তীক্ষ্ণ তরুণী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, গল্পকার মান্নান সৈয়দ আর স্বামী বা মানুষ মান্নান সৈয়দকে তিনি নিজে কীভাবে বিচার করবেন?
লেখক বলেছিলেন, গল্পকার তো জীবনকে পারিবারিকভাবে দ্যাখেন না। তাঁর দৃষ্টি ব্যক্তিগত। তবে পরিবারও তো সমাজেরই অংশ। ব্যক্তিও যেমন। নারীর স্বাধীনতা স্বীকার করি। এমন তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ গল্পকারকে জানি, যার স্ত্রী নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়েন। এমনকি গল্পকার স্বামীর অসুখে পীরসাহেবের পানি পড়াও নিয়ে আসেন, স্বামী সে-পানি খানও বটে, কিন্তু তাঁর গল্পে এসব দেখা যায় না। আমার ধারণা, স্বামী বা মানুষ হিসেবে আমি খারাপ নই।
সহাস্যা তরুণী সাংবাদিক বলেন, স্যার, এই যে আপনি একথা কবুল করলেন, এই সত্যভাষণের জন্যে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেমের ঘুম ভেঙে যায়।
ঘুম আসছে না আর। বাথরুমে যায়। ফিরে, ঘরে আলো জ্বেলে দ্যায়। দেয়ালঘড়িতে দ্যাখে, রাত্রি দুটো। এগারোটায় না শুলো? সারাদিন এত দৌড়ঝাঁপ গেছে! সকালে জাতীয় জাদুঘরে একটা মিটিং ছিল। সেখান থেকে মন্ত্রণালয়ে। অফিসে ফিরেই বুলবুলির ফোন। রাখতে-না-রাখতেই মিনুর ফোন। কী করে যেন টের পেয়ে যায়! বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল ফুরিয়ে আসে। তারপরও ঘুম ভেঙে গেল কেন?
পাশে একটা বহুতল বাড়ি উঠছে। ট্রাকে ইট এসেছে। ইট নামাচ্ছে। তার শব্দ। স্তব্ধ রাত্রিতে বেশ জোরে শব্দ হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটার ক্ষীণ শব্দ। সেকেন্ডে সেকেন্ডে এগিয়ে যাচ্ছে নাকি? জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর দিকে।
রাতে আজকাল স্বপ্ন দ্যাখে না আবুল কাসেম। দ্যাখে, ভোরের দিকে। কাঁচাঘুমে। ঘুমের ওষুধের ফল? তাই স্বপ্নহীন রাত্রি? বুলবুলিহীন রাত্রি? ইট নামানোর জোরালো শব্দ। আর একটি ট্রাক এল নাকি? যেন বাতাসের একটা তোড় এলো। এলো আর চলে গেলো। হায়, নগরীর রাত্রিও নিস্তব্ধ হতে জানে না।
শুয়ে আছে। কদিন আগে নিউমার্কেটে আনোয়ার মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মিনু। আনোয়ার মালিককে চেনাই যায় না। কী দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল! রাজশাহীতে একসঙ্গে চাকরি করেছে। আনোয়ার মালিক না ডাকলে হয়তো চিনতেই পারত না। মিনুকে আনোয়ার মালিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল- রাজশাহীতে আমরা একসঙ্গে চাকরি করেছি। মেয়েরা ওর জন্যে পাগল ছিল, একটি মেয়ে চিঠি দিয়েছিল, জানত এটুকুই। এখন কোদাল দিয়ে সুরকি নামাচ্ছে। তার শব্দ। কলের পানি মৃদু শব্দে কিছুক্ষণ পরপর পড়ছে। ট্রাকের চলে যাবার শব্দ। এখন বালতির পানিতে কলের পানি টপটপ করে মাঝে মাঝে পড়ছে। এতক্ষণ এই শব্দটা শোনা যায় নি। একটা শব্দ আরেকটা শব্দকে ঢেকে দ্যায়। একটা জোরালো শব্দ আরেকটা ক্ষীণ শব্দকে। ভালোবাসাও কি এমনি? বুলবুলি, তুমি ভালো থেকো। আমি অনেকদূর চলে এসেছি। ঘুম আসছে না। দেখতে দেখতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। ঘর অন্ধকার করে দিল। সকালেই না অফিসে যেতে হবে? রাত্রির পাশ ফেরার শব্দ। একটা কুকুর ডেকে উঠল। বৃষ্টির মতো শব্দ হচ্ছে। কাছে আসতে বোঝা গেল, ট্রাক। ট্রাকের শব্দও রাত্রিবেলা বৃষ্টির শব্দের মতো হয়ে যায় নাকি?
মন্ত্রণালয় থেকে ফোন এল।
সিনিয়র অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি নাসরিন ফোন করেছে- স্যার, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে একটা পিকনিক হবে। কুমিল্লার ময়নামতিতে। আগামী শুক্রবার। সব প্রতিষ্ঠান-প্রধানরা থাকবেন। আর তাঁদের মিসেসরা। আর আমরা থাকব মন্ত্রণালয় থেকে।
আবুল কাসেম বললেন. ও আচ্ছা। ভালো। কিন্তু আমার স্ত্রী তো ঠিক কোথাও যেতে চায় না।
নাসরিন হাসল, মনা, না, স্যার। ভাবিকে নিয়ে যেতে হবে। ম্যাডামের ইচ্ছা, স্যার।
ম্যাডাম মানে স্বয়ং মন্ত্রীমহোদয়া।
নাসরিন বলল, আগামী শুক্রবার সকাল ছটায়। পাবলিক লাইব্রেরি থেকে দুটো বাস ছাড়বে। আপনি, স্যার, ইচ্ছা করলে আপনার গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।
হাসলেন আবুল কাসেম আমার গাড়ির যে লজঝড়্ অবস্থা, ওটা নেওয়া যাবে না।
ঠিক আছে, স্যার, তাহলে শুক্রবার ভোর ছটার সময় পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বাস ছাড়বে। ভাবিকে কিন্তু নিয়ে আসবেন, স্যার। অবশ্যই।
আচ্ছা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো আবুল কাসেম।
মিনুও আসলে কোথাও যেতে চায় না।
কিন্তু এবার দেখা গেল, মিনু এক কথায় রাজি। ইনস্টিটিউটে যোগ দেওয়ার পর থেকে মিনুকে সময়ই দিতে পারে না আবুল কাসেম।
যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে এল হাসনাত।
অনেকদিন পর ভোরবেলা বেরোল ওরা একসঙ্গে। আবুল কাসেম আর মিনু। শীতকাল। মিনু শাল পরে নিয়েছে। চমৎকার লাগছে ওকে। খুশিতে ঝলমল করছে। আবুল কাসেম ভ্রমণের জন্যে একটু আলাদা ড্রেস পরেছে। টাই না পরে কোটের নিচে গলাবন্ধ চমৎকার একটা সোয়েটার। ডিসেম্বরের ঘন কুয়াশার মধ্যে ওরা নামল পাবলিক লাইব্রেরির উঁচু সিঁড়ির সামনে। কুয়াশা ছিঁড়ে রোদ উঠছে। মিনু আর আবুল কাসেম ঘুরছে-ফিরছে। দু' একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে মিনুকে। মিনু আর আবুল কাসেমকে রোদে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলল কয়েকটা কোনো এক মিনিস্ট্রির ক্যামেরাম্যান। ওদের অফিসের ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নেয় নি আবুল কাসেম। জয়েন্ট সেক্রেটারি এলেন একা। সেক্রেটারি এলেন সস্ত্রীক নিজের গাড়িতে। মন্ত্রীমহোদয়া আসতে আসতে সাতটা বেজে গেল। একটা ছোটোখাটো গাড়ির বহরই রওনা দিল কুমিল্লার উদ্দেশে।
মিনুর মুখে খুশির আভা জ্বলজ্বল করছে। ও বসেছে জানালার পাশে। ওর পাশে আবুল কাসেম।
ময়নামতিতে দেখা গেল রীতিমতো ভিড়।
ঘুরে-ফিরে দেখা হলো।
প্রাচীনের ধ্বংসাবশেষ।
মিউজিয়াম।
দুপুরে মাঠের মধ্যেই একটা টেবিল পেতে আহার।
আহারের পরে সিগারেট খেতে গেল আবুল কাসেম। যা ভিড়! দূরে। একাকী।
তারপর এসে মিনুকে আর খুঁজে পায় না।
কী অমানুষিক ভিড়!
একবার এদিক যায়। একবার ওদিক। ভিড়ের মধ্যে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। ছোটো জাদুঘরেও ঘুরে এল একবার। কে কার খোঁজ রাখে!
শেষে মন্ত্রীমহোদয়ার বিশ্রাম-কক্ষেই ঢুকে পড়ল। দ্যাখে, মিনু কথা বলছে মন্ত্রীমহোদয়ার সঙ্গে। সেখানে উপস্থিত সচিব সাহেব আর তাঁর স্ত্রী।
আবুল কাসেম মন্ত্রীমহোদয়াকে সালাম দিয়ে মিনুকে বলল, কী ব্যাপার! তুমি এখানে! আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
হেসে মন্ত্রীমহোদয়া বললেন, উনি তো এখানেই আছেন, মন্ত্রীমহোদয়া সর্বদা হাসিমুখ।
একটু কথাবার্তা বলে মিনুকে নিয়ে বেরিয়ে এল আবুল কাসেম।
ওরা দুজন একটু নির্জন জায়গায় গিয়ে বসল।
পরে মিনু বলেছে একজন এসে ‘মিসেস কাসেম কোথায়? মিসেস কাসেম কোথায়?’ বলে ওকে ডেকে নিয়ে গেছেন।
আরো অনেকদিন পরে আবুল কাসেমের একদিন বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে হলো, বুলবুলি যে মাঝে মাঝে তার অফিসে আসে, গাড়িতে নিয়ে বেরিয়েছে ওকে মাঝে মাঝে, ফোনে কথা হয় প্রায় রোজ- তা কি মন্ত্রীমহোদয়া আঁচ করেছেন? তাই কি মিনুকে একটু দেখতে চেয়েছেন? মিনু এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। দেখে তিনি আশ্বস্ত হয়েছেন কি?
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সাম্প্রতিক একটি রচনায় জানিয়েছেন, ষাটের দশকে আবদুল মান্নান সৈয়দকে তাঁরা ভাবতেন আধুনিকতম গল্পকার।
কিন্তু একথা কি একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বলা যাবে? এর জন্যে দায়িত্ব বহন করতে হবে মান্নান সৈয়দকেই। ছোটগল্পে তাঁর যে-অভিনিবেশ আকাঙিক্ষত ছিল, তা তাঁর কাছ থেকে পাই নি আমরা। তবে একথাও সত্য, তিনি কখনো গল্পের কলম একেবারে ধুয়েমুছে ফ্যালেন নি। মুশকিল হলো, তাঁর ধারাবাহিক গল্প পরিক্রমণ সম্ভব নয়। সম্ভবত কতগুলো গল্প লিখেছেন তিনি, তা তাঁরও অজ্ঞাত। উপরন্তু তিনি যেমন নামি পত্র-পত্রিকায় লেখেন, জনপ্রিয় পত্রিকায় লেখেন, তেমনি লেখেন লিটল ম্যাগাজিনেও। যে-কটি গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে তাঁর, তাও প্রায় দুষ্প্রাপ্য। আবার এটাও ঠিক, সমালোচকের যে-দূরপ্রেক্ষণ প্রয়োজন, মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে তা করা যাচ্ছে না। কেননা, পত্র-পত্রিকায় আজো মাঝে মাঝে তাঁর গল্প দেখা যায়।
হাসান আজিজুল হক এই উচ্চারণ করেছেন তিন-চার দশক পরে। আসলে সমালোচককে অপেক্ষা করতে হয়।
সেদিন শোবার সময় মিনু চুল বাঁধছিল স্টিলের আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল আবুল কাসেম।
মিনু চুল বেঁধে খাটের পাশে গা ঘেঁসে বসল। বলল, এই, শোনো- আবুল কাসেম ওর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরল ওর দিকে।
মিনু পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আবুল কাসেমের দিকে। বলল, তুমি যেন কী রকম হয়ে যাচ্ছ-
আবুল কাসেম কিছু বলল না।
শুধু অনুভব করল কথাটা সত্যি। কোনো দুর্ব্যবহার না, কিছু না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে যেন মিনুর ভুবন থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে- তা মুহূর্তে তার কাছে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। দুজন একসঙ্গে ঘর করছে কত বছর হয়ে গেল। এতকাল একসঙ্গে ঘর করার জন্যেই বোধহয় মুহূর্তে এই সত্য অনুভব করল। দুপুরবেলা যেমন খুব আস্তে বিকেলের মধ্যে প্রবেশ করে, রোদ নরম হয়ে আসে, দুপুর বিকেলের ভেতরে মিশে যায়, ঠিক সেরকম একটা অনুভব। রৌদ্রময় মাঠের ভেতরে উঁচু উঁচু গাছের ছায়ারা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ এ রকম যেন। কীরকম একটা বেদনা খুব গভীরে স্পর্শ করল আবুল কাসেমকে। কোনো জবাব দিল না। বইটা তার সামনে খোলা থাকল। অক্ষরের দিকে চেয়ে থাকল। কিন্তু পড়ছিল না আবুল কাসেম। কেবল কতগুলো কালো অক্ষর, বোবা অক্ষর তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
তরুণ গল্পকার ও গল্পসমালোচক আহমাদ মোস্তফা কামাল আবদুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ গল্প-এর ভূমিকায় যেভাবে তাঁর গল্প বিশ্লেষণ করেছেন, তা উৎকৃষ্ট নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সবসময় সহমত পোষণ করতে পারছি না আমি। আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পে, অন্তত সব-মিলিয়ে, একটি কোনো জীবনবেদ প্রকাশিত। যতদূর মনে হয়েছে আমার- একটু-আধটু আশাবাণী সত্ত্বেও তাঁর জীবনবেদ নাস্তির নেমির ভিতরে ঘুরপাক খেয়েছে। তার মধ্যেও একটি কোনো শব্দহীন সত্যবান জড়্ রয়ে যায় কোথাও। তার হাত থেকে নিস্তার নেই কারো। তা-ই তাঁর সীমাবদ্ধতা। একই সঙ্গে তা-ই তাঁর চারিত্র। তাঁর বিশেষতা।
রাত্রি একটা।
আবুল কাসেম খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে একটা বোর্ডের ওপর গল্প লিখছে।
মিনু ওকে জড়িয়ে ধরে অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে।
গল্প লিখছে আবুল কাসেম।
আর থেকে থেকে জেগে জেগে উঠছে বুলবুলির মুখ।
নিজের কথার তোড়ে সেদিন জিজ্ঞেস করা হয় নি, বুলবুলি কেন বলেছিল, ‘তুমি খুব নিষ্ঠুর!’ পরে জিজ্ঞেস করায় বুলবুলি হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, ‘ধুর! কী ভেবে বলেছিলাম সে-সব ছাই মনে নেই।’ আবুল কাসেম কিছুতেই ভুলতে পারছে না কথাটা, ‘তুমি খুব নিষ্ঠুর!’ কেন বলেছিল বুলবুলি? বুলবুলি যে রকম চাপা, যে রকম গভীর, যে রকম ভেতরে-ডোবা, তাতে হঠাৎ বলে ফেলা এই কথাটার মানে ওর ঠিকই মনে আছে। নিজের কথার তোড়ে এমনই মশগুল ছিল আবুল কাসেম, যে, আর জিজ্ঞেস করা হয় নি। আর কখনো এ কথার ব্যাখ্যা করবে না বুলবুলি।
রাত জেগে আবুল কাসেম গল্প লিখে যাচ্ছে। আগামীকাল শুক্রবার। অফিস নেই। বেলা করে উঠলে অসুবিধে নেই।
রাত চারটে বেজে গেল।
মিনুর হাত জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। ‘তুমি কেমন হয়ে যাচ্ছ !’, ‘তুমি খুব নিষ্ঠুর!’ দুটি বাক্য ঘুরে ঘুরে মনে পড়ছে।
আবুল কাসেমের গল্পটি লেখা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
গল্পটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আবুল কাসেম তা জানে না।
যুগপূর্তি সংখ্যা, জানুয়ারি ২০০৮
Leave a Reply
Your identity will not be published.