আহসান হাবীব: মৃত্তিকা সংলগ্ন  আধুনিক কবি

আহসান হাবীব: মৃত্তিকা সংলগ্ন  আধুনিক কবি

মৃত্তিকা সংলগ্ন আধুনিক কবি আহসান হাবীব। বাংলা সাহিত্যে তাঁর একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। তাঁর কবিতায় শ্রেণি বৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা, উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা পরিস্ফুট। ‘শেকড়ের সন্ধানে’র আজকের পর্বে তুলে ধরা হলো আহসান হাবীবের জীবন ও জন্মভূমিকে। 

ধানসিঁড়ি, জীবনানন্দের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি দেখে এখন আমরা যাচ্ছি বাসস্ট্যান্ডে। ইতিমধ্যে আধঘণ্টা অপচয় হয়েছে। রিকশাওয়ালা আমাদের গন্তব্যস্থলের কথা ভালোভাবে না শুনেই যাত্রা শুরু করেছিল এবং আমাদের নিয়ে গিয়েছিল লঞ্চঘাটে। সেখান থেকে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। বলাই বাহুল্য, রিকশাওয়ালাকে বকেছি আমরা, সে তাই দ্রুত প্যাডেল চালাচ্ছে এখন।

এক সময় পৌঁছি বাসস্ট্যান্ডে। রিকশা থেকে নামি। কাউন্টারে টিকেট কিনতে গিয়ে শুনি, কিছুক্ষণ আগে বাস পিরোজপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। আধঘণ্টা পর আর একটা বাস যাত্রা শুরু করবে। অগত্যা পরবর্তী বাসের টিকেটই কেনা হয়।

অপেক্ষার সামান্য সময়ও দুঃসহ মনে হয়। বাসস্ট্যান্ডের চারদিকে ঘুরি, পত্রিকার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখি, অলস চোখে ইতিউতি তাকাই, কান পেতে শুনি যাত্রীদের কথা। অধিকাংশই স্থানীয়। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা শুনতে ভালোই লাগে।

কালস্রোতে ভেসে যায় পঁচিশ মিনিট। আমরা বাসে উঠে বসি। পাঁচ মিনিট কেটে যায়। কিন্তু বাস ছাড়ে না। কেননা পুরো বাসটি যাত্রী বোঝাই হয় নি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সবগুলো সিটই ভরে যায়। অনেকে দাঁড়িয়েও থাকে। ইঞ্জিন এবার গর্জন করে ওঠে। বাসটি এগিয়ে চলে সামনে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজপথে উঠে পিরোজপুরের উদ্দেশে গাড়িটি নিয়ে যেতে থাকে চালক। তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর পার হয়েছে।

বাসটি সরাসরি পিরোজপুর যাবে না। তাই মাঝে মাঝে থামে। যাত্রীরা ওঠা-নামা করে। আবার এগিয়ে যায়। এমনিভাবে প্রায় ছটার সময় আমরা পিরোজপুর পৌঁছি। তখন সূর্যের ম্লান আলো চারপাশে। সূর্যাস্তের আগমনী সঙ্কেত।

বিশ্বজিৎ দ্রুত একটি রিকশায় ওঠে, তার সঙ্গে আমি। রিকশা এগিয়ে চলে শঙ্করপাশা গ্রামের দিকে। বিশ্বজিৎ তাড়া দেয় রিকশাওয়ালাকে। রিকশাওয়ালা দ্রুত চালাতে থাকে বাহনটি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শঙ্করপাশা গ্রামে পৌঁছি আমরা। নজর কাড়ে বাম দিকের পথের ধারের একটি স্মৃতিফলক। লেখা আছে ‘আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি/ ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে/ এখানেই থাকি, আর/ এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা/ সারা দেশে’- কবি আহসান হাবীব।

হ্যাঁ, আমরা কবি আহসান হাবীবের বাড়ির সন্ধানেই এবারে যাত্রা করেছি। ১৯১৭ সালে তিনি জন্মেছিলেন এখানে, পিরোজপুরের শঙ্করপাশায়। লক্ষ করি, ফলকটি উন্মোচন করেছেন আবুল কাশেম মাহমুদ, পিরোজপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী, তারিখ ২০০৩ সালের ২ জানুয়ারি।

আরেকটু সামনে এগোই। তারপর ডানদিকের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি। দশ মিনিট পরে পৌঁছি কবি আহসান হাবীবের পৈতৃক ভিটায়।

প্রচুর গাছপালার মাঝে তিনবিঘা জমির ওপর বাড়িটি। বেড়ার কয়েকটি ঘর। উঠোন।

কবি আহসান হাবীবের ছোটভাই মোঃ গোলাম কবির (হিরু) আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট এবং তিনিই বেঁচে আছেন। আহসান হাবীব বড়ভাই। অন্য ভাইরা হলেন ফজলুর রহমান, মোস্তফা জামাল, গোলাম মোস্তফা এবং মোঃ গোলাম কবির হিরু।

ফজলুর রহমান গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। তার ওষুধের ব্যবসা ছিল। মোস্তফা কামাল তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। ঢাকার নথব্রুক হল রোডে ‘কথামালা লাইব্রেরী’ নামে একটি বইয়ের দোকান ছিল তার।

গোলাম মোস্তফার ছয় মেয়ে তিন ছেলে। এর মধ্যে এক মেয়ে বর্তমানে এই বাড়িতে বসবাস করছে। মোঃ গোলাম কবিরের (হিরু) দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলের ফটোকপির দোকান রয়েছে ঢাকার নীলক্ষেতে। ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। আর মেয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজে সম্মানের (বাংলা) ছাত্রী। জানা যায়, মেজ ও সেজ ভাইয়ের সঙ্গে কবি আহসান হাবীবের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। একসময় সেজভাই মোস্তফা কামাল কবির সঙ্গে থাকতেনও।

আহসান হাবীব পিরোজপুর থেকে প্রবেশিকা পাস করে কিছুদিন বিএম কলেজে পড়েন, আইএ-তে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার জন্যে পড়াশুনা অব্যাহত রাখতে পারেন নি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার এখানেই ইতি ঘটে তার। অতঃপর তিনি কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিকতা করতে থাকেন এবং আমরা জানি যে, আজীবন এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।

আহসান হাবীব কলকাতায় তকবীর (১৯৩৭), বুলবুল (১৯৩৭-৩৮) এবং সওগাত (১৯৩৯-৪৩) পত্রিকায় কাজ করেন। কয়েক বছর (১৯৪৩-৪৮) তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে আহসান হাবীব বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস-এর প্রোডাকশন অ্যাডভাইজার ছিলেন। তার তিনি দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং পরে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

আহসান হাবীবের ভেতরে কবে কবি-সত্তা জেগে উঠল? কীভাবে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হলো? এই যে দাঁড়িয়ে আছি, আহসান হাবীবের স্পর্শধন্য মাটিতে, তাঁর পৈতৃক ভিটাতে, এই তো কবি আহসান হাবীবের উৎসভূমি। মনে পড়ে আহসান হাবীবের কথা, “শৈশবে কিছু পুথিপত্র এবং তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক সাহিত্য; যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি আমাদের বাড়িতেই ছিল। এসব বই পড়তে পড়তে আমি সর্বপ্রথম নিজে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করি। বয়স তখন ১২ কি ১৩। সম্ভবত প্রথম কবিতা লিখি ১৯২৮/২৯ সালের দিকে।... শৈশব বা কৈশোরে কখন কীভাবে একজনের ভেতর যে এই প্রবণতা গড়ে উঠতে থাকে তা বোধহয় কোনো কবিই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। একদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলো কিছু লেখার চেষ্টা করি এবং সম্ভবত এভাবেই শুরু। যদিও সহায়ক কোনো না কোনো ব্যক্তি বা গ্রন্থ অথবা পরিবেশের প্রশ্নটিও একেবারে উপেক্ষা করা যায় না” (ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব, হোসেনউদ্দীন হোসেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃ. ৭৫)।

আহসান হাবীবের প্রথম লেখা কবিতা হলেও প্রথম প্রকাশিত হলো একটি প্রবন্ধ। ‘ধর্ম’ শিরোনামের এই লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়, স্কুল ম্যাগাজিনে। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’, ছাপা হয় পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র। পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় আহসান হাবীবের কবিতা প্রকাশিত হয়। আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো: ছায়া হরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭১), দু’হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা (১৯৮১), বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫) ইত্যাদি।

আহসান হাবীব দুটি উপন্যাসও লিখেছেন। উপন্যাস দুটি হলো অরণ্য নীলিমা (১৯৬০) এবং রাণী খালের সাঁকো (১৯৬৫)।

শিশু-কিশোরদের জন্যেও আহসান হাবীব লিখেছেন। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ হলো জ্যোৎস্না রাতের গল্প, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (১৯৭৭), ছুটির দিন দুপুরে (১৯৭৮)।

আহসান হাবীব সংগ্রামী এক মানুষ। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এবং জীবনকে ঘষে আগুন জ্বালিয়েছেন। তাই তাঁর কাব্যে আছে জীবনের সব উপাদান। একদিকে আছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে আছে সংঘাত-সংগ্রাম, জয়-পরাজয়।

আহসান হাবীব একজন ইতিহাস-সচেতন কবিও। তবে সেই ইতিহাস ঐতিহ্যের ইতিহাস। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে নবজীবন নির্মাণের পরিকল্পনাও আছে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ থেকেই আহসান হাবীব স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। গ্রন্থের ভূমিকায় যে বক্তব্য রয়েছে কবির তা খুবই সত্যি ‘বাংলা কবিতা যখন সমাজ সম্পৃক্ত এক নতুন সংজ্ঞায় নতুন দিগন্তে উত্তীর্ণ হচ্ছে... নতুন কাব্য পরীক্ষার সেই দুঃসাহসী সমাবেশে যোগ স্থাপনে ‘রাত্রিশেষে’ একেবারে অক্ষম হয় নি।’

‘রাত্রিশেষ’-এ ধরা পড়েছে যুগযন্ত্রণা, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণা। পাশাপাশি আছে স্বদেশের প্রতি গভীর অনুরাগ। আশাবাদী কবি দুর্যোগময় ইতিহাসের বুক থেকে ভয়াবহ অন্ধকারের ধ্বস নামতেও দেখেছেন: ‘রাতের পাহাড় থেকে/ খসে যাওয়া পাথরের মতো/ অন্ধকার ধ্বসে ধ্বসে পড়ছে।’ (‘রেড রোডে রাত্রিশেষ’- রাত্রিশেষ)

‘রাত্রিশেষ’-এ আছে হতাশার নৈরাশ্য আর অস্তিত্বের জন্য লড়াই। অন্যদিকে ‘ছায়া হরিণ’-এ আশা-আকাক্সক্ষার এক বিশ্বস্ত রূপ মূর্ত উঠেছে। সব দ্বিধা-সংশয় মুক্ত এক কবিকে এখানে দেখতে পাই আমরা। দেশপ্রেমিক এক কবিকে ভীষণভাবে লক্ষ করা যায়: ‘মায়ের বুকের মতো বুকে পেতে রাখা এই/ দেশকে আমি ভালোবাসি সে কথা সে সোনার দেশের/ আকাশে অরণ্যে আর সমুদ্রের ঢেউয়ে লেখা আছে’। (‘তোমাতে অমর আমি’- ছায়া হরিণ)।

‘নদী’র সঙ্গে কবি আহসান হাবীবের গভীর যোগ। তাঁর কবিতায় ‘সাম্পান’, ‘খেয়া পারাপার’, ‘নদীর ঘাট’ ইত্যাদি প্রতীক জীবন-জীবিকা সমার্থক। অন্য কথায়, মানব ইতিহাসের উত্থান-পতনের বিষয়টি বিজড়িত। দেখা যায়, নদীকে ঘিরে কবি আহসান হাবীবের স্বপ্ন বারবার পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। যেমন ‘আমি এই নদী আর নদীর কল্লোলে/ কান পেতে নির্ভয়’ (এই ঝড়ে অন্ধকারে- সারা দুপুর)। ‘নদীর কল্লোল আর সমুদ্রের ঢেউয়ের স্বপ্নের/ পরিচর্যা পাই নিত্য/ জীবনের এই ক্ষুদ্র ক্লান্ত নদী তীরে’ (শেষ সন্ধ্যা- প্রথম উষা)

আহসান হাবীব মানুষ ও মৃত্তিকা সংলগ্ন এক কবি। তাঁর কবিতায়ও এই দুটি বিষয় প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকের তিনটি কাব্যে অবশ্য মানুষের জীবন প্রবাহের জটিল ছবি দেখা যায়। অন্যদিকে ‘আশায় বসতি’ কাব্যে কবি মানুষের জীবনকে সহজভাবে দেখেছেন। আর আহসান হাবীব কবিতার মধ্যে যে মানুষদের তুলে ধরেছেন তার মধ্য থেকে এই সত্য ফুটে ওঠে যে, তিনি একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর শ্রেণী চেতনা কতখানি প্রখর তার প্রমাণ। পাওয়া যায় ‘আশায় বসতি’ কাব্যগ্রন্থের ‘যতবার এবং এবার’ কবিতায়: ‘নাইলের আমল থেকে/ হাটে হাটে হাটের দরজার খোঁজে ফেরে বুঝি/ অন্ধ বুঝি খোলা দরজা দেখে না, অথবা/ দুঃস্বপ্নে কাতর বুঝি, পৃথিবীর সর্বত্র দেয়াল/ পড়ে বুঝি চোখে তার, অথবা এমন হতে পারে/ দৈত্যাকার দুর্দান্ত প্রহরী জেগে আছে বুঝি/ যখনই দরজায় পথ বাড়ায় সে চায় প্রবেশপত্র। নেই/ ফিরে আসে। /যতবার পৃথিবীতে এসেছি দেখেছি এই দৃশ্য বারবার। / অথচ এবার/ কী আশ্চর্য, লোকটা চেনা, তার সেই বিভ্রান্ত/ দু’চোখ/ শান্ত, অর্থময় ঘোরে না দু’চোখে মিনতির/ ছায়া টেনে, তার/গলায় চিৎকার নেই, এক মনে বসে/ লোকটা শুধু এক মনে বসে বসে শাবল বানায়’। কিন্তু নিজের কবিতা সম্পর্কে কবি আহসান হাবীব কী বলেছেন? তার ভাষ্য হলো: ‘আজ যদি বলি, অহংকার করেই বলছি, পরাক্রান্ত ক্ষুধাকে আমি কবিতার ওপরে হুকুম চালাতে দিই নি। ফিরে যাই নি পিরোজপুর বা শঙ্করপাশায়, আপন বিবরে। তবে এই সময়ে ক্রমান্বয়ে বুঝতে পারি, ক্ষুধাই সে হননকারী শত্রু যে মানব জীবন থেকে কবিতা কামনা হরণ করে, তাকে কবিতাহীন নরকে অনবরত আছড়াতে থাকে। আরো বুঝতে পারি, অনির্বাণ ক্ষুধা মানুষই তৈরি করে মানুষের মধ্যে। এবং এই সময় থেকেই কবিতা আমার আক্রান্ত হতে থাকে ক্ষুধার হাতে, তার অর্থ কবিতা তার চরিত্র বদলাতে থাকে। ক্ষুধার সেই রাজ্যে কবিতা কিছু বলবার দায়িত্ব নিতে থাকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ তৈরি হতে থাকে এই পরিবেশে।

বণ্টন বৈষম্য, সামাজিক অসাম্য, পরাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহাযুদ্ধের দায় এই সবই সমগ্র ‘রাত্রিশেষে’র উপজীব্য। উত্তরতিরিশ কবিতার সমাজ সচেতন অধ্যায়ে নিজের সংলগ্নতা আমি এইভাবেই এই সময়ে আবিষ্কার করি।

তারপর ক্রমান্বয়ে ‘ছায়া হরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ এবং ‘প্রেমের কবিতা’। শ্রেণি বৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা এইসবই আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু। এক শ্রেণি মানুষের কৃত্রিম জীবন তৃষ্ণা তাদের নিচ জীবনাচরণের প্রতি ব্যঙ্গবাণ এইসব” (পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ বিদীর্ণ দর্পণে মুখ)।

এদেশের সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আহসান হাবীব পেয়েছেন ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), একুশের পদক (১৯৭৮), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০) এবং আবুল কালাম স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪)।

১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই মানুষ ও মৃত্তিকা সংলগ্ন কবি আহসান হাবীবের মৃত্যু হয়। এই শঙ্করপাশা গ্রামে, পিরোজপুরে তাঁর আগমন ঘটে নি জীবনের শেষ পর্যায়ে। কেন? পূর্বে উল্লেখিত বক্তব্যে তার কিছুটা আভাস পাই। অভিমানও কি লুকায়িত ছিল কবি’র মনে? যা’হোক শঙ্করপাশা তথা পিরোজপুরের মানুষেরা কিন্তু তাঁকে ভোলে নি। সেটি আমরা টের পাচ্ছি কবির স্বজন এবং এলাকার মানুষদের কথা ও কর্মকাণ্ডে। শুধু স্মৃতি ফলকই নয়, তাঁর ছবি ল্যামিনেটেড করে যত্ন সহকারে রাখা আছে তাঁর ছোটভাইয়ের কাছে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.