তিনি ছিলেন, তিনি নেই, অথচ তিনি আছেন। বলছি প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীর কথা। তিনি অবশ্য কিছু গানে সুরারোপও করেছিলেন।
'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...
এ দেশের সঙ্গীতভুবনে যে কজন শিল্পীর নাম সবার আগে উচ্চারণযোগ্য, সুবীর নন্দী তাদের অন্যতম। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে এ দেশের সুরপিয়াসী মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের বহু গান বাংলার ঘরে ঘরে, প্রতিটি জনপদে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। স্বকীয় গায়কি আর কথা ও সুরের অপূর্ব মেলবন্ধনে গাওয়া তাঁর বহু গান তৈরি করেছিল জনপ্রিয়তার আলাদা বলয়। রেডিও, টিভি এবং মঞ্চ— তিন মাধ্যমেই পদচারণা ছিল তাঁর। আধুনিক গানের শীর্ষে অধিষ্ঠানকারী এই গুণী শিল্পীর শুরুটা হয়েছিল নজরুলসঙ্গীতের মাধ্যমে। পাশাপাশি ভজন, কীর্তন এবং পল্লীগীতিতেও সমান পারঙ্গম ছিলেন।
গত ৭ মে ছিল গুণী এই কণ্ঠশিল্পীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা সেইসব গল্প শোনাচ্ছেন জোবায়দা লাবণী।
ছেলেবেলার দিনগুলি
হবিগঞ্জ জেলার একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ি চা-বাগানের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা পাহাড়ি রাস্তা। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এমনই এক সবুজ শ্যামল প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে এক সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত পরিবারে জন্মেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন সুবীর নন্দী। তাঁর পিতা ছিলেন তেলিয়াপাড়া চা এস্টেটের চিকিৎসক। নয় ভাইবোনের সঙ্গে সেখানেই তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল। ছেলেবেলায় চা-বাগানের অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গ তাঁকে আকর্ষণ করত ভীষণ। সারা দিন ঘুরেফিরে, অন্যের গাছের ফল পেড়ে উদ্দামতায় কাটিয়ে দিতেন সারাবেলা। বিশেষ করে বর্ষাকালটা ছিল তাঁর ভীষণ ভালোলাগার এক ঋতু। বর্ষায় পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা ঝরনার জলে সব বন্ধুরা মিলে হুটোপুটি করে কাটিয়ে দিতেন সারা দিন। প্রকৃতির এই সান্নিধ্য ভূমিকা রেখেছিল তাঁর মানস গঠনেও। তবে এত দুরন্তপনার মধ্যেও পড়ালেখায় ছিলেন ভীষণ মনোযোগী।
সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ততা
পারিবারিক গণ্ডিতেই তিনি পেয়েছিলেন সঙ্গীতচর্চার এক চমৎকার আবহ। তাঁর মা-ও চমৎকার গান করতেন। তবে সেটা পারিবারিক গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিদিন সান্ধ্য প্রার্থনায় গান গাওয়ার নিয়ম ছিল বাড়িতে। সেখানে মায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সব ভাইবোন গান গাইতেন। সবশেষে প্রতিদিনই গাইতেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথা নত করে দাও’ গানটি। সে সময়ের সব গানই যে খুব বুঝে শুনে গাইতেন তেমনটা নয় কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসাটা তৈরি হয় তখন থেকেই। এভাবে মায়ের কাছেই মূলত সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। পাশাপাশি তাঁর বাবাও ছিলেন ভীষণ সংগীত অনুরাগী। তাঁর সংগ্রহে বহু রেকর্ড ছিল। সে সুবাদেই সেই ছেলেবেলাতেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল কানন দেবী, আঙ্গুরবালা, কে এল সায়গলসহ সেই সময়ের সব বিখ্যাত শিল্পীদের গান শোনার। এর পাশাপাশি গানের তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ বাবর আলী খাঁ’র কাছে।
প্রথম রেকর্ডিং
১৯৬৭ সালের দিকে সেসময় রেডিও পাকিস্তান সাব ডিভিশনের সিলেটের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ড. আকবর আলী খাঁ। তিনি খুবই সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই সুবীর নন্দী জানতে পেরেছিলেন, সিলেট বেতারে শিল্পী নেওয়ার জন্য অডিশন নেওয়া হবে। তিনিও নাম জমা দিয়েছিলেন। সিলেকশনের তিনটি ধাপ অতিক্রম করে তিনি এবং তাঁর বড়ভাই সহ মোট তিনজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন সবেমাত্র তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৬৭ সালের ১৪ অক্টোবর নজরুলসঙ্গীত ‘বউ কথা কও’ রেকর্ডের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রেডিওতে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেসময় ঢাকা বেতারে নিয়মিত প্রচার হতো গান শেখানোর অনুষ্ঠান। গান শেখাতেন আবদুল আহাদ। ওই অনুষ্ঠানের সুবাদেই সুবীর নন্দীর আয়ত্ত হয়েছিল বহু নজরুলসঙ্গীত। সেই প্রথম প্রথম গান গেয়ে প্রথম সম্মানী পেয়েছিলেন ৪২২ টাকা। সবমিলিয়েই এটা তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় মুহুর্ত ছিল। আর এর আগেই ১৯৬৪ সালে জগদীশপুর হাইস্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন মঞ্চে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা।
জীবনের এক অন্য অধ্যায়
১৯৬৮ সালের দিকেই মূলত শুরু হয়ে যায় আমাদের মুক্তির আন্দোলনের নানা কর্মকা-। সেসময় সুবীর নন্দীর সৌভাগ্য হয়েছিল মাওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধুকে দেখার। যাই হোক, সে সময় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের আমন্ত্রণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীতও গাইতেন। এভাবেই বেতার ও মঞ্চে গান গাওয়া চলছিল তাঁর। এরই মধ্যে চলে এসেছিল সেই বিভীষিকাময় একাত্তর। অন্য অনেকের মতো সুবীর নন্দীরাও চলে গিয়েছিলেন ভারতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আবার দেশে ফিরে আসার। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দিনটিতে তাঁরাও রওনা দিয়েছিলেন দেশের পানে। কিন্তু পথিমধ্যেই ঘটে গিয়েছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। হঠাৎ করেই তাঁর বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলে যান তিনি না-ফেরার দেশে। পুরো পরিবারেই তখন নেমে এসেছিল এক বিরাট বিপর্যয়। একদিকে বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে শুরু হয়েছিল তার সত্যিকারের জীবনযুদ্ধ। এরই মধ্যে বেরিয়ে ছিল তাঁর ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট। খুব ভালো ফল করেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন ঢাকায় পড়ার ইচ্ছাটাকে। গ্রামেই ভর্তি হয়েছিলেন বি এ তে। পাশাপাশি করছিলেন চাকরির দরখাস্ত। একসময় পেয়েও গিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের পেশা ব্যাংকিং। তবে এতকিছুর পরও তাঁর সঙ্গীতসাধনায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। ব্যাংকে চাকরি শুরুর কিছুদিন পরে তাদের ওখানে একজন নতুন ম্যানেজার আসেন। তিনি তাঁর কাজের প্রতি নিবিষ্টতা আর গানের জন্য তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি সুবীর নন্দীকে ডেকে বলেছিলেন, আপনি তো অনেক ভালো গান করেন। কিন্তু সিলেট বেতারে গান গাইলে সিলেটের বাইরের কেউ তো আপনাকে চিনবে না। আপনি ঢাকায় চেষ্টা করছেন না কেন? সেসময় চাকরি ছেড়ে দেওয়া সুবীর নন্দীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর সেসময় বদলিটাও সহজতরো ছিল না মোটেও। বাস্তবতা তুলে ধরতেই ম্যানেজার বলেছিলেন, আমি যদি তোমার বদলির ব্যবস্থা করি তুমি যাবে ঢাকা? সুবীর নন্দী বলেছিলেন, অবশ্যই। এর অল্প কিছুদিন পরেই অনেক ঝামেলা সত্ত্বেও ম্যানেজার সুবীর নন্দীর ঢাকায় বদলির ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি স্থায়ীভাবে চলে এসেছিলেন ঢাকায়।
ঢাকায় শুরু হয়েছিল তাঁর অন্যরকম এক যুদ্ধ। এমন অনেকসময় গিয়েছে শুধু একটা বিস্কিট খেয়েই সকালটা পার করেছেন, একজনের খাবার দুজনে ভাগ করে খেয়েছেন। পয়সার অভাবে অনেকদিন অফিসে হেঁটেই যাতায়াত করেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাঁর সঙ্গীতচর্চা চলেছিল নিরবিচ্ছিন্নভাবেই।
যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়...
তিনি যখন সিলেট থাকতেন তখন থেকেই নিয়মিতই আসা-যাওয়া ছিল ঢাকা বেতারে। প্রায়ই সেখানে তাঁর এলাকার পরিচিত বড়ভাই মুজাক্কের আহমেদের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন যদি কোনোদিন সুযোগ মিলে যায় ঢাকা বেতারে গাওয়ার। এমনি করে বসে থাকতে থাকতেই সৌভাগ্যক্রমে তিনি নজরে পড়ে যান ওস্তাদ মীর কাসেমের। তিনি মুজাক্কের আহমেদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই যে ছেলেটাকে প্রায়ই দেখি এখানে এসে বসে থাকে। চাকরি-বাকরির দরকার নাকি? তিনি তখন বলেছিলেন, ও আমার এলাকার ছেলে। ওরা দুই ভাই খুব ভালো গান গায়।
এ কথা শুনে মীর কাসেম তাঁকে বলেছিলেন, আমি একটা গান করব। কোনো গান আছে? মুজাক্কের সাহেব তখন বলেছিলেন, আমার কাছে একটা গান আছে। তখন সুবীর নন্দীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমি যদি সুর করি তুমি সেটা তুলে গাইতে পারবে? তিনি তখন খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, পারব। এর আগেই তিনি মানবেন্দ্র, সতীনাথের গাওয়া সিরিয়াস টাইপের সব গান গেয়ে অভ্যস্ত। এসব গান তোলাটা তাঁর জন্য খুব কঠিন কিছুই ছিল না। সেই মুহূর্তে চলছিল আঞ্জুমান আরার রেকর্ডিং। ওস্তাদমীর কাসেম গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্পেশাল গ্রুপটা আছে নাকি? একটা রেকর্ডিং শেষ না হতেই আর একটা গানের রেকর্ডিং তাও আবার স্পেশাল গ্রুপের তলব। সবাই তো ধরেই নিয়েছিল নিশ্চয়ই কোনো বড় শিল্পীর রেকর্ডিং। কিন্তু তাঁকে দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। কিছুটা তাচ্ছিল্যেভরেই, কিছুটা করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে সবাই। কিন্তু রেকর্ডিং হওয়ার পর সবাই অবাক। এত অল্প সময়ের মধ্যেই গানটা তুলে ফেললেন তিনি! ঢাকা বেতারে সেই তাঁর প্রথম গাওয়া। গানটি ছিল- ‘যদি কেউ ধুপ জ্বেলে দেয়/অন্ধ মনের জীর্ণ কোঠায়।’ গানটির সঙ্গে নিজের জীবনের অনেক বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন যেন তিনি।
এরপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয় নি। তাঁর চলার পথ আরও মসৃণ হয়েছিল ট্রান্সমিশন সার্ভিসের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলামের নেয়া একটা উদ্যোগ। তিনি নতুন দেশে একঝাঁক নতুন শিল্পী তৈরির একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনেকটা অঘোষিত নিয়ম চালু করেছিলেন আঞ্চলিক রেডিওর ভালো ভালো শিল্পীদের সুযোগ দেওয়ার। ব্যবস্থা করেছিলেন পুরোনো-নতুন শিল্পীদের এক মেলবন্ধনের। এরই মাধ্যমে অনেকের সুযোগ ঘটেছিল নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর। এরই সুবাদে এদেশের সংগীতাঙ্গনে আবির্ভাব ঘটে এন্ড্রু কিশোর, প্রবাল চৌধুরী, নার্গিস পারভীন, ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পীদের। সে যাই হোক এই উদ্যোগের ফলে সুবীর নন্দী সঙ্গীতযাত্রার পথটা যেন অনেক বেশি মসৃণ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে সত্য সাহার সুরে ও মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথায় গাওয়া ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ গানটি দিয়ে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অন্য উচ্চতায়। এরপর একে একে গেয়েছিলেন- হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, দিন নয়সহ অজস্র কালজয়ী সব গান।
আধুনিক গানের এই কালজয়ী শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছিলেন অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানেও। প্লেব্যাকের শুরু ১৯৭৪ সালে রাজা হোসেন খান ও সুজেয় শ্যামের সঙ্গীত পরিচালনায় আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবির মাধ্যমে। এর পর থেকেই বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি আলমগীর কবির পরিচালিত ‘মহানায়ক’ ছবির সূত্রে। এরপর শুভদা, শ্রাবণ মেঘের দিন ও মেঘের পর মেঘ ছবিতে গান গাওয়ার জন্য একই সম্মাননা অর্জন করেছিলেন। সেইসঙ্গে একাধিকবার পেয়েছিলেন বাচসাস পুরস্কারও। আর বাংলাদেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রির জনক শাহীনের ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে ১৯৮১ সালে বের হয়েছিল তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’।
রিয়েলিটি শো’র রিয়েলিটি
গুণী এই শিল্পী গান গাওয়ার পাশাপাশি রিয়েলিটি শো’তেও বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি অন্যদিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “উদ্যোগটা অবশ্যই অনেক ভালো ছিল। কারণ প্ল্যাটফর্মটা পেতে আমাদেরকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে এটা নবীন শিল্পীদের করতে হচ্ছে না। এটা অবশ্যই খুবই ভালো একটা ব্যাপার। অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী উঠে এসেছে এই শোগুলোর মধ্য দিয়ে।” কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের টিকে না থাকা কিংবা আরও অনেক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কিছুটা ক্ষোভের সুরেই বলেছিলেন, “এভাবে আসলে শিল্পী তৈরি হয় না। আমাদের সময়ে আমরা যে কষ্টটা স্বীকার করেছি এখন মনে হচ্ছে সেই কষ্টটা আসলে সব শিল্পীরই থাকা উচিত। সহজে কিছু মিলে গেলে তার মূল্য সবাই দিতে পারে না। কষ্ট করলেই তারা অনুধাবন করতে পারবে সঙ্গীত কতখানি সাধনার বিষয়। কিন্তু যারা সহজে ওই অবস্থানটা পেয়ে যাচ্ছে তারা আসলে এই পাওয়ার মূল্যটা অনুধাবন করতে পারছে না।”
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে
ডিজিটাল যুগের সঙ্গে মেলবন্ধনস্বরূপ সুবীর নন্দী অনলাইনে কিংবা মোবাইলফোনে গান প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে অন্যদিনকে তিনি বলেছিলেন, “এখন আমি যাদের গানই করি না কেন তাদেরকেই বলি আমার গান শ্রোতাদের শোনানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতেই যখন পাইরেসি ঠেকানো যাচ্ছে না তারচেয়ে ভালো একবারেই উন্মুক্ত করে দেওয়া। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে গানগুলো শোনার ব্যবস্থা করলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। এর পাশাপাশি শ্রোতাদের ফিডব্যাকটাও সরাসরি পাচ্ছি। একটা অ্যালবামের প্রতিটা গান হিট হবে এমনটা তো নয়। কোন গানটা কতজন শ্রোতা শুনছে সেটা জানতে পারছি সহজেই। এর ফলে আমিও একটা ধারণা পাচ্ছি কোন ধরনের গান শ্রোতাদের টানছে। কোন ধরনের গান শ্রোতারা আমার কাছে প্রত্যাশা করে। আর আমার মনে হয়েছে এটাতে ইনকাম সোর্সটাও আরও ভালো হবে।”
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের উদ্দেশে
দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে সুবীর নন্দীর প্রাপ্তির পাল্লাটা ছিল অনেক বেশি। তবে যে জগতটাকে ঘিরে তাঁর সমস্ত স্বপ্ন আবর্তিত হয়েছিল সেই জগতটার দুরবস্থা মাঝে মাঝে তাঁকে অনেক বেশি পীড়া দিত। এ প্রসঙ্গে তিনি অন্যদিনকে জানিয়েছিলেন, “অনেকদিন ধরেই কোনো কালজয়ী গান আমরা তেমন পাচ্ছি না। এর জন্য দায়ী আমাদের এই অস্থির সময়। কেননা এটা তো সত্যি, যতখানি শ্রম তার কার্যকারিতাও ততটাই। আমাদের সময়ের কথা বলতে পারি। সেই সময়ে আমরা একটা রেডিওর রেকর্ডের জন্য অন্তত চারদিন রিহার্সেল করতাম। এখন এত সময় কই! আমাদের সময়ে অঘোষিত রিয়েলিটি শো ছিল সত্যিকার অর্থেই ভালো শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া । লোক দেখানো কিছু নয়। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল আরও ভালো করার। এখন আর সেটা দেখা যায় না।”
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শিল্পীদের মধ্যে একাই সব করতে চাওয়ার মানসিকতা। বিষয়টি সুবীর নন্দী ভালো চোখে দেখতেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি অন্যদিন-কে বলেছিলেন, “আমি কিছুদিন চেষ্টা করেছিলাম গান লেখার। কম্পোজিশনও করেছিলাম। কিন্তু এসব করতে গিয়ে মনে হলো আমি যেন আমার মূল জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এসব বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ এতটাই বেশি চিন্তা-ভাবনা করছি যে গাওয়ার প্রতি আর মনোযোগ দিতে পারছি না। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগের মধ্যেই একাই সব কাজ করার প্রবণতা বেশি। যে কারণে কোনোটাই তারা ঠিকমতো করতে পারছে না। তবে এতকিছুর পরেও আমি ভীষণ আশাবাদী, এই বৈরি সময় নিশ্চয়ই কেটে যাবে। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে আমি শুধু এটাই বলতে চাই, যে যে কাজটাই করুক না সেটাতেই বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। যারা গান গাইতে চায় তাদের অন্তত দশ বছর গাওয়ার মধ্যেই থাকা উচিত। মাঝে মাঝে দু-একটা গান লেখা বা সুর করাতে সমস্যা নেই কিন্তু সেটাই যেন মূল কাজ না হয়ে যায়।”
Leave a Reply
Your identity will not be published.