বন্ধু হে আমার

বন্ধু হে আমার

বন্ধু শব্দটির মানে কী? সম্পর্ক কতদূর গভীর হলে একজন মানুষকে বন্ধু হিসেবে অভিহিত করা যায়? বন্ধুত্ব কি আসলে এমনি এমনি হয়ে যায়? বন্ধু-বিষয়ক এরকম প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। প্রশ্নগুলো জটিল হলেও উত্তর কিন্তু খুবই সহজ। কারণ বন্ধুত্বের আবার বিশ্লেষণ কী? বন্ধু তো বন্ধুই। এটি এমন একটি সম্পর্ক যার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নাই, রক্তের সম্পর্ক নাই, নাই কোনো দান-প্রতিদানের ব্যাপার। জগতের বিশুদ্ধতম সম্পর্ক ‘বন্ধুত্ব’। ১ আগস্ট ছিল বিশ্ব বন্ধু দিবস। এই উপলক্ষে এখানে তুলে ধরা হলো একটি বিশেষ রচনা।

বন্ধুত্ব

বন্ধুত্ব হলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। আত্মার শক্তিশালী বন্ধন হলো বন্ধুত্ব। সমাজবিদ্যা, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং দর্শনে বন্ধুত্বের শিক্ষা দেওয়া হয়। সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব, ইকুইটি তত্ত্ব, রিলেশনাল দ্বন্দ্ববাদ এবং সংযুক্তি শৈলীসহ ইত্যাদিতে বন্ধুত্বের বিভিন্ন একাডেমিক তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ডেটাবেজ গবেষণায় দেখা গেছে যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে মানুষ সুখী হয়।

যদিও বন্ধুত্বের অনেক রূপ আছে। কিছু অবস্থান অনুসারে ভিন্ন হয়, কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনেক বন্ধনের মধ্যে উপস্থিত থাকে। স্নেহ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সততা, পরার্থপরতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সমবেদনা, একে অপরের সঙ্গ, আস্থা, নিজের যোগ্যতা, অনুভূতি প্রকাশ, ভয় ছাড়াই বন্ধুর কাছে ভুল করা—এই ধরনের বৈশিষ্ট্য বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত।

কী ধরনের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গঠন করতে পারেন তার কোনো ব্যবহারিক সীমা নেই। তার ব্যাকগ্রাউন্ড, জীবিকা, ভালো লাগা, অনুরূপ আরও কিছু আছে কি না তা শেয়ার করা।

‘বন্ধু’— এ শব্দের মাঝেই সব লুকায়িত। এতে কোনো বয়স বাধা নয়। সমবয়সের বন্ধুত্ব সবকিছু আবিষ্কার করার এক নব দিগন্ত। কিশোর বয়সের কোনো ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে যদি তার চেয়ে বড় কারও বন্ধুত্ব হয়, তবে তা জ্ঞানের পরিসীমা বাড়াতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তবে তার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি বিশেষ যতœ। অনেক বিষয় ছোট্ট বন্ধু বুঝতে বা মানতে দ্বিধা করবে। সে জন্য তাকে সব সমসাময়িক দিক থেকে বা বর্তমান সময় উপযোগী বিষয় দিয়ে বুঝানো দরকার। মনে যেন কোনো ভয় না থাকে সে বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। এ জন্য বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করা, ভালো-মন্দ সবকিছু খোলামেলা আলোচনা করা, যাতে আগামীর দিনগুলো সুন্দর ও সুখের হয়। আমাদের দেশে দেখা যায়, অনেক বিষয় খুব কাছের বন্ধুর সঙ্গেও শেয়ার করি না। নিজের মধ্যেই তা আবদ্ধ রাখি। সবচেয়ে নিকট সবচেয়ে আপন বন্ধুটিকে বলতেও কেন দ্বিধা করি? পিতা-মাতা সর্বপ্রথম সব থেকে আপন বা কাছের মানুষ। কিন্তু অনেক বিষয় আমরা তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। এটা যত ফ্রি দেশ হোক, সব দেশেই একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে অকপটে সব ভালো-মন্দ যত খারাপ হোক নির্দ্বিধায় বলা যায় আর সবকিছু সব সময় গোপন অতি গোপন রাখার নামই প্রকৃত বন্ধু।

বিশ্ব বন্ধু দিবস

আত্মার আত্মীয় বন্ধুকে ধন্যবাদান্তে একঝুড়ি ভালোবাসা জানাতে দীর্ঘদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব বন্ধু দিবস। আগস্টের প্রথম রবিবার, বন্ধু দিবস। প্রতিবছর প্রিয় বন্ধুর শুভ কামনায় পালিত হয় দিনটি। বন্ধু দিবসের সূচনা বহু আগে। ১৯৩৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস বন্ধুদের সম্মানে একটি দিন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে আগস্টের প্রথম রবিবারকে জাতীয় বন্ধু দিবস বলে ঘোষণা করে। দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন থেকে প্রতিবছর দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের দেশগুলোতে, বিশেষ করে প্যারাগুয়েতে ঘটা করে বন্ধু দিবস পালিত হতো। আস্তে আস্তে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্য দেশে দিনটি জনপ্রিয়তা পায়। দিনটি পালনের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে কারণ হিসেবে কিছু সূত্র পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, ভয়াবহতা, বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা মানুষের মধ্যে হতাশা ও একাকিত্ববোধ তৈরি করে। এ একাকিত্ব ও বন্ধুর অভাববোধ দূর করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধু দিবস নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবার কথিত রয়েছে, ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। বন্ধু বিয়োগের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মৃত ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। বন্ধুর জন্য বন্ধুর এ আত্মত্যাগের ঘটনা চারদিকে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সে বছর মার্কিন কংগ্রেস এ বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। ভিন্ন আরেকটি সূত্রে জানা যায়, বন্ধু দিবসের সূচনা হয় ১৯১৯ সালে। তখন আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কার্ড, ফুল, উপহার ও ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বিনিময় করত। এরপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যায়ে বন্ধু দিবসের দিন ও তারিখ পাল্টায়। ১৯৫৮ সালে বিশ্বে শান্তির উদ্দেশ্যে প্যারাগুয়েতে আন্তর্জাতিক নাগরিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেয়। একই সালের ২০ জুলাই ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডের প্রতিষ্ঠাতা ড. রেমন আর্তেমিও ব্রেঞ্চো বন্ধুদের সঙ্গে রাত্রিভোজনে পরিকল্পনা করেছিলেন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডের।

বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিও

অপু ও মামুন। দুজনই অনেক কাছের বন্ধু। মাঝে মাঝে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। কোনো সাফল্য বা ব্যর্থতা পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করতে না পারলে দুজনেরই মন খচখচ করে, মনে হয় কোনো একটি কাজ অপূর্ণ থেকে গেছে। আসলে বন্ধুত্ব কী? দুটি আলাদা মানুষ কিন্তু কোনো বিষয়ে সমচিন্তা, সমরুচি, সম্প্রীতি ইত্যাদি থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা। কোনো বিষয়ে একই রকম মতামত দুজন মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। এভাবেই বন্ধুত্বের পথচলা।

বন্ধুর সঙ্গে জীবন বদল করেও সুখী হতে পারেন নি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবিতার মধ্য দিয়ে যা অকপটে জানিয়েছেন বন্ধু নিখিলেশকেÑ‘নিখিলেশ আমি এই রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না।’ বন্ধুর কাছে এই অকপটে বলতে পারাই বন্ধুত্বের অন্যতম শর্ত। নিজের লজ্জা, অনুভূতি সবটুকু যার সঙ্গে শেয়ার করা যায় সেই না বন্ধু।

বিশ্বখ্যাত বই ‘ইউ ক্যান উইন’-এর লেখক শিব সেরা বন্ধুত্বের উদাহরণ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার গল্প তুলে ধরেন তার বইতে। যুদ্ধক্ষেত্রে দুই সৈনিক বন্ধু যুদ্ধ করছে। শত্রুপক্ষের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ। একপর্যায়ে প্রথম বন্ধু হঠাৎ শত্রুপক্ষের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংঘাতিকভাবে আহত। মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে এ অবস্থায় দেখে দ্বিতীয় বন্ধু আর স্থির থাকতে পারল না। সে সিদ্ধান্ত নিল, যেভাবেই হোক মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা সে করবে। চারদিকে তখন প্রচ- গোলা-বারুদের শব্দ। প্রথম বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়ে যেখানে পড়ে আছে, সে জায়গায় পৌঁছালে শত্রুর হাতে নিশ্চিত ধরা পড়ার সম্ভাবনা। তবু দ্বিতীয় বন্ধু জীবনের ঝুঁকি নিয়েই শেষবারের মতো তার মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর কাছে পৌঁছে যায়। তখনো দেহে প্রাণ ছিল, মৃতপ্রায় বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে দেখে শেষ কটি শব্দ উচ্চারণ করল, ‘আমি জানতাম, তুমি আসবে।’

এই ঘটনা অনেক বড় একটি দৃষ্টান্ত রেখাপাত করে যায় পাঠকের মনে। মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধু মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করেছে তার বন্ধু পাশে থাকবে। আর বন্ধুটিও শেষবারের মতো দায়িত্ব পালন করে যায়। এই গল্প থেকে এই বিষয় বুঝতে পারি, বিশ্বাস ও অঙ্গীকার বন্ধুত্বের ভিত্তি। এ শর্ত পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ কোনো বন্ধুকে যদি পাশে পাওয়া যায়, তাহলে জীবনের কঠিন পথ চলা সহজ হয়ে যায়।

এসো নীপবনে ছায়া বীথি তলে...

প্রচ- গরমে আপনি দগ্ধ, ঠিক সেই মুহূর্তে এক পশলা বৃষ্টি আপনাকে প্রশান্তি এনে দিল। আপনি অনুভব করলেন বৃষ্টির সিক্ততা—যা আপনাকে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাবে। বন্ধুত্বও তেমনি এক পশলা বৃষ্টির মতোই স্নিগ্ধ স্পর্শ, যা চলার পথে দেয় প্রেরণা। কখনো তা বৃক্ষের ছায়ার মতোও হয়ে থাকে।

দাম্পত্যজীবনেও এমন বন্ধুত্বের ভীষণ প্রয়োজন। যা বেঁচে থাকার শেকড়ে দেয় জল, দেয় মুক্ত আলো-বাতাস।

বিবাহিত জীবনে  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সব কিছু শেয়ার করার মতো স্বামী-স্ত্রী দুর্লভ। অথচ ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ স্বামী-স্ত্রীই হওয়ার কথা। কিন্ত দেখা যায়, হাজার বছর একসঙ্গে থেকেও কেউ যেন কারও হতে পারে না। এই আর্তি প্রায় সব স্বামী-স্ত্রীর। নাসরিন নঈমের কবিতায় তাই লক্ষ করি, ‘এই সব সংসার, সন্তান, পাড়া-প্রতিবেশী, ভালোবাসা বাসি থেকে যদি যাওয়া যেত  অন্য কোনো হৃদয়ের কাছাকাছি। তবে নিশ্চয় জীবন হতো ভিন্ন স্বাদের।’ কেন এই আর্তি, এই খেদ? ভেতরের চোখটা দিয়ে দেখতে পারলে সবগুলো জট খুলে ফেলা যায়, মুক্ত মানুষ হয়ে বের হওয়া যায়।

কেবল বন্ধুত্বই পারে এইসব বদ্ধ দরজা-জানালা খুলে দিতে।

তবুও পথচলা...

প্রতিদিনকার এই একঘেয়ে জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত আমরা। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এসব কিছুই যেন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্য থেকেই আবিষ্কার করি এমন বন্ধুকে যে নিঃস্বার্থভাবে শুধুই গাছ লাগায় পথিক ছায়া পাবে বলে, একজন আলোর দিশারী যে বিনা মূল্যে গরিব ছাত্রদের পড়ায় শিক্ষার আলো জ্বালাতে, জ্ঞান অন্বেষণী যিনি নিজ বই বিনা মূল্যে বাড়ি বাড়ি পড়তে দেন আলোর পথের যাত্রী হতে। আমরা দেখি আর বিস্মিত হই।

এই নিঃশর্ত বন্ধুগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় এখনো সব আছে, কিছুই শেষ হয় নি। তুমি খুঁজে নিও তোমার বাঁচার অবলম্বনকে।

আজ আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ জীবন সর্বত্র এই বন্ধুত্বের অভাবে সংঘর্ষ হয়, দ্বন্দ্ব হয়। জাতীয় জীবন থেকে আন্তর্জাতিক। এই সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন বন্ধুত্বের আহ্বান। আগস্টের প্রথম রবিবার অর্থাৎ ১ আগস্ট বিশ্ব বন্ধু দিবস। আমাদের শপথ হোক প্রতিটি দিবসই হোক বন্ধুত্বের। আমরা বন্ধু হই, বন্ধু খুঁজি, বন্ধুত্ব করি বেঁচে থাকার আনন্দকে উপলব্ধি করতে।

রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়িকা লাবণ্যের মতোই বলতে হয়—

‘যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়,
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি
এবার পূজায় তারি আপনারে
দিতে চাই বলি।’

এটাই বোধহয় চরম সত্য। নিঃশর্ত অসীম ক্ষমা, বন্ধুত্বের সম্পর্কেও তা নিঃশব্দে কাজ করে। আমরা ক্ষমা করতে শিখি ছেলেবেলার কোনো বন্ধুর অন্যায়কে, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘বন্ধু তুমি আসো, আমি অধীর প্রতীক্ষায় আছি তোমার জন্য।’

চলচ্চিত্রে বন্ধুত্ব

চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় মূর্ত হয়ে উঠেছে বন্ধুত্ব¡। প্রথমেই বাংলা চলচ্চিত্রের কথা। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’-তে সন্দীপ ও নিখিলেশের বন্ধুত্ব লক্ষণীয়। স্ত্রীর সঙ্গে সন্দীপের অনৈতিক সম্পর্ক টের পেয়েও বন্ধুকে কিছু বলে না নিখিলেশ। বরং তার রাজনৈতিক কর্মকা-ে নানাভাবে সাহায্য করে। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’,‘হীরক রাজার দেশে’, ‘গুপি বাঘা ফিরে এল’-তে দেখা যায় গুপি-বাঘার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ‘অপুর সংসার’-এ বন্ধু টুলুর সূত্রে অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে হয় অপুর। অকালে স্ত্রীকে হারিয়ে অপু যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন টুলুই সান্ত্বনা জোগায় বন্ধুকে। সাদেক খান পরিচালিত ‘নদী ও নারী’-তে নজু মিয়া ও আসগরের গভীর বন্ধুত্বে চির ধরে এক নারীর জন্য। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর শত্রু হয়ে ওঠে। এর অবসান ঘটে নজু মিয়ার মৃত্যুতে। আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’-তে সুমিত ও অনিতার বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবিতে আমরা দেখতে পাই, বন্ধুত্বের জন্য মাসুম অর্থাৎ রাজ্জাক প্রেম ও একটি চোখের আলো বিসর্জন দিচ্ছে। এমনিভাবে ‘সমাধি’, ‘বন্ধু’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘বাল্যবন্ধু’সহ নানা ছবিতে বন্ধুত্ব¡ মূর্ত হয়ে উঠেছে। এবার বলিউডের হিন্দি ছবির প্রসঙ্গ। মেহবুব খানের ‘আন্দাজ’ এবং রাজকাপুরের ‘সঙ্গম’-এ দেখা যায় এক ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব, পরে যা ত্রিভুজ প্রেমে রূপান্তরিত হয়। ‘শোলে’-তে বিপদশঙ্কুল মুহূর্তে জয় (অমিতাভ) বন্ধু বিরুকে (ধর্মেন্দ্র) নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে নিজে মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘দোস্তি’সহ আরও বহু ছবিতে বন্ধুত্বের দ্যুতি সেলুলয়েডে ফুটে উঠেছে। একই কথা বলা যায়, হলিউডের কিছু ছবির ক্ষেত্রেও।

বাংলা গানে বন্ধুত্ব

প্রেম-বিরহের সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে বন্ধুত্বের গুরুত্বও কম নয়। বাংলা গানের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে বন্ধুত্বের জয়গান। সেটা আধুনিক বাংলা গানে তো বটেই, বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও কোনো অংশে কম নয়।

বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক কালজয়ী বাংলা গান সৃষ্টি হয়েছে। ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’ গানটি আজকের সৃষ্টি নয়। কালজয়ী এই গানটি আধুনিক সময়েও মানুষ তার পছন্দের তালিকায় রেখেছে। এমনকি বিশ্ব বন্ধু দিবসে গানটির শিরোনাম ব্যবহার করে এসএমএস আদান-প্রদান করে থাকে অনেকে। 

‘বন্ধু তোর বারাত নিয়া’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িতে গেলাম’, ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে’, ‘রসিয়া বন্ধুরে’ প্রভৃতি শিরোনামের গানগুলো বন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে  গাওয়া গানের জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক কালের বাংলা গানের ইতিহাসে বন্ধুকে নিয়ে গানের সংখ্যা নগণ্য। বাংলা গানের যে অংশ নিয়ে গর্ব করা যায়, তার বেশির ভাগই চলচ্চিত্রের গান।

মিডিয়া জগতে বন্ধুত্ব

মিডিয়া জগতের মানুষদের মধ্যে নাকি বন্ধুত্ব হয় না—এ ধরনের একটি কথা প্রচলিত আছে। তারপরও এই জগতের মানুষদের মধ্যেও সংখ্যায় অল্প হলেও এমন কয়েকজন মানুষ দেখা যায়, যারা গভীরভাবে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। এমনই কয়েকজনের বন্ধুত্বের কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।

শুরুতেই এদেশের মিডিয়া জগতের কথা। প্রয়াত হুমায়ূন ফরীদি ও আফজাল হোসেনের বন্ধুত্বের কথা কে না জানে! মঞ্চে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর এক পর্যায়ে ফরীদি  বন্ধু আফজালের কাছে টিভিতে অভিনয়ের মনোবাসনা জানালেন। তখন আফজাল  পরপর কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন ফরীদিকে ভেবে। ফলে টিভি মিডিয়ায় প্রবেশের বিষয়টি ফরীদির ক্ষেত্রে সহজ হয়েছিল। পরেও নানাভাবে আফজাল সাহায্য করেছিলেন ফরীদিকে। শেষ দিকে ফরীদির স্বাস্থ্য নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন আফজাল। বন্ধুকে সিগারেট খেতে মানা করেছিলেন তিনি। ফরীদি তখন দুষ্টু বালকের মতো আচরণ করেছেন। লুকোচুরি খেলেছেন বন্ধুর সঙ্গে। অবশ্য তাঁর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা, উদ্বেগ তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নিজের জীবনের প্রতি তখন তাঁর কোনো মায়া ছিল না। তাই অকালেই বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।

শামীম আরা নিপা ও শাকিলা জাফরের বন্ধুত্বের কথাও উল্লেখ করা যায়। এই বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। শাকিলা এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। কিন্তু এই দূরত্ব ও  চোখের আড়ালও তাদের বন্ধুত্বকে ম্লান করতে পারে নি।

এছাড়া আবদুল্লাহ আল মামুন-ফেরদৌসী মজুমদার, রাজ্জাক-দিলীপ বিশ্বাস, শাবানা-আনোয়ারা, ববিতা-জাফর ইকবাল, জাহিদ হাসান-শমী কায়সারসহ আরও কয়েকজনের কথা বলা যায়। এঁদের মধ্যেও গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল অথবা রয়েছে।

পাশের দেশ ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেলা যাক। একদা উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, ছিল ভালোবাসাও। সমসাময়িক সৌমিত্র ও তনুজার মধ্যেও তখন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এ সময়ে দৃষ্টিপাত করি পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় ও অভিনেতা যিশু সেনগুপ্ত এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ও পাওলিদামও গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

বলিউডের দিকে তাকালে দেখতে পাই, একদা রাজকাপুর, দিলীপ কুমার ও দেবানন্দের মধ্যে পেশাগত জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তী সময়ে জিতেন্দ্র, রাকেশ রোশন এবং ঋষি কাপুর বন্ধুত্বের দ্যুতিতে ছিলেন উদ্ভাসিত।

সালমান, অজয় দেবগন ও সঞ্জয় দত্তের বন্ধুত্বের কথা অনেকেই জানেন না। কেননা তারা তাদের বন্ধুত্ব সবার সামনে তেমন প্রকাশ করেন না, যদিও এই বন্ধুত্ব ভীষণ উপভোগ করেন তারা। পরস্পরের বিপদে-আপদেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তারা।

জুহি চাওলা ও শাহরুখ খান একসঙ্গে শুধু অভিনয়ই করেন নি, দুজনের মাঝে রয়েছে গভীর বন্ধুত্বও। এছাড়া দীপিকা পাড়–কোন-সাহানা  গোস্বামী, শাহিদ কাপুর-আহমেদ খান, অভিষেক বচ্চন-সিকান্দার খের, রিতেশ সিদ্ধানি-ফারহান আখতার, কারিনা কাপুর- অমৃতা অরোরা এবং শাহরুখ-কাজল-করণের গভীর বন্ধুত্ব শো-বিজ দুনিয়ায় এখনো টিকে আছে বেশ ভালোভাবেই।

বাণী চিরন্তণী

বন্ধুত্ব একমাত্র সিমেন্ট যা সবসময় পৃথিবীকে একত্র রাখতে পারবে।

—উইড্রো উইলসন

অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়ে ভালো।

—হেলেন কেলার

ছেলেবেলার বন্ধুরা মেয়েদের ভালোবাসার মতোই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে একেক সময়। মনে হয় যে, বুঝি একরকম ভালোই। তাদের নির্মেদ দেহ আর নির্মেঘ মন নিয়ে কৈশোরের নিবিড় মাধুর্যে মিশিয়ে নিটোল মুক্তোর মতোই চিরদিনের স্মৃতির মধ্যে অবক্ষয় থেকে যায় তারা—পরে যে কখনো আর ফিরে দেখা দেয় না তাতে জীবনের মতোই সুমধুর থাকে, পলে পলে দ-ে দ-ে অবক্ষয়ে টাল খায় না, ক্ষয় পায় না।

—শিবরাম চক্রবর্তী

 গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 দুটি দেহে একটি আত্মার অবস্থানই হলো বন্ধুত্ব।

—এরিস্টটল

 বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে প্রাণরক্ষাকারী ছায়ার মতো। যে তা খুঁজে পেল, সে একটি গুপ্তধন পেল।

—নিটসে

 একজন সত্যিকারের বন্ধু তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

—অস্কার ওয়াইল্ড

 বন্ধুত্ব গড়তে ধীরগতির হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিনিয়তই তার পরিচর্যা করো।

—সক্রেটিস

আমার বন্ধুর জন্যে সবচেয়ে বেশি যা করতে পারি তা হলে শুধু বন্ধু হয়ে থাকা। তাকে দেওয়ার মতো কোনো সম্পদ আমার নেই। সে যদি জানে যে আমি তাকে ভালোবেসেই সুখী, সে আর কোনো পুরস্কারই চাইবে না। এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কি স্বর্গীয় নয়?

—হেনরি ডেভিড থিওরো

গোপনীয়তা রক্ষা না করে চললে বন্ধুত্ব টিকে না।

—চার্লস হেনরি ওয়েব

Leave a Reply

Your identity will not be published.