সংবাদপত্রে একটি খবর ও কয়েকটি প্রতিক্রিয়া

সংবাদপত্রে একটি খবর ও কয়েকটি প্রতিক্রিয়া

দৈনিক তাজা খবর
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৩ ভাদ্র ২০, ১৪২০
পৃষ্ঠা-১

এগারো বছর পর শেরপুরের গৃহবধূ কমলার নাটকীয় আত্মপ্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, তাহিরপুর, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৩: দীর্ঘ এগারো বছর পরে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে শেরপুরের গৃহবধূ কমলা যে ২০০২ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখে আট বছরের কন্যা শেফালী ও সাত বছরের পুত্র রুমনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। তার সঙ্গে ছিল তখন কেবল একটি কালো রঙের ছোট্ট ভিনাইলের পার্স যার ভেতর ভাড়া বাড়ির একখানি চাবি ও খুচরা দশ-বিশ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে বাড়ির কোনো জিনিসপত্র বা অর্থ খোয়া যায় নি। বাড়ির ভেতর সবকিছু প্রতিদিনের মতো গোছানো ও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এমন কি আলমারিতে রাখা ৩৭৫ টাকাও যথাস্থানে আবিষ্কার করেছেন পুলিশ। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার সময় ব্যাংকে কর্মরত কমলার স্বামী শামীম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না কমলার। কমলার প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু খুশী চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী শামীম চৌধুরী শিগগিরই কমলাকে তালাক দিয়ে তার ব্যাংকের সহকর্মী রাহেলা বেগমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে কমলা খুব-ই বিচলিত ও বিমর্ষ ছিলেন। কমলার বাপের বাড়ির আত্মীয়দের ও খুশী চৌধুরীর বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কমলার এই রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার জন্যে প্রধান সন্দেহভাজন হন স্বামী শামীম চৌধুরী। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওবার পর দীর্ঘদিন ধরে বিচার চলে। এদিকে সারা দেশে, এমনকি ভারতেও, খবরের কাগজসহ বহুরকম মিডিয়াতে কমলার ছবিসহ তার নিখোঁজ হওয়ার বিজ্ঞপ্তি ছাপানো হয়। বছরাধিক কাল পর্যন্ত নানাভাবে চলতে থাকে তার খোঁজ।  অতঃপর সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে শামীম চৌধুরীকে নির্দোষ বিবেচনায় বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। আরও বছর তিনেক পর কোনো জায়গা থেকে কমলার কোনোরকম সংবাদ না পাওয়া যাওয়ায় ইতোমধ্যেই কমলার মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে থানা থেকে তার অন্তর্ধান ও সম্ভবপর হত্যার মামলা তুলে নেয়া হয়। অতঃপর শামীম চৌধুরী তার প্রেমিকা রাহেলা বেগমকে বিবাহ করেন এবং দুজনে মিলে কমলা-শামীম দম্পতির পুত্রকন্যা শেফালী ও রুমনকে লালনপালন করেন। তারপরে আরও ছয় বছর কেটে যায়। বর্তমানে শেফালী ও রুমন উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দীর্ঘদিন ধরে কমলার নিখোঁজ ও নিশ্চুপ থাকার কারণে সকলেই যখন ধরে নেয় ইতোমধ্যে তার মৃত্যু ঘটেছে, তখন গতকাল হঠাৎ বাড়ি থেকে বহুদূরে হাওর অঞ্চল তাহিরপুরের থানায় নিজ থেকে পায়ে হেঁটে এসে আত্মপ্রকাশ করেছে কমলা। তার স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ও বিগত এগারো বছরের নিখোঁজ অবস্থায় গুপ্ত জীবনের চাঞ্চল্যকর কাহিনি সবিস্তারে এবং খোলাখুলিভাবে পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে বলেছে কমলা। নিখোঁজ কমলার গত এগারো বছরের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক বর্ণনা আজকের তাজা খবরের চতুর্থ পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হলো।

এগারো বছর পর কমলার আত্মপ্রকাশের ওপর প্রথম পৃষ্ঠার এই সংবাদ পাঠে কতিপয় প্রতিক্রিয়া :

কমলার কন্যা শেফালী, বয়স উনিশ, ঢাকা (প্রথম উক্তি): দোজখে গিয়ে পচে মরুক সে। আমার কিছু যায় আসে না।

শেফালির দ্বিতীয় উক্তি: সে আমার কেউ নয়।

কমলার পুত্র রুমন, বয়স আঠারো, ঢাকা: মা বলতে একমাত্র রাহেলা বেগমকেই জেনে এসেছি। আমাদের গর্ভধারিণী মা ছোটবেলাতেই হারিয়ে গেছে, মারা গেছে, এটাই সত্য বলে জানি।

শেরপুরের গৃহবধূ হাসিনার মতে এমন পাষণ্ড মা যে শিশু সন্তানদের ফেলে রেখে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, তার এই ফিরে আসা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

কিশোরগঞ্জের দিনমজুর সোবহান: ওই মাইয়ামানুষের বুকের পাটা কত শক্ত! পোলামাইয়া ছাইড়া গিয়া এত বছর পরে আবার ফিরা আহে।

ঢাকার মানবাধিকার আইনজীবী নাসরীন হক- কোনোরকম অপরাধ না করেও দুই শিশু সন্তান ফেলে রেখে এখন রহস্যজনকভাবে কমলা কেন নিখোঁজ হয়ে গেল, কেন এতদিনে একবার সন্তানদের খোঁজও নিল না, কেনই বা আবার হঠাৎ করে ফিরে এল, এ সবকিছুই গভীরভাবে জানা বোঝা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কমলার ঘটনাটি, তার কর্মকাণ্ড খুব স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাবলির মধ্যে পড়ে না। এটি একটি অভিনব ব্যাপার। তদন্ত ও ব্যাখ্যা দরকার।

ঢাকার পিজি হাসপাতালের মানসিক রোগের ডাক্তার শান্তনু পাল- কোনো দুর্ঘটনা, প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা বিশেষ অসুখ কিংবা ওষুধের জন্যে সাময়িকভাবে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া বা ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন-বোধের জন্ম নেওয়া খুব বিরল বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে কমলাকে পরীক্ষানিরীক্ষা না করে তার সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা না করে তার সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না।

শেরপুরে কমলার প্রাক্তন স্বামী শামীম চৌধুরী: নিজের খেয়ালখুশিমতো এভাবে হারিয়ে গিয়ে (কমলা) আমার জীবনে যে জটিলতা ও ভোগান্তির সৃষ্টি সে করেছিল তা ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। (সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শামীম চৌধুরী এবং তার সন্তানদ্বয় জানান, কমলাকে তাহিরপুর থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কিংবা তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার বিষয়ে কোনো পারিবারিক সিদ্ধান্ত বা আগ্রহ নেই)।

 

দৈনিক তাজা খবর
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৩ ভাদ্র ২০, ১৪২০
পৃষ্ঠা-৪

নিখোঁজ গৃহবধূ কমলার চাঞ্চল্যকর এগারটি বছর

নিজস্ব সংবাদদাতা : তাহিরপুর, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩: পুত্রকন্যাকে স্কুলে দিয়ে প্রতিদিনের মতো বিদ্যালয়ের অতিকায় প্রধান লোহার গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন কমলা। সেটা ২০০১ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখ। এই সকালবেলাতেও ভ্যাপসা গরম সেদিন। কমলা হেঁটে হেঁটে ডাইনে নিজ বাড়ির দিকে যেতে শুরু করেন। কিন্তু কী মনে করে কয়েক গজ যাওয়ার পরে আবার পেছন ফিরে স্কুলের উল্টো দিকে অর্থাৎ বামদিকে যেতে থাকেন। কিছুক্ষণ হেঁটে গেলেই উল্টোপাশে একটি পার্ক। পার্কের সামনে রাস্তার ধারে ঘাসের ওপর বসানো রয়েছে দুটি লোহার বেঞ্চি। এই বড় রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দূরপাল্লার বাস যায়। এই পার্কের কাছাকাছিই হয়তো রয়েছে কোনো বাসস্ট্যান্ড। কমলা লক্ষ্য করেছেন এই বেঞ্চিতে বোচকাবুচকি নিয়ে কখনো কখনো বসে থাকে যাত্রীরা। বাসের জন্যে অপেক্ষা করে। তবে সেই সাতসকালে কেউ ছিল না সেখানে। কমলা বেঞ্চিতে বসে বসে রাস্তার যানবাহনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাবতে শুরু করেন তার জীবনের নানা বাঁক পরিবর্তনের কথা। শামীম চৌধুরীর সঙ্গে তার গত দশ বছরের বিবাহিত জীবন এবং তার পরিণতির কথা। গত পরশুই শামীম চৌধুরী, এতদিন পর, অবশেষে সহকর্মী রাহেলার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন। শিগগিরই কমলাকে তালাক দিয়ে রাহেলাকে ঘরে তুলে আনার সিদ্ধান্তের কথা তখনই জানান কমলাকে। কমলা জানেন না দুটি শিশুসন্তান নিয়ে তিনি এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন, বাকি জীবন কী করে কাটাবেন। এমন কেন হলো, কার অপরাধে হলো? দুঃস্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য এই বাস্তবতাকে মন থেকে একেবারেই মেনে নিতে না পেরে রাস্তার ধারে বসেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন কমলা। একনাগাড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন আর ঘনঘন চোখ মোছেন কমলা। হঠাৎ লক্ষ করেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটি সাদা মোটর গাড়ি। কমলার  মনে হয় যেন উড়ে এসে তীরে ভিড়েছে এক সপ্তডিঙার নাও। তাকে তুলে দূরের কোনো ভীন রাজ্যের বিশাল রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। গাড়ির চালকের সিট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন প্যান্ট-শার্ট পরা ফ্যাশন দুরস্ত এক সুদর্শন লোক যার বয়স চল্লিসের নিচে বলেই মনে হয় কমলার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে থাকা সুবেশ এক নারীও অন্যদিকের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। পরনে তার নীল রঙের সিল্কের শাড়ি। চোখে সানগ্লাস। বেশ আধুনিকা ও সুশ্রী মনে হয় তরুণীটিকে কমলার। তারা এসে দাঁড়ান কমলার ঠিক সামনে। নীল শাড়ি পরা মেয়েটি একটু পরেই ধপ করে বসে পড়েন কমলার পাশে। কমলার কান্নার কারণ জানতে চান তারা। কী হয়েছিল সেদিন কমলার কে জানে? যে কমলা নিজের দুঃখের, বঞ্চনার কথা একমাত্র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী খুশী ছাড়া কারও সঙ্গে কখনো আলোচনা করেন না, হঠাৎ তিনি এই অপরিচিত দম্পতির কাছে নিজের জীবনের বর্তমান পরিস্থিতির কথা সবিস্তারে খুলে বলেন। শুনে পরম সহানুভূতির সঙ্গে তারা দুজনেই কমলাকে পরামর্শ দেন সেই মুহূর্তেই তাদের সঙ্গে গাড়িতে করে রাজধানীতে চলে আসার জন্যে। যেহেতু কমলা হাইস্কুল পাস করা লেখাপড়া জানা নারী, তার পক্ষে শহরে একটি সম্মানজনক চাকরি পাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। চাইলে তাদের নিজেদের কুটিরশিল্পের ছোট্ট কারখানায় এক্ষুনি চাকরি দিয়ে দিতে পারেন তারা। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ান কমলা। তারপর আবার বসে পড়েন। তার পুত্রকন্যার কী হবে? পথে দেখা দম্পতি তাকে বোঝাল, পুত্রকন্যাকে যতদিন পর্যন্ত নিজের কাছে নিয়ে আসতে না পারছেন, তাদের পিতা দেখাশোনা নিশ্চয় করবেন। কে জানে, এমন অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা ছেড়ে দিতেও পারেন তিনি। না দিলেও সন্তানদের তো আর ফেলে দিতে পারবেন না। তারপর কমলা নিজের পায়ে যখন দাঁড়াবেন, বাসা ভাড়া করে রাজধানীতে নিয়ে আসবেন সন্তানদের। কয়েকমুহূর্ত চিন্তা করেন কমলা। তারপর যে কমলা তার সমস্ত জীবনে তার বাবার বাড়ি ও স্বামীর বাড়ির বাইরে অন্য কোনো জনপদে কোনোদিন বেড়াতেও যান নি, সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসেন সাদা গাড়ির পেছনের সিটে। তার কেবলই মনে হতে থাকে, তার এই প্রচণ্ড দুর্দশা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ধরায় নেমে এসেছে কোনো বেহেশতি দোসর কিংবা রাজ্য ও রাজকন্যা বিজয়ে বেরিয়ে পড়া সাদা অশ্বারোহী দূরপাল্লার এক অচীন রাজপুত্র। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না কমলার। কলিকালের রাজপুত্র যে ঘোড়ার বদলে ইঞ্জিনবাহিত যানে চড়ে রাজপথে ঘুরে বেড়ায়, যে রাজপুত্র ষড়যন্ত্র-প্রতিহিংসার শিকার দুঃখিনী ও বঞ্চিত রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিজের সাম্রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সসম্মানে তার পাশে সিংহাসনে বসায় না, টেনে নামিয়ে নিয়ে আসে সমুদ্রের অতল গহ্বরে অথবা পাতালের গভীর অন্ধকারে, সেই রাজপুত্রের কাহিনি বা কর্মকাণ্ড জানা ছিল না কমলার। ফলে কারখানার কারুশিল্পের কাজের বদলে কমলা যা পেলেন তা এরকম। তাকে একটি বাড়িতে বন্দি করে বাধ্য করা হলো নিত্যনতুন মানুষের দেহ ও মনোরঞ্জনের কর্মে। কিন্তু তিন মাসের মাথায় নিজের এক খরিদ্দারের সঙ্গে মিতালী পাতিয়ে কমলা আবার অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হন আলোময় পৃথিবীতে। তার খরিদ্দার ওয়াদামতো বিয়ে তাকে করে না ঠিকই, কিন্তু তার পাশে থেকে তার দেখাশোনা করে। দুজনে মিলে প্রথমে নেত্রকোনা ও পরে তাহিরপুর গিয়ে  প্রধানত জেলেপাড়াতে নৌকায় রঙ করা, ছই বাঁধা ও নৌকা মেরামত করার কাজ শুরু করেন। সেইসঙ্গে কমলা জাল বোনান, জাল মেরামত করার কাজও শেখেন। নাম বদলে কমলা হয় যান বকুল। সারা বছর কাজ থাকে না তাদের। যখন থাকে, সারা মাস ধরে যা রোজগার করেন তারা দুজনে মিলে, ঘর ভাড়াতেই তার সিংহভাগ চলে যায়। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে মাঝে মাঝে মানুষের কাছে হাত বাড়িয়ে খাবার চেয়ে খান; বিনিময়ে কোনো কাজ করে দেন গায়ে খেটেই। তাই একে ভিক্ষা করা বলতে নারাজ কমলা। কখনো কখনো শহরে গিয়ে ডাস্টবিন খুঁজেও খাবার বের করে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন তারা। একসময় আরও উত্তরে, সকল ঝিলবিল ছাড়িয়ে ভারতের সীমান্ত অঞ্চলেও তারা বসবাস করেন। বাড়িভাড়া জোগাড় করতে না পেরে বনে-জঙ্গলেও ঘুমোন কত রাত।

এক ভোরে উঠে হঠাৎ কমলা দেখেন তার সঙ্গী মানিক উধাও। তার ব্যবহৃত তৃণকুটাটিও ফেলে রেখে যায় নি, তার অস্তিত্বের সকল চিহ্ন নিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মানিক! ছোট্ট চিরকুটে লিখে যায় এ জীবনের ভার আর সইতে না পেরে ফেলে আসা স্ত্রী-পুত্রের কাছেই ফিরে যাচ্ছে সে কিশোরগঞ্জে। কমলা এর পরেও কিছুদিন একা একা কাজকর্ম জোগাড় করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কখনো কোনো বাড়ির বারান্দায় কখনো খোলা আকাশের নিচে। ক্ষুধায়, রোদ্রে, তাপে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কমলার বয়স যেন দ্রুত বেড়ে যায়। এগারো বছরেই ষাট বছরের প্রৌঢ়াতে রূপান্তরিত হন কমলা। একসময় নিজের জীবনের এই অবিরত যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে কমলা স্থির করেন আত্মপরিচয় আর গোপন না করে পুলিশের কাছে এসে নিজেই ধরা দেবেন। এরপর জীবন যেখানে নিয়ে যায়, যা ঘটে সবই মেনে নেবেন।

কমলা জানান, তার কৃতকর্মের জন্যে তিনি মোটেই দুঃখিত বা ক্ষমাপ্রার্থী নন কারও কাছে। নিজের জীবনকে অন্যের খেয়ালখুশিমতো চালাতে না দিয়ে তিনি চেয়েছিলেন জীবন নৌকার পাল ও মাস্তুলকে নিজের হাতে শক্ত করে ধরে তার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে। তা করতে গিয়ে তিনি হেরে গেছেন। কিন্তু সে চেষ্টা যে করতে পেরেছেন-নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে বাঁচার প্রচেষ্টায় ঘর ছেড়েছেন এজন্যে তিনি মোটেও লজ্জিত বা অনুতপ্ত নন। এগারো বছর আগে একত্রিশ বছর বয়সী গৃহবধূ কমলার সঙ্গে আজকের বিয়াল্লিশ বছর বয়সী বকুলের চেহারার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া শক্ত। তবু সবকিছু ডিঙিয়ে তার বাম হাতের বাহুতে লাল রঙের উজ্জ্বল জন্মদাগ আর নাকের পাশে ঠোঁটের ওপরে ডান দিকে কালো তিল আগের মতোই জ্বলজ্বল করে। কমলা এখনো বেঁচে থাকার ব্যাপারে পুরোপুরি দৃঢ়সংকল্প। যা-ই ঘটুক জীবনে যা-ই আসুক, যতদিন সম্ভব বেঁচে থাকতে চান তিনি।

‘নিখোঁজ গৃহবধূ কমলার চাঞ্চল্যকর এগারোটি বছর’ সংবাদটি বাংলাদেশের প্রতিটি কাগজে প্রতিটি টিভি চ্যানেলে ফলাও করে প্রচারিত হয়। সেখান থেকে বহু দেশে, বহু ভাষাতেও অনূদিত হয়েও তা প্রকাশিত হয়।

আমেরিকার এক কলেজ শিক্ষক বারবারা বার্গার উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে বলে ওঠেন, Way to go Kamala (ওয়ে টু গো কমলা)! ব্লাউজের হাতার দু’পাশে দু’ হাত দিয়ে চাপড় দিয়ে যেন নিজেকেই নিজে অভিনন্দন করছেন বারবারা।

নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির আয়েশা: এমন করে হারিয়ে যাইতে আমারও কতবার ইচ্ছা অইছে। কিন্তু সাহস পাই নাই।

কলকাতার মীরা চক্রবর্তী (সরকারি চাকুরে, স্ত্রী ও মা): One flew over the cukoo’s nest.

লাহোরের বিলকিস বানু: দোজখের আগুনে পুড়ে মরবে তুমি বারে বার। তোমার গুনাহর মাফ নাই।

রাজশাহীর স্থপতি মাজহারুল ইসলাম: যেমন কর্ম তেমন ফল, কমলা নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে এনেছে। এখানে সে আর কাউকে দায়ী করতে পারবে না, তার এই দুরবস্থার জন্যে সে একাই দায়ী।

শ্রীলংকার টমাস বারী: তোমার সাহসের প্রশংসা করি কমলা।

রংপুরের এনজিও কর্মী ময়নার বড়ই কষ্ট হয় কমলার জন্যে। তার দুঃখে সমব্যথী সে। সাংবাদিকদের কথার উত্তরে ময়না জানায়, কমলার প্রতি রাগ বা ক্ষোভ নয়, প্রচণ্ড সহানুভূতি হয় তার। অনুকম্পা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুমা: এগারো বছর আগের সেই সকালে দেহব্যবসায়ী দালালের বদলে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির সঙ্গেও সাক্ষাৎ হতে পারত কমলার। জীবনটাও তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে বইতে পারত তার যা ঘটে নি। এটি দুঃখজনক।

প্রাক্তন প্রতিবেশী গৃহবধূ ফরিদা: সন্তানদের ফেলে এভাবে হাওয়া হয়ে যাওয়ার পাপেই তার এই করুণ পরিণতি। মা হয়ে সে এটা করতে পারল কী করে?

বন্ধু ও প্রতিবেশী খুশী চৌধুরী: সে যা করেছে আমি তা সমর্থন করি না। তবে কী অবস্থায় কেমন মানসিক বিপর্যয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে, সেটা বুঝতে পারি।

তাহিরপুরের থানার পুলিশ অফিসার শামসুল হক, যিনি একজন সৌখিন লেখকও বটে, যার কাছে কমলা নিজে থেকে এসে জবানবন্দি দেন, একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন: একজন আইন প্রয়োগকারী সরকারি কর্মচারী হিসেবে এটুকু বলতে পারি, কমলা কোনো অপরাধ করে নি। সুখের সন্ধানে, শান্তির অন্বেষণে জীবন থেকে সংসার থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসা কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।

 বর্ষ ১৮ সংখ্যা ১৫

Leave a Reply

Your identity will not be published.