প্রাণীকুলের অন্যসব শিশুর মতোই একই মিথস্ক্রিয়ায় বিচিত্র সম্ভাবনাকে ধারণ করে একটি মানবশিশুও পৃথিবীতে আসে। কিন্তু কিছু দুর্লভ ব্যাতিক্রম ব্যতীত প্রতিটি প্রাণীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হয়ে যায় জন্মসূত্রেই। বিপরীতে, মানবশিশুকে প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে উঠতে আত্মস্থ করতে হয় এক জটিল ঘটনাপ্রবাহ। সময়ের বাস্তব অভিঘাত পেরিয়ে বহু মানুষের মুক্ত-স্বাধীন অবদানের মধ্য দিয়েই নির্মিত হতে থাকে তার অনাগত ভবিষ্যৎ।ভবিষ্যৎ নির্মাণের এই ক্রিয়ায় প্রাথমিক এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন বাবা-মা। বাবা-মায়ের যথাযথ ভূমিকার ওপরেই অনেকাংশে নির্ভরশীল সন্তানের ভবিষ্যৎ। একটি শিশুর মানবিক মূল্যবানবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুড পেরেন্টিং – এর বিকল্প নেই। সন্তানের মৌলিক চাহিদাগুলোই শুধু পূরণ করা নয়, সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সামগ্রিক আয়োজন সুসম্পন্ন করাটাই গুড পেরেন্টিং।
ভালোবাসার প্রকাশ ঘটুক
সন্তানকে ভালোবাসেন না এমন বাবা-মা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রকাশটা হয় না যথাযথ। সন্তানের উজ্জ্বল, নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার প্রচেষ্টায় নিজেকে হয়তো এতটাই ব্যাস্ত রাখছেন যে তাকে সামান্য সময় দেওয়ারও ফুসরত মিলছে না। কিংবা তাকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে বিধি-নিষেধের দেয়ালটা এতটাই বড় করে তুলেছেন যে তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আপনার সমস্ত ভালোবাসা। সন্তানের সামান্য বিপদে আপনি কতটা বিচলিত, সামান্য অসুখে সারারাত জেগে তার শুশ্রুষা, সন্তানের একটুখানি সাফল্যে আপনার পাহাড়সমান আনন্দটা যেন সন্তানের কাছে অপ্রকাশিত না থাকে এ ব্যাপারে সচেতন হোন। আপনার হাজারো শাসনের চেয়েও একটি আনন্দমাখা আলিঙ্গন তার সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। একটি ছোট উৎসাহবাণী, একটু আনন্দমাখা আলিঙ্গন সন্তানকে আরও বেশি ভালো করা, আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উৎসাহিত, প্রাণিত করে।
সন্তানের রোল মডেল হয়ে উঠুন
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বই পড়ে কিংবা উপদেশ শুনে তারা যতখানি না শিক্ষা গ্রহণ করে তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে দেখে। আর এই দেখে শেখার সূচনাটা হয় কিন্তু পারিবারিক গন্ডি অর্থাৎ বাবা-মা’র কাছ থেকেই। আর তাই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে নিজেকেও পাঠ্যাভাস ধরে রাখতে হবে। সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিবারিক গন্ডিতে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন।
প্রশংসা করুন
সন্তানের ভালোর জন্য তাকে শাসন করা যেমন জরুরি তেমনি তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করাটা জরুরি। তাহলে সেই কাজে সে উৎসাহিত হবে। আরও বেশি বেশি ভালো কাজ করার ব্যাপারে তার মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে।তবে খেয়াল রাখবেন যে প্রশংসাটার যেন যুক্তি থাকে। সব কাজেই যদি প্রশংসা করেন তবে সেই প্রশংসা আর গুরুত্ব পাবে না। প্রশংসার পাশাপাশি মাঝে মাঝে গঠনমূলক সমালোচনাও করুন। সমালোচনার ভাষাটাও যেন কঠিন না হয়।সমালোচনার সময়ও ভালো দিকটি আগে উপস্থাপনা করে নেতিবাচক দিকগুলো ধরিয়ে দিন।গঠনমূলক সমালোচনা, প্রশংসা সন্তানকে অনেক বেশি দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
গড়ে তুলুন মানবিক গুণসম্পন্ন করে
হামটি-ডামটি কিংবা টুইংকেল-টুইংকেল লিটল স্টারের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছেন মদনমোহন তর্কালংকার। সকালে উঠে এখন আর মনে মনে বলা হয় না সারাদিন ভালো হয়ে চলার কথা। জেট গতির এই যুগে বাবা-মা সন্তানকে ভালো ছাত্র হিসেবে গড়ে তুলতে যতখানি সচেষ্ট ঠিক ততটাই উদাসীন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে। কিন্তু এটাও তো ভুলে গেলে চলবে না বেগ-আবেগের দ্বন্দ্ব যতই তৈরি হোক না কেন কিছু বিষয় যে চিরকালীন। আর ভাই ফিজিক্স-ক্যামিস্ট্রি-ম্যাথের বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতা, মুল্যবোধের পাঠটাও দিতে যেন ভুল না হয়। মোবাইল, ল্যাপটপ, অন্তর্জালের ভিড়ে আদর্শ লিপির জন্যও যেন কিছুটা জায়গা থাকে।
আর এ ব্যাপারে বাবা-মাকেই পালন করতে হবে মুখ্য ভূমিকা।ছেলেবেলা থেকেই সন্তানকে দেশ, সমাজ, আশেপাশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলুন। ভালো কাজ, মন্দ কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়ে দিন। সবার সঙ্গে ভালো ব্যাবহার, কাউকে আঘাত না দেওয়া, দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে তোলার মানসিকতা গড়ে তোলার শিক্ষাটা বাবা-মাকেই দিতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, মাদার তেরেসা, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মোহাম্মদ মহসীন প্রমুখ মনীষীর সম্পর্কে জানান। সেইসঙ্গে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলুন। দেশমাতৃকার জন্য কত মানুষ অকাতরে জীবনদান করেছে, কত সংগ্রামের পথ পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক- এ বিষয়গুলো সম্পর্কে তাকে ধারণা দিন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নীতিকথা, উপদেশমূলক গল্প-কবিতার বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার দিকনির্দেশনা লাভে সক্ষম হবে।
প্রত্যাশা হোক বাস্তবানুগ
সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের আবর্তিত হয় হাজারটা স্বপ্ন। সন্তান ভালো ছাত্র হবে, ভালো চাকুরে হবে, গান, নাচ, আবৃত্তিতে পারদর্শী হয়ে উঠবে। আরও কত কী। শুধু পারদর্শী হয়ে উঠলেই চলবে না, সব জায়গাতে প্রথম হওয়াও চাই। বাবা-মায়ের এতসব প্রত্যাশার চাপে সন্তানদের চাওয়াগুলো যেনহারিয়ে যাচ্ছে। সন্তানকে অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে হয়তো নিজের অজান্তেই রুদ্ধ করে দিচ্ছেন তার স্বাভাবিক বিকাশের পথ।
সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বা তাকে নিয়ে প্রত্যাশা করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেন সন্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে সেদিকেও খেয়াল রাখুন। সবাইকে যে অলরাউন্ডার হতে হবে তেমন তো নয়। বরং যেটাতে সে আগ্রহী বা পারদর্শী সেটাই তাকে করতে দিন।
- প্রতিটি ছেলে-মেয়েরই সহজাত কিছু গুণ থাকে। সেটা খুঁজে বের করুন। সেই দিকটির বিকাশের প্রতি মনোযোগী হোন। হয়তো সে ক্লাসে প্রথম হতে পারছে না কিন্তু গান বা কোনো বিশেষ নজর দিন।
- সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলা আবশ্যক। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যেন তাকে সব সময় পাঠ্যবইয়ের ঘেরাটোপে বন্দি করে ফেলবেন না। সারাক্ষণ যদি “পড়ো” “পড়ো” করেন তাহলে পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বরং পড়ালেখা শেখাটা তার জন্য কতখানি জরুরি সেই বোধটা আগে তৈরি করে দিন। তাহলে নিজের আগ্রহেই সে পড়বে। ভালো ফলাফলের জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করুন। তাই বলে ফলাফল প্রত্যাশিত না হলে তার জন্য বকাঝকা করবেন না। আগামীতে যাতে ভালো করতে পারে সে ব্যাপারে মনোযোগী হোন। সাফল্যের জন্য ভালো ফলাফল কখনো কখনো জরুরী কিন্তু এটাই একমাত্র বিষয় নয়। পৃথিবীতে বহু সফল ব্যাক্তি আছে যাদের একাডেমিক সাফল্য শূণ্যের কোঠায়।
- সবক্ষেত্রে ফলাফলটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সন্তানের চেষ্টাকে গুরুত্ব দিন। সন্তানকে বোঝান প্রথম হওয়ার চেয়েও বড় হচ্ছে অংশগ্রহণ করা। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। সন্তান যেটাই করতে চায় সেক্ষেত্রে যেন তার তার শতভাগ নিবেদন থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। যে-কোনো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি অভিভাবকের অনেক বেশি চাওয়া তার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
- কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত না হলে তখন সে খুব বেশি ভেঙ্গে পড়ে।এমনটা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। হারাটাও যে প্রতিযোগিতার একটা অংশ এটা তাকে বুঝতে শেখান।
- কোনো প্রতিযোগিতায় সন্তান যদি অংশগ্রহণ করতে না চায় তবে তাকে জোর করবেন না। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ কতখানি জরুরি সেটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। তাই বলে তার ওপর জোর চাপ প্রয়োগ করবেন না।
- সব সময় অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না।
বই হোক প্রিয় বন্ধু
আদরের সন্তানের আনন্দের জন্য খেলনা, জামা-জুতোর ছোটখাটো পাহার গড়ে তুলেছেন। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো অভ্যস্ত করে তুলেছেন কম্পিউটার, ট্যাবের সঙ্গেও। কিন্তু সেই সঙ্গে বইপড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করছেন তো? একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না কিছুতে, তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব যতই এগিয়ে থাক না কেন সন্তানের সৃজনশীল বিকাশে মেধা ও মননে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য বইয়ের বিকল্প আর কিছুই নেই। আর বই পড়ার এই সুঅভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে এক্কেবারে শিশুকাল থেকেই। শিশু কথা বলতে শেখার সময় থেকে তাকে বইয়ের সঙ্গে পরিচিত করে তুলুন। নির্বাচন করুন সন্তানের বয়স অনুযায়ী। শুরুটা করুন ছবিওয়ালা প্লাস্টিকের রঙিন বইগুলো দিয়েই। দশ মাস বয়স থেকেই বই হোক সন্তানের সঙ্গী। কথা বলতে নাইবা পারল, রঙিন চকচকে বই নেড়েচেড়ে দেখার আনন্দটা উপভোগ করতে দিন। আর একটু বড় হলে ছবিওয়ালা বইয়ের মাধ্যমে পরিচিত করে তুলুন নানা জীবজন্তু, ফুল, ফল, পাখির সঙ্গে। ছবি দেখে চেনা জিনিসগুলোর সঙ্গে বাস্তবেও পরিচিত করে তুলুন। সন্তানের বয়স তিন বছর থেকে তাকে উপহার দিন সুন্দর ছবিগুলো ঈশপের গল্প, রূপকথা কিংবা ছড়ার বই। ঘুমুতে যাওয়ার আগে নিয়মিত গল্প পড়ে শোনান। এতে কল্পনার জগত বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি গল্প ছলেই শিখে যাবে নৈতিকতা শিক্ষা। মজার মজার ছড়াও শেখান পাশাপাশি।
নিজে নিজে পড়তে শিখলে এসবের পাশাপাশি সন্তানের বয়স আর আগ্রহ অনুযায়ী যোগ করুন নানা লোককথা, উপকথা, কমিকসের বই। সঙ্গে দিন ছোটদের উপযোগী সাধারণ জ্ঞ্যানের বইও। কিশোর বয়সে বই পড়ার প্রতি আগ্রহটা ধরে রাখা সবচেয়ে জরুরি। এই বয়সে শিশু-কিশোর উপযোগী নানা গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দাকাহিনি, অ্যাডভেঞ্চার, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি প্রভৃতির পাশাপাশি দিন বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক বই।বইয়ের অভ্যাস ধরে রাখতে কে কয়টি বই পড়ল তার ওপর পুরষ্কারের ব্যাবস্থা করতে পারেন। পঠিত বইয়ের ওপর পর্যালোচনা, কুইজের আয়োজনও করতে পারেন। ছেলেবেলা থেকেই স্থানীয় লাইব্রেরির সদস্য করে দিন। নিজেদের বই দিয়ে পারিবারিক পাঠাগার তৈরির ব্যাপারে উৎসাহিত করুন। বিভিন্ন ধরণের রচনা লেখা, কুইজ প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী তৈরি হবে। এতে করে বইপড়ার প্রতিও আগ্রহ তৈরী হবে। খেয়াল রাখবেন পড়াটা যেন
Leave a Reply
Your identity will not be published.