সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (দশম পর্ব)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (দশম পর্ব)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন দশম পর্ব।] 

ভাষা যখন ভাবপ্রকাশের দেয়াল

স্টেডিয়াম থেকে বের হই। আমার গাড়িতে নতুন একজন সিকিউরিটি অফিসার, সঙ্গে সার্ব ড্রাইভার।

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?’

কারও মুখে কথা নেই, সবার মুখচাওয়াচাওয়ি। ড্রাইভারের দৃষ্টি সম্মুখপানে। সেই সম্মুখপানটা যে কোথায়, সেটা আর জানতে পারি না। সিকিউরিটি অফিসার দাঁত বের করে হাসেন। হাতের ইশারা করে সামনে তাকায়, বোঝায় সামনেই কোথাও যাচ্ছি। ওনারা ইংরেজি জানেন না, আমি জানি না তাদের ভাষা। কাজেই নিজের মতো কথা বলে যাওয়ার সুখ ছাড়া আর কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না।

ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো এখানেও ভাষা বড়ো একটি সমস্যা। মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন, স্থানীয় অধিবাসীদের মতিগতি। বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান দেশের লোকজন ইংরেজি বলতে চান না। তারা কি ইচ্ছা করেই ইংরেজিতে কথা বলেন না, নাকি বলতে পারেন না? হয়তো আঞ্চলিকতার গুণ ধরে রাখতে নিজেদের ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় কথা বলতে চান না।

ভাষার এই জটিলতায় প্রথম পড়ি ২০১৩ সালে জাপানে গিয়ে। ভিজিটের অংশ হিসেবে আমাদের নেওয়া হলো হিরোশিমার সংবাদপত্র দ্য চুগোকু শিম্বুনের অফিসে, এটি সেখানকার জনপ্রিয় দৈনিক। বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকিয়ে কেবল ঢঁ ঢঁ সাংবাদিকতা শুরু করেছি দৈনিক আমাদের সময়ে। পিনিক (আগ্রহ) চরমে। যেচে গিয়ে পত্রিকার সিনিয়র এক করেসপনডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে এগোই, ‘হ্যালো... 

ব্যস, মিষ্টি হেসে তিনি শুধু ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন। এত সুন্দর চেহারার নারী সাংবাদিক, মন ভোলানো হাসি দিয়েই আলাপের সমাপ্তি টানলেন। আলাপের শুরু আর সমাপ্তি কী, কোনো কথাই বললেন না। আমি তখন বরফের ঠান্ডায় জমে কাঠ! হায় হায়, ইংরেজির এই হালহকিকত জাপানে! পরে জেনেছি, ইচ্ছে করেই অন্য ভাষা শিখে না। সময়ের সঙ্গে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছে।

জার্মানির বন ইউনিভার্সিটির গবেষক মারুফ মল্লিক বলেছিলেন একবার, ‘ইউরোপে ভ্রমণের সময় তুমি প্রথমত ভাষা জটিলতায় পড়বে। এরা ইংরেজি জানে না, এটা ভাবা বোকামি। ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে ওরা খাস্টামি করবে, ইংরেজিতে কথা বলবে না। এটা তাদের একধরনের হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা বলতে পারো।’

সার্বিয়াতেও একই সমস্যা। ইংরেজিতে কথা বললে মুখে ঠুসি মেরে বসে থাকে। এদের পত্রিকার ভাষা ও বিজ্ঞাপন সার্বিয়ান ভাষায়। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও স্ক্রল করা হয় নিজেদের ভাষাতেও। হাইওয়ে সড়কের পাশে লাগানো ঢাউস সাইজের বিলবোর্ড, শপিংমলে লাগানো ডিজিটাল ব্যানার—সবই সার্বিয়ান। অথচ ইংরেজি বা বাংলা হলে কত মধুর আলাপই-না হতো এদের সঙ্গে!

সবুজ পার্কের রোমান্টিকতা

গাড়িতে করে ঘোরার সময় ট্যুর স্পট বিষয়ে ক্রিভো আমাকে বলল, ‘দেখো, আমাদের হাতে সময় কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু পর্যটন স্পট ঘোরা যায়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বেলগ্রেড সিটির ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যবাহী আর পর্যটন স্পটগুলো ট্যুরের মধ্যে রাখা হয়েছে।’

আমি বললাম, ‘তোমার কথা বুঝলাম। এর বাইরে কিছু সময় দেখি শুধু রাস্তায় ঘোরাঘুরির ট্যুরও রয়েছে।’

‘না না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া হচ্ছে। কিছু জায়গাতে কফি বিরতি রাখা হয়েছে, যেন ওখানকার জায়গাগুলোতেও অন্তত ঢু মারা যায়।’

ক্রিভোর উত্তরে আমি খুশি। সিটি ট্যুর করছি। যত বেশি ঘুরব, দেখাশোনা আর জানার পরিধি বাড়বে।

বেলগ্রেড শহরের পুরোটাই সুন্দর। ভবনের ফাঁকে ফাঁকে খোলামেলা জায়গা বেশি। হলুদ, লাল, লালচে, হলুদাভ, সবুজ কত রঙের গাছের পাতা! দু' পাশে ঘন গাছপালা। শুধু সবুজ নয়, বিচিত্র রঙের বৃক্ষরাজি। ক্রিভো জানায়, ‘এটি কালেমেগদান পার্ক। নানাবিধ বৃক্ষরাজি শোভিত অঞ্চল।’ বাংলাদেশের গাছের পাতা সবুজ। তাই গাছ মানেই সবুজ চলে আসে মনে। ক্লোরোফিলের উপস্থিতিতে গাছের পাতা সবুজ হয়। ক্লোরোফিল যখন ভেঙে যায় তখন সবুজ ছাড়া অন্য রংগুলো প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। তাই পাতা অন্যান্য রঙের হয়। এই যেমন লাল, কমলা, হলুদ। 

পার্কের মধ্যে গাড়ি ধীরে চলছে। প্রতিবছর প্রায় ১৮ লাখ ট্যুরিস্ট সার্বিয়া ভ্রমণ করে। যার বড়ো অংশ এই পার্কে ছবি না তুলে ফেরত যায় না। ট্যুরিজম খাতে সার্বিয়ার আয় মোট জিডিপির ৪ শতাংশ। যার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এককভাবে সার্বিয়ার পার্কগুলো থেকে আসে।

ছোটো ও বড়ো— দুটি অংশে বিভক্ত কালেমাগদান। শহরের এক প্রান্তের এই পার্ক থেকে সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। পেছনের অংশে দানিউব আর সাভা নদীর মিলনস্থল দর্শনার্থীদের মনে প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করে। নদীর ফাঁকা অংশ থেকে উঠে আসা বাতাস মনকে শীতল করে। মন ও হৃদয়ে প্রেমের আভা তৈরির যে রসায়ন, তাও আসে নদীর মোহনা থেকে। তাই তো রোমান্টিক যুগলদের কাছে কালেমাগদানের আবেদন সবচেয়ে বেশি।

শহরের ভেতরে বাইরে— সব জায়গায় গাছ আর গাছ। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের রিপোর্ট বলছে, সার্বিয়াতে বনায়নের হার ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওই বছরেই স্কুল পর্র্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে একটি করে গাছের চারা রোপণ করতে নেওয়া হয় একটি কর্মসূচি। শুধু রোপণ নয়, নিয়ম করে তার ঠিকঠাক পরিচর্যাও করতে হবে। এই কর্মসূচিতে সারা দেশে ১ কোটি গাছের চারা রোপণ করা হয়।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.