ক বি তা ভা ব না
“কবিতা নিয়ে কথা বলা দুরুহ। স্রষ্টা তার সৃষ্টির প্রতি এতটা মোহাবিষ্ট থাকে যে তার চোখে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে না। সচেতন পাঠক ক্ষতগুলো আবিষ্কার করে। চিনা সাহিত্যে একে বলে ওন সাহিত্য বা ওন লিটারেচার অর্থাৎ ক্ষত সাহিত্য।
আমার নিজস্ব একটা পথ আছে। প্রেরণার উৎস আছে। সব সময় পাঠক আমার প্রেরণা নয়। আমি আনন্দের জন্য লিখি। সামাজিক দায় থেকে লিখি।
কবিতা লেখে অনেকে কিন্তু কবিতা পড়ে মুষ্টিমেয়। আমার দেখা কবিতার প্রকৃত পাঠক এত কম যে, কবিরা এ নিয়ে বেশি ভাবলে কবিতা লেখা ছেড়ে দেবেন।
এখন পৃথিবীতে উপন্যাসের রমরমা অবস্থান। মহাকাব্য ছিলো কাহিনিনির্ভর। মহাকাব্য থেকে কাহিনি ঠাঁই নিয়েছে উপন্যাসে। এখন অধিকাংশ পুরস্কার চলে গেছে কথাকারদের কাছে। মানুষ গল্প শুনতে চায়। বিস্মিত হতে চায়। কবিতা সবই দেয় পরোক্ষভাবে। উপন্যাসের মতো সরাসরি দেয়া কবিতার প্রবণতা বিরোধী। বরং আড়াল করে, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকের সাহায্যে কবিরা মহাকাব্যিক দ্যোতনা তৈরি করেন। পাঠকমাত্র তা জানেন।
এই রূপক সৃষ্টির আনন্দ অপার। বিধাতা যাকে এই আনন্দ উদ্যাপনের সুযোগ দেন তিনি অমর।
কবিরা অমরত্বের সাধনায় ব্যাপৃত বলে বহু প্রলোভন তাদের স্পর্শ করে না। পুরস্কার তার অনিবার্য কাম্য হয়ে ওঠে না। মানুষ ও জগৎ তার কাছে প্রণম্য।
আমি কবিতা লেখায় ৪০ বছর অতিক্রম করছি। এখনো অসীম অতৃপ্তি নিয়ে ঘুরি একটা উৎকৃষ্ট মানের কবিতা লেখার জন্য। জোর করে বসলেই কবিতা হয় না। হৃদয়ের তন্ত্রীতে কখন কোন লাইন ঝিলিক দিয়ে উঠবে তার জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হয়। জোর করে কবিতা রচনা করা যাবে, তা কবিতা না হয়ে কিছু অকালগ্রস্ত লাইন হবে।
প্রত্যেক কবির নিজস্ব প্রার্থনা থাকে, নিজস্ব বিধাতা থাকে। যে তাকে বাণী-বর দেয়, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে’। মাক্সিম গোর্কির দিদিমার একজন নিজস্ব ঈশ্বর ছিলেন, তিনি তাঁকে যাচনা করতেন। প্রত্যেক কবির নিজস্ব ঈশ্বর তাকে বাণী-বর দেন। কবি আজীবন সেই মহাবিস্ময়কর বাণীর জন্য কান পেতে থাকে জগতের ডেলফির মন্দিরে। যখন সেই বাণী আসে কবি ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। ওই মুহূর্তকে বলে এপিফেনি।
কবি কিংবা বিজ্ঞানী সবার ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত মুহূর্ত একই আশ্চর্য দ্যোতনায় ধরা দেয়। আর্কিমিডিস থেকে শেক্সপিয়ার, গ্যলিলিও থেকে গ্যটে, নিউটন থেকে মিল্টন, আইনস্টাইন থেকে রবীন্দ্রনাথ, আবদুস সালাম থেকে আল মাহমুদের একই প্রক্রিয়ায় ঘটে সবকিছু।
আমি ভাবি ওই মুহূর্তটি উদ্যাপনের বিষয় নিয়ে। পাঠ করি ইতিহাসের অলিখিত অধ্যায়, চাপা দীর্ঘশ্বাস। লিখি, যা লিখতে চাই না। ভাবি, যা ভাবতে চাই না। কিন্তু সবই ছিঁড়ে ফেলি সময়ের আঁচড়ে। যা রাখি তা কেবল আমার আনন্দাশ্রু।”
ক বি তা
গন্তব্য
পথ যে কেন ঘরের দিকে টানে,
বিক্ষত হই নিজের প্রশ্নবাণে।
জন্মাবধি ইচ্ছে ছিল রথে-
ঘুরতে যাব নতুন কোনো পথে।
পথ যে এত কঠিন কে তা জানে
পাহাড় সমান কষ্ট বয়ে আনে।
নানা শহর হরেক রকম রূপ
ঝাড়বাতি আর বারুদের স্তূপ।
বিজ্ঞাপনের ব্যস্ত প্রজাপতি
দৃষ্টি রাখে ক্রেতাগণের প্রতি।
নাভির নাচ চুলের ঝড়ো হাওয়া,
থামিয়ে দেয় নীলগিরিতে যাওয়া।
ইচ্ছা তবু পদ্মপাতার দেশ
দেখব সব যা আছে নির্দেশ।
মা বলতেন অনেক দূরে যাবি
বন্ধুদেরও একইরকম দাবি।
কিন্তু পথ এমনই একরোখা
লক্ষ্য তার ঘরের ভেতর ঢোকা।
ঘরের চোখে অপেক্ষারা থাকে
এ কথাটা জানাই বলো কাকে!
তোমাকে চাই হাঁটব যতদূর
তোমাকে চাই তোমাকে চাই বলে,
কোন অচেনা পথে এলাম চলে।
এখানে সব নিবিড় ঘন বন,
ছুটবে নদী এই করেছে পণ।
আকাশ নত বাতাসে বান ডাকে,
শহর যাকে তাড়িয়ে দেয় তাকে
অবহেলার পাত্র ভেবে ধুলো,
ময়লা করে দেবে কি চুলগুলো?
গাছ কি তাকে ভাববে তথাগত,
ঠুকরে পাখি করবে মুখে ক্ষত?
ফোসকা পড়া পায়ের তলদেশে,
হাত বুলিয়ে দেবে কি ঘাস হেসে
আমি যে এই অসীম ভালোবাসি,
সবুজ পাতা পাখির হাসাহাসি।
আমি তো ঠিক ফড়িং দেখে চিনি,
কাঠবিড়ালী লেজের রিনিঝিনি।
পিপীলিকার লম্বা ক্যারাভান,
প্রজাপতির ঘুমিয়ে থাকা ভান।
এসব দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবি,
তোমাকে চাই- এই তো শুধু দাবি।
ভুলে থাকার মন্ত্র নেই কোনো,
মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে শোনো-
আমার সাথে কণ্ঠে ধরো সুর,
তোমাকে চাই হাঁটব যতদূর।
পুনর্জন্ম
যদি আবার জন্মাই
ভালোবেসে বৃক্ষ হব- পাতার বিনয়।
ঘাস হব নিরন্তর- পায়ের আশ্রয়,
ভালোবেসে বাতাসের বেগ হব
চুলের আকাশে বিদ্যুৎ।
বিরহে পাথর হবো- প্রাগৈতিহাসিক,
সমুদ্র উজাড় করে
অমৃত রাখব পায়ে চাওয়ার অধিক।
বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দেব বিষ,
মানুষ হয়ে জন্মালে আবার
একেঁ দিয়ো কপালে উষ্ণীষ।
প্রতিবিম্ব
জীবন এক পুড়ে যাওয়া প্রতিবিম্ব
আর মৃত্যু চা পাতার ঘোড়া
টগবগ করছে দরজার ডেকচিতে
প্রেম- এক প্রযুক্তি যা উৎপাদন করে অদৃশ্য জানালা
স্মৃতি- অদ্ভুত পাঠাগার যার বই পড়ে দীর্ঘশ্বাস
স্বপ্ন- ফেলে আসা জাদুঘর যেখানে
হাওয়ার হামলায় লুকিয়ে থাকে বর্ষাতি
আশারা ময়ূর পালকে স্থাপিত
আর্গাসের শত-শত চোখ
দুঃখ- রেশমগুটির নিচে শুয়ে থাকা
ব্যাঙের আর্তস্বর
সুখ- সম্রাটের শুড়হীন হাতি
অতীত-কেবলই স্মরণীয় স্বীকারোক্তি
আর এই বর্তমান এক রক্তের সরুরেখা
যা আলাদা করে দেয় দিন-রাত্রি
এবং ভবিষ্যৎ সেই চিঠি যা কখনো
পৌঁছায় না প্রাপকের কাছে
Leave a Reply
Your identity will not be published.