আমি যে গান গেয়েছিলাম।। শহিদ হোসেন খোকন

আমি যে গান গেয়েছিলাম।। শহিদ হোসেন খোকন

সে অনেকদিন আগের কথা, দেশে তখন এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন চলছে। আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। রকি আমি আর রিংকু একই স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই রকির সঙ্গে সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া বিপাশা নামের একটি মেয়ের খুব ভাব হয়ে গেল। বিপাশা যেমন সুন্দরী তেমনি স্মার্ট, রবীন্দ্রনাথের উপমার মতো—সবাইকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। ওদের দেখলেই বুকের মধ্যে এক ধররের ব্যথা অনুভব করতাম। ঈর্ষা মাখানো ব্যথা। প্রিয় জিনিসটি যখন কাছের কেউ পেয়ে যায় তখনই মনে মধ্যে ঈর্ষার জন্ম হয়। ধীরে ধীরে আমরা বন্ধু হলাম, কাছের বন্ধু। ঈর্ষাগুলো ভালোবাসা হয়ে থাকল। 

গঙ্গাধারা যেমন কালো যমুনায় মেশে না, আমিও ঠিক প্রথম দর্শনে জেনে গেছি বিপাশার মতো মেয়েরা ঠিক আমার মতো এলেবেলের সাথে যায় না, রকির সঙ্গেই মানানসই। মনের মধ্যে এক্সেপ্টেন্স ব্যাপারটা থাকা খুব দরকার, তাহলে জীবন খুব সহজ হয়। আবর্জনা জমে গেলেই নদী যেমন তার নাব্যতা হারায় তেমনি মনের মধ্যে আবর্জনা জমতে দিলেই তা দিনদিন কলুষিত হতে থাকে, আর যাকে যেখানে মানায় তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। সেজন্যেই আমাদের সম্পর্ক কখনোই নাব্যতা হারায় নি। সেটি ছিল টলটলে, স্বচ্ছ।

রকির নামের সঙ্গে মিউজিকটা খুব যায়, ও যেমন গিটার বাজাতে পারত তেমনি ড্রাম, হারমোনিয়াম, বাঁশি সব কিছুতেই পারদর্শী। সবকিছু ছাপিয়ে ওর কণ্ঠটি ছিল ভীষণ মেলডিয়াস। কলেজের নানা অনুষ্ঠানে হেমন্তের মতো ভরাট কণ্ঠে রকি যখনই গান ধরত আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। আর মনে মনে বলতাম, শালা একটা জিনিয়াস, একদিন ঠিকই সব মাত করে দেবে।

সাকসেস ব্যাপারটা শুধু প্রতিভা দিয়েই হয় না। প্রতিভার সাথে ব্যক্তিত্ব, নিয়মনিষ্ঠা, আদর্শ এগুলোও খুব দরকার। কম বয়সের খ্যাতি মানুষকে হতকিত করে দেয়, বোহেমিয়ান করে দেয়। রকির মধ্যে একটা বোহেমিয়ান ব্যাপার চলে এল। পড়াশুনায় অমনোযোগী, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, সিগারেট খাওয়া —এসব করে সে বেশ বখে গেল। বাসায় ভাইদের সাথে বনিবনা হয় না, ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে।

রকি কোনোরকম এইচএসসি উতরে পাশ কোর্সেই রয়ে গেল। অনার্সের জন্যে আমাকে কলেজ ছাড়তে হলো। রকির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্রমে কমে এল। অনেকদিন রকির সাথে দেখা হয় না। কোথায় থাকে কী করে কিছুই জানি না। শহরে গানের অনুষ্ঠানাদিতেও আজকাল ওকে দেখা যায় না।

    একদিন ইউভার্সিটিতে বিপাশার সঙ্গে দেখা, সাথে আরও দুটি মেয়ে। ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম তুলতে এসেছে। আমি হেল্প করলাম, টিএসসিতে চা-কফি খেতে খেতে রকির কথা জিজ্ঞেস করলাম। বিপাশার মুখটা মুহূর্তেই বিষাদময় হয়ে গেল। বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে ওদের মধ্যে। সাথে মেয়ে দুটি থাকায় আমি আর ঘাঁটালাম না। এর কিছুদিন পর রিংকু খবর নিয়ে এল রকি বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতেই বিদেশে চলে গেছে। নিত্য অনিয়ম আর অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে রকির ভাইয়েরা ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথমে যাবে মালয়েশিয়া তারপর ওখান থেকে ইউরোপের কোনো দেশে। একটা আদম ব্যাপারির চক্রও সাথে আছে।

মনটা দমে গেল। এত বড় একটা কাণ্ড হলো অথচ কিছুই জানি না! দোষ আমাদেরই, কেন কোনো খোঁজ নিই নি এতদিন! আমারই উচিত ছিল মাঝে মাঝে ওর খোঁজ নেয়া। স্কুলে পড়ার সময় রিংকু আর আমি কতবার ওদের বাসায় খেয়েছি। ওর মা মারা গেছে সে খবরটাও জানি না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে। বন্ধু হিসেবে আমি কোনো দায়িত্ব পালন করি নি। কত যত্ন করে ওর মা আমার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছেন। আহা মানুষটা নেই!

ঠিক কেন জানি না বিপাশা আমাকে একেবারেই এড়িয়ে চলে। দূর থেকে দেখলে না দেখার ভান করে অন্যদিকে চলে যায়। একদিন তাকে অলমোস্ট জোর করে ধরে লাইব্রেরি চত্বরে নিয়ে গিয়ে বসলাম মুখোমুখি। বিপাশাকে বললাম, আমি তো তোমাদের বন্ধুই ছিলাম, না হয় একটু স্বার্থপর বন্ধু। নিজের কথাই ভেবেছি কেবল। ইউভার্সিটিতে আসার পর খোঁজ নিই নি তোমাদের। আই এম সো সরি ফর দ্যাট। একটু কি আমাকে বলা যায় কী করে হলো এসব?

কী সব?

এই যে তোমরা কী করে দূরে সরে গেলে একে অপরের কাছ থেকে।

বলে কী হবে আর আপনার শুনেই-বা লাভ কী? যার জন্যে বলা সে তো চলে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বাট হোয়াই হি টুক দিস ডিসিশন।

সেটা আমি কী করে বলি, রকি তো আর ছোট শিশু না, নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতাটা তার আছে। প্রত্যেকটা এডাল্ট মানুষকে তার নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হয়। আমি এখনো একজন স্টুডেন্ট, আমি কী করে রকির দায়িত্ব নেব?

তাই তো, তুমি কেন নেবে, কীভাবে নেবে?

পড়াশুনা ছেড়ে শুধু মিউজিক নিয়েও হয়তো বেঁচে থাকা যেত। কিন্তু মিউজিকের প্রতি ওর নিষ্ঠা ডেস্পারেটনেস শেষ পর্যন্ত ছিল না। শেষ দিকে এসে গাঁজা টানত আরও নানা রকম নেশা করত। শেষে পরিবারের সবাই অতিষ্ট হয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

তুমি ধরে রাখতে পারলে না?

আমার কথায় বিপাশা হু হু করে কেঁদে উঠল। কাঁদল অনেকক্ষণ ধরে। আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, আই অ্যাম সো সরি,আমি কিছু মিন করে বলি নি। মানুষ নিজে না বদলালে তাকে আসলে কেউ বদলাতে পারে না। সো সরি।

বিপাশা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, যাওয়ার আগে আমাকে সে কিছু বলে যায় নি, এমনকি দেখাও করে নি। আপনি ধরে রাখার কথা বললেন! কাকে আমি ধরে রাখব? ভালোবাসা তো বেগিংয়ের কোনো ব্যাপার না, এটা মিচুয়েল ভালোলাগা আর রেসপেক্টের ব্যাপার। আমার মনে হয় না রকি আমাকে ভালবেসেছিল। আমি ছিলাম ওর ক্ষণিকের মোহ। বাট দিন শেষে আমার জীবনের দায় আমারই। আমি আমার মতো করে নিজের জীবন গড়ে তুলতে চাই। দোয়া করবেন।

বিপাশা উঠে চলে গেল, একবারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকায় নি। আমিও এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছে, একদিন সেই মানুষটা মেয়েটির স্বপ্ন-সাধ ভেঙে দিয়ে কিছু না বলে চলে গেল। এটি ভালোবাসার অপমান, মেয়েরা এটা নিতে পারে না। তবু ভালো বিপাশা ভেঙে পড়ে নি। নিজের মতো করে পথ কেটে এগিয়ে চলছে। আমি আমার সব শুভকামনা নিয়ে বিপাশার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এ ঘটনার পঁচিশ বছর পর রকির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল। অফিসের কাজে দুদিনের জন্যে কুয়ালালামপুরে গেছি, হোটেলে চেকইন করতে করতে চারটা বেজে গেল। খুব ক্ষুধা পেয়েছে, প্যাভিলিয়নে ঢুকে লাঞ্চ করে নিলাম। সিগারেট কিনতে সেভেন ইলাভেনে ঢুকেছি, ক্যাশ কাউন্টারে বাইফোকাল চশমা আর ক্যাপ পরা শীর্ণ এক লোক টাকা নিচ্ছে। আমি মালবোরো মেন্থল চাইলাম এক প্যাকেট, সাথে চুইংগাম। আমাদের সিঙ্গাপুরে চুইংগাম পাওয়া যায় না, নিষিদ্ধ জিনিস। সিগারেটও তেমন খাওয়া হয় না, কেবল বিদেশে ট্যুরে গেলে এক প্যাকেট কেনা হয়। মনে হচ্ছে বিদেশে গেলে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি এক ধরনের সহজাত আকর্ষণ তৈরি হয়। কিংবা হয়তো আমার অবচেতনেই সুপ্ত হয়ে থাকে। সময় হলে পাখা মেলে।

ক্যাশ কাউন্টারের লোকটি আমাকে বের করে দিল মালবোরো গোল্ড, আমি বললাম, আই ডোন্ট ওয়ান্ট গোল্ড, আই ওয়ান্ট মেন্থল।

লোকটি বলল, উই ডোন্ট হ্যাভ মেন্থল, ইউ মে ট্রাই এনাদার সেভেন ইলিভেন।

লোকটির কণ্ঠ আমার কেমন পরিচিত মনে হলো, মালয়েশিয়ান লোকটির কণ্ঠ শুনে আমি তার মুখের দিতে তাকালাম। বাইফোকাল চশমার আড়ালে কোটরাগত চোখ, শীর্ণ গ্রীবা, গাল বসে গেছে, কণ্ঠের হাড় বেরিয়ে আছে। লোকটার স্বাস্থ্য বলতে কিছু নেই, মনে হয় দীর্ঘ রোগ ভুগে সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে।

আমার কেন যেন মনে হলো লোকটি বাঙালি, মালয়েশিয়ায় বাঙালিরা সেলসের কাজ করে এবং সেইসাথে এটাও মনে হলো, এ আমাদের রকি! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, বুকের কাছে নেমট্যাগে সত্যি সত্যিই ‘জঙঈকণ’ লেখা আছে।

রকি তুই এখানে?

রকি চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, সরি আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারছি না...

আমি বিপ্লব। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম, গান করতাম!

বিপ্লব! একসঙ্গে পড়তাম!...

রকি তখনো আমতা আমতা করছে। যেন আমি পূর্বজন্মের কোনো অচিনপুরের কথা বলছি।

মনে নেই তুই, আমি, রিংকু বিপাশা...আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম, গান করতাম?

বিপাশা নামটি শুনেই রকি ধাতস্থ হলো।

এ কী অবস্থা হয়েছে তোর! স্বাস্থ্য এত খারাপ হলো কী করে!

রকি চিনতে পেরে বলল, তুই বিপ্লব...মাই ফ্রেন্ড...

রকি ক্যাশ কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভাগ্যিস এ সময় আমি ছাড়া আর কোনো কাস্টমার নেই।

এ কী অবস্থা হয়েছে তোর! এখানে কেমন করে? আমি তো ভেবেছি তুই ইউরোপের কোথাও থাকিস।

আর বলিস না, সবই আমার দুর্ভাগ্য। আদম ব্যাপারিরা প্রথমে মালয়েশিয়া নিয়ে এসেছিল। এখান থেকেই ইউরোপে যাওয়ার কথা ছিল, তারপর ওরা সব টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও। জীবন বাঁধা পড়ে গেল এখানে। পরে চেষ্টা করেছি মুভ করার, কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠে নি। তুই উঠেছিস কোথায়?

ওপাশের ম্যারিয়টে।

হোয়াটস এ সারপ্রাইজ!

সত্যিই সারপ্রাইজ! তোর সঙ্গে কুয়ালালামপুরে এভাবে দেখা হবে এটা আমি ভাবতেই পারি নি। আমার তো প্রায়ই এখানে আসা হয়। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে ড্রাইভ করেও চলে আসি। আমি জানতামই না তুই এদেশে থাকিস।

তুই কি সিঙ্গাপুরে থাকিস?

হ্যাঁ, ফ্যামিলি নিয়ে ওখানেই সেটেল্ড।

আমি দেশ ছাড়ার পর আর কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বিড়াল পার করার মতো আমাকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়েছিল বলে আমি আর ভাইদের সাথে যোগাযোগ রাখি না। আর ওদেরও নিজস্ব ফ্যামেলি হয়েছে। আমি কাউকে বদার করতে চাই না।

তোর ফ্যামেলি?

সে কথা হবে পরে। আমার ছুটি হবে সাতটায়। সন্ধ্যায় একটা ইনভাইটেশন ছিল, যাব না। আমার ব্যাগে কাপড় রাখা আছে। তোর ওখানে এসে চেঞ্জ করে নেব। তারপর ডিনার আর গল্প। তোর অন্য কোনো কাজ নেই তো?

আমার কাজ সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে একজনের সাথে বিজনেস ডিসকাশান।

ওকে, তুই হোটেলে গিয়ে রেস্ট কর, আমি কাজ শেষ করে আসছি।

আমি রুমে ফিরে রকির কথা ভাবতে লাগলাম। কী রকম একটা ব্রাইট ছেলে এখানে পড়ে আছে, স্বাস্থ্যের কী দুর্গতি হয়েছে! রকি ছিল যেমন লম্বা তেমনি চওড়া বুক, এথলেটিকেও বেশ নাম ছিল। আর মাথায় কী সুন্দর সিল্কি চুল ছিল। এখন দেখলে মনে হয় প্রাণবায়ু নিয়ে কোনোরকমে দেহটা টিকে আছে। ফ্যামেলির কথা বলতেই কেমন চুপসে গেল! আছে কোনো ছন্দপতন হয়তোবা। আমাদের ক্ষুদ্র এ জীবন কখন কোনো চোরাবালিতে আটকে যায় কেউ জানে না।

রকি এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। ফ্রুটস বাস্কেট থেকে রকিকে আপেল কেটে দিলাম। দাঁতের সমস্যার কারণে রকি আপেল খেতে পারে না, সোফায় আরাম করে বসে আঙুর খেতে লাগল। আমি ফ্রিজ থেকে বিয়ার বের করে দিলাম। রকি খুশি হলো, তারপর পুরোনো গল্প জুড়ে দিলাম।

রকি নিজেই ওর কথা বলতে শুরু করল, আদম ব্যাপারিরা যখন ডলার পাসপোর্ট নিয়ে ওকে ফেলে চলে গেল তখন সুতীব্র অভিমানে রকি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কুয়ালালামপুরে শুরু করে নতুন জীবন। কম বয়সী পরিকল্পনাহীন রঙিন জীবন। একটা বারে কাজ শুরু করার পর নাইট লাইফে আসক্ত হয়ে পড়ে। রকি হয়ে যায় পপুলার বারটেন্ডার। কখনো জিন-ককটেলের পাইট বানাচ্ছে, কখনো ডিজে হয়ে মিউজিক বাজাচ্ছে, আবার কখনো উদ্যাম নাচে ক্লায়েন্টদের আনন্দ দিচ্ছে। এভাবে রকি হয়ে গেল কুয়ালালামপুরের পপুলার বার ম্যানেজার। মালে, চাইনিজ, আর জাপানিজ ভাষা শিখে নিয়ে রকি একবারে আনবিটেবল। সে যে বারে ম্যানেজার হয়ে জয়েন করে সেখানেই বিজনেস জমজমাট।

রকির আরনিংও খুব ভালো ছিল। বেতনের বাইরেও প্রচুর টিপস পেত। পকেটভর্তি থাকত ডলারে। কিন্তু খরচের ব্যাপারে রকি ছিল বেশ দরাজ। যা পেত তা-ই খরচ করে ফেলত। নাইটলাইফে রকি যখন পপুলারের তুঙ্গে, তখন এক ইন্দোনেশিয়ার জাভানিজ এক মেয়ের সঙ্গে রকির প্রেম হয়। মেয়েটা মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিল।

আমি বললাম, জাভানিজ মেয়েরা তো খুব সুন্দরী হয়!

হ্যাঁ মেয়েটা একদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমাদের বারে এল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি চমকে গেলাম।

কেন?

মেয়েটি দেখতে বিপাশার কার্বন কপি। বিপাশার মতোই চোখ, চুল, মুখের গড়ন। আর আশ্চর্য ব্যাপার হলো ওর নামও বিপাশা।

তাই নাকি! ও গড! খুবই স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার! ইন্দোনেশিয়ানদের এ রকম নাম হয়?

জাভানিজ মেয়েদের এরকম নাম হয়, সংস্কৃত ঘেঁষা নাম। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্ট্রেঞ্জ ঘটনা। আমি কিছুতেই বিপাশার মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। আমি গিটার হাতে নিয়ে স্টেজে বসে গাইলাম—

আভি না যাও ছোড় কার

কে দিল আভি ভরা নাহি

কী বলিস! হাউ রোমান্টিক! এ তো দেখি হিন্দি মুভি।

মুভির চেয়েও বেশি কিছু। উই ফল ইন লাভ।

বাহ কেয়া বাত! চিয়ার্স মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড।

ইন্দোনেশিয়ানরা হিন্দি গান খুব পছন্দ করে। বিপাশা প্রায়ই প্রতিদিনই চলে আসত। অবস্থা এমন দাঁড়াল, আমরা কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারি না।

হাউ সুইট!

বিপাশার গ্রাজুয়েশনের পর আমরা বিয়ে করলাম, সংসার সাজালাম। বছর ঘুরতেই ফুটফুটে এক মেয়ে হলো। নাম রাখলাম প্রিয়াঙ্কা।

ওয়ান্ডারফুল!

মেয়ের বয়স যখন দেড় বছর তখন বিপাশার ক্যানসার ধরা পড়ল।

হোয়াট!

হ্যাঁ লিভার ক্যানসার। ট্রিটমেন্ট শুরু করলাম। কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার ব্যাক করল। আমি আমার শাশুড়িকে নিয়ে এলাম, ওদের টেক কেয়ার করার জন্যে। জলের মতো টাকা খরচ হতে লাগল। আমিও গিভ আপ করি নি। দিন রাত কাজ করে ক্যামোর টাকা যোগাড় করি। প্রায় দেড় বছর চিকিৎসা চালিয়ে যাই। একদিন সকালে আর বিপাশার ঘুম ভাঙল না। আমার মেয়ে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, ড্যাড মাম্মি ইজ নট অয়েকিং আপ...

রকি কাঁদতে থাকে। আমি ওকে সান্ত্বনা দিই, টিসু পেপার এগিয়ে দিই। রকি একসময় শান্ত হয়।

তোর মেয়েটি এখন কোথায়?

ইন্দোনেশিয়ায় নানির কাছে থাকে। টেলিফোনে কথা হয়। আমি মাসে মাসে খরচ পাঠাই, আর বছরে একবার করে গিয়ে দেখে আসি। আই মিস দেম...রকির গলা ধরে আসে।

আমি ভারী পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলি, চল বাইরে যাই, আমরা কোথাও বসে ডিনার করি।

সেই ভালো চল।

হোটেলের বাইরে টুরিস্টদের ছড়াছড়ি। চারদিকে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। যেসব দেশে টুরিস্ট বেশি আসে সেসব দেশ যেন সব সময় এক উৎসবের নগরী। সবাই নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলায় ব্যস্ত। ‘জালান আলোর’ নামে একটা জায়গা সিফুডের জন্যে খুব বিখ্যাত, হোটেল থেকে পাঁচ মিনিট ওয়াকিং ডিসটেন্স। আমরা সেদিকে হাঁটতে থাকলাম।

জালান আলোর জায়গাটা বেশ লাইভলি। সন্ধ্যা নামতেই ডিনারের জন্যে ট্যুরিস্টরা ভিড় করেছে। প্রায় হাফ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে সারি সারি সিফুড রেস্টুরেন্ট। দু’একটা রেস্টুরেন্টে আবার লাইভ ফিস, কাঁকড়াও দেখা যাচ্ছে। ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছে সব রেস্টুরেন্টে খাবার অলমোস্ট একই রকম। আমরা ছিমছাম একটায় বসে অর্ডার করে দিলাম—স্টিম ফিস উইথ লেমন, কাংকং, ফ্রাইড রাইস, ব্রকলি। আর স্টাটারের জন্যে রকি অর্ডার করল মাটন সাথে উইথ বিয়ার। বিয়ার খেতে খেতে আমরা আবার গল্পে ফিরে গেলাম।

দেশে গিয়েছিলাম লাস্ট কবে। ১৫ বছর তো হবেই। বন্ধুবান্ধব কাউকেই খুঁজে পাই নি। সবাই প্রায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। রিঙ্কু ডাক্তার, ও আছে রাশিয়াতে। সাইদ আছে টক তে, আমান জার্মানিতে। তুই সিঙ্গাপুরে, সবাই ছড়িয়ে গেছে নানা দেশে। বিপাশা কেমন আছে?

আমি জানতাম একসময় বিপাশার প্রসঙ্গ আসবে। জীবনকে বিপাশা চিনেছিল একবারে প্রথম বেলায়। সে জানত যারা উচ্চাকাক্সক্ষী, সস্তা ইমোশন তাদের জন্যে নয়, এগুলো মানুষকে এগুতে দেয় না, টেনে ধরে রাখে এবং এক সময় পথে বসিয়ে দেয়। একসময় সস্তা ইমোশনের গড্ডালিকায় পড়ে মানুষ আর এগুতে পারে না। পথ হারিয়ে ফেলে। বিপাশা নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। আসলে সব মানুষের জীবনে ডেসটিনেশন ঠিক করাটা ভেরি ইম্পরট্যান্ট। লক্ষ্য স্থির না থাকলে মানুষ একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

বিপাশা মন্টিয়ালে সেটেল্ড। অধ্যাপনা করে, ওখানে পিএইচডি করতে গিয়ে আর ফেরে নি।

বিয়ে করেছে?

হ্যাঁ, এক হাঙ্গেরিয় অধ্যাপককে। ওর কলিগ।

তোর সঙ্গে তো মনে হয় ভালোই যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ, কথা হয় মাঝে মাঝে, ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বিপাশা কিছুদিন সিঙ্গাপুরে ছিল।

তুই খুবই লাকি।

লাকি কিনা জানি না আই অলওয়েজ ট্রাই টু বি কমিটেড উইথ মাই জব, পার্সোনাল লাইফ, ফ্রেন্ডস। এনিওয়ে, তোর স্বাস্থ্য এত খারাপ হলো কী করে?

তুই তো জানিস এখানে ক্যানসার চিকিৎসা আমাদের মতো ফরেনারদের জন্যে ভেরি এক্সপেন্সিভ। বিপাশার চিকিৎসার খরচ জোগাতে আমাকে দিন-রাত পরিশ্রম করতে হয়েছে, রাতে বারে কাজ করার পর আবার দিনে অন্য একটা কাজ করেছি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম গেছে। তখন আর স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া হয় নি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর। হাসপাতালে ছিলাম তিন মাস, ভেন্টিলেশন লাগানো হয়েছিল। সেই থেকেই এই অবস্থা।

তুই মনে হয় অনেক স্মোক করিস।

পুরোনো অভ্যাস, ছাড়তে পারছি না। ভাবছি ডিনার শেষে তোকে এখানকার নাইটলাইফ ঘুরিয়ে দেখাব। অনেকদিন যাওয়া হয় না। সেই কোভিদের পর বারের কাজ ছেড়ে দিয়েছি, শরীর আর রাতজাগা নিতে পারে না।

তাহলে আর যাওয়ার দরকার নেই, হোটেলেই আড্ডা দিই।

অনেকদিন যাই না, মনটা খুব টানছে। আমার এক বাঙালি বন্ধুর দুইটা বার আছে, আজ তোকে ওখানে নিয়ে যাব। ডান্স ফ্লোরে নাচবি।

আমি তো নাচতে জানি না, আজ তোর গান শুনব আর নাচ দেখব, টুডে রকি’স নাইট।

 

ডিনার শেষে আমি মানি চেঞ্জার থেকে বেশি করে ডলার ভাঙিয়ে নিলাম। আমি চাই না রকি কোনো টাকা খরচ করুক। ট্যাক্সি করে আমরা একটু ডাউন টাউনের দিকে গেলাম। ২০ মিনিটের ড্রাইভ। বারের নাম ‘দ্যা ভ্যালেন্টাইন’। থরে থরে লিকারে সাজানো বার কাউন্টার। একটা ছোট ডিজে বুথ তার সাথে ছোট একটা মঞ্চ। কাস্টমার তেমন নেই, একটা টেবিলে দুজন সাউথ ইন্ডিয়ান বসে আছে। রকি জানাল নাইট স্টিল ইয়াং—এ জন্যে এখনো জমে নি।

রকিকে দেখেই একদল মেয়ে ছুটে এল, এর মধ্যে তিনজন বাঙালি আর তিনজন মালে। বুঝা গেল এখানে সে প্রায়ই আসে এবং বেশ পপুলার। দুজন একসময় রকির কলিগ ছিল। সবাই এসে আমাদের সাথে হাত মেলাল, তারপর আমাদের সোফায় নিয়ে বসাল। আমার বিয়ার নেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মেয়েরা ইনসিস্ট করতে লাগল একটা ৭৫০ এমএলের জনি ওয়াকারের বোতল নেওয়ার জন্যে। রকিরও দেখলাম সেই মত। আমি বললাম, ঠিক হ্যায়, আজ রকির সম্মানে জনি ওয়াকার পার্টি।

আমি অবশ্য এ রকম পরিবেশে অভ্যস্ত নই। সিঙ্গাপুরের বার এবং রেস্টুরেন্টেরগুলোর পরিবেশ অন্যরকম। সেখানে আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতে গেলে ড্রিংকের অর্ডার দিই। ওয়েটার কিংবা ওয়েট্রেস বরফ, পানি, সোডা এসব দিয়ে যায়। এখানকার মতো গায়ে পড়ার কোনো ব্যাপার নেই। একটু পরে আসল ব্যাপারটা বুঝা গেল। ছ’জন মেয়েই রকির কাছে ঝোলাঝুলি করেছে ওদের ড্রিকস কিনে দেওয়ার জন্যে। তাহলে ওরা কিছু কমিশন পাবে। মেয়েগুলোর কোনো স্যালারি নেই। কাস্টমারদের কম্পেনি দিয়ে, তাদের সঙ্গে নেচে গেয়ে টিপস আর কমিশন যা পাওয়া যায় সেটাই ওদের ইনকাম। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় উইদাউট স্যালারিতে। আসলে এরা সবাই ইলিগেল ইমিগ্রেন্ট, মালিক সে সুযোগটাই নিচ্ছে।

মনটা খারাপ হলো, ইচ্ছের বিরুদ্ধে বসতে হলো। আমি উঠে গেলে রকির অপমান হবে সে কারণেই বসা। আমার পাশে যে মেয়েটি বসে পেগ বানিয়ে দিচ্ছে ওর নাম নীলা। নীলার ১০ বছরের একটি ছেলে আছে। বাড়ি যশোরে, হাসব্যান্ড ছেড়ে গেছে। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। নীলার ছেলেটাকে ওর মা দেখে।

রকির পাশে যে মেয়েটি বসে গল্প করছে তার নামে রূপা। তারও পারিবারিক কাহিনি অলমোস্ট একই রকম। সকলেই ভাগ্য বিড়ম্বিত। জেনেশুনে কে আর বিপদের পথে পা বাড়ায়? রূপা রকিকে খুব টেক-কেয়ার করছে। পেগের পর পর পেগ রকি মুহূর্তেই শেষ করে দিচ্ছে। একসময় রকি রূপাকে নিয়ে আদনান সামির গানের সাথে নাচতে শুরু করল।

এ জমি রুখ যায়ে, আসমা ঝুঁক যায়ে

তেরা চেহারা যাব নাজার আয়ে...

ডিজে রকির প্রিয় গানগুলো বাজিয়ে চলেছে আর রকি রূপার সঙ্গে নেচে চলেছে কখনো সহজিয়া ঢং, কখনো উদ্দাম ঝড়ের মতো, রূপার সঙ্গে ওর কেমেস্ট্রিটা মনে হয় অনেক দিনের। দেখলাম রূপা মাঝে মাঝে টিসু দিয়ে রকির চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে। আমাকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করল নাচার জন্যে, আমি নাচ জানি না বলে আর উঠলাম না। তবে রকির নাচ খুব এনজয় করলাম। একসময় যে সে পুরো বার কাঁপাত সেটা বুঝা গেল।

রকি অলমোস্ট ড্রাঙ্ক। ওর পা টলছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বিল চুকিয়ে দিলাম, উঠে পড়তে হবে। সকালে মিটিং। রকিকেও সকাল সাতটায় উঠে কাজে যেতে হবে। কিন্তু রকি এখানে আরও থাকতে চাইছে, আরও একটা ব্ল্যাক লেবেল নিতে চাইছে। এরকম পাগলামোর কোনো মানে হয় না। আমি জোর করে ওকে বাইরে নিয়ে এলাম। পাশের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে অমলেট আর পরোটার অর্ডার দিলাম, ক্ষুধা পেয়ে গেছে।

রকি জড়ানো কণ্ঠে বলছে, বন্ধু আই অ্যাম সরি, আমি তোকে কষ্ট দিচ্ছি।

না কষ্ট আমার হচ্ছে না, বাট আরও ড্রিঙ্ক করলে তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।

এই একটা জিনিসে কষ্ট বরং কমে বুঝলি! মাঝে মাঝে এসে মেয়েগুলিকে দেখে যাই। ওরা বড় দুঃখী, আমার মতোই দুঃখী, জীবনে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পায় নি। কেমন যেন একটা টান অনুভব করি মেয়েগুলির জন্যে। আমাদের একটা দেশ আছে সে দেশেও যেতে পারি না। কেনই-বা যাব? কী হবে গিয়ে? এখানে তবু কাজকর্ম কিছু একটা করে খাচ্ছি সবাই। দেশে গিয়ে করবটা কী! খাবটা কী! মা ছিল, সেও মরে গেছে কবে। এখন আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই। বিপাশা ছিল, আমি নিজেই তাকে পর করে দিয়েছি। এখন তার বুলগেরিয়ান হাসবেন্ড।

আমি সংশোধন করে দিই, বুলগেরিয়ান না হাঙ্গেরিয়ান। 

ওই শালা একই হলো, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে হাঙ্গেরিয়ান যা বুলগেরিয়ানও তা। আমি খুব জ্ঞানের কথা বলছি, তাই না বন্ধু? মদ খাওয়ার পর ব্রেনটা খুলে যায়, বুঝলি? পৃথিবীর সব জ্ঞানের কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। এই তো পরোটা এসে গেছে, খেয়ে নে। তারপর তোকে একটা ট্যাক্সি করে দেই তুই চলে যা, আমি আরও কিছুক্ষণ থাকব।

না একেবারেই না, আমরা একসাথেই হোটেলে ফিরব। ডাবল বেড আছে, তুই আমার সঙ্গেই ঘুমাবি। শরীরটা ঠিক রাখতে হবে, বাঁচতে হবে।

কার জন্যে বাঁচব, বেঁচে থাকার একটা প্রয়োজন থাকতে হয় বুঝলি। তোদের তো শালা মিনিংফুল জীবন, চকচকে জীবন। আর আমার? আমার তো কেউ নেই! নো বডি, না আদর করার না শাসন করার!

রকিকে সেদিন জোর করেই আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে খুব সকালে উঠে চলে গেল। রকির সঙ্গে সেটিই আমার শেষ দেখা হবে বুঝি নি।

একদিন সকালে রকির নাম্বার থেকে ফোন এল। ফোন করেছে সবুজ নামে রকির এক রুমমেট। রকি ঘুমের মধ্যে মারা গেছে, ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক করেছে। হাসপাতাল থেকে ডেড সার্টিফিকেট নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাদ মাগরিব ওকে ওখানেই সমাহিত করা হবে। বাংলাদেশে যোগাযোগ করে কারও কোনো রেসপন্স পাওয়া যায় নি। আর ডেডবডি দেশে পাঠানোও খুব খরচান্ত ব্যাপার। ছেলেটি বারবার বলছে আমি গেলে খুব ভালো হয়। রকি সব সময় ওদের কাছে আমার গল্প করত।

প্রতি ঘণ্টাতেই কুয়ালালামপুরে যাওয়ার ফ্লাইট কাছে। আমি সাড়ে ১১টার ফ্লাইটের টিকেট কিনে পাসপোর্ট নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলাম। ৫০ মিনিটের ফ্লাইট, আশা করি সময় মতো পৌঁছাতে পারব। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন শেষ করে একটা ক্যাব নিয়ে সিমেট্রির দিকে রওয়ানা হলাম। সবুজ আগেই আমাকে হোয়াটসআপে ঠিকানা পাঠিয়ে রেখেছিল।

সব মিলিয়ে রকির শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছে ১০ জন। এর মধ্যে ৭জন ওর রুমমেট। রূপা-নীলাও এসেছে। রূপা খুব কাঁদছে, নীলা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আরেকটি লোক আমাকে এড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। সম্ভবত ওই লোকটি বারের মালিক গোছের কেউ হবে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিলাম, সুখে দুঃখে রকির পাশে থাকার জন্যে।

সবুজ ছেলেটা কাছে এসে বলল, রকি ভাইয়ের সেভিংস তেমন ছিল না, মাস শেষ হবার আগেই টাকা ধার করতে হতো। কিছু কাপড় আছে সেগুলো আমরা সলভেশন আর্মিতে দিয়ে দিব। দুমাসের ভাড়া বাকি আছে, সেটা আমরা সবাই মিলে ক্লিয়ার করে দেব।

ভাড়াটা আমি দিতে চাইলাম। রকির রুমমেটদের কেউ রাজি হলো না। রকি ছিল ওদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সব সময় সবাইকে টেক কেয়ার করত, সবার আপদে বিপদে বুক পেতে সামনে এসে দাঁড়াত। রকির জন্যে ওদের একটা কর্তব্য আছে। সবুজ আমাকে জিজ্ঞেস করল, মোবাইলটা কী করব স্যার?

মোবাইলটা রূপার কাছে থাক।

রূপা আবার ডুকরে কেঁদে উঠল। রূপার কান্না দেখে সবার চোখ আবার অশ্রুসজল হয়ে উঠল।

সবুজ বলল, স্যার, এই ফটোফ্রেমটা আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি।

ফ্রেমটা হাতে নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি। রকির কোলে দুবছরের ফুটফুটে মেয়ে প্রিয়াঙ্কা আর পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে বিপাশা। প্রিয়াঙ্কা আর বিপাশাকে আমি কোনোদিন দেখি নি, তবু কেন যেন ওদের খুব আপন মনে হচ্ছে। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.