[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব।]
শম্পা এভাবে হঠাৎ ডুবে মরে যাবে ভাবতেই পারি নি। মিলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আব্বু এখন কী হবে? আমি কেন ওকে আমার সঙ্গে আনলাম?
আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আচ্ছা, আরেকটু খুঁজে দেখি। অন্তত বডিটাও যদি পাই! ওর বাড়িতে খবর দিতে হবে।
মিলি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ওর বাড়ি নিয়ে কখনো কথা হয় নি। আমি জানি না ও কোথায় থাকে।
সত্যি বলতে কী, আমার এখন নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে শম্পার সঙ্গে সঙ্গে আমার গোপন অপরাধও জলে ডুবে গেল। আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে পারব। সে জীবনে থাকবে না কোনো লুকোছাপা আর পাপবোধ। কিন্তু মেয়েটার জন্য মনের কোণে কোথায় একটা বেদনাও অনুভব করছি। বুঝলাম না কেন করছি। রোকসানা আমার হাত ধরে বলল, জাহিদ, প্লিজ একটু ভালো করে খুঁজে দেখো না। কী থেকে কী হয়ে গেল, আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
আচ্ছা, দেখছি।
আমি সৈকত ধরে আনমনে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু ঠেকতেই চমকে উঠলাম। শম্পার লাল রঙের হেডব্যান্ডটা বালুতে অর্ধেক গেঁথে আছে। ভেজা বালু থেকে দ্রুত হেডব্যান্ডটা উঠিয়ে নিলাম। যেই ভাবলাম এটা নিশ্চয় স্রোতের তোড়ে ভেসে এসেছে ঠিক তখনই এক শ’ গজ দূরে দৃষ্টি আটকে গেল। শম্পার নিথর দেহটা সটান হয়ে বালুতে পড়ে আছে। যে-কোনো মুহূর্তে প্রবল টান এসে ওকে আবার সাগরে ভাসিয়ে নেবে। আমি দৌড়ে শম্পার কাছে গেলাম। বেঁচে আছে কি-না নিশ্চিত হওয়ার জন্য আস্তে করে ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, শম্পা, শম্পা…।
শম্পা কোনো সাড়া দিল না। এবার নাকের কাছে হাত নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ও শ্বাস নিচ্ছে কি-না। কিছুই বোঝা গেল না। পালস চেক করে দেখলাম ক্ষীণ স্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এখন কোনো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না, দ্রুত আর্টিফিশিয়াল রেস্পিরেশন আরম্ভ করতে হবে।
আমি শম্পার মাথাটা হালকা করে উঠালাম যেন শ্বাসনালি বাধামুক্ত হয়। তারপরে ওর ঠোঁটে আমার ঠোঁট এমনভাবে চেপে বসালাম যেন আশপাশে দিয়ে বাতাস না ঢোকে। তারপর আস্তে আস্তে ফুঁ দিয়ে ওর ফুসফুসে বাতাস ভরার চেষ্টা করলাম।
প্রতিবার ফুঁ দেওয়ার সময় ওর বুক ফুলে উঠল, অপেক্ষা করলাম বুক আবার নেমে যাওয়ার জন্য। এভাবে পাঁচবার কৃত্রিম শ্বাস দিলাম। এরপর ওর বুকের মাঝে প্রায় ত্রিশ বার হাত দিয়ে চাপ দিলাম। সিপিআর শেষে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আগের মতো ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠালাম। আবার বুকে চাপ দিতে যাব এমন সময় শম্পা চোখ খুলল। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, আপনি ঠিক আছেন? নিঃশ্বাস নিতে পারছেন এখন?
শম্পা ফিসফিস করে বলল, চান্দু আর গোবিন্দলাল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? গোবিন্দলাল কে?
শম্পা এবার বলল, গোবিন্দলাল রোহিণীকে বাঁচিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে। কৃষ্ণকান্তের উইল।
সেটা আমাকে বলছেন কেন?
রোহিণী জলে ডুবে গিয়েছিল আর গোবিন্দ এভাবে চুমু দিয়ে রোহিণীকে বাঁচিয়েছিল, হি হি হি।
কী বলছেন আপনি এসব?
গোবিন্দলাল তখন সেই ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া-রোহিণীর মুখে ফুঁৎকার দিলেন।
এটা কার কথা? বঙ্কিমের, তাই না?
হ্যাঁ, চান্দু।
তার মানে আপনি অজ্ঞান হওয়ার ভান করছিলেন এতক্ষণ?
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের ওই অংশটা রিক্রিয়েট করলাম।
শম্পা বলছে, তুমি কয়দিন আগে ফার্স্ট এইড ট্রেনিং নিছো, তাই ঝালায়া দেখলাম। ভালো হইছে না চান্দু?
কী ভালো হয়েছে?
ওই যে, তুমি আমাকে কোনো গিলটি ফিলিং ছাড়া ইচ্ছেমতো চুমু দিতে পারলা? যাকগে, এখন আমাকে আস্তে করে ধরে উঠাও তো রসগোল্লা। দ্যাখো ওইখানে, আপু আসতেছে।
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম রোকসানা আর মিলি এদিকে আসছে। এখন আমি রেগে উঠলে আরও সন্দেহ তৈরি হবে। ওকে হাত ধরে আস্তে করে টেনে উঠালাম। শম্পা এলোমেলো চরণে যেন কোনোরকমে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে রোকসানার কাছে গেল। তারপর রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, আপু গো, আমি জলে ডুবে মরে যাচ্ছিলাম গো আপু! চান্দু ভাইয়া আমার শ্বাস ফিরায় আনল।
রোকসানা ইমোশনাল মানুষ, সেও দেখি শম্পাকে বুকে টেনে কেঁদেকেটে জগৎ ভাসাচ্ছে। মিলির চোখও সামান্য ঝাপসা। শুধু আমি ভাবছি সামনে না জানি কোন বিপদ অপেক্ষা করছে! এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কক্সবাজার থেকে চলে যেতে পারলে ভালো। কিন্তু রিটার্ন টিকেট তো আগে থেকে কাটা নেই। কী যে করি!
সেই রাতে সবাই ক্লান্তিতে আগেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব ভোরবেলা অন্যরা ওঠার আগেই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। মারমেইড বীচ রিসোর্টের বাইরে একটা মুদির দোকান খোলা ছিল। ওখান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কিনলাম। ধীর পায়ে সমুদ্রের তীরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। শুধু প্রচণ্ড টেনশনে থাকলেই আমি সিগারেট টানি।
ভোরবেলা ভেজা বালুর ওপর কাঁকড়া আর তারামাছের শরীরের ছাপ নক্সার মতো ছড়িয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে ভাবলাম, শম্পা মাসে মাসে দশ হাজার টাকা নিয়ে খুশি থাকলে কক্সবাজারে নাটক করতে আসত না। ওর আরও কোনো জটিল পরিকল্পনা আছে। এই ফাজলামোর সঙ্গে ও এখন আমার মেয়েটাকেও জড়িয়ে ফেলেছে। একটা কিছু ফাঁস হলে শুধু রোকসানাই আহত হবে না, মিলিও আমাকে ওর বাবা পরিচয় দিতে অস্বস্তি বোধ করবে। আমি কি কাল রাতে একটা ভুল করে ফেললাম? ও যখন অজ্ঞান হওয়ার ভান করেছিল তখন যদি কোনো রকম দম আটকে ওকে পানিতে ভাসিয়ে দিতাম তাহলেই কি ভালো ছিল?
কিন্তু তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হতো? এখন তো মনে হচ্ছে ও কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের অংশ। হয়তো আমার মতো অনেকের পেছনেই ওরা এ রকম ধুরন্ধর মেয়েদের লেলিয়ে দিয়েছে। ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে হয়তো আমাকেও আমার যৌবনকালের রূপে ফিরে যেতে হবে। আর বেশি কিছু ভাবতে পারলাম না, হঠাৎ শম্পার কণ্ঠে পেছন ফিরে তাকালাম, চান্দু তুমি উঠে গেছ? দাও দেখি একটা টান দিই।
কিছু বোঝার আগেই শম্পা আমার হাত থেকে সিগারেট টেনে নিয়ে জোরে একটা টান দিল, তারপর নাক দিয়ে জেট ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, কক্সবাজার ট্রিপে খুব ফান হচ্ছে প্রফেসর, কী বলো? কাল তো সিপিআর দেওয়ার নাম করে আমার সঙ্গে যা করলা। এখনো বুক ব্যথা করছে।
এই ভোর সকালেই শম্পা আমার মেজাজ খিচড়ে দিল। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, এক সন্ধ্যায় কী ঘটেছিল সেটা নিয়ে আর কত ঘিরিঙ্গি করবে বলো তো?
ওমা, প্রফেসর, খোলস ছেড়েছ দেখি? আমাকে তুমি করে বলছ, এতদিন তাইলে আপনি আপনি করলা কেন ভণ্ড কোথাকার?
কী চাও তুমি? প্লিজ স্টপ দিস।
‘ইছামতি’ উপন্যাস পড়েছ বিভূতিভূষণের?
না, কেন?
ওখানে নিলু, বিলু আর তিলু আছে।
নিলু, বিলু, তিলু?
হ্যাঁ প্রফেসর, ওরা ভবানী বাড়ুয্যের বউ। এক লোকের তিন বউ, কিন্তু সংসারে কোনো ঝগড়াঝাটি নাই। শুধু শান্তি আর শান্তি।
তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
আমারও কিন্তু আপুর সঙ্গে অনেক খাতির জমে গেছে।
তো?
উফ, নিজে বুঝে নাও না প্লিজ। আর বেশি বলতে আমার নতুন বউয়ের মতো শরমিন্দা লাগছে, হি হি হি।
শম্পা সিগারেটের ফিল্টারটা আমার হাতে দিয়ে রিসোর্টে ফিরে গেল। শম্পার কথায় আমি আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শম্পা কি আমাকে বিয়ে করতে চাইছে? আমি চিন্তিত মুখে রিসোর্টে ফিরে গেলাম।
সকালে নাস্তার পর আমরা শহরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। রোকসানা আমার কাছে এসে বলল, একটা কথা বলি?
কী কথা?
পৃথিবীতে আল্লাহ তো সবাইকে সমান করে পাঠান নাই। আবার অনেকে সমান হওয়ার পরেও কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে জীবনে অনেক পিছিয়ে যায়।
আমি রোকসানার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালাম, রোকসানা ইতস্তত করে বলল, শম্পা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকে, জানো তো?
না, আমি কীভাবে জানব?
ওর বাবা-মা সেই ছোটবেলায় মারা গেছে। ভাই একটা আছে কিন্তু বখাটে। শম্পার সঙ্গে যোগাযোগ নাই। শম্পা এই কাজ সেই কাজ করে কোনোরকমে নিজের খরচ জোগায়।
বুঝলাম, এখন আমরা কী করতে পারি?
না, বলছিলাম যে আমাদের গেস্ট বেড তো সারা বছর ফাঁকাই পড়ে থাকে।
তো?
ওখানে শম্পা থাকতে পারে না? তাহলে ওর থাকা খাওয়ার খরচ বেঁচে যেত। খুব কষ্ট মেয়েটার!
রোকসানার কথায় আমি আঁতকে উঠলাম। রোকসানা নিজেই খাল কেটে কুমির আনতে যাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে ওকে মানা করি?
(চলবে…)
উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন...
 
									 
								 
								 
							 
																
															 
																 
																 
																 
																 
														 
														 
														 
														 
														
Leave a Reply
Your identity will not be published.