অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ ড. আহমদ শরীফকে নিয়ে রচনা-
প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও গবেষক আহমদ শরীফ। অনন্যসাধারণ শিক্ষাবিদ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব একমাত্র তারই। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্বন্ধেও তিনি অনুসন্ধিৎসুু ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। এখানে তুলে ধরা হলো বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা গবেষক ও লেখক আহমদ শরীফ-এর জীবন ও জন্মভূমির কথা।
এবার আমাদের গন্তব্য পটিয়া। চট্টগ্রাম থেকে বহদ্দারহাট এসে আমরা সওয়ার হলাম পটিয়ার গাড়িতে। তবে এ কথা আগেই বলে রাখি, পটিয়া সদর কিন্তু আমাদের গন্তব্য নয়। গন্তব্য একটি গ্রাম। যে গ্রামে যাবার জন্য পটিয়ার গাড়িতে আমরা মিয়ার বাজার নামে একটি বাজারে এসে নামলাম। আলোকচিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ সরকার ও আমি ততদিনে অনেক বাস্তবতাকে রপ্ত করে ফেলেছি। গ্রামের দিকে গেলে দূরত্বের যেমন সঠিক হিসাব মেলে না তেমনি পথের যে সন্ধান তা সবটা কাজে দেয় না।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমরা বিশেষ যে সঙ্কটে পড়েছিলাম তার নাম ভাষা-সঙ্কট। চট্টগ্রামের মফস্বলের ভাষা শহর থেকে আরও বেশি দুর্বোধ্য বলে আমার বিশ্বাস। বাস্তবে সাধারণ মানুষের সরলতা এবং সহযোগিতায় আমাদের কোনো কাজই ঠেকে থাকে নি।
আমরা ইস্টিশন থেকে রিকশা নিয়ে রওয়ানা হলাম সুচক্রদণ্ডী গ্রামের পথে। উদ্দেশ্য প্রয়াত দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পথিকৃৎ আহমদ শরীফের বাড়িতে যাওয়া।
বাংলাদেশের জ্ঞানবিদ্যার জগতে আহমদ শরীফ এক মহীরুহ, এক অনন্যসাধারণ শিক্ষক ও অনুপম ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি শরীফের গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের প্রধান এলাকা হলেও তিনি ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি মানববিদ্যার বিচিত্র শৃঙ্খলা সম্বন্ধে ছিলেন অনুসন্ধিৎসু এবং এসব বিষয়ে তিনি লিখেছেন একাধিক আলোচনা-সমালোচনা ও প্রবন্ধ এবং সেগুলোর কোনো কোনোটি গভীর দার্শনিক তত্ত্বসমৃদ্ধ। কোনো কোনোটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণঋদ্ধ।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই। যোগ্য সম্পাদনা করে ধূসর বিবর্ণপ্রায় বাংলা পুঁথিগুলোকে জীবন্তরূপ দান করে এবং সেগুলোকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ধারায় বিশ্লেষণ ও বিন্যস্ত করা তাঁর অতুলনীয় কীর্তি। তবে শুধু ইতিহাসের অতীতে নয় প্রতিদিনের চলমান জীবন সম্বন্ধেও আহমদ শরীফ ছিলেন দারুণ কৌতূহলী।
তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন মানুষের হালচাল, জীবনযাত্রা, আর্থিক অবস্থা, রাজনীতির ছবি, সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতা। এমন আরও কত প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ আছে যেসব তিনি লিখতেন তাঁর ক্ষুদ্র নিবন্ধে।
বলা বাহুল্য, আমাদের চিন্তার জগতে আহমদ শরীফের বেশ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। আর তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার কেন্দ্রীয় প্রণোদনা যে মানবমঙ্গল ছিল এ কথাও সবার জানা।
এ কারণেই সামাজিক অন্যায়, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কলম সব সময় ছিল শানিত, সবসময় তীক্ষèমুখ এবং বেজায় সাহসী। যুক্তিহীন, পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, অন্ধ প্রথাবদ্ধ ধ্যানধারণার তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তিনি বলতেন—মানুষের দুই পা, দুই হাত, দুই চোখ সামনের দিকে। সুতরাং অগ্রযাত্রাই মানুষের জন্যে স্বাভাবিক। প্রতিদিন সূর্যও একভাবে ওঠে না। পুরোনো নিয়ে থাকলে মানুষ এগুবে কী করে ? মানুষ বিকাশশীল প্রাণী, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষের পুরোনো ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের দুর্গ ভেঙে যাবে এবং এইভাবে মানুষ সভ্যতার পথে এগিয়ে যাবে।
বিশ্লেষণ আর সমীকরণ আহমদ শরীফের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে জন্যে তাঁর যে-কোনো রচনা তা সাহিত্যের ইতিহাস হোক বা সমকালীন দেশজ চালচিত্রই হোক সবই বীক্ষামূলক ও চিন্তার উদ্রেককারী।
আহমদ শরীফ মূলত তাঁর সময়ে তিনটি কালের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ব্রিটিশ আমলে তাঁর জন্ম ও শিক্ষাদীক্ষা এবং এই আমলেই তাঁর কর্মজীবনের সূত্রপাত। তাঁর কর্মজীবন সুব্যাপ্ত পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশকালে।
নির্মল আড্ডা ছিল তাঁর নেশা। মধ্যজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সভাসমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন তিনি এবং এই সম্পৃক্তি বাংলাদেশ আমলে নানা রাজনৈতিক-সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আরও সক্রিয় হয়। ফলে গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সচেতন বুদ্ধিজীবীর সামাজিক ভূমিকা মিলিয়ে আহমদ শরীফ ক্রমশ হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের এক আলোচিত ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান।
এই মহানব্যক্তিত্ব ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকাল নয়টা দশটার মধ্যে সূচক্রদণ্ডী গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম সিরাজ খাতুন। পারিবারিক বংশ লতিকা অনুযায়ী জনৈক হাবিলাশ মল্ল আহমদ শরীফের বংশের আদি পুরুষ। পরবর্তীকালে কাদির রাজা নামে এই বংশের এক উত্তর পুরুষ সুচক্রদণ্ডীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। আহমদ শরীফ কাদির রাজার ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর।
প্রখ্যাত পণ্ডিত ও পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ আহমদ শরীফের পিতৃব্য। শৈশবে অন্যসব মুসলমান ছেলেদের মতো আহমদ শরীফকেও আরবি পড়া, কোরান পাঠ, নামাজ শিক্ষা ইত্যাদি ধর্মীয় পাঠ ও কৃত্যাদি করতে হয়েছিল। তিনি স্থানীয় পটিয়া স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। তথাকথিত আহামরি ছাত্র তিনি কোনোকালেই ছিলেন না। নিতান্ত পুথিগত বিদ্যায়ও আবদ্ধ ছিলেন না তিনি। ছোটবেলায় তাঁর মধ্যে নানা কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা জেগেছিল। সেজন্য স্কুলে বিতর্ক সভায় ও সাহিত্য আলোচনায় তিনি সবসময় উৎসাহ পেতেন। স্বভাবগত গোঁ কোনো বিষয়ে তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উৎসাহকে সবল করত।
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ তখনো গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো ঘটনা তাঁর ছোটবেলাতেই ঘটেছিল। এই সংগ্রামের সময়ে তিনি স্কুলের ছাত্র। আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ ও ১৯৪২ সালে ডিস্টিংশনবিহীন বিএ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে এম এ পাশ করেন বাংলা দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে।
এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত সব পণ্ডিতদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৫ সালে তিনি লাকসামের পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়েজুন্নেসা কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে রেডিও পাকিস্তানে যোগ দেন ঢাকা কেন্দ্রের প্রোগ্রাম এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ১৯৫০ সালে ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর হিন্দু শিক্ষকরা ভারতে চলে গেলে মেধাবী শিক্ষকদের প্রয়োজন পড়ে। এসময়ে তিনি শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত হন।
আমৃত্যু ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তি নিয়ে তিনি খুব রসিকতা করতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও খুবই বৈচিত্র্যময়। স্বাধীনতার পরে বাকশাল রাজনীতির প্রবল প্রতাপকালে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন উপলক্ষে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়—তা ছিল খুবই আপত্তিকর। তাঁর মধ্যে তিনি, আহমদ কামাল, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সন্জীদা খাতুনসহ আরও দুজন শিক্ষক বাকশালে যোগ দেন নি।
আহমদ শরীফ মধ্যযুগ নিয়ে যে কাজ করেছেন তা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সে তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সঙ্গে কোনোমতেই শোভন আচরণ করে নি। আহমদ শরীফ মত প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন দুঃসাহসী। কোনো ভয় তাঁকে কোনোদিন পেয়ে বসে নি। তাঁকে মৌলবাদীরা ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করলেও তিনি তাঁর ক্ষেত্র ছেড়ে যান নি। মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্যে প্রতিটি ক্ষেত্রকেই রেখেছেন উন্মুক্ত। এবং প্রতিটি তরুণ—যারা মুক্তবুদ্ধি চর্চার পক্ষের তাদের জন্যে তিনি ছিলেন একটি আশ্রয়, একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৮-এর অক্টোবর-নভেম্বরে তাঁর বুকে বেজায় ঠান্ডা লাগে। এই অসুস্থতা সেরে উঠতে তিনি অনেক দুর্বল হয়ে যান। এ অবস্থায়ই ১৯৯৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিতে নিতেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আহমদ শরীফের গ্রামের বাড়িটি দূর থেকেই সবাই চেনেন। সেখানে এখনো তাঁর বাড়িঘর-বাস্তুভিটা রয়েছে, রয়েছে পথ-ঘাট-পুকুর। শুধু আহমদ শরীফ চলে গেছেন অনন্তের ঠিকানায়। এলাকায় তাঁর নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সড়ক গড়ে ওঠে নি। এলাকায় নতুন বিধায় পথে বহুজনের কাছে আমাদের কাজের হেতু বোঝাতে হয়েছে। নতুন লোক দেখে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েও থেকেছে অনেকে। এভাবেই রিকশায় উঠে পড়ি আমরা এবং অল্প সময়ের মধ্যে সবার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যাই।
[২০০৪ সালে অন্যদিন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত]
Leave a Reply
Your identity will not be published.