শতবর্ষ আগে (১৯২৪) নিষিদ্ধ হয়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুটি গ্রন্থ— ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’। সে সময় পুরো ভারতবর্ষে চলছিল ইংরেজ শাসন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন বণিক হিসেবে। সেই বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয় ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর। ভারতবাসী হয় পরাধীন। তাই নিজেদের উপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ইংরেজরা নানা ছলাকলার আশ্রয় নিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের আসন টলিয়ে দিতে না পারে, এজন্য এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পুঁতে দিয়েছিল বিভেদের বীজ। তৈরি করেছিল নানা ধরনের হীন আইন। আর বই ও লেখালেখিকে খুবই ভয় পেত ইংরেজ সরকার। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে মানুষ সচেতন হবে। তাদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই বই ও লেখালেখি নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা তৈরি করেছিল কয়েকটি আইন।
কী ছিল সেই আইন? সেডিশিয়াস পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ১৮৮২, নিউজপেপার অ্যাক্ট ১৯০৮, ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট ১৯১০, ইন্ডিয়ান প্রেস ইমার্জেন্সি পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৩০। যা’ হোক, ব্রিটিশ আমলে শুধু বাংলা নয়, সব প্রাদেশিক ভাষার গ্রন্থই শাসকদের রোষানল থেকে রেহাই পায় নি।
এবার আসা যাক নজরুলের গ্রন্থ দুটি প্রসঙ্গে। ‘বিষের বাঁশী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ সালের আগস্টে। প্রকাশক কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ‘কল্লোল’ সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। আর কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো, গ্রন্থটি নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র পরিবর্ধিত রূপ। ‘বিষের বাঁশী’র ভূমিকায় নজরুলই এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “...অগ্নিবীণা দ্বিতীয় খণ্ড’ নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেই সব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশী’ প্রকাশ করলাম। এ ‘বিষের বাঁশী’র বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।”
বইটি প্রকাশের পর সেই সময়ের অভিজাত পত্রিকা ‘প্রবাসী’ লিখেছিল ‘কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবণ ও ঝড়ে রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।’
‘প্রবাসী’র লেখায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে যে ‘বিষের বাঁশী’ কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয়। এতে সেই সময় পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার উপাদান ছিল। আর এ বিষয়টিই তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে—“লেখক ‘বিষের বাঁশী’র মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন।” এভাবে কয়েকবার চিঠি আদান-প্রদানের পর ‘বিষের বাঁশী’ নিষিদ্ধ করার আদেশ জারি হয়। তা ছাপাও হয় প্রজ্ঞাপন আকারে।
হ্যাঁ, নজরুল সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিষের বাঁশিই তো বাজিয়েছিলেন। ওই গ্রন্থটির বিভিন্ন কবিতার পঙ্ক্তিতেই তা মূর্ত হয়ে উঠেছে— ‘আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!’(অভিশাপ); ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর/ওই স্বরাজ রথের আগমনী শুনি চাকার শব্দে তোর।’(চরকার গান); ‘ঝড় কোথা? কই?.../বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই...’। (ঝড়)
এবার ‘ভাঙার গান’-এর প্রসঙ্গ। এটিও প্রকাশিত হয়েছিল ২০২৪ সালের আগস্টে। প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরি ও আর্য পাবলিশিং হাউস। ‘বিষের বাঁশী’ নিষিদ্ধের ১৯ দিন পর নিষিদ্ধ করা হয় ‘ভাঙার গান’কেও।
‘ভাঙার গান’ মূলত গানের বই। আর এখানে ঠাঁই পাওয়া গানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। এই গানটি হুগলি জেলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে অন্য বন্দিরাও গাইতেন (গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করায় ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের সঙ্গে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন দেশবন্ধুও। তখন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে এই গানটি লিখে দিয়েছিলেন নজরুল, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঙ্গালার কথা’য়।) উল্লেখ্য, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরও প্রিয় ছিল।
‘ভাঙার গান’ গ্রন্থেও রযেছে আগুনঝরা সব পঙ্ক্তি। ‘বাঙলার শের বাঙলার শির/বাঙলার বাণী বাঙলার বীর’, ‘দুঃশাসনের রক্ত চাই/ দুঃশাসনের রক্ত চাই/ অত্যাচারী সে দুঃশাসন/ চাই খুন তার চাই শাসন’, ‘আয় ভীম আয় হিংস বীর’...। তাই ব্রিটিশরা এই প্রন্থটিকে ভালো চোখে দেখে নি। ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘বিষের বাঁশী’র মতো ‘ভাঙার গান’কেও নিষিদ্ধ করেছিল।
Leave a Reply
Your identity will not be published.