সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১১)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১১)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন একাদশ পর্ব।] 

শুভ্র শহরের ধূসর প্রান্ত

গাড়ি ধীরেই চলছিল, সেটাও থেমে গেল। গাড়িতে থাকা সিকিউরিটি অফিসারের তাড়া, ‘নামো, নামতে হবে।’

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। সামনে নদী, সাভা ও দানিউবের মিলিত হওয়ার জায়গা। শীতের নির্মল আকাশের দেখা নেই। তীব্র কুয়াশাও নেই, নেই বৃষ্টির ঝাপটাও। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির রেশ থামল কিছুক্ষণ আগে। বেলগ্রেডে আসার পর থেকেই দেখছি মেঘের মন ভার। শীতের এই সময়েও মেঘ-বৃষ্টির এমন খেলা। দিনের অর্ধেক সময় রোদের দেখা মিলছে না। শীতের মাত্রা অবশ্য তীব্র।

গাড়ি থেকে নেমে আগের গাড়িতে থাকা সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিই, সামনে এগোই। ক্রিভোকে আবার পাই।

তার দুষ্টু ভরা ভ্রু নাচানি, ‘কী খবর?’

তার রোমান্টিক হাসি, তাও যদি হয় কেবল আমারই জন্য! স্বভাবতই মন ও হৃদয়ের বেসামাল অবস্থা। হাসি দিয়ে বোঝাই, ‘সব ভালোই চলছে।’

সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ডেলিগেট টিমের দেখভালের সমন্বয় করছে ক্রিভো। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, বয়সও কম; সম্পর্কটা সহজ হতে সময় লাগে নি।

মূলগেট পার হয়ে উপরের দিকে হাঁটতে থাকি। এত দূর এলাম, দুর্গের চূড়া না দেখে ফিরি কীভাবে?

বেলগ্রেডের কেন্দ্রে বেলগ্রেড দুর্গ বা ফোর্টরেস অব বেলগ্রেড, যা অতি পুরাতন। এ দুর্গেই গড়ে উঠেছে কালেমাগদান পার্ক। ঐতিহাসিক এই স্থাপনার অবস্থান বেলগ্রেডের স্টারি গ্রেড পৌরসভায়। সার্বীয় সংস্কৃতির স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বেলগ্রেড দুর্গ অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৯ সালে। সেই সময় থেকে দেখভালের দায়িত্বে সার্বিয়ান সরকার। এটি সার্বিয়ার দর্শনীয় স্পট। এ পর্যটনকেন্দ্রটি ভ্রমণ করা যায় টিকিট ছাড়াই, বিনামূল্যে। প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ দর্শনার্থী বেলগ্রেড দুর্গ ভ্রমণ করেন।

দুর্গ প্রান্তে আমাদের হাঁটাহাঁটি। সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত স্রদজান রিসটিচ। হাত উঁচু করে, ডানে-বাঁয়ে হেলেদুলে দুর্গের ইতিহাস বলছেন তিনি। আমরা দেখছি, শুনছি আর হাঁটছি। চকচকে সড়ক, যা এঁকেবেঁকে বেয়ে গেছে উপরের দিকে। আমরা হাঁটছি সেই পথে, সঙ্গে তৈরি হচ্ছে কল্পনার প্রেম মিথ। পেছনে আমি, বাঁ পাশে ক্রিভো। রোমান্টিক একটা ফিলিংস আসে। সেই কবে যে হেঁটেছিলাম, এমন রোমান্টিক মুডে, সব ব্যস্ততা ফেলে রেখে? মাথা নিচু করে হাঁটছে ক্রিভো, পায়ে পা মিলিয়ে। কিশোরকালের অনুভূতি আমার। সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া বা গ্রামের মেঠোপথে প্রাইভেট পড়ে ফেরার স্মৃতি! কত সুখের কাল ছিল!

বেলগ্রেড দুর্গটি পাহাড়ের চূড়ায়, যার উচ্চতা প্রায় ১২৫ দশমিক পাঁচ মিটার। সড়কের পাশে খানিকটা মেঠোপথ। এরপর পাহাড়ের ঢালে আঁকাবাঁকা সড়ক, এই পথ বেয়ে ওপরের চূড়া। চূড়াপথ থেকে দেখা যায় পুরো বেলগ্রেড। শীতকালে নিম্নচাপ, এর ওপর খানিকক্ষণ আগে হয়ে গেল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। দর্শনার্থীদের সংখ্যাও তাই কম। হাতেগোনা কয়েক জন। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। নিস্তব্ধতা ভাঙতে কয়েকটি পাখির ওড়াউড়ি। শীতকালে পাখি ওড়ে নাকি?

পুরো বেলগ্রেড দুর্গটি চারটি ভাগে বিভক্ত। ডনজি আর গরনজি গ্র্যাড নিয়ে দুর্গ। আর অপর দুটি ভাগ নিয়ে বর্তমানে কালেমাগদান পার্ক তৈরি হয়েছে। ডনজি হলো বেলগ্রেড দুর্গের আপার টাউন আর গরনজি লোয়ার টাউন। দুর্গের মূল বসতিগুলো অবস্থিত এসব এলাকায়। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে বেলগ্রেডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালেমাগদান পার্ক।

একটা সময়ে বেলগ্রেড বলতে এই দুর্গকে বোঝানো হতো। পরে দুর্গকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে পুরো শহর। শুরুর দিকে কয়েক শতাব্দী ধরে লোকজন দুর্গের এলাকাতেই বাস করত। প্রাচীন বেলগ্রেডের অনন্য উদাহরণ এই বেলগ্রেড, যা টিকে আছে যুগ যুগ ধরে।

ক্রিভো মজা করে বলে, ‘হাঙ্গেরিয়ান রাজা বেলা-১ তার ছেলেকে বিয়ে দেন সার্বিয়ান রাজকন্যা জেলেনার সঙ্গে। বিয়ের পর উপহার হিসেবে তার ছেলেকে দুর্গটি দিয়েছিলেন।’

‘আমাদের দেশে উপহার হিসেবে ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি আরও কত কী দেওয়া হয়। রাজা-বাদশার আমলে দেওয়া হতো রাজ্য উপহার। উপহারের এই চল সব আমলেই ছিল বুঝি!’

ক্রিভোর সঙ্গে যোগ করি আমি।

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে এই দুর্গের গোড়াপত্তন। সে সময় এর নাম ছিল সিঙ্গিদুনাম। থ্রেসিয়ান ও ডেসিয়ান উপজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্কোরডিস্কির সেলটিক উপজাতি। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্কোরডিস্কির সেলটিক উপজাতি এখানে বসতি গাড়ে। দুর্গের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে। পরে সেলটিকদের কাছ থেকে রোমানরা জয় করে নেয় এ দুর্গ-শহর। এটি হয়ে ওঠে রোমানদের অন্যতম প্রধান সামরিক সীমানা। তবে মধ্য ইউরোপের আক্রমণের ভয় ছিল রোমানদের। রোমান সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে তারা পাহাড়চূড়ার এ দুর্গ-শহরে বিরাট সৈন্যদলের সমাবেশ ঘটায়। এখানে স্থাপন করে একটি সুরক্ষিত সৈন্য শিবির। কিন্তু পরের সময়গুলো সহজ ছিল না রোমানদের জন্য। ৩৭৮ সাল থেকে ৪৪১ সালের মধ্যে গোথ ও হুনদের বারবার আক্রমণে তাল হারিয়ে ফেলে রোমানরা। ধ্বংস হয়ে যায় রোমান সৈন্য শিবির। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ১৫৩৫ সালের দিকে পুনর্নির্মাণ করেন এ দুর্গটি। হুন সম্রাট আত্তিলার সমাধি রয়েছে দুর্গের নিচে।

বেলগ্রেডকে যে সাদা শহর বলা হয়, তারও মূলে রয়েছে এই দুর্গ। সার্বিয়ান ভাষায় বেলগ্রেডের নাম হলো বেওগ্রাদ। বেশির ভাগ স্লাভিক ভাষায় যার অর্থ হলো ‘সাদা শহর’ বা ‘সাদা দুর্গ’। সাদা শহর ও সাদা দুর্গ বলতে এখানে এই বেলগ্রেড দুর্গকেই বোঝানো হয়। বুলগেরিয়ানরা ৮৭৮ সালে প্রথমবারের মতো সাদা শহর বলে উল্লেখ করে এ দুর্গ-শহরটিকে। বহুবার এ দুর্গের দখল ও শাসনভার পরিবর্তন হয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। তিন শতাব্দীতে বুলগেরিয়া, তারপরে বাইজেন্টাইনরা এবং তারপরে আবার বুলগেরিয়ানরা। ১২ শতক পর্যন্ত এটি ছিল বাইজেন্টাইনদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি।

সময়ের সঙ্গে পালটাতে থাকে দুর্গে পতাকা ওড়ানোর ইতিহাস। কসোভোর যুদ্ধের ১৩২ বছর পরে সার্বিয়ান রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখলে নেয় তুর্কিরা। ১৫২১ সালে তারা এ দুর্গটিও জয় করে নেয়। তুর্কিদের রাজত্ব থাকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৭ শতকে গ্রেট সার্বিয়ান মাইগ্রেশনের সাক্ষী এ দুর্গ। ১৯ শতকে তুর্কি আমলে দুটি সার্বিয়ান বিদ্রোহও ঘটে যায় বেলগ্রেড দুর্গকে সাক্ষী রেখেই। পরে এসে উদীয়মান সার্বিয়ার হাতে পড়ে।

ভূমি থেকে ওপরে উঠছি। পাহাড়ের রাস্তার মতো খাড়া। হাঁটতে হাঁটতে আঁসফাঁস লাগে। টিমের বয়স্ক সদস্যদের কেউ কেউ হাঁটা পথে ক্ষান্ত দিয়েছেন, রাস্তার পাশে রাখা বেঞ্চে বসে পড়েছেন। সামনে আরও কিছু দূর যেতেই ক্রিভো হাত তুলে দেখাল সোনালি রঙের মূর্তি। এটি প্রভু যিশুর মা মেরির আইকন মূর্তি। এ দুর্গেই রয়েছে ‘গির্জা অব দ্য ডর্মেশন অব দ্য মোস্ট হোলি মাদার অব গড’, যেটি ক্যাথেড্রাল চার্চ হিসেবেও পরিচিত।

১২ শতকে বাইজেন্টাইন শাসনের সময় নির্মিত হয় এ চার্চ। বাইজেন্টাইন রাজকুমারী ও সার্বিয়ান রানী সিমোনিদা ১৩১৫ সালে, বেলগ্রেডে থাকার সময়, এ মূর্তির পূজা করতেন। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানাল ক্রিভো, তাদের ধর্মীয় রীতি। 

চার্চের সামনেই দেখা মেলে বয়োবৃদ্ধ এক জুটির। সঙ্গে বেবি ট্রলিতে তাঁদের আদুরে নাতি। চার্চের সামনে তাঁরা জিরোচ্ছেন। সত্তরোর্ধ্ব লোকটির সঙ্গে তার স্ত্রীর বয়স ষাটোর্ধ্ব। বৃষ্টিশীতল এই সময়েও তাঁরা ঘুরতে বের হয়েছেন। তাঁদের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখে হাত তুলে হ্যালো বললেন বয়স্ক নারী, মুখে মিষ্টি হাসি। এগিয়ে গিয়ে আমিও হাই বলি। পরিচিত হই। পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন, থাকেন নিশো শহরে। ছেলে আর ছেলের বউ অন্যদিকে ঘুরছে, তারা নাতিকে নিয়ে এদিকটাতে। 

বর্তমানে বেলগ্রেড দুর্গ সার্বিয়ার অন্যতম প্রধান একটি প্রতœসম্পদ। এর শৈল্পিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ১৯টি স্মারক মূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে, যাঁরা সার্বিয়ান ইতিহাস, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। গবেষক-শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হন রোমান কাস্ট্রাম, প্রধান প্রহরীদের ভবন, ছয়টি স্মৃতি স্তম্ভস্মারকে। এখানে রয়েছে দুটি জাদুঘর ও দুটি প্রদর্শনী গ্যালারি। তুর্কি শাসনের চিহ্ন হয়ে রয়েছে মেহমেত পাশার সমাধিসৌধ। ভ্রমণপিয়াসী দর্শনার্থীদের জন্য বর্তমানে এখানে তৈরি হয়েছে চারটি রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ।

বৃদ্ধ পরিবারের সঙ্গে কথা শেষ করি। তাকিয়ে দেখি, আর সবাই তখনো ওদিকে হাঁটছে। পাশে দাঁড়িয়ে ক্রিভো।

‘চলো ওদিকে।’

ক্রিভোকে ইশারা করি। ক্রিভো আমার হাত ধরে টান দেয়, ‘ওদিকে নয়, এদিকে চলো।’

একটু দৌড়ের মতো করেই চলে আসি কফিশপে। দুটো কফির অর্ডার দেয়।

বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ার দাবিই যেন রোমান্টিসিজমের ধোঁয়া ওঠা কফি!

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.