সিরাজগঞ্জের অগ্নিসন্তান ইসমাইল হোসেন শিরাজী

সিরাজগঞ্জের অগ্নিসন্তান  ইসমাইল হোসেন শিরাজী

[কবি, ঔপন্যাসিক ও রাজনীতিবিদ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। মুসলমানদের নবজাগরণ ও দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য। এ কারণে জাতীয় জাগরণমূলক কাব্য সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত এবং নজরুল ইসলামের পূর্বসূরি। মুসলমানদের অন্ধকার কালে তাঁর কাব্য এবং অনলবর্ষী বক্তৃতা মুসলিম জাতিকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছে তেমনি আলোর পথ দেখিয়েছে।]

এদেশের পথে পথে মানিক-রতন ছড়ানো। সেই পথের টানে আবার আমরা পথে। আবার আলোকিত মানুষের সন্ধানে আগুয়ান।

এবারের যাত্রায় আমরা প্রথমে যাব সিরাজগঞ্জে। বলাই বাহুল্য, এই পর্যায়ে শুরুতেই আমাদের পা পড়বে বাণীকুঞ্জে—যেখানে জন্মেছিলেন সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন শিরাজী।

মহাখালী বাসস্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জগামী বাসে চড়লাম। আমি ও অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকার। মিরপুর, সাভার, গাজীপুর, টাঙ্গাইল পেরিয়ে এক সময় বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর মাধ্যমে আমরা উত্তরবঙ্গের মাটিতে পা রাখলাম। তারপর আরও কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে গেলাম সিরাজগঞ্জে। অতঃপর সিরাজগঞ্জ শহরে।

বগুড়া বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামলাম আমরা। একটি রিকশায় উঠলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বাড়ি বাণীকুঞ্জে যেতে।

রিকশা এগিয়ে চলেছে। এক সময় দেখা গেল, সামনে সুউচ্চ অট্টালিকা—মুক্তা প্লাজা তথা হোটেল অনীক। তার আগে বামদিকে একটি ছোট গলি। এই গলি ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরে বাণীকুঞ্জে পৌছে গেলাম।

বাণীকুঞ্জ একতলা একটি বাড়ি। পুরোনো আমলের কয়েকটি ঘর। চুন-শুরকির প্রলেপ দেয়ালে। কোথাও কোথাও সেই প্রলেপ খসে পড়েছে। বাড়িটির সামনে খোলা জায়গা। চারদিকে নানা ধরনের গাছ—নারকেল, নিম, আম ইত্যাদি। বাড়িটির সম্মুখেই একটি আমগাছ। এর নিচের অংশটি বাঁধানো। বামদিকে একটি পাঠাগার—যা ইসমাইল হোসেন শিরাজীর নাম বহন করছে। খোলা জায়গার ডান দিকে এক গম্বুজের একটি ছোট দালান—ভেতরে সিরাজী ও তার স্ত্রীর কবর। বাইরে আরও দুটি কবর—শিরাজীর দুই ছেলে-মেয়ের।

আমাদের মনে পড়ে যায় যে, ইসমাইল হোসেন শিরাজীর পিতা আবদুল করিম খোন্দকার—যার পেশা ছিল ইউনানী চিকিৎসা, এ উপলক্ষে তিনি ভাগ্যসন্ধানে সিরাজগঞ্জে আসেন। এখানে পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর বাবুখানের প্রথম কন্যা মুসাম্মৎ নূরজাহান খানমের সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং তিনি সিরাজগঞ্জের এই বাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) বসবাস করতে থাকেন। এখানেই ১৫ জুলাই ১৮৭৯ সালে (মতান্তরে ১৮৭৯ সালের ৫ আগস্ট বা ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই) ইসমাইল হোসেন শিরাজীর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার প্রথম সন্তান।... এখন যে এই বাড়ির নাম ‘বাণীকুঞ্জ’—এই নামটি রাখেন শিরাজী স্বয়ং।

আমাদের মনে পড়ে যায় যে, নিজের নামের ক্ষেত্রেও শিরাজী হস্তক্ষেপ করেছেন। সাহিত্যিক নামের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা পারিবারিক নাম অনুসরণ করেন নি; সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রয়োজনেও হরেক রকম পরিবর্তন করেছেন নামে। মুনশী এসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ এসমাইল হোসেন সিরাজীসহ সতেরো রকম নামের উল্লেখ লক্ষ করা গেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে তিনি নামের সঙ্গে সৈয়দ, সিরাজী ব্যবহার শুরু করেন। যদিও সিরাজগঞ্জে বিএল হাই স্কুল রেকর্ডে তার নাম লিখিত রয়েছে—মোহাম্মদ এসমাইল হোসেন।

বাণীকুঞ্জের মূল বাড়ির দরজায় আমরা করাঘাত করি। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে আসে এক কিশোর।

কী ব্যাপার ? আপনারা কারা ?

আমরা পত্রিকার লোক। ঢাকা থেকে এসেছি।

কোন পত্রিকা ? নাম কী ?

পাক্ষিক অন্যদিন। তোমার নাম কী ?

মিতুন শিরাজী।

সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী তোমার কে হন ?

তিনি আমার দাদার বাবা।

মিতুন শিরাজীর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে জানা যায় অনেক তথ্য। ১৯১০ সালে পাকশিয়া গ্রামের মুন্সী মোহাম্মদ আলা বখ্শ তালুকদারের কন্যা ওয়াজেদ নেছার সঙ্গে বিয়ে হয় ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (ওই তো দেখা যাচ্ছে এক গম্বুজের ছোট দালানের ভেতরে স্বামীর পাশেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, তিনি জন্মেছিলেন ১ জানুয়ারি ১৮৮৬ সালে আর মারা যান ১ এপ্রিল ১৯৫১ সালে)। দাম্পত্যজীবনে তারা তিন পুত্র-তিন কন্যার জনক-জননী হন। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সাহিত্যচর্চা ও রাজনীতিক্ষেত্রে বড় ছেলে সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা শিরাজী খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। আসাদউদ্দৌলার তিন ছেলে—মুইন শিরাজী, মনির শিরাজী, ও শামীম শিরাজী। শামীম শিরাজীই মিতুনের বাবা। মিতুনের বড় আরেক ভাই রয়েছে। নাম তার মারুফ শিরাজী। বয়স বিশ। মিতুনের কাছ থেকেই জানা গেল, মুইন শিরাজীর এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সাধক শিরাজী। বয়স পঁচিশ। মেয়ে শাম্মী শিরাজী। বয়স তেইশ। অন্যদিকে, মনির শিরাজীর রয়েছে আট বছরের এক ছেলে (উল্লাস শিরাজী) ও নয় বছরের এক মেয়ে (আনন্দী শিরাজী)। উল্লেখ্য, শামীম শিরাজী সাংবাদিক হিসেবে সিরাজগঞ্জ শহরে বেশ পরিচিত।

আমরা লক্ষ করলাম, ইসমাইল হোসেন শিরাজীর এক ছেলে সৈয়দ আশরাফউদ্দৌলা শিরাজী (মানিক) ও এক মেয়ে সৈয়দা শুলশান মহল শিরাজীর (লালা) কবরও রয়েছে বাণীকুঞ্জে।

এ সময়ে আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বই-খাতা হাতে এক বালক। নিশ্চয়ই সে স্কুলে যাচ্ছে। মনে পড়ে, এই বালকটির মতোই ১৮৮৫ সালে পাঁচ-ছয় বছর বয়সে ইসমাইল হোসেন শিরাজী বাণীকুঞ্জের কাছে সাহেবউদ্দীন পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হন। এর তিন বছর পরে তিনি ভর্তি হন জ্ঞানদায়িনী মাইনর স্কুলে। অতঃপর ১৮৯৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভর্তি হন বিএল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। এখানে প্রবেশিকা দ্বিতীয় শ্রেণিতে (নবম শ্রেণি) পড়ার সময়ই তাঁর ‘অনল প্রবাহ’ কাব্য প্রকাশিত হয়। তখন ১৯০০ সাল। তারপরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি শিরাজীর আগ্রহ কমে আসে এবং তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার এখানেই ইতি ঘটে। তবে বইপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল তীব্র। সাহিত্য, সমাজনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদির নানা বিষয়ে প্রচুর বই তিনি পড়েছেন। এবং সারাটা জীবনই মুসলিম সমাজের শিক্ষার প্রসারের জন্য কাজ করে গেছেন। নারীশিক্ষার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

বাণীকুঞ্জের প্রবেশ পথের বাম পাশে একটি পাঠাগার। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী পাঠাগার। এটি প্রতিষ্ঠা করেছে শিরাজীদের আত্মীয় সৈয়দ আবদুর রউফ (মুক্তা)। তিনি সিরাজগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। শহরে তার নামে একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স ও অনীক নামে একটি হোটেল আছে। পাঠাগারটির দ্বার উন্মোচন হয় ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি। উদ্বোধক প্রাক্তন স্বরাষ্ট এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। পাঠাগারটি তালাবদ্ধ। আমাদের অনুরোধে সেটি খুলে দিল মিতুন শিরাজী। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম।

পাঠাগারটি বেশ লম্বা। চারদিকে বই বোঝাই আলমারি। কয়েকটি টেবিল ও চেয়ার। একটি টেবিলের ওপরে পড়ে রয়েছে দৈনিক প্রথম আলো। কাছে গিয়ে দেখলাম, আজকের কাগজ। অর্থাৎ পাঠাগারটিতে দৈনিক পত্রিকাও আসে। এই সময়ের দেশ ও বিদেশ সম্পর্কে নানা খবরাখবর পায় পাঠকেরা।

বই বোঝাই আলমিরাগুলোর কাছে গিয়ে দেখি, দুষ্প্রাপ্য সব বই রয়েছে ভেতরে। সাহিত্য থেকে শুরু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বই।

একটি আলমিরা খুলে মিতুন শিরাজী একটি বই আমার হাতে দিল। ‘অনল প্রবাহ’—ইসমাইল হোসেন সিরাজীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। পাতা উল্টিয়ে দেখলাম এটির প্রকাশক সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা শিরাজী। মুদ্রণকাল বৈশাখ ১৩৬০। মনে পড়ে যায়, ‘অনল প্রবাহ’-এর জন্য ব্রিটিশ আমলে শিরাজী দু’বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন আর ১৩১৭ থেকে ১৩৫৮ সাল পর্যন্ত ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত থাকে। অর্থাৎ বাংলা ১৩৬০ সালে সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা কর্তৃক প্রকাশিত ‘অনল প্রবাহ’ই বহু বছর পরে পাঠকদের দরবারে হাজির হয়। তবে এটি বাজেয়াপ্ত কপির হুবহু পুনর্মুদ্রণ নয়, কিছুটা পার্থক্য আছে।

আমরা জানি যে, ইসমাইল হোসেন শিরাজী ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। এই বাগ্মিতা তার পেশার অন্তর্গত ছিল। ইংরেজ শাসনের নাগপাশে আবদ্ধ ভারতে—বিশেষত দুই বাংলার নানা জায়গায় তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন। পরাধীন ভারতের মুসলমানকে জাগাতে চেয়েছেন। তাদের অতীত গৌরবকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার সাহিত্যও এর বাইরে নয়। আর ‘অনল প্রবাহ’র মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে যখন তিনি আবির্ভূত হলেন—তখনই জানান দিলেন যে, মুসলমানদের নবজাগরণই তার কাম্য। ফলে ‘অনল প্রবাহ’-এ শিরাজী মুসলমানদের রমণীয় ভবিষ্যতের কথা শুনিয়েছেন, একে জয় করে নেওয়া শক্তিসাপেক্ষ, ‘অনল প্রবাহ’ সেই সম্ভাব্য শক্তি সাধনার অংশ। শিরাজীর বাগ্মিতা এখানে কবিতার ছন্দে গ্রথিত হয়েছে, বক্তৃতাকেই তিনি অপেক্ষাকৃত আন্তরিকভাবে কবিতার ছন্দে উপস্থাপিত করেছেন।

ইসমাইল হোসেন শিরাজীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২টি—রায়নন্দিনী (১৩২২), তারাবাই, ফিরোজা বেগম (১৩২৫), নূরউদ্দীন (১৩২৬), অনল প্রবাহ (১৩০৬), উচ্ছ্বাস (১৩১৪), নব উদ্দীপনা (১৩১০), উদ্বোধন (১৩১৫), সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৩২২), প্রেমাঞ্জলি (১৩২৩), মহাশিক্ষা কাব্য (১ম খণ্ড, ১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য (২য় খণ্ড, ১৯৭১), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪), স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৩১৪), তুর্কী নারী জীবন (১৩২০), তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩), আদব-কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা (১৯১৬), নিখিল বঙ্গীয় কর্মী সম্মেলন [১ম অধিবেশন], সভাপতির ভাষণ (১৯২৮), ইসলামের ডাকে শিরাজী সাহেবের বাণী (১৯৩৮), ইসলামের জেহাদ ও মুক্তির বাণী (১৯৬৫)। এইসব গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ, সংগীতগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি।

আমার হাতে ‘অনল প্রবাহ’। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাচ্ছি। শুরুর একটি অংশে চোখ আটকে গেল, মনে মনে আবৃত্তি করলাম এই পঙ্ক্তিমালা : ‘আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া/ উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া/ আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া/ পুত বিভু নাম স্মরণ করি। যুগল নয়ন করি উন্মীলন/ কর চারদিকে কর বিলোকন,/ অবসর পেয়ে দেখ শত্রুগণ/ করেছে কীদৃশ অনিষ্ট সাধন, / দেখরে চাহিয়া অতীত স্মরি’।

মনে পড়ে যায়, ‘অনল প্রবাহ’-এর মতোই শিরাজীর সুপরিচিত গ্রন্থ ‘রায়নন্দিনী’। এই উপন্যাসটির নায়ক ঈশা খাঁ—যার সঙ্গে স্বর্ণময়ী নামে এক হিন্দু রমণীর প্রেম এবং পরিণয় হয়। এটি ইসমাইল হোসেন শিরাজী রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’র পাল্টা জবাব হিসেবে। ওই উপন্যাসে হিন্দু জগৎসিংহের সঙ্গে মুসলমান নারী আয়েশার প্রেম দেখানো হয়েছে। এমনিভাবে ‘তারাবাই’ এবং ‘নূরউদ্দীন’ উপন্যাসের নায়কও মুসলমান, নায়িকা হিন্দু। অন্যদিকে ‘ফিরোজা’ উপন্যাসটি শিরাজী রচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি যেভাবে স্বদেশী ও সন্ত্রাসবাদীদের কাছে প্রায় ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করে, রাজনৈতিক বিপ্লবীরা আনন্দমঠের সন্তান সেনাদের আদর্শে জীবনকে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন তেমনিভাবে ‘ফিরোজা’ উপন্যাসের মাধ্যমে শিরাজী মুসলমানদের রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, শিরাজীর উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, হেমচন্দ্র, রমেশ দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এটাও আমরা দেখতে পাই, শিরাজীর সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের চিত্র প্রতিফলিত, হিন্দুর তুলনায় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শিত হয়েছে।

‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি মিতুন শিরাজীকে ফেরত দিই। সে সেটি আবার আলামিরাতে তুলে রাখে।... পাঠাগারে হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর ছবি। পরনে সৈনিকের বেশ। বুলেটের বেল্ট কোমর ও বুকে জড়ানো। মাথায় পাগড়ি। পায়ে বুট। হাতে লাঠি। এটি শিরাজীর তুরস্ক প্রত্যাগত সময়ের ছবি। হ্যাঁ, তিনি বলকান যুদ্ধে তুরস্কের সাহায্যে মেডিকেল মিশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন—যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডা. আনসারী। তুরস্কে শিরাজী স্বাস্থ্য বিভাগের ইন্সপেক্টর ছিলেন। তার কাজের জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন। তবে সবচে’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ভ্রমণ ইসমাইল হোসেন শিরাজীকে এক অন্য মানুষে রূপান্তরিত করে। তার সামাজিক রাজনৈতিক-সাহিত্যিক জীবনে এর বিরাট প্রভাব পড়ে।

শিরাজীর ছবিটি দেখতে দেখতে আমি ভাবি, আচ্ছা এই মানুষটি কি সাম্প্রদায়িক ছিলেন ? তার উপন্যাসগুলো পড়লে অনেকেরই হয়তো এ ধারণা হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিনি বাংলার মুসলমানদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত জীবনকেও তো উপেক্ষা করেন নি। সত্যি কথা, মুসলমানের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন করতে গিয়ে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের প্রতি শিরাজী উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে দূরে ছিলেন। তিনি ইংরেজ বিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে অবিচল ছিলেন। আজীবন কংগ্রেস করেছেন। মুসলিম লীগে কখনো ছিলেন না। আবার মুসলিম লীগ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতেও তাকে দেখা যায় নি। তিনি প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিকতার দ্বন্দ্বে সমগ্র জীবনকে নিবেদিত করেন এবং আধুনিকতার প্রতিই তার আগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। মুসলমান সমাজের অনেক যুক্তিহীন প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন, একই সঙ্গে মুসলিম জাগরণেরও অন্যতম কর্মী ছিলেন। মুসলিম জাগরণ সম্পর্কে তার ধারণা প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের সঙ্গে কোনো প্রকার মিলনের অন্তরায় ছিল না। জাতীয়বাদী রাজনৈতিক চেতনার সুগভীর উৎস থেকেই তিনি ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ ইত্যাদিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতা থেকে দূরে ছিলেন।

আমার সঙ্গী, অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকার এতক্ষণ তার কাজে অর্থাৎ ছবি তোলায় মগ্ন ছিলেন। কাজ শেষ। তাই ক্যামেরা ব্যাগে বন্দি করে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা পড়ায় মগ্ন। তাকে এই অবস্থায় দেখে আমার মনে পড়ে যায়, পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনার সঙ্গেও ইসমাইল হোসেন শিরাজী সম্পৃক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ‘নূর’ পত্রিকাটি অন্যতম। এখানে সমকালীন অনেক হিন্দু-মুসলমান বিখ্যাত কবি-কথাসাহিত্যিকের মূল্যবান রচনা প্রকাশিত হয়।...মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সঙ্গে শিরাজী যুগ্মভাবে ‘ছোলতান’ পত্রিকা পরিচালনা করেন। তবে তিনি পত্রিকার অংশীদার ছিলেন না, সম্পাদনাও করতেন না। এছাড়া কেউ কেউ মনে করেছেন শিরাজী ‘হাবলুল মতীন’ (সম্পাদক-মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী) পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না।

মিতুন শিরাজীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাণীকুঞ্জ থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। একদিন, ১৯৩২ সালের ১৭ জুলাই (মতান্তরে ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই) তার আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে অসীমে মিশে যায়। তখন তার বয়স হয়েছিল তেপান্ন কি চুয়ান্ন। কেন এত অল্প বয়সে তার মৃত্যু ? হয়তো বহুমূত্র রোগে তার ভোগা, হয়তো ফোঁড়াসহ রোগের প্রতাপ বৃদ্ধি পাওয়া অথবা মৃত্যুর কয়েক মাস আগে কারাবাস (১৯৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে শিরাজী তিন মাসের জন্যে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন) যেটাই শিরাজীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিক না কেন—এদেশের সাহিত্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি বেঁচে থাকবেন।

[অন্যদিন, জুন ২০০৩]

Leave a Reply

Your identity will not be published.