আত্মহত্যা জনস্বাস্থ্যের একটি বড় সমস্যা। এটি মানুষের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০০৩ সাল থেকে ১০ সেপ্টেম্বরকে আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’।
মানুষ যখন নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়, তখন সাধারণত তাকে আত্মহত্যা বা সুইসাইড বলে। প্রতিবছর আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও আত্মহত্যার সংখ্যাতে পিছিয়ে নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে বছরে প্রায় ৬ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। করোনাকালে এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছেন আর ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছেন। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় তিন গুণ, আবার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা করার হার দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে কীটনাশক, ইঁদুর মারার বিষ, ফাঁসি, ঘুম বা ব্যথার ওষুধ, হারপিক, স্যাভলন ইত্যাদি বিষাক্ত তরল পান করার মাধ্যমে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলোতে সাধারণত দেখা যায় পারিবারিক সমস্যা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, বৈবাহিক সমস্যা, ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া, বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক, স্বামীর নির্যাতন এবং অর্থকষ্ট থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অবশ্য কোনো কোনো আত্মহত্যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে/নিয়ে গেছে তারে;/ কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ।’ জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার এই ব্যক্তিটির আত্মহত্যার কারণ যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। সে পরিপূর্ণ সুখী মানুষ ছিল, তবুও কেন এই আত্মহত্যা! আসলে এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের রক্তের ভেতরে খেলা করে, যার দরুনই এমন আত্মহত্যা। এ ছাড়া আত্মহত্যার ধরনেও নানা বৈচিত্র্য দেখা যায়।
কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেকে আহত বা নিজের ক্ষতি করে। কিন্তু তাদের আসলে মৃত্যুবরণ করার কোনো প্রকৃত ইচ্ছা নেই। একে বলে প্যারাসুইসাইড।
কেউ নিজেই নিজের জীবন নিয়ে নেয়। আবার কেউ এক বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। একে বলে প্যাক্ট সুইসাইড। কখনো কখনো দলের চাপে অনেকে একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। একে বলে ম্যাস সুইসাইড।
আবার কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেকে আহত বা নিজের ক্ষতি করে। কিন্তু তাদের আসলে মৃত্যুবরণ করার কোনো প্রকৃত ইচ্ছা নেই। একে বলে প্যারাসুইসাইড।
কোনো কোনো সমাজে সম্মান রক্ষার জন্য আত্মহত্যার চল ছিল। একে বলে অনার সুইসাইড। জাপানের সামুরাইরা নিজের পেট কেটে আত্মহত্যা করত। একে বলা হতো সেপুকু। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধ করার পর আত্মহত্যা করার মাধ্যমে বিচার ও অসম্মানিত হওয়া থেকে নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতেন। একে বলে ডিউটিফুল সুইসাইড।
অনেক সময় যিনি আত্মহত্যা করতে চান, তাঁর শারীরিক সক্ষমতার অভাব বা সাহসের অভাব থাকায় তিনি অন্য কারও সাহায্য নিয়ে আত্মহত্যা করেন। একে বলে ইউথানসিয়া। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এ ধরনের আত্মহত্যার বৈধতা আছে।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? তার কি তখন মাথা ঠিক থাকে? সুস্থ মাথায় কি এটা করা সম্ভব? নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেখা যায়।
অনেক সময় নিজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রভাবিত হয়ে আত্মহত্যার সময়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করে তারপর কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন। একে বলা হয় মার্ডার সুইসাইড (ভিন্নমতে মার্সি কিলিং)।
কোনো আদর্শ দ্বারা পরিচালিত অন্য মানুষকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য কেউ কেউ অন্যদের মেরে নিজেও মারা যায়। একে বলে সুইসাইড অ্যাটাক।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? তার কি তখন মাথা ঠিক থাকে? সুস্থ মাথায় কি এটা করা সম্ভব? নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেখা যায়।
মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি থাকে, যেমন বিষণ্নতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্ত, উদ্বেগে আক্রান্ত ইত্যাদি রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উচ্চ। বিষণ্নতার রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আশাহীনতা তৈরি হয়। দুনিয়ার সবকিছু তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। তারা নিজের সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ও অন্য মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা পোষণ করে। তারা ভাবে, এই পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হবে এবং এটি পরিবর্তনের জন্য শত চেষ্টায়ও কোনো লাভ হবে না। এর চেয়ে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এই চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে। অনেক বিষণ্নতার রোগী খামোখাই তীব্র অপরাধবোধে ভোগে। ফলে নিজেকে শাস্তি দিতেই তারা আত্মহত্যা করে।
কিছু কিছু গবেষণায় আত্মহত্যার পেছনে জিনগত ভিত্তি পাওয়া গেছে। পরিবারের মধ্যে আত্মহত্যার ইতিহাস থাকলেও এই ঝুঁকি বাড়ে। পরিবারের কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যা করলে তার সন্তানদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করার আশঙ্কা বেশি থাকে।
মনঃসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, যখন ভালোবাসার মানুষের প্রতি সৃষ্ট তীব্র রাগ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব নিজের প্রতি ধাবিত হয়, তখন মানুষ আত্মহত্যা করে। অন্যকে হত্যা করার সুপ্ত কামনা যখন অবদমিত হয়, তখন সেটা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। মানুষের মধ্যে একটি শক্তি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, আরেকটি তাকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। এই ধ্বংসের শক্তির জন্যই মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারীর মধ্যে হত্যার কামনা, নিহত হওয়ার কামনা ও মৃত্যুর কামনা লক্ষ করা যায়।
কিছু কিছু গবেষণায় আত্মহত্যার পেছনে জিনগত ভিত্তি পাওয়া গেছে। পরিবারের মধ্যে আত্মহত্যার ইতিহাস থাকলেও এই ঝুঁকি বাড়ে। পরিবারের কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যা করলে তার সন্তানদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করার আশঙ্কা বেশি থাকে। একই ডিম্বাণু থেকে জন্মানো যমজদের একজন আত্মহত্যা করলে আরেকজনও আত্মহত্যা করার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
মিডিয়ার, যেমন পত্রিকা ও টেলিভিশনে ভুলভাবে উপস্থাপিত প্রতিবেদনের মাধ্যমেও আত্মহত্যা উৎসাহিত হতে পারে। যেমন বিখ্যাত কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর আত্মহত্যার খবর খুঁটিনাটিসহ ব্যাপক সহানুভূতি দিয়ে প্রচার করার পর তার ভক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। খারাপ মানুষের দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়ে অমুক নামের নিরীহ একটি মেয়ে নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা করেছে—এমন খবর দিনের পর দিন প্রচার পাওয়ার পর একইভাবে উত্যক্ত আরেকটি মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে।
অনেকের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যই এমন যে তারা খুব ঝোঁকের মাথায় চলে। কিছু মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে তা করতেই হবে, এমনটা ভাবে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা নেই। এদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকে।
আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের মধ্যে তার মৃত্যুর পর কী কী পরিস্থিতি হবে, কার কী কী প্রতিক্রিয়া হবে, তার মৃত্যুর ফলে কে কে গুরুতর কষ্ট (শাস্তি) পাবে, এসব বিষয়ে নানা রকম কল্পনা দেখা যায়। অনেকে এর মাধ্যমে নিজেকে শাস্তি দিতে চায়। অনেকে তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে আত্মহত্যা করে। অনেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করে। অনেকে পুনর্জন্ম লাভের আশায় আত্মহত্যা করে।
যাদের ঘরবাড়িতে আত্মহত্যা করার উপাদান বেশি থাকে, তারাও কিছুটা ঝুঁকিতে থাকে। যেমন আমাদের দেশের কৃষকদের বাড়িতে কীটনাশক সহজলভ্য থাকতে দেখা যায়।
অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। সমাজে যখন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যখন মানুষ বিচ্ছিন্নতায় ভোগে, তখন আত্মহত্যার হারও যায় বেড়ে।
রাজনৈতিক আদর্শের কারণে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়, যেমন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা করে থাকে।
কোনো কোনো পেশার মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা যায়, যেমন ডাক্তার, ডেন্টিস্ট বা দন্তবিশেষজ্ঞ, পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনীর লোক ইত্যাদি।
অনেকে বাধ্য হয়েও আত্মহত্যা করে, যেমন বন্দি শিবিরের তীব্র নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করেন।
দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় আত্মহত্যা করে। অসুখের তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেকে এই পথ বেছে নেয়।
সাধারণত আবেগী তরুণ কিংবা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আত্মহত্যায় নারী-পুরুষের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।
আত্মহত্যা করার আগে আত্মকারীরা কিছু ইঙ্গিত দেন। সেসব ইঙ্গিতগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
> খুব বেশি মরার কথা বলা।
> কাউকে বিদায় জানাতে বা কিছু দিয়ে দিতে ভয় পাওয়া।
> আত্মহত্যার বিভিন্ন উপায় নিয়ে কথা বলা।
> নিজের অসহায়ত্ব, কষ্ট, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা নিয়ে কথা বলা।
> অন্যের ওপর নিজেকে বোঝা মনে করা।
> যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যবহার করা।
> অতিরিক্ত বা খুব কম ঘুমানো।
> সাধারণ জীবন থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
> অতিরিক্ত রাগ বা প্রতিশোধের মনোভাব থাকা।
> খুব ঘনঘন ও অকারণে মেজাজ বদলে যাওয়া।
আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে সচেতন হওয়া জরুরি।
> যার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তার কথা মনোযোগসহকারে ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। ঠিক কী কারণে তার এ ইচ্ছা হয়েছে, তা জানতে হবে। এরপর চেষ্টা করতে হবে তা সমাধানের। কেননা, অনেকেই হঠাৎ করে আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা করে থাকে। এ কারণে তার প্রতি কিছুটা মনোযোগ দিলেই আত্মহত্যা প্রবণতা কমে যায়। শুধু কথা শুনে সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও এতে তার উপকার মেলে।
> আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে পেশাদার মনোবিদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি। তাই কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেলে তাকে অভিজ্ঞ একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। থেরাপির মাধ্যমে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব।
> মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েই একজন মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মহত্যপ্রবণ অনেকেরই মনে হতে পারে যে তার ওপর কারও আস্থা নেই। এ কারণে অন্যদের তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস প্রকাশ প্রয়োজন। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের উচিত তার প্রশংসা করা।
> আত্মহত্যা প্রবণতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ ও সঠিকভাবে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে আত্মহত্যা প্রবণতা দূর করা সম্ভব।
আত্মহত্যা কোনো সমাধানের পথ নয়। কাপুরুষের মতো পালিয়ে না গিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হবে। প্রাণভরে বাঁচতে হবে নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য।
Leave a Reply
Your identity will not be published.