নায়করাজ রাজ্জাক: জীবন ও কর্ম (পর্ব ১)

নায়করাজ রাজ্জাক: জীবন ও কর্ম (পর্ব ১)

এই ধারাবাহিক রচনায় প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও ক্যারিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। বিপুল ভক্ত ও সিনেপ্রেমী পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর থাকবে এই রচনায়।  

এই রচনায় মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।

আজ রাজ্জাকের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। বিশেষ এই দিনে তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের জীবনের একটি অধ্যায়।

জিরো থেকে হিরো

চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা একদা আকাশের তারার মতোই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ছিলেন। এখনকার মতো প্রকাশ্যে তাদের তেমন দেখা যেত না। তারা ছিলেন অধরা। রহস্যময়তার পরিমণ্ডলে বন্দি। কী হলিউড কী বলিউড, টালিউড অথবা ঢালিউড— সর্বত্রই এই চিত্র দেখা যেত। এর মধ্যেও কোনো কোনো তারকা-অভিনয়শিল্পীদের সাধারণ মানুষ কাছের জন মনে করত। অবশ্য সেইসব তারকার অবস্থান ছিল মাটির কাছাকাছি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাক তেমনই একজন তারকা-ব্যক্তিত্ব। তিনি সাধারণ অবস্থা থেকেই অসাধারণ হয়েছেন; জিরো থেকে হয়েছেন হিরো। অত্যন্ত কষ্টের দিন পেরিয়ে, কঠিন জীবনসংগ্রামের পরই তিনি চলচ্চিত্র জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই জগতে বিচরণ করেন সম্রাটের মতো। এই নায়করাজের জীবনের নানা বাঁকের ওপর আলো ফেললেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।

টালিগঞ্জের সেই ছেলেটি

রাজ্জাকের জন্ম হয়েছিল কলকাতার টালিগঞ্জে, সেখানকার ৮ নম্বর নাগতলা রোডে। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাকের জন্ম হয় ওই পাড়াতে। বাবা আকবর হোসেন। মা নেসারুন্নেসা। দাদার নাম চিমাই মোল্লা। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। রাজ্জাকের বাবা আকবর হোসেন ছিলেন আধা জমিদার। নাকতলায় তাঁর অনেক জমি ছিল। এখনো সেই এলাকার প্রবীণ মানুষরা রাজ্জাকদের পরিবারকে জমিদার পরিবার বলেই স্মরণ করে। যদিও এখন রাজ্জাকদের পারিবারিক জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে বিশাল জনবসতি। গড়ে উঠেছে ফ্ল্যাট বাড়িও। যা’ হোক, বিশাল সম্পত্তি থাকায় তিন ভাই এবং তিন বোনসহ রাজ্জাকদের বেশ বিলাসবহুল জীবনযাপন ছিল। ছোটবেলা থেকেই রাজ্জাক খেলার পাগল ছিলেন। তাদের বাড়ির সামনে প্রচুর খোলা জায়গা থাকা সত্ত্বেও তিনি বল হাতে নিয়ে ছুটে যেতেন মাঠে। এ জন্য মাঝে মধ্যে বাবা-মা কিংবা বড়ভাইয়ের হাতে মার খেতেন।

রাজ্জাকের বাবা আকবর হোসেনের ২৪ পরগনার বোরাল গ্রামে ছিল একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে আকবর হোসেন প্রায়ই যেতেন প্রজাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। তার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা ছিল।

রাজ্জাকের ভাইবোনদের মধ্যে কারোরই সংস্কৃতিচর্চার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিল না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কেননা তারা ছিলেন গোঁড়া মুসলিম পরিবারের সন্তান। এমন অবস্থায় রাজ্জাক যে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, নাটকে অভিনয় করেন—এটা ছিল বিস্ময়কর ব্যাপার।

ছোটবেলায় রাজ্জাক প্রথম চলচ্চিত্র দেখেছিলেন মা-বাবার সঙ্গে। কী ছবি ছিল, সেটি পরে আর স্মরণ করতে পারেন নি তিনি। তবে হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার দেখা ছবিটির কথা তার স্মরণে ছিল। ‘মানে না মানা’ নামের সেই ছবির একটি গানও স্মৃতিপটে উঁকি দিত তাঁর। গানটি হলো ‘ভুল করে তুই ঝাঁপ দিলিরে প্রেম যমুনায়’।

স্কুলে পড়ার বয়সে রাজ্জাক ভর্তি হন খানপুর হাইস্কুলে। এর আগে বাড়িতেই শিক্ষকের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় তার। তৎসঙ্গে নামাজ পড়াও শেখেন। কিন্তু পড়াশোনা তার মোটেও ভালো লাগত না। অঙ্কে ছিলেন খুবই কাঁচা। স্কুলের শিক্ষক বলতেন, ‘অঙ্কটা ভালো করে শেখ। যোগ-বিয়োগ ঠিকমতো না শিখলে পরিবারের এত সম্পত্তি সামলে রাখবি কী করে?’

বলা যায়, ছাত্র হিসেবে রাজ্জাক খারাপ ছিলেন না। তবে খুব মেধাবী ছাত্র, তাও ঠিক নয়। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত ক্লাসে তিনিই মনিটর ছিলেন। তখন স্কুলের কোনো ক্লাসে সেই ছাত্রকেই মনিটর করা হতো, যে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাকে যে ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড বয় হতে হবে এমন কোনো কথা নয়। রাজ্জাক ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন বলেই তিনি মনিটর ছিলেন।

তখন ফুটবল ছাড়া আর কিছুতেই রাজ্জাকের মন বসত না। তিনি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন তখন থেকেই এলাকায় ভালো গোলকিপার হিসেবে তার একটা সুনাম ছিল। উল্লেখ্য, কলকাতায় বিশেষ করে টালিগঞ্জে তখন পাড়ায় পাড়ায় নাটক হতো। প্রত্যেকটি পাড়ায় সাংস্কৃতিক সংঘ ছিল। ক্লাব ছিল। এইসব ক্লাবে খেলাধুলা হতো, নাটক, বিচিত্রানুষ্ঠান হতো। কোনো কোনো পাড়ায় দুই-তিনটি ক্লাবও ছিল। তখন বন্ধু-বান্ধব মিলে রাজ্জাক প্রচুর নাটক দেখতেন। সত্যি কথা বলতে কী, রাজ্জাক কোনো নাটকই বাদ দিতেন না। এভাবে ফুটবলের পাশাপাশি নাটকও রাজ্জাকের নেশায় পরিণত হয়। দুটো ক্ষেত্রেই তিনি সমান আগ্রহ বোধ করতেন। ফলে প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিতেন। আর বাড়ি থেকে স্কুল সামান্য দূরে ছিল বলে সহজে ধরাও পড়ে যেতেন।

ডানপিটে রাজ্জাকের তখন দিন কাটত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা আর হইহুল্লোড় করে। ফুটবল খেলায় তিনি এতই ভালো ছিলেন যে পাড়ার বয়স্করা ভবিষ্যৎ বাণী করতেন, ‘এ ছেলে বড় হলে মোহনবাগান অথবা মোহামেডানের একজন সেরা খেলোয়াড় হবে।’ রাজ্জাক তখন ভালো মাউথ অর্গানও বাজাতেন। তার সুর সবাইকে মুগ্ধ করত। কোনোদিন যখন তিনি অবসরে বন্ধুদের নিয়ে গাছতলায় বসে মাউথঅর্গানে কোনো পরিচিত গানের সুর তুলতেন, পথচারীরা থমকে যেত। কিছুক্ষণের জন্য তাদের পথচলা যেত থেমে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনই অভিভূত হতেন যে, কিশোর রাজ্জাককে কাছে টেনে তার কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিতেন।

অভিনয়ে হাতেখড়ি

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অভিনয়ের প্রথম বীজটি রাজ্জাকের মনের জমিনে রোপিত হয় ছোটবেলা থেকেই। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন তখনকার ঘটনা। তাদের স্কুলের বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে নাটক করা হবে। তখন মহিলা চরিত্র ছাড়া স্ক্রিপ্ট পাওয়া যেত। তেমনই একটা স্ক্রিপ্ট জোগাড় করে শরীরচর্চার শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি তাদের ডাকলেন। নাটকের মূল চরিত্র ছিল একজন কিশোরের। গ্রামের এক সমাজকর্মী। বলা যায়, গ্রাম-উন্নয়নমূলক নাটক ছিল সেটি। ছাত্ররা গ্রামে কী কী কাজ করতে পারে, উন্নয়নে অংশ নিতে পারে, এ রকম থিম নিয়ে লেখা নাটক। নাম ‘বিদ্রোহী’।

সেদিন রাজ্জাক স্কুলের মাঠের কোনায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি তাকে ডেকে নিলেন। রাজ্জাক যখন ধীরে ধীরে হেঁটে স্যারের কাছে যাচ্ছিলেন, তখন নানা ভাবনা ভিড় জমাচ্ছিল মনে। ভাবছিলেন কী ব্যাপার? স্যার ডাকছেন কেন? কিন্তু কাছে গিয়ে স্যারের কথা শুনেই মনের সব ভাবনা ও দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে গেল।

রথীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই তুই নাটকে অভিনয় করবি?’

এ কী বলছেন স্যার! সে কি শুনতে ভুল করেছে? হ্যাঁ, সে বন্ধুদের নিয়ে বহু নাটক দেখেছে বটে কিন্তু নিজে অভিনয় করবে, এমন তো কখনো ভাবে নি। তাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাজ্জাক বলেন, ‘পারব তো স্যার? আমাকে দিয়ে কি হবে?’

রথীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি সাহস জোগান ছাত্রকে। বলেন, ‘অবশ্যই পারবি। সারা মাঠ ঘুরে খেলতে পারিস আর অভিনয় পারবি না? আমরা তো আছিই। স্কুলের নাটক। সবাই তোর চেনাজানা। শুধু মনে জোর রাখবি। ব্যস।’

স্যারের কথায় রাজ্জাক আশ্বস্ত হন। কয়েকদিন রিহার্সেল দিয়ে নিজের চরিত্রও রপ্ত করে ফেলেন। কিন্তু যেদিন নাটকটি মঞ্চস্থ হবে, সেদিন স্টেজে উঠে শুরুতে তিনি ভীষণ নার্ভাস ছিলেন। ধীরে ধীরে প্রাথমিক জড়তা আর নার্ভাসনেস কেটে যাওয়ার পর অভিনয়ে তিনি বেশ স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠেন এবং নাটক শেষ হলে সবাই বেশ প্রশংসা করেন। এমন কি তার ভাই-বোনরাও তাকে উৎসাহ দেন। বলা যায়, নিজের অজান্তে মনের ভেতর অভিনয়ের যে বীজটি রোপিত হয়েছিল তা ক্রমশঃ চারায় পরিণত হলো। আর সেই চারা এক সময় রূপ নেয় বৃক্ষে— যা তিনি দীর্ঘদিন লালন আর সাধনার মাধ্যমে পরিপুষ্ট করে নায়করাজে পরিণত হন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.