নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৭)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ১৭)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১৭তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬

ফাহিম বলেছিল, সিমি যেভাবে পরিকল্পনা করবে সেভাবেই সে সময় বের করবে। কিন্তু বাস্তবে সেভাবে সময় মেলানোটা ঠিক হয়ে ওঠে নি ফাহিমের। গত দু’দিন সে তার মায়ের সঙ্গেই থেকেছে। কোথাও বের হয় নি।

তবে আজ শুক্রবার বন্ধের দিন বিধায় সিমি মোটামুটি লম্বা একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। ফাহিম সেদিন কথায় কথায় জানিয়েছিল, দেশে এলে আর কোথাও তার যাওয়া হোক না হোক, তিনটি জায়গায় সে যায়। এক শহীদ মিনার, দুই জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর তিন ওদের গ্রামের বাড়ি।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফাহিমকে নিয়ে আজ স্মৃতিসৌধ দেখতে যাবে সিমি। সারা দিন ওখানেই থাকবে। সেখান থেকে ফেরার পথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ফাহিমের। সেখানেও যে তার স্মৃতি রয়েছে অনেক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস প্রথম দেখাতেই ফাহিমকে মুগ্ধ করেছিল। পুরো ক্যাম্পাসটাকেই প্রকৃতি এক নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে যেন। প্রকৃতিকে এত কাছে থেকে দেখা, হৃদয় শীতল করা বিশুদ্ধ বাতাস— সব মিলিয়ে অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করত তখন।

এয়ারপোর্ট রোডের পাশে ঢাকা রিজেন্সী হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলফাহিম।সিমিই বলেছিল ফাহিমকে ওখানে আসতে। সকাল দশটার কিছু আগেই ফাহিম এখানে চলে এসেছে।একটা রিক্সা নিয়ে সিমিযখন সেখানে পৌঁছলতখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। ফাহিমকে দেখে সুন্দর করে হাসলসিমি। ফাহিমও হাসল তার স্বভাব-সুলভ ঠোঁট বাঁকানো হাসি।সিমি নেমে দাঁড়াতেই ফাহিম এগিয়ে গেল।

সিমি আজ নীল জিন্সের সঙ্গে সাদা রঙের ফতুয়ার মতো কিছু একটা পরেছে। চোখে সানগ্লাস। তার কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ।এ পোষাকে তাকে অন্যরকম লাগছে।সেদিনের শাড়ি পরা সিমি আর আজকের জিন্স পরা সিমি— একই মানুষ অথচ অন্যরকম। কিছু কিছু মানুষ আছে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়। সিমি তাদেরই একজন।

সিমির কাঁধের ব্যাগটি নিতে চাইল ফাহিম। সে বাঁধা দিল না। ফাহিমের কাছে ব্যাগটা একটু ভারী মনে হলো। ফাহিম সারাদিনের জন্য একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছে। ওরা উঠে বসতেই ড্রাইভার ট্যাক্সি ঘুরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে পড়ল। 

বন্ধের দিন থাকায় রাস্তায় জ্যাম তুলনামূলকভাবে কম। মোটামুটি অল্প সময়েই ওরা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। এখানে যতবার এসেছে ততবারই বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে ফাহিমের মন। তবুও দেশে এলেই বিদেশিদের মতোই জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যায় ফাহিম। দীর্ঘ সময় বসে থাকে সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাহিমের বাবাকে ‘একটু বাইরে আসেন’ বলে রাজাকার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। আর কখনোই সে ফিরে আসে নি। বাবার সঙ্গে ফাহিমের কোনো স্মৃতি নেই। এখানে এলে ফাহিমের মনে হয় তার বাবার কাছে এসেছে।

ফাহিম সাভারের এই স্মৃতিসৌধে যখনই এসেছে, কোনো এক বিচিত্র কারণে, ওর তখন নিউ ইয়র্কে স্থাপিত স্ট্যাচু অব লিবার্টির কথা মনে পড়েছে। ফাহিম যখন প্রথম স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যায়, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সে। ছোটবেলা থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা বুঝাতে এই মুর্তিটির ছবি দেখে আসছে। পৃথিবীতে স্বাধীনতার এর চেয়ে ভালো প্রতীক কী আর আছে!

সেই মুর্তিটা ফ্রান্সের জনগণ দিয়েছিল আমেরিকার জনগনকে। বিশ্ব বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে। এবং সেটা বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রতীক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতারও গৌরবময় প্রতিক এই জাতীয় স্মৃতিসৌধ। যা কি-না বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত বেসামরিক বাঙালি এবং অবাঙ্গালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। বিশিষ্ট স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন করেছেন এই অনন্য সাধারণ নকশাটি। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কগণ সরকারিভাবে বাংলাদেশ সফরে আগমন করলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত।

অপরুপ সৌন্দর্যে ভরপুর জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্তরে ছায়া ঘেরা বিস্তির্ণ এলাকায় বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফাহিমের একটু ক্ষিধে পেয়ে গেল। ইতোমধ্যে সময় গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। বেলা বাজে প্রায় দেড়টা। সিমির দিকে তাকিয়েফাহিম বলল, ‘আমার না ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু একটা খেতে পারলে ভালো হতো। যদিও বাইরে খাওয়াটা আমার জন্য একটু রিস্কি। এখানে একটা পর্যটনের রেস্টুরেন্ট ছিল না? ওটাতে যাওয়া যেতে পারে, কি বলো?’

সিমি মুচকি হেসে বলল, ‘সেটা নিয়ে আপাতত ভাবতে হবে না। চলো ঐ ছায়াটায় গিয়ে বসি। আর ব্যাগটা আমাকে দাও।’ বলেই সিমি ব্যাগটা নিল ফাহিমের কাঁধ থেকে। সুন্দর একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসল ওরা দুজন।

সিমি ওর ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের একটা বাটি বের করে বলল, ‘তোমার জন্য একটু নুডুলস বানিয়ে এনেছিলাম। তুমি কি নুডুলস পছন্দ করো?’

ব্যাগটা ভারী লাগার পেছনের রহস্য কিছুটা বোঝা গেল। যদিও নুডুলস ফাহিমের খুব প্রিয় কোনো খাবার নয়। কারো বাসায় গেলে নুডুলস খেতে দিলে দু’ এক চামচের বেশি সে তার প্লেটে কখনোই তুলে নেয় না। ফাহিমের ধারণা নুডুলস সবাই ঠিক মতো বানাতেও পারে না। কারোটা বেশি সিদ্ধ হয়ে কাদা কাদা হয়ে যায়, কারোটা হয় আঠাল। তবে সিমির বানানো এই নুডুলসটা দেখেই ফাহিমের পছন্দ হলো। সে বলল, ‘সব নুডুলস পছন্দ করি না। নুডুলস করার একটা আর্ট আছে। দেখা যাক তোমার নুডুলস পাশ করে কি-না।’

সিমি দুটো ছোট প্লেট, কাঁটা চামচ বের করে একটা প্লেটে নুডুলস তুলে দিল ফাহিমকে। ফাহিম এক চামচ খেয়ে চোখ বন্ধ করে স্বাদটা বোঝার চেষ্টা করল। এতটা সে আশা করে নি। অনেক সময় প্রিয় মানুষ যাই করে সেটাই ভালো লাগে। কিন্তু নুডুলসের বেলায় সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফাহিম চোখ খুলে বলল, ‘তুমি পাশ করেছ। শুধু পাশ নয়, লেটার মার্কসসহ পাশ। আজ থেকে আমার নুডুলসের স্ট্যান্ডার্ড বেড়ে গেল। প্রিয়দর্শিনী সেফ সিমির তৈরী আজকের এই নুডুলসই হলো নতুন স্ট্যান্ডার্ড।’

ফাহিমের কথার ধরণে সিমি খুব মজা পেল। সে শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘বেশি হয়ে যাচ্ছে না? নাকি বাটার দিচ্ছ?’

‘একেবারেই না। সত্যি বলছি, খুব ভালো হয়েছে। আমি সাধারণত নুডুলস খাই না। তবে, তোমার বানানো এই নুডুলসটা সত্যিই অসাধারণ হয়েছে।’ বলতে বলতে ফাহিম গপাগপ আরও কয়েক চামচ মুখে দিল।

সিমি অবাক চোখে ফাহিমের খাওয়া দেখছে আর মিটি মিটি হাসছে। ফাহিমের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, নুডুলসের মতো এমন সুস্বাদু খাবার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই এবং সেই খাবারটি জীবনে এই প্রথম সে খাচ্ছে।

ফাহিম চামচ দিয়ে সরিয়ে নুডুলসে কী কী উপকরণ আছে তা একবার দেখে নিল। সিমি বাংলাদেশের মোটা নুডুলসটা নিয়েছে। তার ভেতর দিয়েছে আলু সেদ্ধ, মটরশুটি, গাজর, ফুলকপি, ডিম, মাংসের টুকরো আর শুকনো মরিচ। ওপরে টমেটো কেচাপ। তাতেই স্বাদ বেড়ে গেছে বহুগুনে।

‘তুমি ঘুমাও নি রাতে?’ বলল ফাহিম।

‘কেন?’

‘এত কিছু কখন করলে?’

‘সকালেই। একটু আর্লি উঠে গেলাম। আর তাছাড়া আমি ছুটির দিনেও বিছানায় বেশি ক্ষণ থাকতে পারি না। অফিসের যাওয়ার নিয়মে উঠে পড়ি।’

‘আমাকে রেসিপিটা দিও তো।’

‘রেসিপি লাগবে না। তোমার যখন খেতে মন চাইবে বলবে, আমি বানিয়ে নিয়ে আসব।’ মিষ্টি হেসে বলল সিমি।

‘আর আমি যখন শিকাগো ফিরে যাব, তখন?’

‘তখন কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিব।’ বলেই বাচ্চা মানুষের মতো হেসে উঠল সিমি।

ফাহিমও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আশ্চর্য, তুমি খাচ্ছ না কেন? আমি তো একাই শেষ করে ফেলছি।’

‘চান্সই তো পাচ্ছি না।’ সিমি আবারও হাসল।

ফাহিম মুগ্ধ হয়ে তাকাল। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসতে পারে! ফাহিম তার প্লেটে আর একটু নুডুলস তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরল সিমির দিকে। সিমি একটু অবাক হলো, সেই সাথে মুগ্ধও। সে তার চামচ দিয়ে একটু নুডুলস মুখে দিল।

একই প্লেট থেকে দুজনে মিলে নুডুলস খাচ্ছে। নরম রোদ আর গাছের প্রশস্ত ছায়ায় বসে এক প্লেটে নুডুলস খাওয়ার চেয়ে সুখের জীবন আর কী আছে?

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.