উলঙ্গ আষাঢ়
আসাদ মান্নান
ঋতুচক্রে ঘুরতে ঘুরতে সময়ের বিদেহী চাকায়
পঞ্জিকার পৃষ্ঠা ছেড়ে ধরাধামে খরাকে তাড়াতে
নিজেকে উজাড় করে আহা কী সুন্দর নগ্নতায়
শূন্যতার হাত ধরে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে নাচে
জলের যুবতী কন্যা বিরহিনী উলঙ্গ আষাঢ়!
অগ্নিজাত প্রেমে দগ্ধ অন্তরঙ্গ কালের চুলোয়
শ্রীমতি রাধার মনে অবিরাম ধিকিধিকি জ্বলে
বৃন্দাবনী কল্পলোকে মহাপ্রেমী কৃষ্ণ মহাজন।
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তিনি প্রভু প্রেমের রক্ষক
স্বয়ং ঈশ্বর নিজে; আজ তিনি বড়ো অসহায়:
রাধা-কৃষ্ণ মরে গেছে—অন্ধকার ভূতের গলিতে
কৃষ্ণহীন লীলাগানে মুখরিত নগরমন্দির,
দাবানলে পুড়ে ভস্ম প্রেমহীন মানুষের ঘর—
জীবের ললিত কামলীলা ছাড়া আর কিছু নেই!
২
এমন আষাঢ় দিনে আশপাশে কেউ কি আছেন
গরিব চাষার হাতে হাত রেখে প্রাণের গভীরে
শঙ্খ আর উলুধ্বনি দিতে দিতে অনাবাদী ক্ষেতে
নতুন শস্যের গন্ধে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবেন ?
মেঘের ভেতরে শুয়ে অগ্নিবালা দীর্ঘ গিরিশৃঙ্গে
ছড়িয়ে দিয়েছে তার আজানুলম্বিত নগ্নতাকে,
শ্রী জ্ঞানদাসের মতো একজন কানে কানে বলে,
প্রতি অঙ্গ লাগি কেন বলো কবি প্রতি অঙ্গ কাঁদে ?
বড়ই কঠিন প্রশ্ন; পৃথিবীর সব নদীজল
সমুদ্রকে পান করে এ প্রশ্নের মেলেনি উত্তর!
যখন মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে নেশায় আচ্ছন্ন
চৈতন্যগলির মোড়ে, তখন কেন যে টের পাই
একটা প্রেমের কানা ডানাহীন পাখি বসে আছে
এ বুকের অগ্নিকুঞ্জে ফুটে ওঠা বেদনা কুসুমে।
তাঁর চোখ গাজার আকাশে
মিনার মনসুর
গতকাল ছিল বাবা দিবস। ছেলে বলল, ‘তোমার ছেলেবেলার কথা বলো।’ বললাম, ‘চলো, তোমাকে আকাশ দেখাব। আষাঢ়ের প্রথম আকাশ।’ ছেলে জানতে চায়, ‘কী আছে ওখানে ?’ বলি, ‘আমাদের সমস্ত জীবন।’
—‘তোমরা, মানে তোমাদের কবিবন্ধুরা ? ওরা কি ওখানেই থাকে ?’
কী এক অদৃশ্য ঝড়ে হৃদয় উত্তাল। তবু বলি, ‘শুধু কি বন্ধু ও স্বজন! আস্ত হৃদয়টাই জল হয়ে মিশে আছে আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে। হিমালয়-চূড়া থেকে গৌতম বুদ্ধের মতো সন্তর্পণে নেমে আসে সেই জল। বয়ে যায় বিপন্ন বদ্বীপের শিরায় শিরায়।’
ছেলে বলে, ‘বাবা, তোমাদের আকাশ কি লাল ছিল ? আমি তো সেখানে রক্ত, আগুন আর আর্তনাদ ছাড়া কিছুই দেখি না।’ ‘বলুন তো হে মহাকবি কালিদাস, এ কি অস্তগামী সভ্যতার মেঘ না মায়া ?’—পদ্মার বিধ্বস্ত বুকে বজরার ডেকে বসে শুধান বিমূঢ় রবীন্দ্রনাথ। তাঁর চোখ গাজার আকাশে।
বৃষ্টির দিনরাত্রি
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
উদাহরণস্বরূপ উপমায় বৃষ্টিমগ্ন দ্রৌপদীর বিরহে
অতিশয় কাতর সংকটে টের পাই,
দেবযানীর মায়াবী হাতছানি কসমোপলিটান রোমান্স গাঁথে।
লেখা হয় হরিৎ পাতায় দিনশেষে খসড়া চুক্তি বিশেষ—
“ভালোবাসা বাদামখোসা নয়।
পুটুস করে ভেঙে, দিলাম দূরে ছুড়ে। বহু দূরে।
ভালোবাসা একটা প্রহর, মন্ত্রমুগ্ধ চোখের সাথে
বিবশ করা চোখ।”
এরপর কতগুলো দলিলদস্তাবেজ ঘেঁটে বহু মেঘে
নির্মিত চুক্তি করে এল দেবযানীর অর্ঘ মতোন
বৃষ্টি সকল বসন্তের পল্লবিত ভোরে, অন্য রকম করে।
বহু পথ ঘোরা ধুলোর পরতে অবাক হওয়া বৃষ্টিগুলো
গলির মুখে অঝোর ধারায় হঠাৎ ছিটকে আসা মিসাইল ছুঁয়ে
সবিস্ময়ে বলে,
“একবার দ্রৌপদী হয়ে দ্যাখো তুমি,
জানবে, প্রেম আর বিরহ পরস্পর আবদ্ধ একই চুক্তিতে।”
ঈশ্বরের অশ্রুপাত
টোকন ঠাকুর
প্রতিটি বৃষ্টিকণা, ঈশ্বরের অশ্রুপাত ছাড়া
আর কিছু নয়
আষাঢ়-শ্রাবণে ঈশ্বর শোকগ্রস্ত থাকেন
তাই বর্ষাকাল হয়
কী এমন দুঃখ, এত কান্না তার ?
ঈশ্বরের অশ্রুবিন্দুই সমুদ্র বলে শুনেছি
কে দেয় সমুদ্রে সাঁতার ?
প্রশ্ন হচ্ছে, ঈশ্বর কাঁদেন কেন ?
উত্তর হচ্ছে, ঈশ্বর কাঁদলেই বৃষ্টি হয়
বৃষ্টিতে ভিজে রোদেলা বাধায় জ্বর
জ্বরের ঘোরে সে বিড়বিড় করে, বিয়েই হয় নি
এই মেয়ে তার ভাবটা দেখায়—সন্ধ্যায় আসবে বর
ঈশ্বর আরও বেশি করে কাঁদলে
সেকেন্ড ইয়ার চুলোয় তুলে রোদেলা বাঁধবে ঘর
যাই হোক আর তাই হোক, হলোও তো
ঈশ্বরের অশ্রুপাতই আমার নামে লেখা
সেই অভিমান বুকের মধ্যে চেপে
একটা শালিক কোথাও তখন ভিজতে থাকে একা
কিন্তু বসন্তে বৃষ্টি, হঠাৎ! কী অসুখ ঈশ্বরের ?
এত এত একাকিত্ব! অশ্রুবিন্দু! আমার নামে লেখা
লেখা বলতে সদ্য রচিত প্রেমের কবিতা—
Leave a Reply
Your identity will not be published.