‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে...’

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে...’

‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ না, কেউ চায় না। এ দেশের মানুষও চায় নি। যুগে যুগে তারা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রাণিত ও উদ্বেলিত করেছে বহু গান। কিছু গান অবশ্য স্বাধীনতার পরেও রচিত হয়েছে। এইসব গানের মধ্যে অন্যতম ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে...’।

এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলিতে এটি প্রচারিত হয়েছে। গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। তিনি ছিলেন আকাশবাণী বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। পেশাগত জীবনে ছিলেন আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা। গানটির সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ। তাঁর জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৭, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার সোনার চর মুন্সী বাড়িতে। তিনি একাত্তরের জুন মাস পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। এরপর তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ গানটি ছাড়াও তিনি ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ গানে কণ্ঠ দেন। এই গানের গীতিকারও তিনি। ২০০৫ সালে তার নামে একুশে পদক দেয়া হয়।

এই গানে বাংলাদেশের মাটি, প্রকৃতি, মানুষ, প্রেম-ভালোবাসা এবং অবশ্যই দেশপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠেছে। গানটি একাত্তরে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে। ২০০৬ সালে বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতাদের মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, রাতের বেলা ক্যাম্পে বসে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বেতারের সেটকে ঘিরে আছে। আর সেই বেতারে বাজছে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটি।

গানটি প্রসঙ্গে সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘একাত্তরের জুন মাসের কথা। তখন আমাদের ঘরবাড়ি-ঠিকানা বলতে একটাই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। থাকা-খাওয়া-ঘুমানো-গান বাঁধা-গান গাওয়া, এই ছিল নিয়মিত রুটিন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্ব্বাধীন দেশের পতাকাতলে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমরা। হঠাৎ একদিন গোবিন্দ হালদার নামের মানুষটি সামনে এসে দাঁড়ালেন। সে দিনই প্রথম পরিচয়। তার কথা থেকেই জানতে পারি, লেখালেখি রক্তে মিশে আছে। এরপর গোবিন্দ হালদার আমার হাতে তুলে দেন তার লেখা গানের একটি পাণ্ডুলিপি। যে পাণ্ডুলিপির একেকটি গীতিকবিতায় চোখ বুলিয়ে কোনোভাবেই মেলাতে পারিনি গোবিন্দ হালদারের সাদাসিধে অবয়বের সঙ্গে। কারণ, তার পাণ্ডুলিপিতে গান নয়, ছিল বারুদ। তাই বিস্ময় নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, একজন মানুষের মনে কতটা আগুন লুকিয়ে থাকলে এমন সব গান লেখা যায়? তার অন্যান্য গানের মতো 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি' গানের কথাগুলো পড়েও অবাক হয়েছিলাম।মুগ্ধ হয়েছিলাম গানের কথায় বিশ্বশান্তি, নারী, ফুল, মাটি আর মানুষের কথা কী চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা দেখে! শব্দ মানুষকে কাঁদাতে পারে, হাসাতে পারে, ভাসাতে পারে, মনের মাঝে জন্ম দিতে পারে রাগ-ক্ষোভ-জ্বালা; করে তুলতে পারে বিদ্রোহী- গণসংগীত গাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এটা জেনেছি।”

Leave a Reply

Your identity will not be published.