নিরু ব্লাউজের পিছনে নীল সুতোয় ফুল তুলছে একমনে। এক থোকা নীলমণিলতা আর পাশে পেঁচানো লতাপাতা। গত সপ্তাহে একটা বড় অর্ডার এসেছে বিয়েবাড়ির। পঁচিশ পিস ব্লাউজের অর্ডার। প্রতি পিস সতেরো শ’ করে।
একটা ফুল শেষ করে থেমে গেল নিরু। তার আঙুলে সুঁই লেগেছে। হালকা রক্ত বের হচ্ছে। সে চুপচাপ আঁচলে আঙুলটা মুছল। তারপর আবারও কাজ শুরু করল, যেন কিছুই হয় নি।
নিরু খুব সুন্দর ব্লাউজ বানায়। ফেইসবুকে তার একটা পেইজ আছে। টুকটাক ভালোই অর্ডার পায় সে। যদিও খুব বেশি দিন হয় নি সে এই কাজে নেমেছে। সাত-আট মাস হবে। একা হাতে সে নিজেই সব করত এতদিন, তবে এখন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বড় বড় অর্ডার আসছে। ব্যবসাটাও বড় হচ্ছে। তার স্বপ্ন, আরও অনেক বড় করবে এই ব্যবসাটা। ইতিমধ্যে দুটো মেয়েও রেখেছে তার সহকারী হিসেবে।
এই কাজের জন্য নতুন এক রঙের সুতো আনতে হয়েছিল, যা এখন শেষের পথে। সে ঠিক করল বিকেলে বের হবে। সুতো আর ছেলের জন্য টুকটাক কিছু দরকারি জিনিসপত্রও কিনবে।
কাজ করতে করতেই অন্য রুম থেকে ‘হায় হায়’ শব্দ ভেসে এল তার কানে। তার মা আর শাশুড়ি চিৎকার করে তাকে ডাকছে। সে ধীরে ধীরে ফোঁড় দেয় কাপড়ে। কাপড়টা এফোঁড়-ওফোঁড় হলেও উপরে কী সুন্দর চমৎকার সব নকশা আর ফুলে ফুলে ভরে যাচ্ছে। তার হৃদয়ও তো এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে আছে, অথচ সে কেন একরাশ হাহাকার আর শূন্যতার গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!
কিছুক্ষণ পর নিরুর মা পারুল হন্তদন্ত হয়ে তার কাছে এসে দাঁড়াল। কোলে নিরুর দেড় বছরের ছেলে। চোখেমুখে বেশ বিরক্তি নিয়ে তিনি বললেন, তুই কি মানুষ নিরু! জামাই হুইলচেয়ার থেকে পড়ে গেছে নিচে আর তুই এইদিকে...
নিরু কাজ থামায় না। একটা সুতো হঠাৎ জড়িয়ে যায় সুঁইয়ে। সে ধীরে ধীরে খুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, এ আর নতুন কি মা, এটা তো নিত্যকার ঘটনা!
তুই হাসছিস নিরু ? জামাই পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছে আর তুই কাপড়ে ফুল তুলছিস ? তুই পাষাণ হয়ে গেছিস নিরু। এই রকম মেয়েকে আমি পেটে ধরেছি, ভাবতেই...
নিরু হাসল। সশব্দে। এই কথার মধ্যে হাসির কি পেল নিরু! মেয়ের মাথাটা কি একেবারেই গেছে না কি ? হতেও পারে। স্বামীর এমন কঠিন বিপদ দেখে কোনো স্ত্রীর কি আর মাথা ঠিক থাকে ? এসব ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন পারুল।
নিরুর ছেলে কেঁদে উঠলে নিরু দ্রুত হাতে কাজ গুটিয়ে নিল। কাপড়টা নামিয়ে রাখল পাশে। ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আয়, আমার সোনা মানিক, আমার কলিজা। কোলে আয়।
তার মা এ বাসায় এসেছে প্রায় দুই মাস হয়েছে। তিনি আসাতে নিরুর অনেক কাজ সহজই হয়েছে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার, ছেলেটাকে দেখে রাখা, আরও অনেক কাজই করে তার মা। এসব তিনি নিজ থেকেই করেন। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাঝেমধ্যে চোখ ভিজে ওঠে নিরুর।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। নিরু একটা শাড়ি নিতে শাহাদের রুমের দিকে গেল। শাহাদ তার স্বামী। বছর খানেক আগে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় দুটো পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে সে। সেই থেকে বন্দি জীবন তার।
অলংকরণ : আশুতোষ দেবনাথ
একসময় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করত শাহাদ। কিন্তু দুর্ঘটনার পর চাকরিটা চলে যায়। কিছুদিন চেষ্টা করেছিল ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করতে, কিন্তু মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, মন বসে না কোথাও। দিনগুলো কেটে যায় হুইলচেয়ারে বসে বারান্দায় অথবা জানালার বাইরে তাকিয়ে।
নিরু রুমের দরজায় দাঁড়াতেই শুনতে পেল তার শাশুড়ি রত্নার গলা। শাহাদকে তিনি বলছেন, এখনো সময় আছে বউকে শাসন কর। নইলে কিন্তু পস্তাবি বলে দিলাম। পা গেছে তো কি হয়েছে ? হাত তো আছে তোর। হাত দিয়েও শাসন করা যায়।
দরজার ফাঁক দিয়ে নিরু দেখল, শাহাদ চুপচাপ শুয়ে আছে খাটে। চোখে তার কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া নেই। সিলিংয়ের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে।
নিরুর কাছে এসব নতুন কিছু নয়। ব্যবসাটা শুরু করার পর থেকেই রত্না বেগমের ব্যবহার দিনে দিনে বদলেছে। শুরুতে হয়তো কথার মধ্যেই থাকত একরাশ বিরক্তি, এখন তা প্রকাশ্যে অপমান আর কটাক্ষে রূপ নিয়েছে। আজকাল তো তিনি নিরুর চরিত্র নিয়েও কথা তুলছেন। সবার মাঝে বিষের মতো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সন্দেহ আর অপবাদ। অথচ তিনি ভালো করেই জানেন খরচের হাত দিন দিন লম্বা হচ্ছে। নিরুকেই তো সামলিয়ে নিতে হচ্ছে এবং হবে।
মধ্যবিত্ত সংসার তাদের, যাদের আয়-রোজগার থেমে গেলে প্রতিদিনের বাজারটাই হয়ে ওঠে যুদ্ধের মতো। শাহাদের বাবার রেখে যাওয়া একতলার পুরোনো বাড়িটাই এখন তাদের মূল সম্বল। তা ছাড়া শাহাদের চিকিৎসার পেছনে তার সব জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে যেখানে প্রতিটা টাকাই নিশ্বাসের মতো দামি, সেখানে নিরুর ব্যবসার ছোট্ট আয়ের উপরই দাঁড়িয়ে আছে এই ভাঙাচোরা সংসারের ভার। অথচ শাশুড়ির কাছ থেকে সাহস আর ভরসার বদলে পাচ্ছে শুধু তিরষ্কার আর নিন্দা।
ছেলের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে বিরক্ত হয়ে আবারও বলা শুরু করলেন রত্না বেগম।
প্রতিদিনই নানা কাজের বাহানায় বাসা থেকে বের হয় নিরু। কিসের এত কাজ থাকে প্রতিদিন ? মনে করেছে কিছু বুঝি না! বাইরে গিয়ে কার সাথে ফস্টি...
কথা শেষ করার আগেই নিরু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। নিজের কানে নিজের নামে কটুকথা শুনতে আর ইচ্ছে করল না তার। রত্না বেগম কথা বন্ধ করে চুপচাপ চলে গেলেন।
নিরু আলমারিতে সুতি নীল রঙের একটা শাড়ি খুঁজছে। এপাশ-ওপাশ খুঁজছে, পাচ্ছে না। শাহাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিরুর দিকে। কিন্তু নিরুর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
শাহাদ শান্তস্বরে বলল, আজকেও হুইলচেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, অনেক ব্যথাও পেয়েছি। তুমি আমাকে ধরতে এলে না কেন নিরু ?
সে তো তুমি রোজই পড়ে যাও। আর সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে। তা ছাড়া তোমার মা আর আমার মা তো আছেনই। তারা তোমাকে নিশ্চয়ই নিচে ফেলে রাখবে না। শাহাদের দিকে না তাকিয়েই বলল নিরু।
নিরু শাড়িটা কোথায়ও খুঁজে পাচ্ছে না। গেল কোথায় শাড়িটা! শাহাদ আবারও নিরুকে বলল, পিঠটা একটু চুলকিয়ে দিবে নিরু ?
তোমার পা গেছে কিন্তু হাত দুটো এখনো অক্ষত এবং মজবুত আছে। পাশে চিরুনি আছে সেটা দিয়েই পিঠ চুলকিয়ে নাও, নয়তো তোমার মাকে বলো। রেগে গিয়ে বলল নিরু।
তারপরও আমার কাছে আসবে না ? আহত কণ্ঠে বলল শাহাদ।
নিরু ইচ্ছে করেই শাহাদকে এড়িয়ে চলে। তার পা দুটো নেই, তাতে কী ? সৃষ্টিকর্তা যেন সেই অনুপস্থিতির ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছেন তার হাতে। এক পঙ্গু মানুষের শরীরে এত শক্তি, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। শাহাদ যখনই নিরুকে কাছে পায়, একরকম উন্মাদ হয়ে যায় যেন। তাকে জাপটে ধরে। তাকে আরও কাছে পেতে চায়। যেন এইটুকুই তার বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়। নিরুর দম বন্ধ হয়ে আসে তখন। মনে হয়, সে যেন কোনো এক অদৃশ্য দেয়ালে আটকে যাচ্ছে, বেরোবার পথ নেই।
না আসব না। তোমার কাছে আসার মতো কোনো কারণ অথবা রুচি নেই আমার। বলল নিরু।
শাহাদ এবার রাগে ফোঁসফোঁস করে ওঠে। হাতের কাছে রাখা চিরুনিটা নিরুর দিকে ছুড়ে মারে। তারপর হিসহিসিয়ে বলে, মা তাহলে ঠিক বলেন। প্রতিদিন বাইরে গিয়ে ফস্টিনস্টি করিস অন্য পুরুষদের সাথে। শরীরের জ্বালা মিটাতে যাস...বেশ্যা মেয়ে!
এসব কথা প্রথম প্রথম যখন শুনত নিরু, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারত না, কানে যেন ঝিঁঝি ধরে যেত। এখন আর ওসব হয় না। তবে তার গলা উঁচু হয়ে যায় এখন।
কী করব বলো, ঘরে অক্ষম স্বামী থাকলে বাইরে তো যেতেই হয়। শারীরিক চাহিদা বলে কথা! শরীর বিদ্রোহ করে বসে যে! রহস্যময় হাসি হেসে বলল নিরু।
নষ্টা মেয়ে। তুই কাছে থাকলে এখনই তোকে খুন করে ফেলতাম। অতিরিক্ত রাগে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শাহাদ।
নিরু হাসল। একটু জোরেই হাসল, যেন শাহাদ কোনো মজার কথা বলেছে। হাসি থামিয়ে বলে, ‘নষ্টা মেয়ে’ কথাটা আমি জীবনে অসংখ্যবার শুনেছি। কিন্তু ‘নষ্ট পুরুষ’ কেউ কাউকে কোনো দিন বলেছে, এটা আমি শুনি নি। কেন বলো তো ? কেন এত নারী-পুরুষের বৈষম্য ?
নিরু আর দাঁড়াল না। দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। আর শাড়িটাও সে খুঁজে পেয়েছে। নিরু যেতে যেতে শাহাদকে বলল, যাওয়ার সময় দেখা করে যাব। বাইরে বেরোনোর আগে কেমন সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে যাই, সেটা দেখিয়ে যাব তোমাকে। আর তোমার কিছু লাগলে বলো, নিয়ে আসব।
শাহাদ অসহায় চোখে নিরুকে যেতে দেখল। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কিন্তু সে কিছুই বলল না, হয়তো যা বলার তা বলা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
নিরু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সোজা সুতোর দোকানে যায়। নানা রঙের সুতো কিনে ব্যাগভরে। পাশের ফুলের দোকান থেকে বেলিফুলের মালা কিনে খোঁপায় পরে নেয়। তারপর রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে বেশি করে টক-ঝাল দিয়ে এক প্লেট ফুচকা খায়। বেশি ঝাল লেগেছে বলে একটা আইসক্রিমও খায়।
এসব নিরু প্রায়ই করে। তাকে আদিখ্যেতা করার, হাত ধরে রাখার কেউ নেই। সে এসব করে নিজেকে ভালোবেসে। আর এই ভালোবাসাটুকু তাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রতিদিন।
ছেলের জন্য ডায়পার কিনতে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকল নিরু। শেলফের দিকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা নোংরা হাত তার বুক ছুঁয়ে চলে গেল ঠিক তখনই। এক সেকেন্ডের জন্য জমে যায় নিরু। তারপর তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে আগুনে রূপ নেয়। সে চট করে ঘুরে দাঁড়ায়। দেখে এক মাঝবয়সী লোক। মুখে পৈশাচিক হাসি, তাকে দেখে নিজের ঠোঁট চাটল লোকটা। তারপর চোখ নামিয়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে যাচ্ছিল, যেন কিছুই হয় নি।
নিরুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে এক ধাক্কায় লোকটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। পাশে ছিটকে পড়ে লোকটা। দোকানের সিকিউরিটি আর বাকিরা ফ্যালফ্যাল করে দেখে তা। তারা কেউই প্রথমে ঘটনাটা বুঝতে পারে নি। নিরু ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার ওপর। তারপর এলোপাথাড়ি লাথি ঘুষি মারতে মারতে বলে, তুই ভাবলি, আমি চুপ করে চলে যাব ? জানোয়ারের বাচ্চা! নিরুর শরীরে যেন অশরীরী আত্মা ভর করেছে। মনের মধ্যে জমে থাকা সব ক্ষোভ, অপমান যেন বেরিয়ে এল মুহূর্তে।
তার খোঁপা খুলে গেছে। মুখটা ঘামে ভিজে উঠছে। কিন্তু চোখে এখনো হিংস্রতার ছাপ।
লোকটা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। পাশ থেকে লোকজন এসে টানছে নিরুকে। কিন্তু সে থামে না।
আজ আমি থামব না। কারণ তোদের মতো লোক থামে না, যতক্ষণ না একটা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থামিয়ে দেয়! বলে ওঠে নিরু।
চারপাশে লোক ভিড় করেছে। সবাই অবাক হয়ে নিরুকে দেখছে। একটা ছোটখাটো গড়নের মেয়ে, এতটা মায়াবী আর নিষ্পাপ চেহারার অথচ তার প্রতিবাদের গর্জন এতটা ভয়ংকর হতে পারে তা যেন কল্পনার বাইরে। একজন মহিলা বলে উঠল, ভালো করেছ মেয়ে! এভাবেই এদের শায়েস্তা করতে হবে।
নিরু তার জুতা দিয়ে লোকটার পায়ের আঙুল পিষে দেয়। লোকটার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, চোখেমুখে ব্যথা, ভয় আর অপমানের ছাপ স্পষ্ট। নিরু তার দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে বলে ওঠে, আমার চেহারাটা চিনে রাখ, শুয়োরের বাচ্চা। পরের বার কাউকে স্পর্শ করার আগে মনে করিস।
সিকিউরিটি লোকটাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল। নিরু ডায়াপার হাতে সোজা ক্যাশ কাউন্টারে যায়। আত্মবিশ্বাসে ভরা মন আর মাথা উঁচু করে।
শাহাদ হুইলচেয়ারে বারান্দায় এসে বসেছে। এখান থেকে রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যায়। নিরু এখনো বাসায় ফেরে নি। মেয়েটার জন্য শাহাদের বুকে তীব্র দাবানলের মতো ছড়িয়ে আছে ভালোবাসা। অথচ সেই ভালোবাসা এখন নিরুর চোখে পড়ে না। তার চোখে এখন শুধু ঘৃণা আর নীরবতা। শাহাদ নিজেই পুড়ে যায় তার সেই এক পাক্ষিক ভালোবাসায়।
বিকেলের রোদ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। হলুদ আলোয় ঝিম ধরে আছে বারান্দার ধূসর কার্নিশ, আর হুইলচেয়ারে বসে থাকা শাহাদ বুকের ভেতর খুলে বসেছে একেকটা স্মৃতি।
চার বছর আগে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় শাহাদ আর নিরুর। অবশ্য এতে শাহাদের আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল। নিরুকে প্রথম দেখেই খুব পছন্দ করে ফেলেছিল সে। এরপর দেখতে দেখতে এক বছর সুখেই কেটে গেল তাদের সংসার। তবে সেই সময়টা একটা বিষয় ছিল খুব পরিষ্কার। নিরু প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছিল শাহাদকে। আর শাহাদ ? সে হয়তো তখনো বুঝে উঠতে পারে নি যে, ভালোবাসা মানে কেবল আগ্রহ নয়, যত্নও বটে। তারপর...সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের রং বদলাতে শুরু করল। শাহাদ বদলে গেল।
অফিসের নামে রাত করে ফেরা, মোবাইলে অচেনা নাম্বার, অকারণ রাগ। সবকিছু মিলিয়ে নিরুর মনে প্রথম সন্দেহ দানা বাঁধে। প্রথমদিকে চোখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল সে। ভাবত, হয়তো নিজেরই কোনো ভুল! একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু একদিন সে দেখে ফেলল এক মেয়ের সাথে শাহাদের ঘনিষ্ঠ ছবি—মেয়েটা শাহাদের কলিগ। অফিসের বিভিন্ন কাজের ছুঁতোয় প্রায়ই রাত কাটাত হোটেলে। নিরু এসবের ব্যাখ্যা চাইলে শাহাদ দিত না। শুধু চিৎকার, রাগ, অপমান আর অবশেষে হাত তুলতে শুরু করল নিরুর ওপর। বাবাহীন নিরুর কোনো আশ্রয় ছিল না যাওয়ার। মুখ বুজে সংসার করে যায় সে।
একসময় শরীরে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব টের পেল নিরু। ভেবেছিল এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না! প্রেগনেন্সির খবর শুনে নিরুর সাজা আরও বাড়িয়ে দিল শাহাদ। প্রতিনিয়ত ডিভোর্সের ভয় দেখাত। নিজের অপমান, চোখের পানি, আর অসহায়তা, সবকিছু গিলে নিরু শুধু চুপ থেকেছে সেই অনাগত সন্তানের জন্য। যে সময়টায় শাহাদের সবচেয়ে পাশে থাকার কথা ছিল, যার হাত হতে পারত নির্ভরতার একমাত্র প্রতীক, ঠিক তখনই তা হয়ে উঠেছিল অবহেলা আর নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি। হাত দিয়ে নিরুকে আঘাত করতে একবারও হাত কাঁপত না শাহাদের।
অবশেষে নিরুর ফুটফুটে এক ছেলে হয়। ছেলেকে দেখেও শাহাদের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে ঠিক করল, নিরুকে ডিভোর্স দিয়ে সেই কলিগকে বিয়ে করবে। ছেলের ছয় মাস যেতে না যেতেই ডিভোর্সের জন্য তোড়জোড় শুরু করল শাহাদ।
একদিন ডিভোর্স পেপার হাতে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিল শাহাদ। মনে তখন নতুন সংসারের ভাবনা। পুরোনো মানুষ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ ছিল চোখে মুখে। মুখজুড়ে ছিল বিস্তীর্ণ হাসি। হঠাৎ সে হাসি মিলিয়ে গেল ট্রাকের ধাক্কায়।
হাসপাতালের বিছানায় পড়ে ছিল সে অসহায়, নিরুপায়। সব জেনে তখনো পাশে ছিল নিরু। তবে নিরুর চোখে তার জন্য কোনো মায়া আর দেখে নি শাহাদ। এর বদলে জায়গা নিয়েছে করুণা। নিরুর কাজেকর্মে প্রতিনিয়ত যেন ফুটে ওঠে শাহাদের প্রতি অব্যক্ত বার্তা। যেন সে বলছে, ‘সারাজীবন তুমি আমার করুণার পাত্র হয়ে থাকবে, এটাই তোমার শাস্তি আর এটাই আমার প্রাপ্তি।’
আজ শাহাদ বুঝতে পারে, নিরু আসলে কী ছিল তার জীবনে! সে যা পেয়েছিল, তা ছিল একটা নিঃস্বার্থ হৃদয়, অথচ সে নিজ হাতে সবকিছু নষ্ট করে ফেলেছে। একসময় যে হাত দিয়ে নিরুকে আঘাত করত, আজ সেই হাত খুঁজে বেড়ায় নিরুর চুল, হাত বোলানোর জন্য। যে চোখ একসময় অন্য কারও দিকে ছিল, আজ সে চোখ সারাক্ষণ নিরুর পায়ের শব্দ খোঁজে।
নিরুকে ভালোবাসে শাহাদ। কিন্তু সেই ভালোবাসা দিয়ে নিরুকে ছুঁতে গেলেই কাটে, জ্বালায়, পোড়ায় তাকে। এটাই তার প্রাপ্য শাস্তি।
ইদানীং মধ্যরাতে পারুলের ঘুম ভেঙে যায় নিরুর গোঙানির শব্দে। ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা কাঁদে। একটা চাপা কান্না, যেন বুকের গহিন কষ্ট ঘুমের পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে আসে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.