মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত লাহিনীপাড়া

মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত লাহিনীপাড়া

‘শেকড়ের সন্ধানে’র এই পর্বে আমাদের কাঙ্খিত মানুষটি হলেন মীর মশাররফ হোসেন। সেই মশাররফ হোসেন— যিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রথম সার্থক সাহিত্যশিল্পী। ঊনিশ শতকের সেই সব্যসাচী লেখক— যিনি রচনা করেছেন উপন্যাস, উপাখ্যান, নকশা, নাটক, প্রহসন, পদ্য কবিতা, সংগীত, প্রবন্ধ, জীবনী, আত্মজীবনী, ছাত্রপাঠ্য পুস্তক প্রভৃতি। এই সব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টাটি জন্মেছিলেন অবিভক্ত নদীয়া (বর্তমানে কুষ্টিয়া) জেলার কুমারখালী থানার অন্তর্গত গড়াই নদীর তীরবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে।

আমরা ঢাকা থেকে নাইট কোচে এসেছি কুষ্টিয়ায়। উঠেছি এক হোটেলে। বিশ্রাম ও সকালের নাস্তা সেরে রিকশাতে চলেছি লাহিনীপাড়ার উদ্দেশে।

কুষ্টিয়া শহর থেকে লাহিনীপাড়া বেশ দূরের পথ। যতই এগোচ্ছি শহরের পরিচিত অবয়ব ততই অপসৃয়মাণ— খোলা প্রান্তর, বৃক্ষ আর সবুজের রাজ্যে প্রবেশ করছি।...কুষ্টিয়ার শেকড় সন্ধানে ধাবিত হলে আমরা এই তথ্য জানতে পারি যে, মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে গড়াই নদী তীরে একটা বন্দর গড়ে উঠেছিল। সেই নদীবন্দরটিই পরবর্তী সময়ে ‘কুষ্টিয়া’ নামে পরিচিতি পায়।

বহু বছর পর কুষ্টিয়ার মাটিতে আমার পা পড়ল। দেখতে পাচ্ছি, কুষ্টিয়ার দারুণ পরিবর্তন হয়েছে। কুষ্টিয়া শহরে বহুতলা দালানের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে নাগরিক সুবিধাদি। এমনকি শহরের নানা প্রান্তেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।

ধীরে ধীরে রিকশা চালাচ্ছে রিকশাশ্রমিক। আমাদের চারপাশে এখন সবুজ শস্যের অবারিত ভূমি। মাঝে মাঝে বাড়িঘর। দুরন্ত বাতাস খেলা করছে মাথার চুলে। ভালো লাগছে, বেশ ভালো লাগছে!

‘আর কত দূরে লাহিনীপাড়া?’ এই প্রশ্নের জবাবে রিকশাশ্রমিক সমুখে অঙুলি নির্দেশ করে জানাল যে, আর বেশি সময় লাগবে না, কাছেই আমাদের কাঙ্খিত স্থানটি।...সত্যিই তাই, কিছুক্ষণ পরেই আমাদের চোখে পড়ল পথের ধারের একটি ফলক— মীর মশাররফ হোসেন সড়ক।

আমাদের রিকশাওয়ালা দিক পরিবর্তন করল। রাজপথ থেকে প্রবেশ করল জনপদে। আমার মনে কবিতার পঙ্ক্তিমালা গুনগুনিয়ে উঠল: ‘এই পথ শুয়ে আছে পথের ওপর/ওই নীলে মিশে আছে আরও নীল।’

লাহিনীপাড়ার মীর মশাররফ হোসেন সড়কের ওপর দিয়ে আমাদের রিকশা চলছে। দুই দিকে দোকানপাট, বাড়িঘর। বৃষ্টি হয়েছে বোধহয় কিছুক্ষণ আগে। মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে লাগছে।...আমাদের রিকশার পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটি গাই, অদূরে ছোট্ট খোলা জায়গায় খড় চিবোচ্ছে একটি ছাগল, পাশেই খড়ের স্তূপ; একটি বাড়িতে দেখা গেল ঢেঁকিতে ধান ভানছে বয়স্ক এক মহিলা।

পথের ধারের এক চায়ের দোকানের সামনে থামতে বললাম রিকশাশ্রমিককে। এক তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম মীর মশাররফ হোসেনের আবাসভূমি সম্পর্কে। সে জানাল, কাছেই সেই স্থান; তবে এখন সেখানে গড়ে উঠেছে দুটি বিদ্যালয়। অবশ্য তার আগে আমরা ইচ্ছে করলে দেখতে পারি মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম স্ত্রী আজীজান্নেসার কবর।...তরুণটির কথায় সায় দিয়ে আমরা জানালাম যে, হ্যাঁ, প্রথমে আমরা মীর মশাররফের প্রথম পত্নীর কবরই দেখব, সে যেন অনুগ্রহ করে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।

তরুণকে অনুসরণ করে আমরা পথের ধারের একটি জায়গায় উপস্থিত হলাম। দেখলাম ছোট্ট এক বাঁশবনের ভেতর বাঁধানো একটি কবর। কবরের গায়ে কবরবাসিনীর পরিচয় উৎকীর্ণ রয়েছে। হ্যাঁ, এখানেই শুয়ে রয়েছেন মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম স্ত্রী আজীজান্নেসা—যাকে দেখে মশাররফের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল গভীর বিতৃষ্ণার। তাঁর ভাষায়, ‘আমি নজর করিতেই আমার হৃদয় কাঁপিয়ে উঠিল। আরসীর দিকে তাকাইয়া থাকিতে পারিলাম না। চক্ষু নিচে করিয়া মাথা হেঁট করিলাম। আমার কলিজার কাঁপুনি তখনো যায় নাই। চক্ষে পড়িল, চক্ষে ছায়া পড়িল গৌরবর্ণ কিন্তু মুখের গঠন ওষ্ঠ অধর চিবুক নিতান্তই কদাকার। নাসিকা একপ্রকার নাই বলিতেও হয়। ভ্রুর রেখা আছে মাত্র। এক নজরে দেখিয়া আর দেখিতে ইচ্ছা হইল না।...কেবল ঈশ্বরের নিকট হৃদয় হইতে কান্দিয়া কহিলাম, দয়াময়! আমার কপালে ইহাই ছিল!’ আসলে আজীজান্নেসার সঙ্গে মশাররফের বিয়ে ছিল একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনা। শ্বশুর নাদের হোসেনের গোপন ইচ্ছের বলিতে রক্তাক্ত হয় মশাররফের হৃদয়। কেননা, তিনি ভালোবেসে ছিলেন নাদের হোসেনের প্রথমা কন্যা লতিফননেসাকে— তাকেই জীবনসঙ্গিনী করতে চেয়েছিলেন। লতিফনের সঙ্গে তাঁর গভীর প্রেমের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। অবাঞ্ছিত বিয়ের পরে লতিফন তাই বেশি দিন বাঁচেন নি। মশাররফের কোলে মাথা রেখেই তিনি মারা যান। সংগত কারণেই আজীজান্নেসার সঙ্গে মশাররফের দাম্পত্যজীবন সুখের হয় নি। স্ত্রীর আচার-আচরণে মশাররফ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল বিষময়। কিন্তু একটি বিষয় বেশ রহস্যময়, যে স্ত্রীকে মশাররফ পছন্দ করতেন না—অকপটে যে কথা তিনি স্বীকার করতেন—সেই স্ত্রীর নামেই কেন যে তিনি ‘আজিজন নেহার’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন!

আজীজান্নেসার কবর দেখার পরে পরিচিত তরুণের নির্দেশিত পথে আমরা পৌঁছে যাই মীর মশাররফ হোসেনের জন্মস্থানে— আবাসভূমিতে। দেখতে পাই, বর্তমানে এখানে দুটি বালিকা বিদ্যালয় অবস্থিত। প্রবেশ পথে একটি তোরণ নির্মিত হয়েছে। সেখানে ইটের গায়ে উৎকীর্ণ রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কিত তথ্য।

মীর মশাররফ হোসেন জন্মেছিলেন এখানেই, লাহিনীপাড়ায়, ১৮৪৭ সালে, ১৩ নভেম্বরে। আর ১৩১৮ বঙ্গাব্দের শেষের দিকে তথা ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে মীর মশাররফ হোসেনের মৃত্যু হয়—শেষ কর্মস্থল রাজবাড়ীর পদমদীতে। এর আগে মৃত্যু ঘটে মশাররফের দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমের।...কুলসুমের মৃত্যুতে নিজের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— ‘সময় সময় মনে হয়, আমার সর্বস্ব গিয়াছে, ঘরকান্না গিয়াছে, একের অভাবে সমুদয় ধ্বংস হইয়াছে। আমার আর কিছু নাই। মাথা আছে মস্তিষ্ক নাই, জীবন আছে জীবনীশক্তি নাই...।’

বিবি কুলসুমের প্রকৃত নাম কালী। তিনি কুষ্টিয়ার নওপাড়া থানার অন্তর্গত বারখাদা গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কালীর মা লালন ও বাবা শেখ সদরদ্দীর মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে কালীর মা ছেলে মন্দির ও মেয়ে কালীকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে লাহিনীপাড়ার দক্ষিণে সাঁওতা গ্রামে আশ্রয় নেন। এখানে বালিকা কালীর সঙ্গে মশাররফের বহুবার দেখা হয়। ঘোড়সওয়ার মশাররফের দিকে কালী অবাক চোখে চেয়ে থাকত। এমনিভাবে কেটে যায় তিনটি বছর। একদিন দুপুরবেলা গ্রামের দক্ষিণে মাঝিদের পাড়ায় আগুন লাগে। মীর মশাররফ হোসেন মাঠের ভেতরে পৌঁছাতেই ভীতসন্ত্রস্ত কালী কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে এসে তাঁর বুকের মধ্যে মাথা গোঁজে। এত বিপদ ও ভয়ের মধ্যেও মশাররফের হৃদয় থেকে এই কামনা বেরিয়ে আসে ‘যে বক্ষে মাথা রাখিয়াছে যে বুকে বুক মিশাইয়াছে চিরকাল যেন এইভাবে থাকে।’ এরপর একপর্যায়ে মীর মশাররফ কালীকে বিয়ে করেন। বিনদীয়ার পীর কালীর নাম রাখেন ‘কুলসুম’।

কুলসুমের সঙ্গে মশাররফের দাম্পত্যজীবন ছিল শান্তি, সুখ ও সাফল্যে পরিপূর্ণ। মশাররফের সাহিত্যিকজীবনে কুলসুমের প্রেরণা ছিল তাঁর চলার পথের পাথেয়।...পঁয়ত্রিশ বছরের দাম্পত্যজীবনে কুলসুম ছয় মেয়ে ও পাঁচ ছেলের জননী হন। অন্যদিকে, প্রথম স্ত্রী আজীজান্নেসার গর্ভে মশাররফের দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্মে। এ ছাড়া ইঙ্গ-বঙ্গ-বারাঙ্গনার গর্ভে মশাররফের এক পুত্র জন্মেছিল।

মীর মশাররফ হোসেনের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কেউ এখানে রয়েছেন কি? এই প্রশ্নের জবাবে আমাদের সঙ্গী তরুণটি জানালেরন যে, হ্যাঁ লাহিনীপাড়ায়ই, রাজপথ সংলগ্ন একটি বাড়িতে মীর মশাররফ হোসেনের বংশধরেরা রয়েছেন। নাতি মীর আবদুল হামিদের নাতি-নাতনিদের বসবাস সেখানে। তাঁদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র—বদনা, থালা, চেয়ার, টুল...।

ডান দিকে চোখে পড়ল মীর মশাররফ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে মাটিতে এই বিদ্যালয়টি অবস্থিত একদিন এই মাটিতে একটি পাঠশালা ছিল—জগমোহন নন্দীর পাঠশালা। মশাররফের পিতার অনুরোধে নন্দী মশাই লাহিনীপাড়ার উত্তরে জায়নাবাদ গ্রাম থেকে পাঠশালাটি উঠিয়ে এনেছিলেন এখানে। আর নন্দী মশাইয়ের কাছেই মীর মশাররফ হোসেনের পরিচয় ঘটে বাংলা বর্ণমালার। অবশ্য এর আগে লাহিনীপাড়ার পাশের গ্রাম পাহাড়পুরের মুনশী জমিরুদ্দীনের কাছে শেখেন আরবি। এরপর মশাররফ পড়েন কুষ্টিয়া স্কুল, পদমদীর ইংরেজি-বাংলা স্কুল এবং কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট স্কুলে।

মীর মশাররফ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চোখ ফেরাতেই আমাদের দৃষ্টিপথে এল কয়েকটি স্তম্ভ। স্তম্ভের ওপরে লেখা রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের অমর গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’র কয়েকটি অমূল্য বাণী, যেমন— ‘স্বাধীনতা-সূর্য একবার অস্তমিত হলে পুনরুদ্ধার হওয়া বড়াই ভাগ্যের কথা।’ ‘প্রণয়, স্ত্রী, রাজ্য, ধন— এই কয়েকটি বিষয়ের লোভ বড়ই ভয়ানক। এই লোভে লোকের ধর্ম, পুণ্য, মাধুর্যতা পবিত্রতা—সমস্তই একেবারে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়।’...মীর মশাররফ হোসেন সব ধরনের লেখাই লিখেছেন। ‘বিষাদ সিন্ধু’ ছাড়াও তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে—জমীদার দর্পণ, উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়াঁর বস্তানী, আমার জীবনী, বিবি কুলসুম। মশাররফের পঁচিশটি গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া গেছে। আরও কিছু অপ্রকাশিত রচনা ও গ্রন্থের কথা জানা যায়।

মীর মশাররফ হোসেন শিশুকাল থেকে নাচ-গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। পিতার পত্রলিখনের মুসাবিদা করার সূত্রে বাংলা গদ্যরচনায় তাঁর নৈপুণ্য জন্মে। বলা যায়, কৈশোরে মশাররফ পত্রলিখন আর বাংলা হেঁয়ালী রচনায় বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কৈশোরে তাঁর মধ্যে যে সাহিত্যবোধ গড়ে ওঠে তা একাত্তই গ্রাম্য-পুঁথির রুচি শাসিত। পুঁথির এই রুচি থেকে তিনি মুক্তি পান ঢাকায় বেড়াতে এসে। এক আত্মীয়ের বাসায় এক হিন্দু শিক্ষকের দেওয়া ‘শব্দার্থ প্রকাশিকা’ ও ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থ দুটি পড়ার মাধ্যমে। তবে মশাররফের সাহিত্যচর্চার প্রকৃত হাতেখড়ি বলা যায় ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিত’ সম্পাদক কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ ও কলকাতার ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তাদের সম্পাদিত পত্রিকায় মশাররফ লিখতেন মফস্বল সংবাদ ও মাঝে মধ্যে প্রতিবেদন।...কাঙাল হরিনাথের অনুরোধ মশাররফ ফিকির চাঁদের দলের জন্যে সুরে কথা বসিয়ে একটি গান রচনা করেন। বলা যায়, এই গানটিই মশাররফের প্রথম স্বকীয় সৃষ্টি। গানটির প্রথম দুটি ছত্র ছিল— ‘রবে না চিরদিন সুদিন কুদিন একদিন দিনের সন্ধ্যা হবে/আমার আমার সব ফক্কিকার কেবল তোমার নামটি রবে।’

মীর মশাররফ হোসেনের বহু রচনাই আত্মজীবনীমূলক রচনা (যেমন, ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা)’। ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিষয় তাঁর অন্যান্য রচনাতেও ছায়া ফেলেছে। যেমন— মশাররফের দ্বিতীয় স্ত্রী কুলসুমকে তাঁর প্রথম স্ত্রী আজীজান্নেসা হত্যার ষড়যন্ত্র করেন এবং ব্যর্থ হন। নারী চরিত্রের এই ক্রোধান্ধ অসূয়া মীর মশাররফ হোসেনের কথাশিল্পী-মানসে প্রচ- দাগ ফেলে—যার পরিণত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে হাসানের প্রথম স্ত্রী হাসনে বানু ও দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদার চরিত্রাঙ্কনে।

স্তম্ভগুলো পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে। লক্ষ করি স্কুল চত্বরে একটি ল্যাংড়া জাতের আমগাছ। আমাদের পথপ্রদর্শক তরুণটি জানাল, এই আম গাছটি মীর মশাররফ হোসেন নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন।...আমরা তরুণটির কাছে জানতে চাই আরও কিছু এখানে রয়েছে কি না—যেগুলো মীর মশাররফ  হোসেনের স্মৃতি বহন করছে। হ্যাঁ রয়েছে—তরুণটি আমাদেরকে জানায় এবং সে আমাদেরকে নিয়ে যায় বালিকা বিদ্যালয়টির ডান দিকের একটি খোলা জায়গায়। আবিষ্কার করি একটি কুয়ার সামনে দ-ায়মান আমরা। তরুণটি জানায়, এই কুয়াটি বেশ প্রাচীন। এর পানি পান করেছেন মীর মশাররফ হোসেন স্বয়ং। আর কিছু? তরুণটি জানায়, মশাররফের ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছে— সেই কথা তো আগেই বলেছে সে।

মীর মশারররফ হোসেনের বসতভিটা ঘুরেফিরে দেখলাম আমরা। এখানকার স্থানীয় মানুষ, আমাদের পথপ্রদর্শক তরুণ জানাল যে, বাংলা একাডেমির কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আবেদন জানিয়েছে যে, এখানে সরকারি উদ্যোগে ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র’ স্থাপিত হোক। তার এই কথায় আমার মনে পড়ে গেলে যে, রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলাধীন পদমদী গ্রামে বর্তমানে বাংলা একাডেমির পরিচালনায় ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র’ তৈরির কাজ চলছে। মোট এক একর জমির ওপর এই স্মৃতিকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। এখানে থাকবে গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা, অতিথিশালা ও অফিস ভবন। সেখানে মশাররফ পত্নী বিবি কুলসুম ও মীর মশাররফ হোসেনের কবরও রয়েছে। আরেকটি কারণে পদমদীর গুরুত্ব রয়েছে। সেটি হচ্ছে, পদমদী এস্টেটই ছিল মীর মশাররফ হোসেনের শেষ কর্মস্থল। এ ছাড়া তিনি কাজ করেছেন দেলদুয়ার এস্টেটে। স্বল্পকাল কাজ করেছেন পাবনা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে। কলকাতায় তিনি বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অনারী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করেন। পৈতৃক জোত-জমা ও নিজের বই-পুস্তক থেকেও আয় উপার্জন হতো।

পথপ্রদর্শক তরুণটির কাছে বিদায় নিয়ে রিকশায় চড়ে লাহিনীপাড়া ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশে যাত্রা করি আমরা। ...মীর মশাররফ হোসেন সড়ক থেকে এক সময় রাজপথে নামল আমাদের রিকশা, তারপর এক সময় কুষ্টিয়া শহরে...। জনারণ্যে মিশে গেল আমাদের রিকশা, মিশে গেলাম আমরা।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.