খাঁচা।। মাসউদ আহমাদ

খাঁচা।। মাসউদ আহমাদ

মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেম কখনো ভুলতে পারে না। আবার এমন হয়, সে তার কোনো প্রেমই ভোলে না। জনান্তিকে এ কথাও ফেলে দেওয়া যায় না— সব প্রেমই মানুষ ভুলে যায়।

ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথাই কেবল মনে আসে নীতুর।

 

একদুপুরে, রাহাত আলমের পাসপোর্ট আকারের ছবিটা দেখে নীতু বেশ অবাক হয়। অবাক ও বিস্মিত; সে দুটোই হয়েছে।

নীতুর প্রথমে মনে হয়েছিল, সে ভুল দেখছে। একই রকম দেখতে পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে। এই লোক কিছুতেই সেই রাহাত আলম নয়, যাকে সে একসময় চিনত। সামান্য চেনা নয়, তাঁর সঙ্গে নীতুর একজীবনের স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া ও জীবনের গল্প বাঁক নিয়েছিল।

না, রাহাত আলমকে সে পায় নি। স্বপ্ন ও চাওয়া-পাওয়া এখন তার কাছে সবচেয়ে অসহ্য শব্দ। তবু কী আশ্চর্য, এতদিন পর আজ এসব শব্দেই নিজেকে প্রকাশ করতে হচ্ছে।

আপা, এই যে আপনার চিনিছাড়া লেবু-চা।

নীতুর কি খানিকটা ঝিমুনির মতো এসেছিল? মাথা ঝাঁকিয়ে সে বাস্তবে ফিরে আসে। চায়ের কাপে চোখ রেখে একবার সামনে তাকায়। অফিসের কমবয়সী আয়াটা কী বুঝল কে জানে, সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। 

নীতু বেসরকারি ব্যাংকের যে শাখায় কাজ করে, সেটি প্রচলিত কোনো ব্রাঞ্চ নয়। এখানে নগদ টাকার লেনদেন ও সরাসরি পাবলিক রিলেটেড কোনো সার্ভিস নেই। বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা—বিশেষ করে নানা প্রতিষ্ঠানের স্যালারি অ্যাকাউন্ট, লোন, লিমিটেড ও বিজনেস অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ করা হয়। ক্লায়েন্ট চেকবই ও ডেবিট কার্ড নেবে কি না, সিস্টেমে সেসব রিক্যুজিশন দেওয়া এবং কোন ব্রাঞ্চ থেকে তা নেবে, কী সুবিধা থাকবে; প্রধানত এসব নিয়েই কাজ।

এর বাইরেও কিছু কাজ থাকে। মানুষের জীবনই তো সব সময় নিয়ম মেনে আর মেপে চলে না। চাকরির ক্ষেত্রেও সে রকম অলিখিত নির্দেশিকা থাকে। প্রতিষ্ঠান তার সুবিধা ও মর্জি অনুযায়ী যে-কোনো আউটলেট বা ব্রাঞ্চে পাঠাতে পারে। ট্রান্সফার, এমনকি কাজের ধরন বদলে দিতে পারে।

ব্যাংকের চাকরিতে সাড়ে চার বছর পেরিয়েছে নীতুর। কাজের পরিবেশ ও নতুন সিস্টেমের সঙ্গে সে অ্যাডজাস্ট করে গেছে। এটা অফিসের প্রয়োজনেই সে করে, এমন নয়। জীবন ও তার দাবির প্রবহমানতাকে সে কতগুলো ফর্মুলার ভেতরে নিয়ে নিতে পেরেছে। বৈরী বাতাস ও টুকরো বিপদেও সে শান্ত থাকে, ঘাবড়ে যায় না।

দুপুরে, লাঞ্চের পর নীতু ডেস্কে এসে বসতেই বস এসে সামনে দাঁড়ালেন। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের একটা ফাইল ধরিয়ে দিলেন। বললেন, দিস ইজ ভেরি আর্জেন্ট।

নীতু মৃদু হাসে, জি বস, এখনই করে দিচ্ছি।

কোনো ফাইলে ক্লায়েন্টের জন্য নতুন অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনারেট করার আগে প্রাথমিক কিছু কাজ থাকে। অ্যাকাউন্ট ফরমটা প্রপারলি স্ক্রিনিং ও ডাটা চেক করা; সাপোর্টিং ডকুমেন্ট, ইনকাম সোর্স ও তার ডকুমেন্ট, ক্লায়েন্ট বিজনেসম্যান হলে ট্রেডলাইসেন্স দিয়েছে কি না; এমনকি তার জাতীয় পরিচয়পত্রটা ভুয়া না আসল, তা ভেরিফাই করে দেখে নিতে হয়।

জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের ফাইলটা মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনিং করছে নীতু, তখন হঠাৎই রাহাত আলমের পাসপোর্ট আকারের ছবিটা সামনে আসে। রাহাতের ছবির পাশে অল্পবয়েসী একটা সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটিকে রাহাত তার একাউন্টের নমিনী করেছেন।

রাহাত আলমের ছবিটা নীতু ভালো করে দেখে। আবার দেখে। চোখ সরু করে আর একবার দেখে। আরও একবার। পাঁচ বছর পরে তাকে শেষ দেখছে নীতু; মুখের আদল, কপাল ও চুলের ধরন বদলে গেছে। রাহাতকে সে কখনো চশমা পরতে দেখে নি, আজ দেখছে। তবু চিনতে অসুবিধা হয় না।

রাহাত আলম তাহলে আবার বিয়ে করেছে?

আমার সঙ্গে তো ডিভোর্স হয় নি। সে কীভাবে আর একটি বিয়ে করল? সম্পর্ক আরম্ভ করার দু’ একটা নিয়ম আছে, সমাপ্তিরেখা টেনে দেওয়ারও নিশ্চয়ই কিছু থাকা উচিত; ভাবে সে।

অফিসের কেউ অবশ্য নীতুর বিয়ের খবরটা জানে না। সবাই জানে, সে স্বল্পভাষী, রাগী ও গম্ভীর ধরনের মেয়ে। তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে, সাধরণত যে বয়সে মেয়েরা বিয়ে করে, দশ বছর আগেই তা পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সে এখনো অবিবাহিত।

নীতু ধন্দে পড়ে যায়, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ড হোল্ডারের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। দুজনের সম্পর্কটা কী? রিলেশনশিপ উইথ নমিনীর ঘরটা ফাঁকা। ফরমে কিছু লেখা নেই। নমিনীর ছবি ও সম্পর্কটা পরিষ্কারভাবে লেখা না থাকলে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না।

কী করা যায়?

অ্যাপ্লিকেন্ট, মানে রাহাত আলমের নম্বরে ফোন করে নীতু। যতটা না সম্পর্ক জানতে, লোকটা আসলেই তার চেনা সেই রাহাত আলম কি-না— নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

রাহাত আলমের ফোন বন্ধ। সে আর একবার ফোন করে। সংযোগ পাওয়া যায় না। নীতুর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। একবার ভাবে, এই লোককে কিছুতেই ছাড়া যাবে না। যোগাযোগ না থাক, এখনো সে তার স্ত্রী। ফরমালি তাদের ডিভোর্স হয় নি। কাজেই রাহাত আলম আর একটা বিয়ে করলে করুক, আপত্তি নেই। নিয়ম অনুযায়ী আমাকে খোরপোষ দিতে হবে। এটা আমার আইনি অধিকার।

কিন্তু লোকটির সঙ্গে নীতু যোগাযোগ করবে কীভাবে? তখন, এমন গম্ভীর ও সিরিয়াস মুডের ভেতর থেকেও সে হেসে ফেলে। ফরমের ভেতরে, ইনডিভিজ্যুয়াল ইনফরমেশনের পাতায় তো ঠিকানা দেওয়া আছে। নীতু চিরকুটে ঠিকানাটা লিখে নেয়।

 সাত বছর আগে, একরকম পছন্দ করেই দুজনের বিয়ে হয়েছিল। ব্র্যাকের একটা প্রজেক্টে ওরা একসঙ্গে কাজ করত। কাজের ক্ষেত্র ও বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও দুজনের দেখা হতো। কখনো চা খেতে খেতে কুশল বিনিময়। অল্প কথা। অফিস ও অফিসের কাজের ধরন নিয়ে দুয়েকটা কথা। কাজের সূত্রেই কখনো মুঠোফোনে যোগাযোগ। একটি কথা আরেকটি কথার দিকে এগিয়ে যায়। বয়স ও দুজনের নিজের জেলার মধ্যে বেশ দূরত্ব ছিল। রাহাত অন্তত এগারো বছরের বড়। নীতুর গ্রামের বাড়ি বগুড়া, রাহাতের খুলনায়। মায়া ও অনুভবের দৌরাত্ম্যে দূরত্বটা ক্রমশ ঘুচে যায়। দুজনের মনের দিক থেকেই নিবিড় নৈকট্য গড়ে ওঠে। একসময় তারা একসঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ভাবে।

 নীতুর মনে পড়ে, একদিন অফিসশেষে শখ করে বাসায় নিয়ে এল রাহাত আলমকে। মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল— মা, ও রাহাত। অফিসে আমরা একসঙ্গে কাজ করি।

নীতুর মা কী যে খুশি হলেন! তাঁর মুখ আলো হয়ে উঠল। যাক, এতদিনে তাহলে মেয়ের মতি হয়েছে। নীতুর বাবা মারা যাওয়ার পর, সংসার নিয়ে অকূল পাথারে পড়ে আছেন তিনি। কীভাবে সংসার সামলাবেন, মাথার ওপর থেকে ছায়াটা সরে গেল। বড়মেয়ের বিয়ে থা হয়ে গেছে। নীতু মেজো। ত্রিশ হয়ে গেলেও সে বিয়ের নাম মুখে আনে না। কী করবেন তিনি এই মেয়েকে নিয়ে? রাতে দুশ্চিন্তায় তাঁর ঘুম হয় না। একা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সেই নীতু, ছেলেদের কাছ ঘেঁষতে চায় না যে, সে নিজে থেকে কাউকে বাসায় আনল, মায়ের বুক থেকে যেন পাথর নেমে যায়। তিনি হবু জামাইকে যত্ন করে খাওয়ালেন। স্নেহ ঢেলে কুশলাদি বিনিময় করলেন। পাশে বসে গল্প করলেন। কথা বলার ছলে ঘুরেফিরে ছেলেটাকে দেখলেন। নীতুর থেকে বয়সে খানিকটা বড়ই হবে। এতে কোনো সমস্যা মনে হলো না তাঁর।

রাতের খাওয়া-পর্ব শেষ হয়ে এলে নীতু রাস্তা পর্যন্ত রাহাতকে এগিয়ে দিয়ে আসে।

ছেলেটাকে তো বেশ দেখতে। মা বললেন।

নীতু মৃদু হাসল, তোমার পছন্দ হয়েছে?

মা মিষ্টি করে হেসে মাথা দোলান— বিয়ে করবে তো?

নীতু মায়ের হাত ধরে— আমরা দুজনেই চাই।

তাহলে দেরি করছিস কেন?

আমি আর একটু ভাবতে চাই, মা।

এত ভাবার কী হলো? শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

হুম। রাহাতের যে অমত আছে, তা নয়। দেখা যাক।

 বিয়ের পর, প্রথম বছরটা স্বপ্নের মতো কেটে গেল।

নাখালপাড়ায় ওরা দুই রুমের বাসা নেয়। নীতুর মা আসেন। মাঝে মাঝে শাশুড়ি ও ননদ এসে দু’ একদিন থেকে যান। জীবন ও সংসারটা ধীরে ধীরে গুছিয়ে নেয়। সময় পেলেই দুজনে নানা জায়গায় বেড়াতে যায়। একবার ওরা সাজেক ঘুরতে গেল। কিছুদিন পর রাঙামাটি ঘুরে এল। জীবন এত সুন্দর—আগে কেন মনে হয় নি? একা নিরালায় বসে বসে ভাবে নীতু। আনন্দ ও সুখ জীবনে এমনভাবে ধরা দেয়, সংসারটা স্বপ্নের মতো হয়ে উঠতে থাকে।

কিন্তু বছর খানেক পর, কী এক অজানা কারণে দুজনের প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয়। কথা ও তর্ক। তর্ক থেকে ক্রমশ ভুল বোঝাবুঝি। কথা কমে আসে। আবার মাঝে মাঝে দুজনের কথা এত বেশি হয়ে যায়, ঝগড়া ছাড়া ওটাকে আর কিছু বলা যায় না। সম্পর্কের লাবণ্য থিতিয়ে আসে। নীতুর মনে হতে থাকে, সে ভুল জীবনে ঢুকে পড়েছে। সন্দেহ ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।

আরও কিছুদিন পর, এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে নিজের বাসায় না ফিরে সে মায়ের সংসারে চলে আসে। রাহাত প্রথম প্রথম যোগাযোগ করত। একসময় নীতু বা রাহাত, পরস্পরের খোঁজ নেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। আরও পরে, মাস তিনেক তো হবেই, একরাতে রাহাত আলম ফোন করে জানাল, অফিস তাকে ময়মনসিংহে বদলি করেছে।

ধীরে ধীরে দুজনের কথা, দেখা হওয়া আর যোগাযোগটা শূন্যে নেমে আসে।

পুরোনো জীবন ও স্মৃতিভার নীতু প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু এই এখন, নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝল, মানুষ কিছুই ভোলে না। প্রায় ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কের স্মৃতিভার তাকে উদাসীন ও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

না, একটু হেঁটে আসি; ভেবে সে আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়।

মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেম কখনো ভুলতে পারে না। আবার এমন হয়, সে তার কোনো প্রেমই ভোলে না। অজান্তিকে এ কথাও ফেলে দেওয়া যায় না—সব প্রেমই মানুষ ভুলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে এসব কথাই কেবল মনে আসে নীতুর।

রাহাত আলমের সঙ্গে নীতুর প্রেম ছিল, সংসার ও যাপনের গল্প ছিল। সেসব পুরোনো হয়ে গেছে। এখন প্রেম ও মায়া কিংবা সম্পর্কের অধিকার, কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই।

কিন্তু এত বছর পর, রাহাত আলমের ছবি দেখে বুকের ভেতর কী যে হয়, সে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কাজের ব্যাপারে সে খুব সিরিয়াস ধরনের মানুষ। অফিসের কলিগরা এটা ভালো করে জানেন। তবু আজ কী যে হয় তার, হাতের কাজ হাতে রেখে সে স্ট্যাচুর মতো বসে থাকে। আড়চোখে নিজেকেই একবার দেখে। এতগুলো বছর লোকটির সঙ্গে তার দেখা হয় না, কথা হয় না, দিনশেষে তাকে সে ভাবে না, অনুভবও করে না। তাহলে এতদিনে তো জীবন থেকে সবকিছু ধুয়ে মুছে যাওয়ার কথা।

তাহলে কি রাহাত আলমের জন্য নীতুর মনের কোথাও এখনো চোরা টান রয়ে গেছে— মায়া কিংবা ঘৃণার?

এক ছুটির দিনের দুপুরে, উত্তরা থেকে আরও ভেতরে গ্রামের মতোন একটা এলাকায় নীতু রিকশা থেকে নামে। মাঘ শেষ হয় নি। কোকিল ডাকছে। এদিকে অনেক গাছপালা। সে মুগ্ধই হয়।

একটা পুরোনো টিনশেড বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে ঠিকানাটা মিলিয়ে নেয়। নতুন বিয়ের সঙ্গে বাড়িও কিনেছে রাহাত আলম? বাহ। কিছুতেই লোকটিকে ছাড় দেওয়া যায় না।

নীতুকে দেখে রাহাত আলম সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। তাঁর চোখে বিস্ময় না অন্যকিছু, বোঝা যায় না। ধাতস্থ হতে তিনি খানিকটা সময় নেন।

বাইরে থেকে এসে অন্ধকার ঘরে ঢুকলে চোখ সয়ে আসতে সময় লাগে। ধীরে ধীরে অন্ধকারের ছায়াটা সরে যায়।

আমি নীতু। চিনতে পেরেছ?

নামটা বলার পর, শেষ বিকেলের কোমল আলোর মতো রাহাতের চোখ নরম হয়ে আসে। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। রাহাতের চোখের পাতার দ্রুত ওঠানামাও খেয়াল করে নীতু।

রাহাত আলম পায়ে পায়ে নীতুর কাছে সরে এলেন— তুমি এসেছ? এতদিন পর এলে তুমি?

নীতু কোনো কথা বলে না।

রাহাত আলম জানালার কাছে যান। কাঠের জানালার কপাট খুলে দিলে ঘরটা আলোয় ভরে যায়। এবার রাহাতকে ভালো করে দেখার সুযোগ পায় নীতু। কতদিন পর লোকটাকে সে দেখল। কেমন বিষণ্ন ও রুগ্ন মুখ। এ কোন রাহাত আলমকে সে দেখছে? লম্বা ও নির্মেদ শরীরের মানুষটা কেমন নুব্জ হয়ে গেছে। আগের সেই দৃঢ় ভঙ্গিটি নেই। কথায় ও চলায় এমন ধীরতা কোনোদিনই ছিল না লোকটার। তার মাথার চুল শুধু কমেছে তাই নয়, অর্ধেকের বেশি পেকেও গেছে।

রাহাত আলমের ঘরটাও তেমন গোছানো নয়। সর্বত্র দারিদ্র্যের ছাপ। বয়সের তুলনায় তাকে বুড়োটে দেখায়। নীতু ঠিক মেলাতে পারে না।

দাঁড়িয়ে কেন, বসো;—অতিথিকে সমাদর করার গলায় বলেন রাহাত আলম।

বসতে আসি নি। কেবল একটা কথা জানতে এসেছি।

ঠিক সেই মুহূর্তেই কি রাহাত আলম খানিকটা গম্ভীর হয়ে উঠলেন? তাঁকে কিছুটা বিব্রত দেখায়। তিনি কোনো কথা বলেন না, শুধু মুখ তুলে নির্নিমেষ প্রশ্নচোখে তাকিয়ে থাকেন।

নীতু নিরাবেগ গলায় বলল, ফারিয়া মেয়েটা কে?

রাহাতের চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর হয় না। তিনি নীতুর কথা বুঝতে পারেন না।

তোমার স্ত্রীকে একবার ডাকো। কথা বলি।

আমার স্ত্রী?

নীতু কোমরে হাত রেখে মুখে বিশেষ একটা ভঙ্গি করে—অবাক হলে মনে হচ্ছে? থাক। ডাকতে হবে না। আমাদের যেহেতু ডিভোর্স হয় নি, আইনি মতে, আমি এখনো তোমার বৈধ স্ত্রী। অ্যানিওয়ে, তুমি বিয়ে করে নতুন সংসার গড়েছ। বেশ। আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আমি খোরপোষ চাই।

কথা শেষ করে নীতু প্রায় ঘামতে থাকে। সে খেয়াল করে, লোকটির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

কয়েকটি মুহূর্ত নীরবে কেটে যায়। কথাহীন। কথা আর এগোয় না। কথা থেমে থাকে। আরও কিছুক্ষণ পর, কথা মুখ বাড়ায়।

রাহাত আলম সরল গলায় বললেন, তুমি কার কথা বলছ?

নীতু প্রায় গর্জে ওঠে— ফারিয়া খান তোমার স্ত্রী নয়?

ফারিয়া খান? রাহাত আলম হা হা করে হেসে ওঠেন।

খবরদার, হাসবে না। অসহ্য!

রাহাত আলম সহজ হয়ে আসেন। বলেন, আচ্ছা, হাসব না। কিন্তু ফারিয়া আমার স্ত্রী নয়।

তাহলে?

রাহাত আলম সে কথার জবাব দেন না। তিনি উদাসীন চোখে জানালা গলে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। গলাটা নরম করে বলেন, একটু চা খাবে?

নীতু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়। ঘড়িতে সময় দেখে।

চলে যাচ্ছ?

না। তোমাকে না মেরে আমি যাব না।

মারতে চাও? আমাকে? আমি তো মরেই বসে আছি, নীতু।

বাইরে একটা ছোট সাইনবোর্ডে দেখলাম ‘ফুলকলি’। জিনিসটা কী?

ওটা একটা স্বেচ্ছাসেবী সংঘের মতোন।

নীতু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কী রকম?

সুবিধাবঞ্চিত কিছু পথশিশুকে পড়ানো আর দেখভালের আশায় এটা করেছি। নামটা ফারিয়াই পছন্দ করেছে।

এত টাকা পাও কোথায়?

নিজের বলতে কিছু নেই আমার। সবই অনুদান আর সাহায্য।

তাহলে মেয়েটা কে?

রাহাত আলম আবার হাসার চেষ্টা করেন। এবার তার হাসিটা ঠিক ফোটে না। তিনি কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, ফারিয়া আমার বোনের মেয়ে। আমার অবর্তমানে সে ‘ফুলকলি’র হাল ধরতে পারে—ভেবে ওকে নমিনী করেছি।

নীতু লজ্জিতভাবে তাকায়। এবার সে মন থেকেই সহজ হয়ে আসে। রাহাত আলমের পাশে গিয়ে বসে—তুমি কেন করছ এসব?

বাঁচার জন্য। একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য।

নীতুর মুখে কথা সরে না। চোখ ভিজে উঠেছে, সে টের পায়। একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে সে জানালার বাইরে তাকায়—বাসায় কাউকে দেখছি না যে?

ছুটির দিন বলে ছেলেমেয়েরা ওদের মায়ের কাছে গেছে। 

শোনো! নীতু রাহাত আলমের হাতটা ধরে।

রাহাত আলম আকুল হয়ে তাকান। তাঁর চোখ স্থির। তাঁর চোখে হাহাকার।

নাক টেনে নীতু বলে— যাই।

যাচ্ছ? প্রায় আর্তনাদের মতো শোনায় রাহাত আলমের গলাটা।

দরজার চৌকাঠ থেকে নীতু ঘরের ভেতরে দু’পা এগিয়ে আসে— না, তোমার উপর আমার আর কোনো অভিমান নেই। দাবিও নয়। ভালো থেকো।

তুমি তো আমাকে বাঁচিয়ে দিলে, নীতু! কথাগুলো ভাবনায় এলেও প্রকাশ করতে পারেন না রাহাত আলম।

নীতু আর দাঁড়ায় না। হাতঘড়িতে একবার চোখ রেখে হাঁটতে শুরু করে। সে টের পায়, মনের খেদ ও অভিযোগের শেষ রেখাটিও মুছে গেছে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.