নক্ষত্র-নূপুর (দ্বিতীয় খণ্ড)

নক্ষত্র-নূপুর  (দ্বিতীয় খণ্ড)

[১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন নতুন রূপ পেতে থেকে। বাংলা এবং ভারতবর্ষের এই বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ল জার্মানি এবং রাশিয়া। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব-প্রয়াসের প্রায় সমান্তরালে চলতে থাকল বাংলা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবের প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে রুশ বিপ্লবী এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেম এবং বিপ্লবের কাহিনি ও এই দুই ভূখণ্ডের বিপ্লবীদের আন্তঃসম্পর্ক। লেখাটির প্রথম খণ্ডের কাহিনি শেষ হয়েছে ১৯১৪-১৫ সালে এবং এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘অন্যদিন’-এ। এই খণ্ডের গল্প আরম্ভ হয়েছে ১৯১৪ সালের রাশিয়ায় আর শেষ হয়েছে ১৯২১-২২ সালে গিয়ে।]

 

ইনেসা প্যারিসে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু ও প্যারিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা ওখরানার প্যারিস ব্র্যাঞ্চ সেই খবর জেনে গেছে। তবে ওখরানা আপাতত কিছুই করল না। ওরা অপেক্ষা করছে ইনেসার আরও কিছু ভুল পদক্ষেপের জন্য। ভুলের গর্ত আরেকটু গভীর হলে ইনেসাকে সেই গর্তেই ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হবে।

প্যারিসে এসে ইনেসা প্রথমেই ফ্রেঞ্চ সোস্যালিস্ট নেতাদের সাথে দেখা করল। কিন্তু ওরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ইনেসাকে দলের কর্মীদের সাথে যুদ্ধের বিপক্ষে কোনো কথা বলতে দেওয়া হবে না। এমনটা হবে ইনেসা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। ওরা জাতীয়তাবাদের নেশায় একেবারে বুঁদ হয়ে গেছে। আরও বেশ কয়েকদিন প্যারিস ঘুরে ইনেসা একটা প্যাসিফিস্ট গ্রুপের খোঁজ পেয়েছে। এরা যুদ্ধবিরোধী কিন্তু শাসক শ্রেণির উচ্ছেদ বা বিপ্লবের পক্ষে লড়াই করার মতো যথেষ্ট চরমপন্থী না। এদের সঙ্গে কাজ করে ইনেসার খুব একাট লাভ হবে না। শেষমেশ পুরোনো কিছু বলশেভিক কর্মীর খোঁজ পাওয়া গেল। এরা যুদ্ধবিরোধী লিফলেট বিলি করতে রাজি হয়েছে। ওদিকে ভিয়েনা থেকে বের করে দেওয়ার পর ট্রটস্কিও এখন প্যারিসে আশ্রয় নিয়েছে। ট্রটস্কি মেনশেভিক নেতা মার্টভের বন্ধু। ইনেসা ক’দিন লিফলেট বিলি করবার পরই ট্রটস্কি ওর সাথে যোগাযোগ করে বলল, এসব বন্ধ করো। এতে কী হচ্ছে জানো, লেনিনের কট্টর যুদ্ধবিরোধী অবস্থান ফরাসি সরকারের নজরে আসছে। তোমার জন্য প্যারিসের বিপ্লবী আন্দোলন ক্ষতির মুখে পড়বে।

ইনেসাকে লেনিন প্যারিস পাঠিয়েছে। তাই ও ট্রটস্কির উপদেশ উপেক্ষা করে প্যারিসের সমাজতান্ত্রিকদের মাঝে যতটা পারে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরল। ইনেসার আশা প্যারিসের কিছু লোক নিশ্চয় ওর কথায় প্রভাবিত হবে।

কিন্তু লেনিনের সাথে ইনেসার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। লেনিন যথারীতি ইনেসাকে একের পর একটা চিঠি লিখে জানতে চাচ্ছে, ইনেসা, প্যারিসের কী অবস্থা ?

ইনেসা লেনিনের চিঠির কোনো জবাব দিচ্ছে না। এমন না যে সে লেনিনের চিঠি পাচ্ছে না। কারণ ইনেসা নাদিয়াকে মাত্রই লিখেছে,

প্রিয় নাদিয়া,

প্যারিসের পরিস্থিতি খুব থমথমে। স্বজন হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রচুর মহিলা কান্নাকাটি করছে। সবার মন শত্রুর প্রতি বিষিয়ে আছে। জাতীয়তাবাদী আবেগ এখন তুঙ্গে। এই মুহূর্তে এখানে আমি যুদ্ধের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।

অনেক চেষ্টার পর আরও কিছু নিচের র‌্যাঙ্কের বামপন্থী কর্মীকে ইনেসা লাইনে আনতে পেরেছে। এই সাফল্যের পর ইনেসা লেনিনকে চিঠি লিখে পুরো পরিস্থিতি জানাল। ইনেসা ভাবল প্যারিসের বিরূপ রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ইনেসা যা করতে পেরেছে তাতে লেনিন অনেক খুশি হবে। কিন্তু লেনিন ইনেসার চিঠির জবাবে বলল, ওসব ছুটকাছাটকা লোকদের হাতে এনে কী লাভ হবে ? যুদ্ধ আর শান্তির প্রশ্নে মূল পার্টিতে ভাঙন ধরাতে হবে।

লেনিনের চিঠি পেয়ে ইনেসা এবার সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেল। জবাবে ও যা মনে আসে তাই লিখে পাঠাল লেনিনকে। লেনিন আবার উত্তরে বলল, প্রিয় ইনেসা, খারাপ শব্দ ব্যবহার করে কোনো অর্জন সম্ভব না। তুমি এভাবে বাজে করে চিঠি লিখলে আমার পক্ষে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

লেনিনের চিঠি পেয়ে ইনেসা ভীষণ আহত হলো। লেনিন ওর আসল মনোকষ্ট বুঝল না। লেনিনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে ফ্রান্সে এসেছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছে। ক’দিন আগে ইনেসা ফ্রেঞ্চ সোশ্যালিস্ট পার্টির এক সভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। যুদ্ধের সময় এর মানে হলো দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ধরা পড়লে ওর মৃত্যুদণ্ড হতে পারত। লেনিন এগুলোর কোনো মূল্যই দিল না। কেবল পড়ে রইল ওর চিঠিতে ভাষার ব্যবহার নিয়ে। একটু নরম করে কথা বললে কী ক্ষতি হতো ?

ইনেসার প্যারিসজুড়ে ছোটাছুটিতে ফ্রান্সের পুলিশ সতর্ক হয়ে গেছে। রাশিয়ার গোয়েন্দারা আগেই পিছু নিয়েছিল। এখন আবার প্যারিসের পুলিশও ওর পেছনে লেগেছে। যুদ্ধের সময় ধরা পড়লে কোনো ভংচং নেই, সরাসরি মৃত্যুদণ্ড। হাজার হাজার হত্যার মাঝে আরেকটা অপমৃত্যু কেউ গায়ে মাখবে না। ইনেসা বুঝে গেছে প্যারিসে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। কোনো রকমে লুকিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ইনেসা সুইজারল্যান্ড ফিরে এল।

কিন্তু ফিরে এসেও ইনেসার কোনো বিশ্রাম নেই। দু সপ্তাহ পরেই বার্ন থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দক্ষিণে কিয়েনতালে জিমারওয়াল্ড গ্রুপের সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কনফারেন্স শুরু হলো। লেনিন ইনেসাকে সেখানে নিয়ে গেছে। ইনেসা নিজে কোনো বক্তৃতা দেয় নি, কেবল লেনিন আর জিনভিয়েভের বক্তৃতা অনুবাদ করে দিয়েছে। নিজের অবস্থানকে শক্ত করবার জন্য লেনিন এখন পাগলের মতো খাটছে। এ কারণে ওর না আছে ক্লান্তি, না আছে স্বস্তি।

কনফারেন্স শেষে নাদিয়া আর লেনিন বার্ন থেকে জুরিখে চলে গেল। পার্টির অবস্থান ধীরে ধীরে মজবুত হচ্ছে। জুরিখের রাজনৈতিক আবহাওয়া অনেক টগবগে। লেনিনের এখন বার্নের চেয়ে জুরিখে থাকা কৌশলগতভাবে বেশি প্রয়োজন। তবে ইনেসা বার্নেই রয়ে গেল। ও একটু নিজের মতো করে কাজ করতে চাইছে। জুরিখে আসার পর লেনিন শুনতে পেল জার্মানির কায়জার এবং রাশিয়ার জারের মাঝে একটা সমঝোতা হবে। লেনিন নিজেই এতদিন যুদ্ধের বিপক্ষে প্রচার চালিয়েছে। কিন্তু সমঝোতার কথা শুনে ও রাগে ফেটে পড়ল। নাদিয়াকে বলল, জার যদি সত্যিই সিদ্ধান্ত নেয় যে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনবে তাহলে আমার এতদিনের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তাহলে রাশিয়ায় কোনো বিপ্লব হবে না।

হলেও তার জন্য আবার অনেক বছর লেগে যাবে।

লেনিন আবার কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসে গেল। পত্রিকায় লিখল,

সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যদি গৃহযুদ্ধে রূপান্তর করা না যায় তাহলে যে শান্তি আসবে সেটা ওই সাম্রাজ্যবাদী শান্তি। সাধারণ লোকের ওই শান্তিতে কোনো লাভ হবে না, বড়লোকদের হাতেই ক্ষমতা থাকবে। যুদ্ধ চিরকালের জন্য দূর করতে হলে শুধু রাশিয়া না, সারা পৃথিবীতে বুর্জোয়াদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে।

কিন্তু লেনিন জুরিখে বসে যাই বলুক, রাশিয়ার ভেতরের রাজনীতি তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। এত বছর দেশের বাইরে থাকার কারণে লেনিন ধীরে ধীরে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে প্রভাব বাড়লেও রাশিয়ার রাজনীতিতে লেনিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। লেনিন নিজেও সেটা বুঝতে পারছে। আর এসব ভাবনা লেনিনের নার্ভের ওপর চাপ ফেলছে। পাবলিক লেকচার দিতে পর্যন্ত সে ভয় পাচ্ছে। নাদিয়া লেনিনের অবস্থা লক্ষ করে একদিন বলল, তুমি নিজের নেতৃত্ব নিয়ে এত ভয় পেলেও রাশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুসংগঠিত গ্রুপ বলশেভিকরাই। ভারী শিল্প কারখানা, রেল শ্রমিক এবং নাবিকদের মাঝে আমাদের দল খুবই জনপ্রিয়। আর পেট্রগ্রাডে আমাদের সঙ্গে আর কোনো দলই পেরে উঠবে না। ওখানে এখন আমাদের তিন হাজার কর্মী।

সেটা জানি। কিন্তু ওদের সাথে আমার যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। 

লেনিন আর নাদিয়া যখন কোথাও বেড়াতে যায়, ইনেসা প্রায়ই সঙ্গে থাকে। কিন্তু এবার গ্রীষ্মে লেনিন যখন পাহাড়ে গেল, ইনেসা ওদের সঙ্গে এল না। ও জিনভিয়েভদের সাথে লুসার্নের কাছে একটা রিসোর্টে গেছে। সেখান থেকে কিছুদিন পর ইনেসা লেক জেনেভার কাছে কারেন্স শহরে গেল। রাশিয়ান লাইব্রেরির উল্টোদিকে ইনেসা একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছে। এতে ওর পড়ালেখার সুবিধে হয়েছে। ইনেসার বাড়ির আশেপাশে আরও অনেক বিপ্লবী থাকে। বেশির ভাগই একটু রোমান্টিক ঘরানার, অনেকটা ইনেসার মতো।

ইনেসা গোয়েন্দাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে প্যারিস থেকে পালিয়ে আসার পর আজ অবধি লেনিন ওকে অন্তত পঞ্চাশটা চিঠি লিখেছে। লেনিনের লেখা প্রতিটি শব্দ আর যতিচিহ্ন ইনেসা তন্নতন্ন করে ঘেঁটেছে। দু পঙ্ক্তির মাঝের শূন্যস্থানগুলোয় আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে লেনিনের মনেও কি ওর জন্য কোনো কোমল শূন্যতা আছে ? কিন্তু কোথায় সেই বিচ্ছেদের চাপা কষ্ট আর মন খারাপের করুণ দীর্ঘশ্বাস ? বরং চিঠিগুলো এত সহজ-স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত ভাষায় লেখা যে পড়ে মনে হয়, ওদের প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর লেনিন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। লেনিন মাঝে আবার অনেকগুলো টেলিগ্রাম করেছে, ফোনেও কথা বলেছে। সব সময় সেই রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের আলাপ।

লেনিনের ব্যবহার ইনেসাকেও বদলে দিচ্ছে। লেনিনের সব কথাবার্তা সে এখন আবেগের মেঘ সরিয়ে বিচার করে। লেনিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ যতই যন্ত্রণার হোক, এই নিবিড় একাকিত্বে ইনেসার নিজস্বতা গড়ে উঠছে। যে-কোনো প্রসঙ্গে অমত হলে ইনেসা এখন লেনিনকে সরাসরি জানিয়ে দেয়। লেনিন নিজের মতের কোনোরকম বিরোধিতা নিতেই পারে না। কেবল ইনেসার ক্ষেত্রে সে কখনো অসহায় বোধ করে, কখনো ধৈর্য হারায়, কিন্তু বেশি কিছু বলতেও পারে না।

হরদয়াল নামের এক শিক্ষককে ঘিরে বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধছে। সান ফ্রান্সিসকোতে যে তিনজন প্রবাসী ভারতের স্বাধীনতার জন্য গদর পার্টি বানিয়েছে, হরদয়াল তাদের একজন। ও এখন গদর পার্টির সভাপতি। গত কয়েক বছর ধরে হরদয়াল চেষ্টা করছে আমেরিকানদেরও দলে ভেড়াতে। এ কারণে হরদয়াল আমেরিকান র‌্যাডিক্যাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ওখান থেকে মূল ধারার অনেক বিপ্লবঘেঁষা লোকদের ওর নিজের দলে টানা যাবে।

তবে বার্কলে ইউনিভার্সিটির আন্ডারগ্র্যাড মেয়েদের দিকে হরদয়ালের নজর বেশি। জীবনের প্রথম বসন্তগুলোতে ন্যায়বিচারের প্রতি সবার আগ্রহ একটু বেশি থাকে। এ কারণে তরুণ-তরুণীদের দলে টানা সহজ। বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীদের গোয়েন্দারা সহজে সন্দেহের চোখে দেখে না। হরদয়াল বুঝতে পারছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যে-কোনো গোপন বিপ্লবী তৎপরতায় এই মেয়েগুলোই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে। এ কারণে কোনো সভাসমিতিতে গেলে হরদয়াল এরকম মেয়েদের খুঁজে বের করে। ওদের সঙ্গে আলাপ জমায়। তারপর ওদের কফির নেমন্ত্রণ করে। কয়েকবার গল্প করে আস্থা এলে হরদয়াল মেয়েগুলোকে ওর আসল উদ্দেশ্য খুলে বলে। এদের ভেতর থেকে কেউ কেউ হরদয়ালের দলে ভিড়ে যায়। এরকম মেয়েদের একজন হলো অ্যাগনেস। অ্যাগনেস সবে একুশে পা দিয়েছে। বার্কলেতে পড়ছে। অ্যাগনেস ক’দিন আগে সান ফ্রান্সিসকোর সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দিয়েছে। কিন্তু ওদের একঘেয়ে সভাসমিতি আর নখদন্তহীন ভ্যাজরভ্যাজরের চেয়ে ভারতের উন্মাতাল স্বাধীনতার আন্দোলনই ওকে বেশি করে টানছে।

গদর পার্টির প্রতি অ্যাগনেসের আগ্রহের আরেকটা কারণ আছে। অ্যাগনেস খুব গরিব ঘরের মেয়ে। দারিদ্র্য আর অপমান কী জিনিস সেটা অ্যাগনেস ভালোমতো জানে। সানফ্রান্সিকোর বেশির ভাগ ভারতীয়রাই ওর মতো শ্রমিক শ্রেণির। কয়েক বছর ধরে এখানে এশিয়ান শ্রমিকদের প্রতি বিদ্বেষ চরমে উঠেছে। এদের মাঝে সবচেয়ে ঘৃণার শিকার হচ্ছে শিখ সম্প্রদায়। মাথায় পাগড়ি পরে বলে ওদের তাচ্ছিল্য করে সাদারা বলে লুছনি-মাথা। গদর পার্টিতে বেশিরভাগই শিখ। তাই ওদের প্রতি অ্যাগনেসের আলাদা সহানুভুতি আছে।

অ্যাগনেস স্মিডলির বিয়ে নিয়ে ভয়ংকর উৎকণ্ঠা। মিসৌরির একটা জীর্ণ কুটিরে ওর মা সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ওর বাবা কখনো কৃষি কাজ করেছে, কখনো নির্মাণ শ্রমিক ছিল, কখনো আবার ট্রাভেল সেলসম্যান হিসেবে দেশে দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছে। ওর মদ্যপ বাবা দুটো কাজ ভালো পারত, ট্রাভেলিং সেলসম্যান হিসেবে চাপাবাজি করা, আর ঘরে ফিরে ওর মার সঙ্গে দুর্ব্যবহার। অ্যাগনেসের বাবা ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার কাজে সুবিধা করতে না পেরে রকফেলারের কয়লা খনিতে শ্রমিকের চাকরি নিয়েছিল। খাটতে খাটতে একসময় ভেঙে পড়েছিল। তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল অ্যাগনেসের খালা। ওর খালার দেহব্যবসার টাকায় ওদের সংসার চলেছে অনেকদিন। অ্যাগনেস জানে গরিব ঘরের মেয়েদের বিয়ে আর সন্তান হলো মরণ ফাঁদ। জীবনের সব স্বপ্ন ত্যানাত্যানা হয়ে যায় এই বিয়ের ফাঁদে পড়ে। তারপরও অ্যারিজনা নর্মাল স্কুলে পড়ার সময় অ্যাগনেস নিজেই এই ফাঁদে পা দিয়েছিল। আর্নেস্ট নামের এক হ্যান্ডসাম যুবকের প্রেমে পড়েছিল। ওদের বিয়েটাও হয়ে যায় ঝড়ের বেগে। কিন্তু যৌনমিলন এবং গর্ভধারণ, এ দুটোকেই অ্যাগনেস প্রচণ্ড ভয় পায়। পৃথিবীতে এসে অ্যাগনেস যে কষ্ট পেয়েছে আর কাউকে এই একই কষ্টের মুখোমুখি করতে সে চায় না। এ কারণে শারীরিক মিলন ওর কাছে ভয়াবহ মানসিক আঘাতের মতো। বিয়ে করার পর অ্যাগনেস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটাকে যথাসম্ভব প্ল্যাটোনিক রাখতে। কিন্তু বিবাহিত জীবনে শরীরের সম্পর্ক সে কতদিন এড়াতে পারবে ?

আর্নেস্ট সান ফ্রান্সসিকোতে চাকরি পায় নি কিন্তু সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় ভালো কাজ পেয়েছে। অ্যাগনেসকে খুশি হয়ে জানিয়েছে, অ্যাগনেস, দারুণ খবর।

কী ?

আমরা সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছি। চাকরি হয়ে গেছে।

অ্যাগনেস গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি যাও। আমি যাচ্ছি না।

কেন ?

এখানে আমার কাজের অনেক সুবিধা, তা ছাড়া আমার ইউনিভার্সিটিও কাছে।

শেষমেশ আর্নেস্ট একাই গেছে। আর্নেস্ট চলে যাওয়ার পর অ্যাগনেস একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকছে, স্টেনোগ্রাফারের চাকরিও পেয়েছে, নিজের মতো ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছে। ও যে বিবাহিতা এ কথাই ওর অনেক সময় মনে থাকে না। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে অ্যাগনেস আর্নেস্টের কাছে থেকে মাসে মাসে ঠিকই টাকাপয়সা নিচ্ছে।

আর্নেস্ট যাওয়ার কিছুদিন পরই সরকার আন্টি-অ্যালিয়েন আইন নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এই আইনে বিদেশিরা আমেরিকায় জমি কিনতে পারবে না। ভারতীয়রা এই আইনের সবচেয়ে বড় শিকার। ওরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে ধর্না দিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ওদের কোনো পাত্তাই দেয় নি। অ্যাগনেস বিভিন্ন বড় বড় মানুষেরর কাছে দৌড়াদৌড়ি করেছে যেন এ আইন পাশ না হয়। কিন্তু আইনটা শেষ পর্যন্ত পাশ হয়ে গেছে। ভারতীয়রা এই আইন নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট। হরদয়াল এই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে। প্যাসিফিক কোস্টে ঘুরেঘুরে হরদয়াল শিখ শ্রমিকদের গদর পার্টির পতাকাতলে সমবেত করেছে। পুলিশের কানে খবরটা পৌঁছেছে। হরদয়াল কতদিন এভাবে কাজ করতে পারবে নিজেও জানে না।

গদর পার্টিতে অ্যাগনেসের এখনো তেমন কোনো কাজের দায়িত্ব নেই। অ্যাগনেসের স্বামী আর্নেস্ট মাস তিনেক পর এসে অনেক কাকুতিমিনতি করে অ্যাগনেসকে মেক্সিকোর সীমান্তের কাছে ওর নতুন কাজের জায়গায় নিয়ে গেল। এখানে এসে আর্নেস্টের সঙ্গে শারীরিক মিলন এড়ানো গেল না। প্রথম মিলনের পর ভোরবেলা অ্যাগনেস ডাইরির পাতায় লিখল,

আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি এই শুনে যে যৌনমিলন একটা নোংরা আর লজ্জার কাজ। অথচ একটা মন্ত্র পড়ার পর সেই বাজে কাজটাই প্রায় দৈনন্দিন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল। যে-কোনো সংবেদনশীল মেয়েই এরকম অবস্থায় হয় শারীরিক, না হয় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.