জামালপুরের চিঠি

জামালপুরের চিঠি

এ চিঠি জামালপুরের। বাংলাদেশের হাজার হাজার দরিদ্র গ্রামের মতো জামালপুরও ছোট অখ্যাত দরিদ্র একটি গ্রাম। তবুও এ গ্রামে পাখি ডাকত। চাষিরা খেতে ধান পাট রবিশস্যের আবাদ করত। ছোট ছেলেরা মাদ্রাসা মক্তবে যেত। মেয়েরা নির্ভয়ে গ্রামের পথে হাঁটত। সে তো বছর খানেকেরও আগের কথা।

এখন একবার যদি  এসো জামালপুরে তবে হাতেমের দাদির সঙ্গে দেখা করতে ভুলো না। সে-ই তোমাকে পোড়া ইসকুল ঘরটা দেখিয়ে দেবে। বলবে সেই লালমুখো পাঞ্জাবি সৈন্যরা ওটায় কেমন করে আগুন ধরিয়েছিল। বলবে ইসকুলের পিছের বায়োয়ারি কবরটায় কার কার লাশ চাপা দেওয়া হয়েছে। বাজারখোলার পোড়া ভিটে খুঁটি কালচে টিন দেখিয়ে বলে দেবে কেমন করে দুদিন ধরে বাজারটা পুড়েছিল।

তাঁতিপাড়ার পোড়া তাঁতগুলোর চিহ্ন এখন আর না থাকলেও হাতেমের দাদি কিন্তু তোমাকে পোড়া তাঁতগুলোর কথা বলতে ভুলবে না। গ্রামের কিছুটা অবস্থাপন্নদের বাড়ি কেমন করে লুট হয়েছিল সে কথাও হাতেমের দাদি তোমায় জানাবে; গ্রামের শেষে যে মেঠো পথটা মহকুমা শহরের দিকে চলে গেছে সে পথটার পাশে বুড়ো অশ্বত্থের ধারেই ভাঙা যে ইটের দালানটা সেটা দেখবার সময় হাতেমের দাদির ঘোলাটে চোখ কুঁচকে উঠবে, শরীরে কাঁটা দেবে। কপালে করাঘাত করে বলবে—গজব দিছে আল্লায়, এই পাপের গজব হেই কুত্তাগো উপর।

ওই ভাঙা বাড়িটাতেই তো আসমত আলীর বউ, রহিম হাজীর দুই মেয়ে আর বিধবা বোন, করিম শিকদারের ভাগ্নী, মতি বিশ্বাসের শালী আরও গ্রামের বহু বউঝিদের ধরে এনেছিল সেই নির্দয় মানুষের চেহারাধারী পশুরা।

সন্ধ্যার পর কত আর্ত অসহায় চিৎকার ওই অশ্বত্থের বুড়ো জটায় ভয়ার্ত শিহরণ তুলেছে সে কথা বলবার সময় হাতেমের দাদি বারবার সেই বিগত শত্র“দের অভিশাপ দেবে। কেয়ামতের দিনের বিচারের অঙ্গীকার শোনাবে।

হাতেমের দাদি কিন্তু ভারি গরিব। বাঁশঝাড়ের ধারে ছোট একটা কুঁড়ে ছিল তার। বাতাসে ঘরের শন উড়ে যেত। উলুখাওয়া ঘরের থাম খুঁটি টোকা লাগলে ঝরঝর করে উঠত। এক কানিও জমি নেই তার। থাকার মধ্যে এক পনের বছরের নাতি হাতেম। আগে সে লোকের ক্ষেতে নিড়ান দিত। পৈরাত খাটত। মাটি কাটত। তাতেও দাদি-নাতির খাওয়া কুলোত না। এখনো যে তার অবস্থা ফিরেছে তা নয়। তবু হাতেমের দাদি তোমায় গর্বে উজ্জ্বল হয়ে বলবে তার হাতেম স্টেনগান চালাতে জানে। যুদ্ধ করতে জানে। জামালপুর সড়কের তিনটে পুল ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছিল যারা তাদের সঙ্গে হাতেমও ছিল। গত আষাঢ় মাসে যখন দুই লঞ্চ বোঝাই পাকিস্তানি লাল কুত্তারা বড় গাঙ উজিয়ে জামালপুরের খালে ঢুকছিল তখন খালপাড়ের তেমাথার বাঁশঝাড় থেকে দমাদম গুলি ছুড়ে লঞ্চ দুটোকে মোচার খোলার মতো উল্টে দিয়েছিল লুঙ্গি পরা মাথায় শরীরে লতাপাতার আচ্ছাদন ঢাকা যে বাহাদুর মুক্তিবাহিনী তাদেরই একজন বাহাদুর সেনা হাতেমের দাদির হাতেম।

হাতেমের দাদির কাছে শুনতে পাবে যে তারও আগে বৈশাখ মাসের এক বিকেলে হাট থেকে আধসের চাল আর পোয়া সরিষার তেল সওদা করে বাড়ি ফিরে হাতেম বলেছিল—দাদিরে! চিনার জাউ খাইতে আর ভালো লাগে না। দুগা ভাত রানধ।

তারপর ওচা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল খালের স্বল্প পানিতে দুচারটে চিংড়ি কি পুঁটিমাছ ধরবার জন্য।

হাতেমের দাদি ভাত রেঁধেছিল। মেটে আলু পুড়িয়ে ভর্তা করেছিল। মাছ না ধরেই ফিরেছিল হাতেম। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার সাহেবের একটা ট্রানজিস্টার ছিল। তাতে গরম গরম ভয়-উত্তেজনা মিশ্রিত খবর নিয়ে বাড়ি ফিরছিল হাতেম। খবর আসছিল অবশ্য আগে থেকেই। ঢাকা শহর আর নেই। রাস্তার ড্রেনে পানির বদলে মানুষের রক্ত গড়াচ্ছে। রাত দিন দাউদাউ করে পুড়ছে মহল্লা গঞ্জ বাজার। ভীত ত্রস্ত পিঁপড়ের মতো ছুটছে মানুষ! শুনে আতঙ্কিত এক গ্রাম মানুষের সঙ্গে ভয় পেয়েছে হাতেমের দাদিও। এই তো ক’মাস আগে হাতেমের হাত ধরে নৌকায় ভোট দিয়ে এল সে। সবাই বলাবলি করেছে শেখ সাহেবকে ভোট দিয়ে পাস না করালে গ্রামের মানুষের দুঃখের সীমা থাকবে না। গাছের পাতা খেয়ে জীবন বাঁচাতে হবে। পরার তেনিও জুটবে না। আহা! কত আশা করেছিল হাতেমের দাদি। শেখ সাহেব দেশের কর্তা হলে তাদেরও সুদিন ফিরবে। তার হাতেম আর পৈরাত দিয়ে চিনা ক্ষুদের জাউ খেয়ে সারাটা দিন কাটবে না। তাদের অন্তত দুবেলা পেটে ভাত পড়বে। শীতে তিন ফালি হাওয়া কাপড় গায় জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে হবে না। কমসে কম হাতেমের গায়ে একটা নতুন রঙিন চাদর তো উঠবে। তারপর....হাতেম জোয়ান হবে....হয়তো বা টিনের ঘর, হালের বলদ, সবুজ ধানে ভরা কয়েক কানি নিজের জমি .... নাঃ অতটা আশা করতে ভয় পেয়েছে চিরদিনের অভাবী দুঃখী আধ-পেটা খাওয়া হাতেমের দাদি। শুধু ভাত আর কাপড় এই যথেষ্ট। কিন্তু সে আশায় এ কী আগুন লাগল! তাদের আশার একমাত্র প্রদীপ শেখ সাহেব না কি বন্দি! আর ভাত-কাপড় চেয়েছিল বলেই পাঞ্জাবি সেপাইরা বন্দুক গোলা বোমা দিয়ে মানুষ মেরে সাফ করছে।

হাতেম মাস্টার সাহেবের রেডিও শুনে খবর এনেছিল—পাঞ্জাবিরা আর বেশিদিন আমাগো মারতে পারত না। আমাগোরও মুক্তিবাহিনী হইছে। তারা এইবার পাঞ্জাবিগো লগে লড়াই শুরু করছে। মাস্টার সাবে কইছে আমরা স্বাধীন হইয়া যামু।

বিহ্বল হাতেমের দাদি বলেছে, পাঞ্জাবিগো মারব আমাগো পোলাপাইনে? আহ! আল্লাহ বাঁচায়ে রাখুক। আল্লায় অগোর মনের ইচ্ছা কবুল করুক। আমাগো শেখ সাহেবের কী অইব?

হাতেম উদ্দীপনায় উত্তেজিত হয়েই জবাব দিয়েছিল—তারে! তারে আমরা লড়াই কইরা ছাড়ায়ে আনুম।

গরম ভাত আর ভর্তা খেতে বসবার আগেই কিন্তু ঘরের পেছনের শুকনো বাঁশ পাতা মচমচ করে উঠেছিল। বন্ধ ঝাঁপে ঠেলা দিয়ে মাস্টার সাহেব ডেকে উঠেছিলেন—দুয়ার খোল হাতেম।

বেরিয়ে এসেছিল হাতেমের দাদি আর হাতেম। মাস্টার সাহেবের পিছে কয়েকজন লোক। একজনের পরনে খাকি উর্দি আর সকলে লুঙ্গি পরা। হাতেমের দাদি অবাক হয়ে দেখেছিল ওদের মাথায় কেমন ভারী লোহার টুপি। পিঠে বড় বড় বন্দুকের মতো কী ঝোলানো।

হাতেমকে ডেকে নিয়ে কী যেন ফিসফিস করে বলেছিল মাস্টার সাহেব। কুপির আলোয় হাতেমের মুখ দেখতে পায় নি হাতেমের দাদি। হাতেম ছুটে এসে বলেছিল—এরা মুক্তিবাহিনী দাদি। ওই যে খাকি পরা উনি ক্যাপ্টেন সাহেব। আমাগো বাঙালি মিলিটারি। জলদি খাওনের বন্দোবস্ত করো। সারাদিন এরা কিছু খায় নাই। কিন্তু সাবধান! রাও করবা না। তড়িৎপ্রবাহ সঞ্চারিত হয় হাতেমের দাদির দুর্বল রক্ত শিরায়।

ঠিলায় করে হাত-মুখ ধোবার পানি দিয়ে খেজুর পাতার চাটাই পেতে খাবার জায়গা করেছিল সে। দুজন চলে গিয়েছিল মাস্টার সাহেবের সঙ্গে। বাকি দুজন ছিল। মাটির সানকিতে ভাত আর ভর্তা বেড়ে দিয়ে দুচোখ উপচে পানি এসেছিল হাতেমের দাদির। বলতে গেলে কোনোরকমে চেয়ে চিন্তে খাওয়া উপবাসী মানুষ সে। মাঝে মাঝে কপালের দুঃখে আপসোস হয়। কিন্তু আজ নিজের দারিদ্র্য বড় একটা আক্ষেপের ঝড় তুলল তার মনে। আহা, আজ এই ছেলে দুটিকে সে যদি পেট ভরার মতো ভাত, অন্তত একটা মাছের সালুন, এক হাতা ঘন দুধ খাওয়াতে পরত! এমন সোনার চাঁদ ছেলেরা। তাদের দুঃখ ঘোচাবার জন্য, তাদেরই প্রাণ বাঁচাবার জন্য, তাদের প্রিয় শেখ সাহেবকে ছাড়িয়ে আনবার জন্য যুদ্ধ করছে এরা। কেমন করে কী দিয়ে এদের সমাদর করবে হাতেমের দাদির মতো গরিব মানুষ!

ছেলেদের কাছেই পাক-সেনাদের বর্বর অত্যাচারের কাহিনি শুনে ভয়ে আতঙ্কে বিভীষিকায় যেন হিম হয়ে গেল হাতেমের দাদি। হায়রে আল্লার নির্দোষ বান্দা! নবীর প্রিয় উম্মত। তাদের এই কুকুর বেড়ালের মতো মৃত্যু! কুকুরে শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাদের লাশ। ওরা, ওই নির্মম সৈন্যরা নিজেদের বলে মুসলমান। কিন্তু মুসলমান হয়ে তারা নারীর ইজ্জত লোটে। শিশুকে হত্যা করে। ফলন্ত শস্যক্ষেতে আগুন দেয়! উহ্ আল্লাহ তোমার এত সহ্য! হায় এখনো কেন ওই আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে আগুন নামে না! কেন প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে দুনিয়া বিচূর্ণ হয় না! কেন গজবে ধ্বংস হয় না অত্যাচারীর উঁচু মাথা! কেন আসে না পাপী ধ্বংসকারী নূহের বন্যা ? উড়ে আসে না কেন কঙ্কর চূর্ণ মুখে আবাবিলের ঝাঁক ফেরাউনের জালেম সেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে?

নিজের অভাবী জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে আজ পর্যন্ত ছোটখাট যেসব ফরিয়াদ পাঠিয়েছে হাতেমের দাদি সেসব তুচ্ছ করে এক বিরাট ফরিয়াদের আবেগ হাতেমের দাদির অন্তর থেকে প্রচণ্ড বেগে উত্থিত হয় সেই অদৃশ্য ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারীর উদ্দেশে।

চটের ওপর নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে থাকা ক্লান্ত ছেলে দুটির শিয়রে সজাগ পাহারায় বসে পাখা নেড়ে হাওয়া করতে করতে নতুন সংকল্পে বুক বাঁধে বুড়ি হাতেমের দাদি! ভোরে কাকপক্ষী ডাকার আগেই হাতেমের দাদি ওদের চিনার জাউ রেঁধে দেয়। ওদের খাওয়া হলে নিজের সংকল্পের কথা জানায় সে,—আমার হাতেমেরে তোমরা সঙ্গে নেও দাদারা। আমি আর কী দিমু? আমার তো ওই এক সম্পত্তিই আছে।

চমকায় হাতেম। দ্বিধা আনন্দের আলোকে ভাসে তার মুখ- আমি! আমি যামু? কিন্তু আমি গেলে তরে খাওয়াইব কে দাদি?

যা দাদা। আমার কথা চিন্তা করিস না। আমার তিন কাল যাইয়া শ্যাষ কাল ঠেকছে। আমি মরলে দুঃখু কী! আমি শাক পাতা টোকাইয়া একটা প্যাট চালামু। তুই যা দাদা। যুদ্ধ কর। যারা আমাগো মা বইনের ইজ্জত লোটে, যারা বিনা দোষে মানুষ মাইরা সাফ করে তাগো সাথে লড়াই ফরজ। যাও দাদা, আল্লাহ তোমাগো সাথে আছে।

হাতেম চলে যেতে অশ্রুভরা চোখ ভোরের আকাশে তুলে দোয়া চাইল হাতেমের দাদি—অগো মনের আশা পূর্ণ কইরো আল্লাহ। ওরা জানি জালেমের নির্বংশ করবার পারে। ওরা জানি আমাগো শেখ সাহেবেরে ছাড়াইয়া আনবার পারে।

এরপর দীর্ঘ কয়টি মাস কী দুঃখ যন্ত্রণা আর বিভীষিকার মধ্যে একাকিনী দুঃখিনী হাতেমের দাদির দিন কেটেছে সে কথা হয়তোবা হাতেমের দাদি তোমায় নাও শোনাতে পারে। কিন্তু একটা কথা বলতে ভুলবে না হাতেমের দাদি। জ্বলা-পোড়া গাঁয়ের বিরল হয়ে আসা বসতির মধ্যে যে কয়জন ছিল তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর শুনত হাতেমের দাদি। হাতেমের দাদি তোমায় বলবে সেই যে স্বাধীন বাংলা রেডিও বলে একটা খবর হতো, সমশের মিয়ার ট্রানজিস্টরে সন্ধ্যার পর সেই খবর শুনবার জন্য অনেকখানি হেঁটে সমশের মিয়ার দাওয়ার একধারে উদ্গ্রীব হয়ে বসে থাকত হাতেমের দাদি সন্ধ্যা থেকে। মুক্তিবাহিনীর নিত্য নতুন বিজয়ের সংবাদে হাতেমের দাদির ঘোলাটে চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠত। প্রাণভরে দোয়া করত সে। আহ্ কবে সেদিন আসবে যেদিন তার হাতেমরা পূর্ণ বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরে আসবে। হয়তো তারা ফিরে আসার শুভলগ্ন দেখা পর্যন্ত এ গ্রামের অনেকেই বেঁচে থাকবে না।

হাতেমের দাদির কুঁড়েটাও কিন্তু আগুনে পুড়েছিল। তবে ওই ভাঙা কুঁড়েটায় আগুন দিয়েছিল রাজাকাররা। এ গ্রামেও কিছু রাজাকার ছিল। তবে এরা আগে ছিল ছ্যাচড়া চোর ডাকাত।

শমসের মিয়া দয়াপরাবশ হয়ে তার ঢেঁকির ঘরটায় থাকতে দিয়েছিল হাতেমের দাদিকে। সেই ভাঙা ঢেঁকির ঘরটার এককোণে শুয়ে হাতেমের দাদি একান্ত মনে প্রার্থনা করত আল্লাহর কাছে— আল্লা আমাগো হাতেমেরে, আমাগো সব মুক্তিবাহিনীরে তুমি হায়াতদরাজ কইরো আর হায়াতদরাজ কইরো আমাগো শেখ সাবেরে। আমাগো মুক্তিবাহিনী জানি সবখানে জিত্তা যায়। তারা জানি অনেক গোলা বারুদ কামান বন্দুক পায়।

হাতেমের দাদি তার দন্তবিহীন মুখে হাসি ফুটিয়ে জানাবে, আঘুন মাসে মুক্তিবাহিনীরা পাকাপাকি ক্যাম্প করল জামালপুরে। সমশের মিয়ার পাছ দুয়ারে বসে কুড়িয়ে আনা দুটো সুপারির ডাল জ্বেলে কলমী শাক সিদ্ধ করছিল হাতেমের দাদি। ঠিক সেই সময় সমশের মিয়ার জামতলায় সরু পথটা দিয়ে হঠাৎ এসে পড়ল হাতেম। এসেই দুহাতে দাদিকে জাপটে ধরল, দাদিগো! আমি আইছি।

হর্ষে বিষাদে হেসে কেঁদে হাতেমকে দেখল দাদি। এই কয় মাসে অনেকখানি যেন মাথায় বেড়েছে হাতেম। পরনে লুঙ্গি আর সার্ট। পিঠে বন্দুক।

বন্দুকটা দেখিয়ে হাতেমের দাদি বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় প্রশ্ন করে—ওডা কী রে দাদা? হাতেম হাসে—এইডা এস এল আর। পাকিস্তানি সিপাইরে মাইরা পাইছি। এতক্ষণে সাবধান হয় হাতেমের দাদি। হায় হায় বেইল থাকতে বাইরাইলি, কেউ যদি দেইখা ফালায়। রাজাকাররা খবর পাইলে উপায় নাই আর।

অকুতোভয়ে হাসে হাতেম,—ডর নাই দাদি। হেই বেইমানের বাচ্চারে দিছি খতম কইরা। আমরা তো জামালপুরে ক্যাম্প করছি।

এবার হু-হু করে কাঁদে হাতেমের দাদি—তোরা আগে ক্যান আইলি না ? এ গেরামের কি আর মানুষ আছে! এই গেরামের কি আর ইজ্জত আছে! জ্বালাইয়া পোড়াইয়া শ্যাষ কইরা দিচ্ছে না সব।

জামালপুরে মুক্তিবাহিনীর গল্পও অনেক শুনতে পাবে হাতেমের দাদির কাছে। জনবিরল আগুনে পোড়া ধ্বংস্তূপের মধ্যে যে কয়ঘর মানুষ ছিল, তারাই মাথায় বয়ে চাল জ্বালানি কাঠ ক্ষেতের লাউ কুমড়া পুকুরের মাছ এনে পৌঁছতে লাগল ক্যাম্পে। গরিব জীর্ণ একটা গ্রাম, তবু হাটের দিন দুআনা চার আনা এক টাকা যে যা পারে তোলা উঠিয়ে মুুক্তিবাহিনীর খরচের বন্দোবস্ত হলো।

হাতেমের দাদি বিনীত কুণ্ঠায় জানাবে অনেকগুলো নফল রোজা আর নফল নামাজ মানত করেছিল সে।

সে নফল রোজার মানত সত্যিই একদিন সফল হলো। সমশের মিয়ার আট বছরের ছেলেটা কোমরের লুঙ্গি কষে খড়ের পালায়ে গড়াগড়ি দিয়ে আনন্দে উচ্ছ্বাসে তার কচি কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল—জয় বাংলা। সন্ধে-নামা গ্রামের চকে বিলে তখন কুয়াশা নামছে। গ্রামের গাছ-গাছালির মাথায় কিচিরমিচির করছে পাখিরা। তবু শেষবেলায় হলুদ রোদ মাখা বাতাসে শিশুকণ্ঠের আনন্দ ধ্বনি বিজয়ের হিল্লোল তুলে দিল দিকে দিকে। ট্রানজিস্টরকে ঘিরে ভেঙে পড়ল শিশু বৃদ্ধ যুবক নারী পুরুষ। আবেগের আনন্দ, ত্যাগের দুঃখ, ফিরে পাওয়ার নিরাপত্তায় মানুষের মুখে তখন কান্না আবিল অসীম সুখ। সে সুখ বেঁচে থাকার। স্বাধীনতার।

বাজারখোলার পোড়া দোকানের মাথায় মাথায় তখন হর্ষের ঢেউ তুলে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ক্ষুদের চাপড়ি দিয়ে ইফতার করে নফল রোজা শেষ করল হাতেমের দাদি। ছেঁড়া কাপড়ের খুটে খুশির অশ্রু মুছে বলল, দেখ সব। বুঝ এইবার আল্লার বিচার।

হাতেমের হাত ধরে নিজের পোড়া ভিটেয় এল হাতেমের দাদি। একে একে ফিরে এল গ্রামের আরও অনেকে। স্বাধীন সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে তারা সবাই বুঝল দরিদ্র গ্রামটির মানুষেরা এখন প্রায় নিঃস্ব। হাঁস-গরু, ঘর-দোর, নৌকা, আত্মীয়-পরিজন সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছে। কিন্তু তাতে কী! স্বাধীনতার সূর্য যখন সত্যকে উন্মোচিত করেছে, তখন সুদিন ফিরতেও আর দেরি নেই। শুধু সেই জল্লাদের কবল থেকে তাদের প্রিয় নেতা শেখ সাহেবকে আল্লাহ্ ভালো ভালাইতে ফেরত এনে দিলে হয়।

পোড়া ভিটের ওপরেই সুপারির ডাইগার বেড়া আর শনের চাল দিয়ে কোনোরকমে একটা চালা তুলে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে ফেলল হাতেম। ইস্কুলের মাস্টার সাহেবও গাঁয়ে ফিরল একদিন। তাকেই ব্যাকুল প্রশ্ন করল সবাই—কী অইব আমাগো শেখ সাহেবের ? মাস্টার আশ্বাস দিল—হইব হইব। শেখ সাহেবের ছাড়ানই লাগব তাগো। তা নইলে আর বাঁচন লাগত না তাগো। হাতেমের দাদি আবার নফল নামাজ আর রোজা মানত করল। হিমে ভেজার চালার নিচে শুয়ে বিধাতাকে আবেদন পাঠাল নির্মম প্রহর ভরে।—আল্লা আমার হাতেম ফিরা আইছে। এইবার আমাগো শেখ সাবেরে ফিরাইয়া দেও। নইলে আমরা গরিব-গরবারা ক্যামনে বাঁচুম ? কে দিব আমাগো ভাত কাপড়!

হাতেমদের চালার পাশে গাছটার মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিল হাতেম। যে পতাকাটাকে দেখতে ভারি ভালো লাগত হাতেমের দাদির, সেই পতাকার ওপর যখন একদিন কুয়াশার অনিশ্চয়তা ছিন্ন করে নতুন দিনের সূর্য মাত্র আশার আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তখন ছুটতে ছুটতে প্রায় রুদ্ধনিঃশ্বাসে দাদিকে এসে খবর দিল হাতেম—ও দাদি। শেখ সাহেব ছাড়া পাইছে। আইতাছে আইজ ঢাকায় ফির‌্যা। ও দাদি কী জবর খুশি লাগতাছে আমার!

এক লাফে হাতেম ঘরে ঢুকে তার বিজয়ের স্বাক্ষর স্টেনগানটা বের করে শূন্যে ফাঁকা আওয়াজ করে উল্লাস ধ্বনি করতে থাকে। চোখে পানি আসে হাতেমের দাদির। সবই আল্লাহর লীলা খেলা। তার যে বাপ মরা নাতি হাতেম দু’বছর আগেও সন্ধ্যারাতে বাঁশঝাড়ে হুতোম প্যাঁচা ডাকলে ভয় পেয়ে দাদির কোলের কাছে ঘন হয়ে বসত, সেই হাতেম ওই বন্দুকের গুলি দিয়ে শত্র“র সঙ্গে লড়াই করেছে। আজ আবার সেই মারণাস্ত্রেই প্রকাশ পাচ্ছে তাদের একজন একান্ত আপজনকে ফিরে পাবার উল্লাস।

হাতেমের দাদির মনে পড়ল হাতেমের বাবা একবার ধান কাটতে গিয়েছিল বরিশাল। ধান কাটা শেষ করে সবাই ফিরে এসেছিল। ফেরে নি শুধু হাতেমের বাবা। সঠিক খবরও কেউ দিতে পারে নি। কেউ বলেছে বাঘে খেয়েছে। কেউ জানিয়েছে ওলাওঠা না কী যেন অপঘাতে মরেছে। এমনি নানা কিছু। মা মরা ছোট্ট নাতি হাতেমকে বুকে করে শোকে দুঃখে অভাবে হাতেমের দাদির কেঁদে কেঁদে যখন অন্ধ হবার উপক্রম, ঠিক সেই সময় একদিন ফিরে এল দীর্ঘদিন নিরুদ্দিষ্ট হাতেমের বাবা।

হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে হাতেমের দাদির মনে সেদিন যে অনির্বচনীয় আবেগের অনুভূতি উত্তাল হয়েছিল আজ এতদিন পরে ঠিক তেমনি একটা অনুভূতিতে মূক হয়ে গেল সে। শুধু আপনজন নয়, বুঝি মহামূল্যবান হারানো কিছু আবার ফিরে পেল তারা।

হাতেম স্টেনগান লোফালুফি করতে করতে বলল—লও দাদি, মাস্টার সাহেবের বাড়ি যাই। তার ট্রানজিস্টারে আজ শেখ সাহেবের খবরই কইব খালি।

কাজ সেরে নাতির হাত ধরে মাস্টার সাহেবের বাড়ি রওয়ানা হলো হাতেমের দাদি। খাল ধরে জিওলের ডালে উঠতি সূর্যের আলোর ঝিলিমিলি। সে আলোটা হাতেমের দাদির ভারি একটা সুখ আর আশার মতো মনে হয়। পথ চলতে চলতে বলে—শেখ সাহেব আইতাছে। অহন আর আমাগো কোনো দুঃখ নাই। আমাগো সুদিন ফিরে আইল।

সুন্দর প্রসন্ন শীতের সকালটাকে হাতেমেরও খুব ভালো লাগে। উদ্দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল—আর কিয়ের দুঃখ? জানো দাদি শেখ সাব আমাগো ভারি মহব্বত করে। যখন তারে মিলিটারিরা ধরবার আইল তার আগে সবতে কইছে শেখ সাব আপনে পলাইয়া যান। আপনেরে পাইলে জল্লাদরা আনাম থুইব না। শেখ সাব কী কইল জান দাদি?

কী কইল ?

উৎসুক প্রশ্ন করল হাতেমের দাদি।

কইল, আমার দ্যাশের মানুষ আমার আপনজনেগো মউতের মুখে ফালাইয়া আমি কই যামু! আমি যাইবার পারুম না। হাতেমের দাদি ছেঁড়া কাপড়ে আবার চোখ মোছে—আহাহা, কী মানুষ আল্লায় বানাইছে। কী দিল! কী মহব্বত! কী সাহস!

ট্রানজিস্টর ঘিরে উদগ্রীব একদল মানুষ। প্রতীক্ষার আনন্দে চঞ্চল তাদের মন। শেখ সাহেব নয়, যেন হাজার হাজার দুঃখী পোড়-খাওয়া গ্রামের উপবাসী অগণিত মানুষের মুশকিল আসান ফিরে আসছে। কম দোয়া খয়রাত নামাজ রোজা মানত করেছে না কি তারা ? কাল সারাদিন তো গ্রামের ছেলেরা পাড়ায় পাড়ায় চাল চাঁদা তুলেছে। আজ সন্ধ্যার পর মসজিদে তাই দিয়ে সিন্নি রেঁধে মিলাদ আর কোরআন খতম দেওয়া হচ্ছে। আজ যেন ঈদের মতো খুশির দিন গ্রামের মানুষের।

সারাদিন একরকম অভুক্ত থেকে ট্রানজিস্টরের ধারা বিবরণী শুনল হাতেমের দাদি সকলের সঙ্গে। তারপর শেখ সাবের বক্তৃতা।

তোমাকে শোনাবার সময় এখনো হাতেমের দাদির কণ্ঠ আবেগে বুজে আসবে।

আহা, কী কথা! শুনলে কলিজাটা ঠান্ডা হইয়া যায়। কে এমন দরদ দিয়ে বলেছে যদি তার দেশের মানুষ ভাত না পায় কাপড় না পায় তবে ...

হাতেমের দাদি তোমায় বলবে—কী দরের মানুষ। কিন্তু কত চিন্তা কত কান্দাকাটি আমাগো মতো দুঃখিত মানুষের লাইগা। বড় দিলের মানুষেরেই আল্লাহ বড় করে।

জামালপুরে যেতে অবশ্য তোমার একটু অসুবিধাই হবে। জামালপুরের বাসিন্দারাই আক্ষেপ করে বলবে, আইতে যে বড় কষ্ট। কিছু কি হেই দুষমনেরা থুইয়া গেছে? গাঙ্গে তো অহন একটা মোটে লঞ্চ, দুই দিন পর পর ক্ষেপ আনে। দুঃখ করলেও দেশের অবস্থা জামালপুরের লোকেরা যেন বেশ ভালোভাবেই বোঝে। সারা দেশটা যেন তাদেরই মতো নিঃস্ব গরিব হয়ে গেছে। ডিজেল পেট্রোল নাই। লঞ্চ চলে না। বড় গাঙ পার হয়ে বাসে চড়ে ফেরি পার হয়ে যে আসবে তারও তো উপায় নাই। একে তো পাকিস্তানি সৈন্যরা ফেরিগুলো নষ্ট করে দিয়ে গেছে, তার ওপর নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো যে ফেরিটা আছে তেলের অভাবে সেটাও প্রায় বন্ধ থাকে। যাই হোক ফেরি না হয় কপালগুণে পার হওয়া গেল। কিন্তু এই যে দু’এক মাইল অন্তর অন্তর কতগুলো পুল ভেঙে জামালপুর সড়ক অচল হয়ে পড়ে আছে সে পথ ভাঙা তো সোজা কথা নয়। অনেক টাকা আর সময়ের যে দরকার এসব ঠিক করে তুলতে।

হাতেমের দাদিকে যদি তুমি প্রশ্ন করো—কী করে এখন তোমার হাতেম ? অম্লান হেসে জবাব দেবে সে,—ক্যান! মাটি কাটে। পৈরাত দেয়। কেরায়া নাওয়ের লগি ধরে। পাটক্ষেত নিড়ায়। পাঁচসিকা কামায় দিনে। 

অবশ্য গ্রামের লোক বলেছিল—যা হাতেম একবার শহরে যা। অনেক তো খাটলি-বিটলি। যুদ্ধ করলি। শেখ সাহেবের কইয়া একখানা চাকরি বাকরি ধর। টাকা-পয়সা কিছু আইব, দুঃখ খুচব।

ঘাড় বাঁকা করেছে হাতেম,—ক্যান, কিয়ের লাইগ্যা? আমি যুদ্ধ করছি আমার মা-বইনোগো ইজ্জত বাঁচাইতে। অস্ত্র ধরেছি দ্যাশ থনে দুষমন খেদাইবার। আমাগো শেখ সাবেরে ফিরাইয়া আনবার। আমি বড় ট্যাকার লোভে চাকরির লালচে যুদ্ধ করছি নিকি? কী কাম শহরে! আমাগো এই গেরামেই ভালো।

হাতেমের দাদি কিন্তু ভারি খুশি। যদিও তার ভিটের ওপর সেই চালা ঘরটার নিচেই তারা এখনো ঘুমায়। কিন্তু তাদের দরদবন্দ শেখ সাহেব কি তাদের কথা ভুলতে পারে! এই ক’মাসের মধ্যে দু’বার রিলিফের মাল বোঝাই লঞ্চ এসে ভিড়েছে জামালপুরের ঘাটে, জামালপুরের পাস করা মেম্বারের বাড়িতেই সেসব জিনিস উঠেছে। কিন্তু এর মধ্যে হাতেমের দাদি দু’দুবার পেয়েছে পাঁচসিকে নগদ। একবার পেয়েছে পুরো পাঁচটা টাকা। তার ওপর আধ সের করে গম ফি হপ্তায়। একি কম কথা!

গম সিদ্ধ করে তাতে কিছু আখের গুড় ফেলে ক্ষীর জাতীয় খাদ্য রান্না করে গর্বের সঙ্গে হাতেমকে পায়েস খাওয়ায় হাতেমের দাদি। পাশের বাড়ির সমশের মিয়ার স্ত্রীর কাছ থেকে একটু পান সাদা চেয়ে পাটায় ছেচে মুখে পুরে দাওয়ার ওপর জাঁকিয়ে গল্প করতে বসে পড়ন্ত বেলায়। ফালি হয়ে যাওয়া কাপড়ে গিঁট দেওয়া সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়া হাঁটুটার আভ্রু ঢাকতে ঢাকতে মুখে একটু চুন ফেলে শমসের মিয়াকে বলে,—কী কও মিয়াভাই! দিন তো আমাগো ফিরল। এই যেন মালতা পানিডা আইতাছে এমনে আইতে আইতে আর আইব।

শমসের মিয়াও হাসে—হ বুয়া। ঠিক কইছ। কয়টা দিন এটুকু দুঃখ কইরা পরাণ ধইরা থাকন লাগব। তারপর আরও দুঃখ নাই।

শমসের মিয়ার স্ত্রী পানের পিক ফেলে এক গাল হেসে বলে— কথাডা তো ঠিকই। কত বড় একটা যুদ্ধ গেল দ্যাশের উপর দিয়া। ঠিক হইতে তো কিছু সময় লাগব। ওই যে কয় না তুফানে সুপারি গাছটা ভাঙলেও হেইডারে খাড়া করতে কিছু মেহনত আর সময় লাগে।

জামালপুরের মাস্টার সাহেব কিন্তু তোমাদের শহরের অনেক খবর রাখে। সে হাতেমকে বলে যে শহরগুলোতে না কি ভারি ওলট-পালট। সেখানে সমাজতন্ত্র না কী যেন বলে তাই তৈরি করা হচ্ছে। হাতেম শোনে কেউ আর এখন বেশি বেশি মায়না পাবে না চাকরি করে। শ্রমিক—মানে ওই যারা কলকারখানায় চাকরি করে তাদেরকে অনেক সুখ সুবিধা দেওয়া হবে। সমাজতন্ত্রের তাই নিয়ম কি না। আবার শহরে না কি অনেক স্লোগান-টোলোগান দিয়ে মিছিলও হয়। সরকার এখন এইসব বড় চাকুরে শ্রমিক সবাইর রোজগার মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসছে। কেউ আর বেশি বড় লোক হয়ে মজা লুটতে পারবে না। আর হ্যাঁ হাতেম আরও শুনেছে সেখানে শিল্প মানে কলকারখানাগুলোরও মেলাই সংস্কার শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা কথা শুনে হাতেম বড় বিচলিত হয়। শহরের ব্যবসায়ীরা না কি দেদার পয়সা লুটছে। তাই তো হাতেমের মনে প্রশ্ন আসে,Ñ আইচ্ছা এই ব্যবসায়ীরা যে নাহক জিনিসের দাম বাড়াইয়া চোরা বড়লোক হইতেছে তা হইলে কেমনে গরিব বাঁচব? এ তো গরিবের রক্ত চুইষা খাওয়া। মাস্টার সাহেবই তো কয় বাংলাদেশের আমরা সবতেই গরিব।

মাস্টার হাসে—দ্যাখ হাতেম আমরা গেরামে থাকি শতকরা আশিজন লোক। চাষবাসই আমাগো রোজগারের পথ। আর কারখানার মজুর তো সাত কোটি মানুষের মধ্যে সব মিলাইয়া চার পাঁচ লাখ হইব। আর অফিসের চাকরিই বা করে কয়জন! খালি এইসব মানুষের হেরফের কইরা আর শিল্প কারখানা হাতে লইয়া কি সমাজতন্ত্র হইব এই দ্যাশে? কয়টা কারখানা ফ্যাক্টরি আছে এই দ্যাশে?

তা হইলে কী করণ লাগব? হাতেম প্রশ্ন না করে পারে না। কী করতে হবে সেটাও মাস্টার বলে। তার সবটুকু না বুঝলেও হাতেম মোটামুটি বোঝে যে দেশের ধান পাট চাষাবাদের দিকে বেশি খেয়াল দিতে হবে। বন্যা, অনাবৃষ্টি রোধ করে ক্ষেতের ছোট ছোট আলগুলো ভেঙে দিয়ে এক বিশাল শস্যক্ষেত হবে দিগন্ত বিস্তারিত। ওই ক্ষেতের আবাদই গ্রামের আধপেটা খাওয়া অবহেলিত মানুষগুলোর সুদিন ফিরিয়ে আনবে। মাস্টার সাহেব বলে এ দেশ ওই যে কৃষিভিত্তিক না কী যেন একটা বলে সেই কৃষি ভিত্তির কাঠামোর ওপর শিল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অবশ্য হাতেম অতসব বোঝে না। কিন্তু হাতেমের দাদির সুখের ষোলকলা প্রায় পূর্ণ হলো বলে। কারণ রিলিফ থেকে সে একটা কম্বল পেয়েছে। কেমন ছাই রঙের তুলতুলে গরম কম্বল! এতটা বয়স পর্যন্ত এমন কম্বল চোখেও দেখে নি হাতেমের দাদি।

তুমি হয়তো হাতেমের দাদিকে দেখে সত্যি অবাক হবে। তোমরা যখন শেষরাতে মহান একুশের প্রভাত ফেরি গাও, তখন ফজরের নামাজে বসে হাতেমের দাদি তার চেনা-অচেনা যারা শহীদ হয়েছে, যাদের নাম তোমরা কোনোদিন জানবে না তাদের আত্মার শান্তি প্রার্থনায় কেঁদে আকুল হয়। যখন তোমরা অনেক পয়সার বিদ্যুৎ পুড়িয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতির গালভরা বক্তৃতা শোনো, তখন এরা ছেঁড়া কাপড় গায়ে জড়িয়ে রিলিফের গম সিদ্ধ খেয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের ভিটের ওপর নারকেল পাতার ছাওনা দিয়ে রোদ বৃষ্টি ঝড় ঝাঁপটা ঠেকাবার আচ্ছাদন বুনতে হয়রান হয়।

তবু হাসিমুখে নিজেরা বলাবলি করে—আর কয়টা দিন একটু কষ্ট করন আর কী! দ্যাশটা কিছু গোছগাছ হইলেই আমাগো দিন ফিরব।

তুমি কি একবারও ভাববে না যে দেশের স্বাধীনতায় এরা কত আশাবাদী। কত ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।

হাতেমের দাদির চালাটায় গেলে দেখবে সে উঠোনে বসে ঝরা শুকনো পাতা জ্বালিয়ে চুলোয় ক্ষুদ গম আর শাকের ডগা একসঙ্গে সিদ্ধ করে এক বিচিত্র খিচুড়ি রাঁধছে।

তুমি জিজ্ঞাসা করবে—ভাত রাঁধছ না যে ? হাতেমের দাদির মুখে একটু অবশ্য বিষণœ হবে, বলবে—দুই টাকা সের চাইল। কিনবার পারি কই?

তুমি চমকাবে—দুই টাকা সের। তার মানে আশি টাকা মণ! তা তোমরা কি কেরোসিন টেরোসিন পাও?

কই পামু বাজান? তেল তো বাজারে নাই।

জ্বালাও কী?

কিছু না। বেইল থাকতেই রাইনধা খাইয়া লই। আন্ধারেই থাহি রাইতে। একটু বিজ্ঞতার সঙ্গে হয়তো তুমি প্রশ্ন করবে—তা যাই হোক দেশ তো স্বাধীন হলো। খুশি হও নি?

প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ যেন হতভম্ব হয়ে যাবে হাতেমের দাদি। তারপর একমুঠো শুকনো পাতা চুলোয় ঠেলে দিয়ে ধীরে ধীরে বলবে—এর চাইয়া বড় খুশি এই জীবনে আর কী আছে বাজান?

তুমি থতমত খাবে। অপ্রস্তুত হয়ে বলবে—না মানে এই জিনিসপত্র এত দাম! তোমাদের কষ্ট হচ্ছে।

হাতেমের দাদির মুখে আবার প্রসন্ন হাসির আভাস জাগবে— কষ্ট তো কিছুদিন করণই লাগব বাবা। আস্তে আস্তে ভালো হইব। সব ভালো হইব। ওপরে আল্লাহ নিচে আমাগো শেখ সাহেব। সে তো আমাগো লাইগাই কান্দাকাটি করতাছে। আহা! কত দোয়া করি তারে ? খালি পিন্দনের একখান কাপড় যদি দেয় বাবা তাহলেই আমার সব হইব।

তুমি সত্যি অবাক হবে। তোমাদের শহুরে বুদ্ধিজীবী সংগ্রামী চাকুরে শ্রমিক আর নেতাদের জটিল চিন্তাধারার সঙ্গে কিছুতেই যেন হিসেব মেলাতে পারবে না জামালপুরের মানুষেরা। তোমাদের দাবির স্লোগানের পাশে তুমি খুঁজবে সাত কোটি মানুষের শতকরা আশি ভাগ দরিদ্র গ্রামবাসী কৃষকের দাবির কোনো স্লোগান! জানি তুমি ব্যর্থই হবে।

সেদিনই তুমি হয়তো জামালপুর থেকে ফিরে আসবে তাই জানতে পারবে না সুপারিপাতার ছাওয়া চালের নিচে খেজুরপাতার চাটাইয়ের ওপর রিলিফের কম্বলখানা বিছিয়ে শুয়ে নিজেকে খুব যেন একটা সম্পদশালিনী মনে হয় হাতেমের দাদির। কম্বলের বেশি অর্ধেক বিছিয়ে দিয়েছে হাতেমের দিকে। এক মাথায় গুটিশুটি হয়ে শুয়েছে সে নিজে। সুপারিপাতার ছাউনির ফাঁক দিয়ে এক চিলতে চাঁদ দেখা যায়। বাঁশঝাড়ে হাওয়ায় শন শন কট কট শব্দ ওঠে। সুখের ঘুমে চোখ জুড়ে আসে হাতেমের দাদির। আধতন্দ্রার মধ্যেই সে মনে মনে বলে, ‘খোদা’ সামনের ভোটে আবার শেখ সাহেবই যেন পাস হয়। আল্লাহই তারে গদিতে রাখব। তারপর পরম একটা নিরাপত্তা আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে সত্তর বছরের বৃদ্ধা হাতেমের দাদি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.