নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১২)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১২)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ১২তম পর্ব।]

 প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব 

পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ 

আমি ট্যাক্সি কিনতে যাচ্ছি এ খবর জানতে পেরে আমার এক নিকটাত্মীয় আর এক বন্ধু আগ্রহ দেখালেন। দুজনেই আমার পরিচিত। একসাথে অনেকদিন গাড়ি চালিয়েছি। দুজনেই আমার সাথে পার্টনারশিপে ব্যবসা করতে চান। আমিও রাজি হয়ে গেলাম, কারণ আমি তখনো কিছুটা দ্বিধার মধ্যে ছিলাম গাড়ি কিনব কি কিনব না এই নিয়ে। দলে তাদের নেওয়ার পর মনের জোর অনেকখানি বেড়ে গেল।

এক দুপুরবেলা তিনজনে মিলে ব্রোকারেজে গেলাম। কথাবার্তা বলার পর ওইদিনই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ডাউন পেমেন্টের টাকা দিলাম, বাকি টাকা ব্যাংক ফাইনেন্স করবে। তিনটি গাড়ির ঋণ পরিশোধ করতে আমাদের মোট দুই বছর সময় লাগবে। হাইব্রিড গাড়ি প্রায় সাত বছর ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে সবকিছু ঠিকঠাক মতন চললে বাকি পাঁচ বছর আমাদের প্রতি সপ্তাহে শুধু মেডালিয়ানের ভাড়া দিতে হবে। কারণ গাড়ি তখন ঋণমুক্ত, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে পেইড-অফ। 

সপ্তাখানেকের মধ্যে গাড়ি কেনা হলো। গাড়ি কেনার পর গাড়িটিকে  ‘হ্যাক আপ’ করানো হলো অর্থাৎ ট্যাক্সিতে রূপান্তরিত করা হলো। আমাদের গাড়িগুলো ছিল ফোর্ড এস্কেপ ২০০৮ মডেলের হাইব্রিড গাড়ি। হাইব্রিড টেকনোলোজি তখন নতুন বাজারে এসেছে। এই গাড়িতে জ্বালানি খরচ অন্যান্য গাড়ির প্রায় অর্ধেকেরও কম।

যে তিনটি গাড়ি আমরা কিনেছিলাম তার মধ্যে একটি গাড়ি আমরা নিজেরা চালাব বলে ঠিক করেছিলাম আর বাকি দুটো গাড়ি ভাড়া দিয়ে দেব। আমি সোমবার থেকে শুক্রবার দিনের শিফটে চালাতাম, বাকি দুজন রাতের ও উইকেন্ডের শিফটগুলি ভাগাভাগি করে চালাতেন। আমাদের তিন গাড়ির সাপ্তাহিক পেমেন্ট ছিল ১২০০ করে মোট ৩৬০০ ডলার। বাকি দুটো গাড়ি ভাড়া দিয়েছিলাম ১৫০০ ডলার করে। ওই দুই গাড়ি থেকে প্রতি সপ্তাহে ৩০০০ ডলার পেতাম। নিজেদের পকেট থেকে মাত্র ৬০০ ডলার আমরা তিনজন ভাগাভাগি করে দিতাম। কোনো গাড়ি লিজ দেওয়ার পর তার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মালিকের। ধরা যাক, ভাড়া দেওয়া দুটো গাড়ির একটির চাকা পাংচার হয়েছে, সেই খরচও আমাদের বহন করতে হবে। তাছাড়া আরও কত ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ আছে। প্রতি তিন হাজার মাইল চলার পর ইঞ্জিন ওয়েল বদলাতে হয়। আমরা আমাদের গাড়িগুলো বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ ড্রাইভারদের ভাড়া দিয়েছিলাম। ইয়াং কলেজে পড়ুয়া ছেলেদের ভাড়া দেই নি কারণ এঁরা যাচ্ছেতাই গাড়ি চালায়।

যাইহোক, গাড়ির ব্যবসা আমরা মোট সাত বছর করেছি এবং সফলভাবে। এই সাত বছরে আমাদের কোনো গাড়িই বড় কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে নি। ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আমরা গাড়িগুলো বিক্রি করে এবং মেডালিয়ানের প্লেট ফেরত দিয়ে দিই, কারণ তখন রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। চাইলে আমরা আরও এক বছর গাড়িগুলো ব্যবহার করতে পারতাম, কিন্তু করি নি।

কিছু তথ্য দিই। নিউইয়র্ক শহরের ট্যাক্সিগুলো দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই চলে। বিক্রি করার সময় আমাদের নিজেদের ব্যবহার করা ট্যাক্সিটির মাইলেজ ছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ বিরাশি হাজার মাইল। পুরো পৃথিবীর ব্যাস হচ্ছে ৭,৯১৭.৫ মাইল, সেই হিসেবে আমাদের ট্যাক্সিটি পুরো পৃথিবীকে মোট তিয়াত্তর বার চক্কর দিতে পারত। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব দুই লক্ষ আটত্রিশ হাজার মাইল, সেই হিসেবে আমাদের ট্যাক্সিটি সেই দূরত্বও অতিক্রম করেছে।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.