পালকি: হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য

পালকি: হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য

পালকি! বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীন বাহন। মানুষ বহন করার কাজেই এ পালকি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিলাসবহুল বাহন হিসেবেই এর পরিচিতি। প্রাচীনকালে সাধারণত ধনী গোষ্ঠী ও সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন।

পালকি চাকাবিহীন এক বাহন। তাই কয়েকজন মানুষকেই এই পালকি ঘাড়ে করে বহন করতে হয়। সাধারণত পালকিকে চারজন ঘাড়ে ঝুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যারা পালকিকে ঘাড়ে বা কাঁধে করে বহন করে থাকেন তাদের পালকির বেহারা বা কাহার বলে। পালকির ভেতরে একজন বা, দুইজন আরোহী থাকত, আর পালকির বেহারা হিসেবে থাকত দুই থেকে আটজন।

ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে দেব-দেবীকে আরোহণ বা দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেই পালকি দিয়ে দেবতাদের বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়ণেও আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লেখ পাওয়া যায়।

আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার ঘোনাপাড়া গ্রামে। আমার ছোট চাচার বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। চাচার শ্বশুরবাড়ি আমাদের গ্রামেই। হেঁটে গেলে বড়জোর সাত থেকে আট মিনিটের রাস্তা। বলতে গেলে এ বাড়ি ও বাড়ি। এই সামান্য পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া গেলেও নতুন বধূকে তো ঠিক এইভাবে নিয়ে যাওয়া যায় না। এতে নতুন বধূর অসম্মান হয়। তাই আমার ছোট চাচা বাড়িতে পালকি ডেকেছিলেন। পালকির বেহারা ছিল মোট ছয়জন। ওরা সনাতন ধর্মাবলম্বীর বিশেষ গোত্রের মানুষ। বিয়ের পালকিটিকে সেদিন রঙিন কাগজ ও ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী এই বেহারারাদের সবার পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া ও গলায় গামছা ঝুলানো ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আমার ছোট চাচি যখন পালকিতে উঠে বসেন, আমার ছোট চাচা তখন পরম স্নেহে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে পালকির ভেতরে গিয়ে বসেন। আমার বয়স তখন চার-পাঁচ বছর হবে। পালকিতে চড়ার সেই ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতার কথা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল মনে আছে। পালকি যখন শূন্যে ওঠে তখন চলার সময় হালকা দোল অনুভব হয়। অনেকটা দোলনায় চড়ার সুখানুভব। আশির দশক পর্যন্ত কালীগঞ্জে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে পালকির ব্যাবহার আমি নিজ চোখে দেখেছি। ১৯৮২ সালে কালীগঞ্জের সাথে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পরে এখানে পালকির ব্যাবহার শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের এ দেশে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার অনেক কমে যায়। স্থলপথে দূরদূরান্তে যেতে গ্রামের সাধারণ মানুষের বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি অথবা গরু কিংবা মহিষের গাড়ি। বিশেষ করে ১৯৩০-এর পর থেকে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন শুরু হলে পালকির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। তবে শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে বর-কনে বহনে পালকির ব্যবহার থেমে থাকে নি। পালকি ব্যবহারের সাথে মিশে আছে আমাদের এদেশীয় সংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নবাবদের আমল থেকে ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় থেকে পুরোনো ঢাকার সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ তাদের যাতায়াতের কাজে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে আসছে। তবে আমাদের দেশের গ্রামবাংলায় বিয়ে-শাদি অনুষ্ঠানে নববধূ বহনে পালকির ব্যবহারের প্রচলন অব্যাহত থাকে, বিগত বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত।

আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে কাহিনির প্রয়োজনে পালকি ব্যবহারের অসংখ্য ছবি চিত্রায়িত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি ‘ময়নামতি’র ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’— এই গানের দৃশ্যে পালকি ছবি চিত্রায়িত হয়েছে। ছবিতে বরকে একটা ঘোড়ার উপরে সওয়ার হয়ে পালকির সামনে থেকে পথ চলতে দেখা যায় আর পিছনে পালকিতে উপবিষ্ট ছায়াছবির নায়িকা কবরীকে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়। ব্যর্থ প্রেমের ছায়াছবির এই মর্মস্পর্শী গানের দৃশ্য বহু দর্শকদের কাঁদিয়েছে। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের লেখা ‘দত্তা’ উপন্যাসের কাহিনি থেকে নির্মিত ছায়াছবির বেশ কয়েক জায়গায় পালকির ব্যাবহার দেখা যায়। পালকি বেহাড়াদের কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য ও অমানবিক। দূরের পথে যেতে পালকি বেহারাদের মাঝেমধ্যে কাঁধের উপর থেকে পালকি নামিয়ে গাছতলায় বিশ্রাম নিতে হতো। পালকি বহনের সময় শরীরের ক্লান্তি দূর করতে নানা রকম আওয়াজ তুলে পুরোনো পালকিওয়ালারা গান বাঁধতেন, ‘কর্তাবাবুর রঙটি কালো/গিন্নি মায়ের মনটি ভালো/সামলে চলো হেঁইও।’ আবার কর্তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় বাহকেরা গাইতেন, ‘হেঁইও জোয়ান, সরু আল, চলো ধরে/ কর্তাবাবুর, দরাজ দিল, দেবে ধরে…।’

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত ‘পালকি চলে/ পালকি চলে’ ‘গগন তলে/ আগুন জ্বলে’ এই কালজয়ী গানটির কথা মানুষ এখনো ভুলে যায় নি। এই ধরনের বহু গান আত্ম-অবহেলায় কালের স্রোতে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া আধুনিক গান ‘পালকি চলে দুলকি চালে’/ (ছোঁয়া সর্দার); চতুর্দোলাতে চড়ে দেখো ওই বধূ যায়’; (কুমার বিশ্বজিৎ ইত্যাদি রচিত হয়েছে পালকি ঘিরে।

এলাকাভেদে বাংলাদেশের পালকিগুলোর আকার আকৃতি ও গঠনশৈলীর মধ্যে ভিন্নতা ছিল। সবচেয়ে ছোট এবং সাধারণ নকশার পালকিকে ডুলি বলা হয়। এই ডুলি সাধারণত দুইজন বহন করে নিয়ে চলে। বাংলাদেশে একসময় হাঁড়ি, মাল, দুলে, বাগদি বা, উড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক পালকি বহনের কাজ করত। এরা পালকি বহনের পাশাপাশি অবসরের দিনগুলোতে দিনমজুরের কাজ এবং মাছের ব্যবসাও করত। কাঠমিস্ত্রিরা সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গাব কাঠ প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করত পালকি। পালকির বহন করার দণ্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হতো বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেত। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দুদিকে দুটি দরজাও থাকত।

আয়না পালকির বৈশিষ্ট্য হলো, এতে আয়না লাগানো থাকত। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি বসার জায়গা এবং একটি টেবিল রাখা হতো। তবে আয়তনের দিক থেকে বলতে গেলে ময়ূরপঙ্খি পালকি সবচেয়ে বড়। এই পালকিটি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি তাকও থাকত। সাধারণত জমিদার পরিবারের সদস্যরা এই ধরনের বিলাসবহুল পালকি ব্যাবহার করত। তবে ওজনের দিক থেকে বিলাসবহুল এই পালকিগুলো অনেক ভারী হতো। পালকি বেহারাদের অনেক কষ্ট করে এই ধরনের ভারী পালকিগুলো বহন করতে হতো।

বর্তমানে পালকিকে আমাদের বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই গণ্য করা হয়। বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান জাদুঘরে। সভ্যতা ও বাস্তবতার কথা চিন্তা করলে পালকিকে হয়তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ঐতিহ্য ও অবদানের কথা ভুলে না যায়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.