ব্ল্যাক আউট

ব্ল্যাক আউট

১। অন্ধকার শব্দ একটি অদৃশ্য ও সমান্তরাল রেখা ধরে ক্রমাগত ওঠে পড়ে, ক্রমশ ঘনিয়ে আসে, জোর হতে থাকে, আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়, ফিরে আসে, জোর হতে থাকে, শ্রুতির খুব ভেতরে মস্ত বুটজুতো অলৌকিকভাবে পড়তে থাকে, বুকের ভিতরকার অরণ্যে অতিপ্রাকৃতিক ড্রাম বাজে, কখনো আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়, ফিরে আসে ফের, ক্রমশ ঘনিয়ে আসে, ক্রমাগত ওঠে পড়ে, বুকের উপর অস্থি-কঠিন বুটজুতো পড়তে থাকে, পরে দূরে চলে যায়, আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়।

২। ছায়ার ভেতরে গাঢ়তর ছায়া তৈরি করে বসে আছে একটি নিথর শরীর : আজিজ। বাইরের রাস্তার ক্রমশব্দ তার মনোমণ্ডলে ছবি আঁকে : পেশিদৃঢ় মুখ, খাকি মুখ, খাকি শরীর, খাকি হৃদয়।

৩। আজিজের কান বড় হতে হতে একটা মাঠের মতো বিশাল হয়ে ওঠে। তার ভিতর দিয়ে একটি পথ চলে গেছে। সেই পথে একতারা বাজাতে বাজাতে একটি বাউল চলে আসে। কাছে এলে দেখা যায় লোকটি সবুজাভ প্রায় খাকি পোশাক পরে আছে হাতে তার একতারা নয়, বন্দুক।

৪। নিঃশব্দে বসে আছে আজিজ।

৫। জানালার পাটাতনে উঠে পড়ে আজিজ ভেন্টিলেটর-এ কাগজ গুঁজে দেয়। হাতে নাগাল পায় না বলে সে পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে দাঁড়ায় কাত হয়ে, তার পা টলমল করতে থাকে।

৬। সবুজ মাঠে গোল ও পাটকিলে একটি ফুটবল-এর ওপর আজিজ কেবলি চেষ্টা করতে থাকে দাঁড়াবার। অদৃশ্যে তাকে ঘিরে হাসি বাজে।

৭। কোথাও আলো নেই  আকাশে না, পৃথিবীতেও না। কার্ফ্যুর কালো পরদা নেমে এসেছে ভূমণ্ডলে। রঙ্গমঞ্চে বা নাটকঘরে এখন অনুষ্ঠিত হবে অভিনয়। রাস্তায় আলো জ্বলে নি : রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর  বা দোকানপাট নীরব ও নিরালোক। সমস্ত শহর যেন উঁচুনিচু সমাধিতে একটি বিশাল কবরগাহ হয়ে আছে।

৮। অসিত-কঠিন শব্দ একটি অদৃশ্য ও সমান্তরাল রেখা ধরে নির্দিষ্ট নিয়মে ওঠে পড়ে, ক্রমশ ঘনিয়ে আসে, সোজা আজিকের বুকের ভেতরে উঠে আসে অন্ধকার বুটজুতো, হৃৎপিণ্ড দুমড়ে-মুচড়ে যায়, অতিচৈতন্যের মধ্য দিয়ে সেই শব্দ কখন নিজেকে অতিক্রম করে যায় এবং তারপর থেকেই অপেক্ষা করতে থাকে সমস্ত চেতনা জাগ্রত রেখে কখন আবার সেই শব্দ ফিরে আসবে।

৯। ভালো করে পরদা টেনে দিচ্ছে আজিজ। সে ও তার ভাইবোন কটি ও তাদের আব্বা-আম্মা সবাই বসে আছে এই ঘরে নিঃশব্দে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

১০। তাদের গলিপথের বুটজুতোর ক্রমশব্দ তার কানে ক্রমাগত বেজে চলেছে। সব বন্ধ করে দেওয়ায় শব্দ একটু আবছা ঝাপসা হয়ে গেছে মনে হয়। একবার মনে হয় সত্যি শুনছে  একবার মনে হয় না তো।

১১। বাইরে আলো যাবার মতো একটুও রন্ধ্র নেই এরকম নিশ্চিত হয়ে আজিজ আড়াল করে একটি দেশলাই কাঠি জ্বালে। দেশলাইয়ের চমকানো আলো হঠাৎ বসে-থাকা শরীরগুলোর ওপর রক্তলোভী ছুরির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১২। জ্বলে-ওঠা মোমবাতির আলোয় সোফায় পালঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পারিবারিক সবাইকে অর্ধালোকে আশ্চর্য লাগে। খুব আপন মনে হয়। একই বাড়িতে থেকেও আজিজ যেন বহুদূরে চলে গিয়েছিল। এখন আবার বাড়ির সবার খুব নিকটে চলে এসেছে, তারা যে এত কাছাকাছি  হৃদয়ের এত সন্নিকটবর্তী তা যেন এবার জানা গেল। যেন আজিজ কিসের পিছনে হাঁটছিল কী উদ্দেশে তা সে জানে না, হঠাৎ সেই ছুটন্ত পথের ধারে একটি বিশ্রামনীড় পেয়ে মনে হচ্ছে এখানে অনন্তকাল কাটিয়ে দেওয়া যায়  উদ্বেগে ভরা; কিন্তু বিশ্রামের একটি বৈকালিক আলস্য দিয়েও মাখানো যেন।

১৩। টেলিভিশন চালিয়ে দেওয়া হলো। অন করার শব্দ গুলির শব্দের মতো এসে বেঁধে যেন সবার কানে।

১৪। টেলিভিশন থেকে যে আলো এসে পড়েছে, তা যেন সূর্যের মতো মনে হয়। মোমবাতি নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এত আলো! দ্বিতীয় সূর্যের মতো, নিশীথ সূর্যের মতো, নিষিদ্ধ সূর্যের মতো। এত আলো! জানালা, দরজা বা ভেন্টিলেটর-এর কোনো গোপন ফোকর বেয়ে বাইরে গিয়ে পড়ে নি তো! তাহলেই সর্বনাশ! কাগজে, রেডিওতে, টেলিভিশনে বারংবার হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে : নিষ্প্রদীপ রজনীতে যেন এক ফোঁটা আলো দেখা না যায়। যদি আলো দেখা যায়  বাকিটা ভাবতে পারে না আজিজ।

১৫। ঘরের মধ্যে টেলিভিশনের চড়া একতরফা আলো। সেই আলোয় যেন অনেকগুলো ভাঙাচোরা মূর্তি স্তব্ধ হয়ে আছে আলো-আঁধারের দোজখে।

১৬। গোলাপবাগে একটি ছোট ছেলে; চতুর্দিকে তছনছ সৌন্দর্যের মাঝখানে একেলা দাঁড়িয়ে।

১৭। টেলিভিশনের শব্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু সেই শব্দ যেন ঘরময় পায়চারি করে বেড়ায়। যেন সেই শব্দ সমস্ত বাড়িময় ঘোরে। অন্য ঘরগুলো অন্ধকার। অন্য ঘরগুলো শব্দহীন। শুধু এই ঘরে টেলিভিশনের শব্দ, টেলিভিশনের আলো। যা কিছু শব্দ সব টেলিভিশনের, যা কিছু আলো সব টেলিভিশনের, আর সব স্তব্ধ। জীবিতরা চুপ হয়ে আছে, যন্ত্র কাকলিময়।

১৮। অন্ধকার ঘর, অন্ধকার বারান্দা, অন্ধকার আকাশ, অন্ধকার পৃথিবী। ঘনকৃষ্ণ বিশাল একটি জাল পড়ে আছে পৃথিবীর ওপর। তার ভেতরে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে কেবল আকাঙ্ক্ষার সাদা, চকচকে ও ঝিলমিল মাছ।

১৯। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আজিজের অন্ধকার মূর্তি।

২০। নিষ্প্রদীপ রজনী, নিষ্প্রদীপ মহড়া; কিন্তু নৈঃশব্দ্যও তার অনুচর। টেলিভিশনের শব্দ কমিয়ে যেন সেই অন্ধকার বাড়িয়ে দেওয়া যাবে। শব্দ যেন আলোর শত্রু“। শব্দের ভেতর দিয়ে কখনো কখনো আলো ঠিকরে বেরোয়।

২১। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আজিজের অন্ধকার মূর্তি।

২২। পাড়ার কোনো বাড়িতে কোনো অনুসন্ধান কাজ চলছে কি ? তা না হলে টহল কেন ? অথবা আসন্ন ? ভয়াল সেই নিয়মিত আওয়াজটাকে হত্যা করার অবচেতন ইচ্ছা থেকেই কি টেলিভিশন চালিয়ে দেওয়া হয়েছে; পায়ের শব্দ শুনে ঘরের ভিতরকার মানুষগুলো নিথর হয়ে গিয়েছিল কেন ? রাস্তার গম্ভীর বুটজুতোর শব্দ কি এতদূর থেকে মানুষগুলোর গলা টিপে ধরেছিল ? ব্ল্যাক আউট চলছে; কার্ফ্যু চলছে; চোখে দেখি নি; তবু কি ওই মোড়ে, এই গলিপথটুকু যেখানে বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে, সেখানে একটি জাল-বিছানো অলিভ-রং গাড়িকে এসে থামতে দেখি নি ?

২৩। বারান্দায় আজিজের অন্ধকার মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।

২৪। পরক্ষণে আজিজ দ্রুত বারান্দায় আলো জ্বেলে দেয়, ঘরের আলো জ্বেলে দেয়। বারান্দার আলো জ্বলে ওঠে, তাদের বাড়ির ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। আজিজ সদর দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে রাস্তায়;  রাস্তায় লাইটপোস্টে মুহূর্তে পাকা ফলের মতো চমৎকার আলো জ্বলে ওঠে। সারি-সারি, মায়াবীর মতো জাদুস্পর্শে  সেই আলো-জ্বলা সরল রাস্তার দারুণ নির্জনতার ভেতর দিয়ে আজিজ ছুটতে থাকে। আজিজ যে রাস্তায় যায়, সে রাস্তায় আলো জ্বলে ওঠে। সারা শহর আলোয় আলোকময় হয়ে ওঠে। ঝলমল করতে থাকে। ঝলমলে বিজন সেই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে আজিজ ছুটতে থাকে একা, একা।

২৫। বারান্দায় আজিজের অন্ধকার মূর্তি দাঁড়ানো। বারান্দা অন্ধকার, ঘর অন্ধকার, বাড়ি অন্ধকার, পাড়া অন্ধকার, শহর অন্ধকার, আকাশ অন্ধকার।

২৬। আজিজ ঘরে। টেলিভিশন চলছে। ঘরময় তার শব্দ, তার আলো  একটা জীবিত আশ্বাসের মতো মনে হয়। মনে হয় : না, আমরা একা নই। ঘরময় গমগম করছে ভোমরার মতো শব্দ, অন্ধকার ঘরে টেলিভিশনের আলো ওদের শরীরে চলাফেরা করছে ফড়িঙের মতো। টেলিভিশনের শব্দে কখন সেই টহল দিয়ে ফেরা পদশব্দ মরে গেছে  আর একটুও শোনা যায় না।

২৭। ঘরে কেউ নেই, বাড়িতে কেউ নেই, শুধু অন্ধকার খেলা করে। মৃত সেই বাড়িতে শুধু টেলিভিশন চলছে! কোনো শ্রোতা নেই, কোনো দর্শন নেই।  উদ্দীপ্ত এক ভদ্রলোক বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন।

২৮। ঘরের মধ্যেকার সবাই চুপচাপ বসে, টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে বক্তৃতা শুনছে বলে মনে হয় না।

২৯। টেলিভিশনের শব্দের মধ্যে অন্য একটি শব্দ শোনা গেল।  গুলির শব্দ।

৩০। একটি গুলি জানালার কাচ ভেদ করে সামনের দেয়ালে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছে। গেছে সোফায় বসে-থাকা আয়েশার ঠিক মাথার ওপর দিয়ে।

৩১। ঘরের মধ্যে পিনপতন স্তব্ধতা। রুদ্ধশ্বাস সবাই। কেবল টেলিভিশনের বক্তৃতারত সেই ভদ্রলোক যেন আরও উদ্দীপিত হয়ে উঠেছেন।

৩২। সংবিত ফিরে পেতে না পেতেই বাইরে একসঙ্গে অনেকগুলো পদশব্দ শোনা যায়।

৩৩। পরমুহূর্তে দরজার ওপর প্রবল করাঘাত ও তুমুল পদাঘাত। দরওয়াজা খোলো! দরওয়াজা খোলো!

৩৪। যেন এই আদেশের ব্লটিংপেপার এক মুহূর্তে অদৃশ্যভাবে সবগুলো মুখ থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। প্রত্যেকের মৃত মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখ অপরের মুখের ওপর ন্যস্ত। আজিজ তার আব্বার দিকে তাকায়। করিম সাহেব বিমূঢ়। আম্মাকে মনে হলো আজিজের, যেন মূর্ছিত হয়ে পড়বেন।

৩৫। বাইরে দরওয়াজা খোলো! ভেতরে টেলিভিশনের বক্তৃতা।

৩৬। আজিজ খাপছাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে সোফা ছেড়ে। করিম সাহেবের সহসা যেন হুঁশ ফিরে আসে; বলে ওঠেন, না, না, তোকে যেতে হবে না  আমি যাচ্ছি।

না, আমি যাই।

না, না, তুই বোস। আম্মা এরই মধ্যে কখন সজীব হয়ে তাঁর মাতৃশক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছেন, তিনি ছেলের হাত ধরলেন, তোকে যেতে হবে না, তোর আব্বা যাক, তুই...ওরা জোয়ান ছেলেদের...তুই...তুই বরং...আয়েশা, তুই ওই ছোট ঘরটায় যা।

৩৭। দরজা খুলে যায়।

৩৮। দরজার ওপরেই কয়েকটি মুখ ও শরীর, উদ্যত বন্দুক প্রায় সবার। ইধার-সে গোলি কিয়া! গুলি করেছ তোমরা। করিম সাহেব বলতে যান : না, আমরা তো গুলি করি নি, কারা যেন...। পাঁচ-ছ জন ছোকরা, কাঁধে বা হাতে প্রত্যেকের বন্দুক, একজনের হাতে রিভলবারও রয়েছে।

৩৯। চলো, আন্দার দেখাও। বুটজুতোর মর্মভেদী মচমচ শব্দ করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সবাই।

৪০। এটার সাথে চিন পহচানতা আছে তো ? বন্দুক তুলে ধরে একজন জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ বলা মুশকিল, না বলাও মুশকিল। মুহূর্তে এ কথা বুঝে নিতে দেরি হয় না করিম সাহেবের। বলেন : চিনি।

চেন ? তাহলে এসব জিনিস আছে তোমার বাড়িতে ?

না।

সাচ বলবে। তা নইলে তোমার বউ-ব্যাটা এখনি তোমার লাশ দেখতে পাবে।

সাচ বলছি।

আচ্ছা ? তবে চলো। দেখাও।

৪১। রান্নাঘর, শোবার ঘর, পায়খানা, আশপাশ  সমস্তটা একবার অতিদ্রুত চক্কর দিয়ে দেখে নেয় দলটা। যেন কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই  এ রকম নিশ্চিত হয়ে ঘরে এসে ঢোকে ফের। এসেই হুকুম করে খাটের তলা থেকে দুটো বড় বড় বাক্স বের করায়। কিন্তু নিজেরা হাত দেয় না। উঁকি মেরে দেখে। ঘরময় ছড়িয়ে থাকে ওরা।

৪২। টেলিভিশনে এখন গম্ভীরভাবে খবর পড়ছেন একজন  দেশে সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।

৪৩। একটি ছোকরা আজিজের সামনে বন্দুুক খুলে কার্তুজ ভরে, তার পর তার বুকের ওপর বন্দুকটা ধরে থাকে। সারাক্ষণ। আর সবাই অন্যত্র ব্যস্ত। এই ছেলেটির সুন্দর মুখে এক ধরনের ঠান্ডা জিঘাংসা যেন স্থির হয়ে আছে।

৪৪। আসলে এ ঘরেই সবাই আছে : অন্য ঘরে যায় নি।  হয়তো সাহসে কুলোয় নি। আজিজের অব্যবহিত ছোটভাই আজিম, আর একেবারে ছোট, স্কুলে-পড়া আনিস, কলেজে-পড়া বোন আয়েশা। আজিজ বড়, সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে এই বয়েসেই চাকরি পেয়েছে মোটা মাইনের।

৪৫। বারবার বলছে ওরা : দেখাও দেখাও। আজিজের আম্মাকে ভীত সংকুচিত কিন্তু আশ্চর্য তৎপর মনে হয়। আব্বা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে। আম্মা পালঙের তলা থেকে বড় বাক্স দুটো বের করে দেখালেন। ওরা নিজেরা হাত দিচ্ছে না। একটু যেন অধৈর্য। বাক্স খুলে দেখাতে না-দেখাতেই বলছে  আলমারি খোলো।

৪৬। আজিজের বুকের ওপরেই বন্দুক ধরে ছোকরাটা পালঙে আধশোয়া হয়ে শুয়েছে।

৪৭। আজিজের ভাবনাশক্তি লুপ্ত হয়েছে যেন। যেন সে একটি শূন্যবিন্দুর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিংবা নিজেই হয়ে উঠেছে এক ফাঁপা ও ওজনহীন শূন্যবিন্দু।

৪৮। টেলিভিশন চলতে থাকে।

৪৯। হঠাৎ যেন নজরে পড়ে আজিজের আয়েশাকে। আয়েশা বিবর্ণ মুখে মাথা নত করে বসে আছে। তার মুখ রক্তশূন্য। দেখতে দেখতে হঠাৎ আজিজের খেয়াল হয় : কখন ওরা আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আলো জ্বালাল কখন ? আশ্চর্য তো! সারাক্ষণ তো আমি এই ঘরেই ছিলাম : কিন্তু আলো জ্বালাতে দেখলাম না তো ? আজিজ কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। ওরা কি ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়েছিল ? নাকি পরে ? যেন এই প্রশ্নের ওপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে, এ রকম অধৈর্য আর অস্থির হয়ে ওঠে সে ভেতরে ভেতরে। সেই অস্থিরতা তার শরীরেও সঞ্চারিত হয় কখন। আর তখনই বন্দুকের ঠান্ডা নলটা  যা শার্টের ওপর দিয়েও টের পাচ্ছিল সে  তার বুকের ওপর নড়ে ওঠে। যেন তাকে তার অস্তিত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন সে যেন বাস্তবে ফিরে আসে, তার বুকের ওপর পরিষ্কার স্থির বন্দুকের নল দেখতে পায়। জবাব পাবে না জেনে আস্তে আস্তে সে যেন হাল ছেড়ে দেয়, তার ভেতর কেউ যেন অদৃশ্যভাবে সমস্ত শক্তি শোষণ করে নিতে থাকে। অনতিকাল পরেই সে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যায়।

৫০। টেলিভিশনের একজন গায়িকা সুমধুর কণ্ঠে গান গাইতে থাকেন।

৫১। আলমারি খুলে দেখাতে দেখাতে কাপড়ের ভাঁজ থেকে একটি চমৎকার কারুকাজ করা চারকোণা কৌটা মেঝেয় পড়ে যায় শব্দ করে। এই কৌটোর মধ্যে সংসার খরচ থেকে কিছু কিছু টাকা আম্মা জমিয়ে রাখছিলেন অনেকদিন ধরে। কৌটোটা মেঝে থেকে যে তুলল, সে তার ভেতর থেকে সমস্ত টাকাটাই তুলে পকেটের ভেতরে রেখে দিল। এক মুহূর্ত তার খুশি-চোখ কৌটার ওপরকার কারুকাজ দেখে। পরে শূন্য কারুকাজময় কৌটা সে আম্মার হাতে ফেরত দেয়।

৫২। আজিজের বুক ছুঁয়ে-থাকা বন্দুকের নল হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। আজিজ মেঝেতে শুয়ে পড়ে, ঘরময় এক হাজার ছিদ্রঅলা একটি ফোয়ারা তৈরি হয়।

৫৩। টেলিভিশনে গায়িকা চমৎকার ঠোঁট গোল করে চমৎকার চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছেন।

৫৪। বন্দুকের নল আজিজের বুক ছুঁয়ে আছে।

৫৫। আজিজ একবার নতমুখে আয়েশার দিকে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ আয়েশাকে দুজন ছোকরা দুই সরকারি হাতে দুই বাহু ধরে পাশের অন্ধকার ঘরের দিকে নিয়ে চলে। আয়েশা মর্মভেদী চিৎকার করে ওঠে। তবু তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।

৫৬। আয়েশা নীরবে নতমুখে বসে আছে।

৫৭। ওরা বোধহয় একটু জিরিয়ে নিতে চায়। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে ওরা টেলিভিশনের দিকে তাকায়। গায়িকা যেন জানতে পেরে হেসে-হেসে গান গেয়ে চলে।

৫৮। আজিজের পা টনটন করে কনকন করে, যেন হাঁটু ভেঙে পড়তে চায়। অনন্তকাল ধরে বুকে আসন্ন মৃত্যু নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।

৫৯। টেলিভিশনে গান চলছে।

৬০। সহসা এক ঝটকায় বন্দুকটা কেড়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আজিজ বিদ্যুৎগতি শক্তিতে বন্দুকধারীর পেটে একটা লাথি মারে আর বন্দুক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছিটিয়ে পড়ে ঘরে। সব কজন শত্র“ ধরাশায়ী।

৬১। আজিজ দাঁড়িয়ে। একজন তার বুকের উপর বন্দুকের নল স্থির রেখে তারই বিছানায় শুয়ে আছে। তার সুন্দর মুখে, নতুন-ওঠা গোঁফে, ছোট সরু চোখে যেন শয়তান ছদ্মবেশ পড়ে আছে।

৬২। আজিজ মেঝের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার বুকের একপাশের আলপিনের মতো ছোট একটি ছিদ্র থেকে বেগে বেরিয়ে এসে সরু একটি রক্তের নদী বয়ে চলেছে। চলেছে ঠিক দরজার দিকে, যার বাইরে গেলেই মুক্তি।

৬৩। আজিজ দাঁড়িয়ে। বন্দুকের নল তার বুক ছুঁয়ে আছে।

৬৪। রিকশায় চলেছে আজিজ। নীলক্ষেত রেলগেটের কাছে একজন বন্দুকধারী রিকশা থামায়। অত্যন্ত অল্পবয়সি ছেলে বারো-তের বছরের বেশি কিছুতেই হবে না  তারও কম। বয়সের চেয়ে আয়তনে বড় মনে হয়। উতারো বলে আজিজকে। আজিজ নিঃশব্দে নেমে পড়ে। রিকশার সিট উল্টে দেখে নিয়ে বলে, যাও। রিকশাঅলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আজিজের দিকে তাকায়ও না।

৬৫। টেলিভিশনে গান চলছে।

৬৬। ছোকরাগুলো সোফায় পালঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছে। একজন দাঁড়িয়ে। নতমুখে বসে আছে আয়েশা। আম্মা বসে আছেন সংকুচিত হয়ে। আব্বা বসে আছেন যেন বসে নেই।

৬৭। গান শেষ। ঘোষকের মুখে পরবর্তী অনুষ্ঠান বিবৃত হয়। একজন সাংবাদিক ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বর্ণনা করতে শুরু করেন।

৬৮। হঠাৎ ছোট্ট আনিসের দিকে চোখ পড়ে আজিজের। আনিসের মুখটা ব্যথায়-বেদনায়-বিস্ময়ে কী রকম হয়ে গেছে। এতটুকু ছেলে, ওর অপরাধ কী। ওর জন্যে অসম্ভব মায়া করতে থাকে বলে চোখ ফিরিয়ে নেয় আজিজ।

৬৯। বন্ধ করো। বন্ধ করো। একসঙ্গে দু-তিনটে অধৈর্য গলা। বিরক্তিতে, হুকুমে মেশানো। একটা কাজ করতে পেরে করিম সাহেবের স্থাণু ভাবটা কেটে যায় যেন। অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে কিন্তু দ্রুত ভঙ্গিতে তিনি টেলিভিশনটা বন্ধ করে দেন। সাংবাদিক ভদ্রলোক চকিতে উধাও। টেলিভিশন বন্ধ করে ফিরে এসে করিম সাহেব আবার অসহায় বোধ করতে থাকেন। ভেতরে ভেতরে কে যেন দ্রুত তাঁর সমস্ত শক্তি শোষণ করে নিচ্ছে। শক্তির তুষার সূর্যতাপ লেগে দ্রুত গলতে শুরু করেছে। ফতুর হয়ে যাবার আগে করিম সাহেব কাতর দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকান  তাকান ছোকরাদের দিকে, যদি একটা হুকুম পাওয়া যায়, যদি একটা কাজ পাওয়া যায়।

৭০। এখন সবাই কী রকম যেন অসহায় বোধ করতে থাকে। টেলিভিশন যতক্ষণ চালু ছিল ততক্ষণ যেন কোথায় একটা ভরসা বাজছিল! এখন যেন সমস্ত কেন্দ্রিত হয়েছে আসন্ন ঘটনার ওপর।

৭১। একুইরিয়ামের কাছে গিয়ে একজন দাঁড়ায়।

এটা কী ?

একুইরিয়াম।

কী ?

মাছ রাখে, মাছ পোষে।

একজন বোধহয় চেনে। হুকুম করে : আলো জ্বালাও। করিম সাহেব আলো জ্বালিয়ে দেন। চারকোনা কাচের আধারে পানি ডোবার মতো ঘোলা। দু-তিনটি মাছ নিচে শ্যাওলায় নুড়ি পাথরে মুখ গুঁজে মৃত পড়ে আছে  ধুলো-পড়া ময়লা ও অব্যবহার্য চাবির মতো।

৭২। আজিজের দাঁড়িয়ে থাকতে আর কোনো কষ্ট হয় না। বুকে বন্দুকের উঁচোনো নল ঠেকিয়ে সে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অনন্তকাল পার করে দিতে পারবে।

৭৩। ঠিক ডোবার জলের মতো বোবা-বোকা-বধির পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একুইরিয়াম।

৭৪। দাঁড়িয়ে আছে আজিজ। তার ভেতরকার লাল-নীল-সোনা মাছগুলো মরে পড়ে আছে।

৭৫। ওরা আবার আর একটা আলমারি খুলিয়েছে। একটার পর একটা তাক দেখে। দ্রুত এলোমেলো করে। আম্মার যতœ করে সাজানো ধোপার বাড়ি থেকে কাচিয়ে আনা, কোনো-কোনোটি নিজের হাতে ইস্তিরি-করা কাপড়চোপড় এলোমেলো হয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। মেঝের উপর ডালা-খোলা একটি বাক্স পড়ে ছিল। আম্মা একটু সাজিয়ে পালঙের ওপর কাপড় রাখতে যাচ্ছিল। ওরা বলে : রাখো রাখো, এখানে রাখো  জলদি করো। অগত্যা মেঝের উপরেই রাখতে হয়। স্তূপের পর স্তূপ জমে ওঠে। সাজানো কাপড়চোপড় ছত্রখান হয়ে যায়। এক মুঠো গয়না ছিল সুন্দর একটি আধারে। একজন ছোঁ মেরে গয়নাগুলো নিয়ে নেয়।

৭৬। আজিজের বুক থেকে বন্দুক সরে গেছে। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়  চলচ্ছক্তিহীন।

৭৭। ঠিক একটা সোনালি মাছের মতো একজনের হাত পিছলে সোনার একটি হার পড়ে যায় মেঝেয়। মেঝেতে পড়ে মাছের মতোই সাঁতরে চলে যাচ্ছিল ওটা। অন্য একজন কুড়িয়ে নেয় সেটা। তৎক্ষণাৎ সেটা কঠিন সোনার হারে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

৭৮। চালো, ইয়ার।

চালো। চালো।

ছোকরারা দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠিকঠাক হয়ে নেয়।

দেখো, কিছু মনে করো না। আমরা কি খুব খারাপ আদমি ?

ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি এই প্রথম দেখা যায়।

হাসির উত্তরে হাসি। না, না।

পরক্ষণে হাসি নিবিয়ে ফেলে। বলে : দেখো, কোনো ঝুট ঝামেলা না হয় যেন।

মুখ পাংশু হয়ে ওঠে করিম সাহেবের। না, না, কখনোই না।

ঠিক হ্যায়।

করিম সাহেবের মুখ আবেগ আর কৃতজ্ঞতায় উছলে ওঠে। তার মুখে শব্দ যোগায় না আর।

৭৯। এবার আর দরজা খোলার হুকুম দেয় না ওরা। নিজেরাই দরজা খোলে। খুলে একটুও দেরি করে না, দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। মেঝের উপর পাঁচ-ছয় জোড়া বুটজুতোর মর্মভেদী শব্দ হয়। সেই শব্দে বিজয়ের আর ফুর্তির আনন্দ মিশে আছে যেন।

৮০। দরজা বন্ধ করতে ইতস্তত করেন করিম সাহেব। কী জানি : আবার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করলে কী মনে করে যদি অপমান বোধ করে ? যদি ফিরে আসে ? আজিজ তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে। তাঁর পাশে আম্মা। তারপর করিম সাহেব এমনভাবে দরজা বন্ধ করতে থাকেন যেন এতটুকু শব্দ না হয়।

Leave a Reply

Your identity will not be published.