প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের মনে নিজ অবস্থান শক্ত করে ধরে রেখেছেন যে নায়িকা তিনি হলেন সুচিত্রা সেন। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই একজন মাত্র অভিনেত্রী আছেন, যাকে মহানায়িকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নায়িকাদেরও নায়িকা যিনি, তাকে তো মহানায়িকাই বলতে হয়। আজ সেই মহানায়িকার প্রয়াণ দিবস।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সুচিত্রা সেন। মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি সরে যান সিনেমার দুনিয়া থেকে। কিন্তু দর্শক তাকে কখনো ভোলেন নি। মনের ভেতর গেঁথে রেখে দিয়েছেন সযত্নে। সেই যত্নে ঘাটতি পড়েনি আজও। এখনো সুচিত্রা সেনকে সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেন সবাই।
সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম রমা দাশগুপ্ত। সেখান আট ভাইবোনের মধ্যে রমা ছিলেন মেজো। বাবা ছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, নাম করণাময় দাশগুপ্ত। বাবার বড় আদরের ছিলেন তিনি। ডাকনাম ছিল কৃষ্ণা। ছোটবেলায় লেখাপড়াও পাবনাতেই। পাবনায় মামার বাড়িতেও কিছুদিন থেকেছেন। দেশভাগের সময় সুচিত্রা সেন চলে যান কলকাতায়। তবে বাবা করুণাময় অবসরের পরই পাবনা ছেড়ে উঠেছিলেন শান্তিনিকেতনের পাশে ভুবনডাঙ্গায়। অসামান্য সুন্দরী হওয়ায় মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রিয়নাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। নিত্য নতুন অশান্তির কালো মেঘ সরাতে অবশ্য সময় নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাধা’ ছবি যখন করছেন, তখনই ডিভোর্স হয়ে যায়। ‘সাত পাকে বাধা’ ছবিটি ছিল সুচিত্রার জীবনের সেই সময়েরই প্রতিচ্ছবি।
সুচিত্রার সিনেমায় নামা তার নিজের ইচ্ছায় নয়। স্বামী দিবানাথই জোর করেছিলেন সুচিত্রা যাতে অভিনয় করেন। অবশ্য তখনও তিনি রমা সেন। ১৯৫২ সালে প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’। কিন্তু সেই ছবি মুক্তি পায়নি। মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ১৯৫৩ সালের ‘সাত নম্বর কয়েদি’। এই ছবিতেই রমা সেন পরিবর্তিত হয়েছিলেন সুচিত্রা সেনে। ছবির পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতিশ রায়ই এই নতুন নামটি দিয়েছিলেন। তবে প্রথম উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ই ব্রেক এনে দিয়েছিল। তারপর থেকে সুচিত্রা সেন বাঙালির হৃদয়ের রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন।
১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে একের পর এক সাড়াজাগানো ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। তার ম্যানারিজমকে পর্যন্ত বাঙালি আপন করে নিয়েছিল। ওরা থাকে ওধারে, অগ্নিপরীক্ষা, উত্তর ফাল্গুনি, শাপমোচন, শিল্পী, দীপ জ্বেলে যাই, হারানো সুর, সাত পাকে বাধা, অগ্নিপরীক্ষা, সূর্যতোরণ, সাগরিকা, সপ্তপদী এমনি অসংখ্য ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় তার সময়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী সবার বিপরীতে আভিনয় করলেও উত্তম কুমারের সঙ্গে যে ৩০টি ছবি করেছেন। তাতে সুচিত্রা-উত্তমের জুটি হয়ে উঠে অমর।
বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন সুচিত্রা। ১৯৫৫ সালে ‘দেবদাস’ করেছেন। দোনন্দকে নিয়ে করেছেন ‘বাম্বাই কা বাবু’ ও ‘সরহদ’। গুলজারের পরিচালনায় ‘আঁধি’ ছবিতে ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে তার অভিনয় সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
নিজের সম্পর্কে অসম্ভব সচেতন ছিলেন সুচিত্রা। তাই ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিটি দর্শক ভালোভাবে না নেয়ায় সুচিত্রা সেন সিনেমাকে বিদায় জানাতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। তার ধারণা হয়েছিল পাবলিকের প্রত্যাশা আর পূরণ করতে পারবেন না। সেই থেকেই তিনি চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। সবার অলক্ষে ৩৫টি বছর আত্মগোপণে গিয়ে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই অবস্থানেই ছিলেন। কারো সঙ্গেই দেখা কিংবা যোগাযোগ করেননি। যার কারণে সুচিত্রা সেনের শেষ জীবন ছিল রহস্যময়।
Leave a Reply
Your identity will not be published.