উতল হাওয়া (প্রথম পর্ব)

উতল হাওয়া (প্রথম পর্ব)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব]

আজ ১২ জানুয়ারি ১৯৭১। ঢাকা শহরের সব মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। শেখ মুজিবুর রহমান আজ ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনায় বসবেন। বাঙালির ভবিষ্যৎ আজ নির্ধারিত হবে।

অনেকগুলো জরুরি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু কোথায় হবে- ঢাকা না রাওয়ালপিন্ডি? ইয়াহিয়া খান কি শেখ মুজিবকে এত সহজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানাবে? জুলফিকার আলী ভুট্টোই কি শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে?

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, এটা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আশা করে নি। পূর্ব-পাকিস্তান গণপরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন জিতে নেয় শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ। আর পশ্চিম-পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি পায় ৮১টি আসন।

পূর্ব-পাকিস্তানে মুসলিম লীগ প্রার্থী দিয়েছিল ৯৩টি আসনে। ডেমোক্রেটিক পার্টি ৭৯টি এবং জামায়াতে ইসলামী ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এদের সবাই গো হারা হেরেছে! আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়ে ইয়াহিয়ার সব হিসাব উল্টে গেছে। এখন শেখ মুজিবকে সরকার গঠন করতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের খায়েশ- শেখ মুজিব সরকার গঠনের পরও তিনি প্রেসিডেন্ট পদেই থাকবেন। সেজন্যে ইয়াহিয়া চাইছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে শেখ মুজিব পশ্চিম-পাকিস্তানে আসুক। সংবিধান রচনা ও ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য সামরিক সরকারের জারি করা ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা এলএফও’র আওতায় সমঝোতার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে আলোচনা শুরু করুক।

কিন্তু মুজিব ইয়াহিয়ার প্রস্তাব মানতে নারাজ। সবকিছুর জন্যে পশ্চিমাদের কাছে বারবার ধর্না দিতে যাবেন কেন? আলোচনা করতে চাইলে পশ্চিমাদেরই এখানে আসতে হবে। শুধু তাই না, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংবিধান রচনায় আওয়ামী লীগের অধিকার থাকতে হবে এবং সেই সংবিধানে ছয়-দফার প্রতিফলন অবশ্যই যেন থাকে।

অন্যদিকে ইয়াহিয়া আর ভুট্টো ভাবছে, শেখ মুজিবের ছয়-দফার সমস্ত শর্ত মেনে নেয়া মানে হলো পশ্চিম পাকিস্তানের আয় এবং খবরদারি দুটোই বন্ধ হওয়া। মুজিবের দম্ভ দেখে মনে হয়েছে সে যেন চাইছে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থাকবে ঢাকায়, রাওয়ালপিন্ডিতে নয়।

শুধু তাই না, ৩ জানুয়ারি ছয় দফাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রমনার রেসকোর্সে শেখ মুজিব তার সব এমএনএকে দিয়ে শপথ করিয়ে যে শো ডাউন করেছে সেটা দেখে মনে হয়েছে শেখ মুজিব পাকিস্তানকে ভাগ করতে চায়। মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র কিছুতেই মেনে নেওয়া হবে না।

শেখ মুজিবুর রহমান ইস্কাটনের প্রেসিডেন্ট ভবনে গাড়ি থেকে নামলেন। তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে করমর্দন করতে করতে ইয়াহিয়া বলেন, আজ কী সৌভাগ্য আমার অবশেষে আপনার দেখা পেলাম! নাইস টু সি এ গ্রেট লিডার লাইক ইউ। আসুন আসুন প্লিজ।

ইয়াহিয়া অভ্যর্থনা করে শেখ মুজিবকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। নির্ধারিত আসনে বসতে বসতে ইয়াহিয়া বললেন, কিয়া কামাল কি বাত হ্যায়- আপ কা পার্টি আওয়ামী লীগ এক শ সাত সিট ছিন লিয়া!

শেখ মুজিব সিগারেটের পাইপে আগুন দিতে দিতে বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট ছিন লিয়া নেহি, জিত লিয়া। আর ও এক শ সাত নেহি, এক শ ষাট, হানড্রেড অ্যান্ড সিক্সটি।

আচ্ছা আচ্ছা হানড্রেড অ্যান্ড সিক্সটি। বাংলা ওর উর্দু মে তো বিস্তার ফারাখ হ্যায়। ম্যায় বলা একশ ষাট, আপ শুনা এক শ সাত। কয়ি বাত নেহি। ইসি লিয়ে জিন্না সাব কেহেতা থা, বাঙালক উর্দু শিখনা জরুরি হ্যায়।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বাঙালি কী শিখবে কী শিখবে না, কী রাখবে কী ছাড়বে সেটা বাঙালির উপরই ছেড়ে দিন। আপনি নির্বাচন দিয়েছেন, আমরা পার্টিসিপেট করেছি, আমাদের দল উইন হয়েছে, ব্যস। এখন আপনার দায়িত্ব হলো গণপরিষদের সভা ডেকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তখন আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করে নেব।

শেখ মুজিবের এই দম্ভোক্তিকে ইয়াহিয়া সহজে নিতে পারলেন না। তিনিও রাগতস্বরেই বললেন, আপকা পার্টি ইস্ট পাকিস্তানপে তামাম সিট জিত লিয়া, ম্যায় মান গায়া, মাগার ওয়েস্ট পাকিস্তানমে আপ কা কয়ি ক্যান্ডিডেট নাহি থা! ওধার ভুট্টো সাহাবকা পিপলস পার্টি ৮১ সিট জিতা। ভুট্টোর সঙ্গে আপনি কথা বলুন এবং আমাকে দ্রুত আপনাদের আলোচনার রেজাল্ট জানান।

শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টোর সাথে কথা বলার আমি কোনো প্রয়োজন দেখি না। ভুট্টোর পিপলস পার্টিও আমাদের পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো প্রার্থী দেয় নি। ডেমোক্রেসির নিয়ম অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমরাই সরকার গঠন করব।

সেটা ঠিক আছে, বাট আপনাকে তো তামাম পাকিস্তানের কথা ভাবতে হবে। তামাম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে, ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবকিছু চিন্তা করতে হবে। ওয়েস্ট পাকিস্তান লিডারক সাথ বাত-চিট ছোড়কে কুচ নাহি হোগা।

হ্যাঁ, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আসছেন এবং আমরা কথা বলছি তাদের সাথে।

বাট ভুট্টো সাহাব আভি তাক নাহি আয়া!

না, ভুট্টো আসেন নি। ভুট্টো ছাড়া অন্যান্য দলের নেতারা এসেছেন এবং তারা কথাও বলে গেছেন।

যারা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে তারা সবাই পরাজিত দলের নেতা। ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১টি আসনে জয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাকে ইগনোর করে আপনি কী করে সরকার গঠন করবেন?

ভুট্টোকে আমি ইগনোর করছি না, হি হ্যাজ টু প্লে হিজ পার্ট। আওয়ার ডোর অলওয়েজ ওপেন, এনিবডি কেন কাম অ্যান্ড টক টু আস। আমার মনে হয় সব ফেডারেল ইউনিটের নেতারা একত্র হলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে।

বাট, আপ বিচ মে কেয়া ছে দফা-অফা রাখ দিয়া, এ কিয়া বেততামিজি হ্যায়?

এ বেততামিজি নেহি হ্যায়। এ হামারা রাইটস হ্যায়। বাঙালি ভিখ নাহি মাংতা মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আমার ধানের আয় পাটের আয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ইন্ডাস্ট্রি হয়, স্কুল হয় আর এদিকে আমার কৃষক না খেয়ে থাকে, আমার বাচ্চার জন্যে স্কুল নাই। নভেম্বর মাসে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকায় ৫০ হাজার লোক মারা গেল অথচ পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে কোনো ত্রাণ আসে নি, এমনকি কোনো নেতাও আসে নি খোঁজ নিতে।

এ বহুতই বুড়া হুঁয়া আপকে সাথ, ম্যায় ইসিলিয়ে বহুত শরমিন্দা হ্যায়।

দিন দিন আমাদের এখানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য চলে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। পূর্ব-পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের ৭০ ভাগই খরচ হয় পশ্চিম-পাকিস্তানে। ১৯৬৫-১৯৭০ এই পাঁচ বছরের পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট দেখুন, পশ্চিম-পাকিস্তানে খরচ হয়েছে ৫,১৯৫ কোটি রুপি আর আমার পূর্ব-পাকিস্তানে খরচ করা হয়েছে মাত্র ২,১৪১ কোটি। বছরের পর বছর আমরা এই বৈষম্য মেনে নিতে পারি না। এনাফ ইজ এনাফ।

মুজিব আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন, এ রেসকোর্স কা ময়দান নাহি হ্যায়।

এটা না বোঝার মতো মূর্খ আমি না।

৩রা জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দান পে আপ জো কিয়া ও ঠিক নাহি থা। সভা ডেকে আপনি যে শো ডাইন করেছেন সেটা বেআইনি, ১৬০ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে যে শপথ করিয়েছেন সেটাও বেআইনি।

আমি আমার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেছি, তাদের দিয়ে শপথ করিয়েছি এটা ছিল আমার দলীয় কর্মসূচি, এটা বেআইনি হবে কেন? জাতীয় পরিষদের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর নতুন যে সংবিধান রচনা করা হবে, সেখানে যেন এই ছয় দফার প্রতিফলন থাকে সেটাই আমি আমার জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে শপথ করিয়েছি।

আপনার কি মনে হয় না এই ছয় দফা পাকিস্তানকে ভেঙে দেবে?

মোটেই তা নয়। ছয় দফায় আমি যা বলেছি সেগুলো হলো:

১। পাকিস্তান একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হবে।

২। ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র। অন্যান্য বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে থাকবে।

৩। প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক তবে অবাধে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। যদি একক মুদ্রা হয়, তাহলে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।

৪। রাজস্ব থাকবে প্রদেশের হাতে।

৫। প্রতিটি প্রদেশের মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।

৬। আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি প্রদেশকে মিলিশিয়া রাখার অনুমতি দিতে হবে।

আলাদা করে মিলিশিয়া কেন রাখতে হবে?

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আপনারা সমস্ত সৈন্য নিয়ে জড়ো করেছিলেন পশ্চিম সীমান্তে। আমরা ছিলাম অরক্ষিত। আমাদের না ছিল কোনো গোলাবারুদ, না ছিল কোনো মিলিশিয়া। ভারত ইচ্ছে করলে সেই সময় পূর্ব-পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। বাধা দেওয়ার মতো কোনো শক্তিই আমাদের ছিল না।

হিন্দুদের সে সাহস কোনোদিন হবে না। গরু খাওয়া পাকিস্তানিদের হিম্মতের কাছে ইন্ডিয়ানরা দুগ্ধপোষ্য শিশু। তারপর আমাদের সাথে আছে চায়না, আমাদের সাথে আছে আমেরিকা। আমরা আক্রান্ত হলেইআমেরিকার ৭ঃয ফ্লিট ছুটে আসবে। এক ঘণ্টার বোমা হামলাতেই ইন্ডিয়া লেজ গুটিয়ে পালাবে। কিসিঞ্জারের সাথে আমার কালই কথা হয়েছে। হি ইজ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন। মনে রাখবেন, যতদিন আমি আছি ততদিন আমেরিকা আমাদের সাথে আছে। আমেরিকা হামারা জিগিরি দোস্ত।

মি. প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ল্ড পলিটিক্সে জিগিরি দোস্ত বলে কিছু নেই। সবই স্বার্থের খেলা, যতক্ষণ আপনি তাদের স্বার্থ দেখছেন ততক্ষণ আপনি তার বন্ধু, স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই শত্রু। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে আমেরিকা গত ১৫ বছরে ৫০ হাজার সোলজার হারিয়েছে। আমার মনে হয় না এরপর তারা আবার নতুন করে কোনো যুদ্ধে জড়াবে।

আচ্ছা ছোড়িয়ে এ বাত, ছোড়িয়ে এ ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স। আপ আজ হামারা খাস মেহমান। মেহমানক খিদমত মেরা জমিদারি। কিয়া পিয়োগে? হুইস্কি? ভদকা উইথ অরেঞ্জ জুস ওর ককটেল উইথ রাম!

কিছুই না, এ কাপ অব টি ইজ এনাফ।

আরে মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, এনজয় ইয়োর টাইম। রাজনীতি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। যতদিন এই দুনিয়া থাকবে মানুষ থাকবে, ততদিন রাজনীতি থাকবে। ঠিক বলেছি কি-না?

ইয়েস ইউ আর রাইট।

ইয়াহিয়া নিজের মনেই বলছে, বাঃ কথাটা তো ভালো বলেছি মনে হচ্ছে! ...যতদিন এই পৃথিবী থাকবে, মানুষ থাকবে ততদিন রাজনীতি থাকবে। রিমেম্বার দিজ ওয়ার্ড মি. মুজিব, কোটেট বাই ইয়াহিয়া খান। হা হা হা! মানুষটা আমি খুব জ্ঞানী না, তবে মাঝে মাঝে দু’ একটা জ্ঞানের কথা বলে ফেলি। হা হা হা... আমার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা মি. মুজিব?

শেখ মুজিবের ইচ্ছে করছে ইয়াহিয়াকে বলে, তুই হারামজাদা একটা বড় সাইজের গাধা, বড় সাইজের গাধা। কিন্তু মুখের উপর একজন প্রেসিডেন্টকে গাধা বলা যায় না।

শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে খুশি করার জন্যে বলে, মি. প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান থেকে ক্ষমতা নেওয়ার সময় আপনি বলেছিলেন আপনি গণপরিষদ নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। আপনার কথা ও কাজের মিল আছে, আপনি একজন ওয়াইজ ম্যান।

ইয়াহিয়া মুজিবের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে বলে, বাঃ আপনার কমপ্লিমেন্টস শুনে খুব ভালো লাগল মি. মুজিব। শুনুন আমার এখানে এই বারটেন্ডার ছেলেটা খুব ভালো ককটেল বানায়। একটা ট্রাই করে দেখুন। আমি তো সারাদিন পানির বদলে ভদকার সাথে অরেঞ্জ জুস মিশিয়ে পান করি। আপনিও নিতে পারেন।

নো থ্যাংকস! আই ওয়ান্ট কাপ অব টি।

সিদ্দিক সালিক বলছিল বাঙালিরা নাকি সব কিছুই খায়-  ভাত-মাছ খাবে, চা-পানি-মদ সেও খাবে। ঘুষ এবং বৌয়ের হাতের মার সেও হামেশাই খাবে। হা হা হা- বাঙালি কুচ পিতা নাহি...

দীর্ঘক্ষণ পর শেখ মুজিবুর রহমানের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল। সত্যিই বাংলা ভাষায় ‘পান’ শব্দটার ব্যবহার কম, বাঙালির সব কিছুতেই খাওয়া হা হা হা...।

শেখ মুজিব ভাবছে উর্দিপরা পাকিস্তানি আর্মিগুলো সুযোগ পেলেই মদের গ্লাস নিয়ে ফুর্তি করতে বসে। ইয়াহিয়ার মতো মদ্যপ লোকের সাথে আজকের আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে কে জানে! এ মুহূর্তে মুজিব তাজউদ্দীনের খুব অভাব বোধ করছেন। আজকের মিটিংয়ে তাজউদ্দিনের থাকাটা দরকার ছিল! আজ যদি আলোচনায় কোনো কিছুর সুরাহা না হয় তাহলে কাল তাজউদ্দীন আর কামাল হোসেনকে নিয়ে আসতে হবে।

এক শের কাহু মুজিব সাহাব?

জি কাহিয়ে!

না পিনা হারাম হ্যায়, না পিলানা হারাম হ্যায়...কিয়া বলা? না পিনা হারাম হ্যায় না পিলানা হারাম হ্যায়, মাগার পিকে হোশ পে রেহানা জরুর হারাম হ্যায়। হা হা হা ডোন্ট অরি, ম্যায় আভি তাক হোশ পেই হ্যায় মুজিব সাহাব। আপনাকে কংগ্রেচুলেট করার জন্যে নুরী আসতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে।

নুরী কে?

পাকিস্তানের আসমান কা রশ্মি, দ্য ফেমাস সিঙ্গার নুরজাহান। সে দিন দিন আপনার ভক্ত হয়ে উঠছে।

আমার ভক্ত?

নুরীর ধারণা আপনার মতো স্ট্রং পার্সোনালিটির পুরুষ নাকি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই...হা হা হা... কী দারুণ কমপ্লিমেন্টস! নুরীর মতো সিঙ্গারের কমপ্লিমেন্টস পাওয়া কিন্তু সহজ ব্যাপার না... নুরীর পাগলামো দেখুন- আমাকে নিয়ে সে একটা গান বেঁধেছে। গানটা বলব আপনাকে?

বলুন!

আমার গলায় সুর নেই, নয়তো আপনাকে গেয়ে শোনাতাম-  চাঁদনিরাতে সব যাব শোয়ে তাব হাম জাগে, তারোসে কারে বাতি...চাঁদনি রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি জেগে থাকি, তারাদের সাথে কথা কই- গানটা কেমন?

ভালো।

আচ্ছা মুজিব, বলুন তো আমাকে আপনার কেমন লাগে?

শেখ মুজিব মনে মনে খুবই বিরক্ত হচ্ছেন, কী সব অপদার্থের হাতে পড়েছে পাকিস্তানের শাসন-ভার! বাংলার মানুষের দুঃখ বোঝার ক্ষমতা এদের নাই। খুব ভালো হতো তিনি যদি ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মেরে এই আলোচনার টেবিল উল্টে দিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন! কিন্তু সেটি হওয়ার নয়। বাংলার সব ছাত্র-জনতা, প্রতিটা মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও মুজিব নরম করেই বললেন, আপনি আইয়ুব খানের উত্তরসূরি। আপনি টেকওভার করার পর যা ওয়াদা করেছিলেন সেসব ওয়াদা পূরণের জন্যে আপনাকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আমাদের বাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে- ‘শেষ ভালো সব ভালো তার।’ আমরা শেষ ভালোটুকু দেখার অপেক্ষায় আছি।

এই যে আমি এতগুলো ভালো কাজ করলাম তার পুরস্কার কী হবে?

সেনাপ্রধান হিসেবে আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করছেন, দেশের মানুষের জন্যে কাজ করলে মানুষের ভালোবাসা পাবেন, এটাই তো বড় পুরস্কার।

কুতুবউদ্দিন আইবেককে তো আপনি চেনেন?

কোন কুতুবউদ্দিন? দিল্লির প্রথম সুলতান?

বাঃ আপনার ইতিহাস জ্ঞান তো ভালো! শুনুন, কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন একজন ক্রীতদাস। ইরানের খোরাশানের প্রদেশের প্রধান কাজী সাহেব তাকে কিনে নেন। কাজী সাহেব তাকে তার নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন এবং তিনি কুতুবউদ্দিন আইবেককে ফার্সি ও আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলেন। শুধু ভাষা নয়, তীর এবং অশ্বচালনায়ও প্রশিক্ষণ দেন। কাজী সাহেবের মৃত্যুর পর কাজীর ছেলে কুতুবউদ্দিনকে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন।

শেখ মুজিব বলেন, তারপর কুতুবুদ্দিনকে কিনে নেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ ঘুরি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরির প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন এবং ঘুরি তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। তারপর ঘুরি তাকে সহচর হিসেবে নিযুক্ত করেন।

বাঃ বাঃ কিয়া বাত, আপনি তো সব জানেন দেখছি। আমি ভীষণ মুগ্ধ হলাম আপনার ইতিহাস জ্ঞান দেখে মুজিব। কুতুবউদ্দিনের কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল জানেন তো?

জানি। পলো খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

আপনি কি জানেন আমি পলো খেলা খুব অপছন্দ করি? কেন করি জানেন? আমি চাই না ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আমার মৃত্যু হোক। আমি ঘোড়া নয়, আপনার মতো পপুলার জনপ্রতিনিধির সাথে থাকতে চাই, দেশের জন্যে কাজ করতে চাই।

সে তো খুব ভালো কথা। সেনাপ্রধান হিসেবে আপনি তো আমাদের সঙ্গেই আছেন।

শুনুন আরেকটু খোলাসা করে বলি, গণপরিষদের অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন করে আপনারা পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা এডপ্ট করার পর এস পার দ্যা কন্সটিটিউশন আপনি হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রেসিডেন্ট পদটিতে কে থাকছে?

গণপরিষদের অধিবেশনের পরই সেটি ঠিক হবে।

আপনি এক কাজ করুন মুজিব, আমার সাথে পাকিস্তানে চলুন। ভুট্টো তার লারকানার জমিদারিতে হাঁস শিকারের আয়োজন করেছে, সেখানে গিয়ে আমরা তিনজন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে ঠিক করি কী করা যায়। আপনার নুরীও আসবে গান শোনাতে- চাঁদনিরাতে সব যাব শোয়ে তাব হাম জাগে, তারোসে কারে বাতি....

শেখ মুজিব বুঝে গেলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইয়াহিয়া কেন কুতুবউদ্দিন আইবেকের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। আবার হাঁস শিকার আর নুরজাহানের গানের লোভও দেখাচ্ছে। লোকটা একটা ঘোড়েল, প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। একে প্রেসিডেন্ট বানানো হলে যে-কোনো অজুহাতে সে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারে। ২০০ বছর ইংরেজদের গোলামি করার পর আবার পাঞ্জাবীদের গোলামি করার কোনো মানে হয় না। বাংলাকে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্ত করতেই হবে। গায়ের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি দেশের জন্যে লড়বেন। এই জুলুমের জিঞ্জির ভাঙতেই হবে। বাংলার জয় হবেই!

মুজিবকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে ইয়াহিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি কি যাবেন?

চোয়াল শক্ত করে মুজিব বললেন, আমি আমার জনগণকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.