‘জনারণ্যে প্রেমারণ্য’: প্রেম ও মানবতার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত

‘জনারণ্যে প্রেমারণ্য’: প্রেম ও মানবতার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত

সম্প্রতি একটি উপন্যাস পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের ‘জনারণ্যে প্রেমারণ্য’। উপন্যাসটিতে প্রেম ও মানবতাকে ফোকাস করা হয়েছে বিশেষভাবে। ঔপন্যাসিকের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও ভালো লাগবে পাঠকদের। 

‘জনারণ্যে প্রেমারণ্য’-এর প্রধান চরিত্র চারটি—উৎসব, তনিমা, ইমন ও কণিকা। এই চারজনের হৃদয়ঘটিত সম্পর্কই উপন্যাসটির উপজীব্য। এই সূত্রে অবশ্য চারজনের ব্যক্তিগত জীবন, দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্যা, সামাজিক অবস্থান—সবই উঠে এসেছে। 

উৎসব ভীষণ উদাসীন প্রকৃতির, পত্রিকা অফিসে কাজ করে। গৃহ শিক্ষকতা করতে গিয়ে তনিমার সঙ্গে তার পরিচয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। প্রেম। নরম প্রকৃতির তনিমা উৎসবকে শুধু ভালোবাসে না, ভক্তিও করে। সূর্যমুখীর মতো সে প্রতীক্ষায় আছে কবে উৎসবের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। অন্যদিকে কণিকা ডাকাবুকো মেয়ে। ‘চলনে বলনে যেন একটু পুরুষালি ঠাট। দুবার ব্লাকবেল্ট চ্যাম্পিয়ন, মার্শাল আর্ট ওর যেন কব্জিবদ্ধ’ (পৃষ্ঠা: ২৬)। ক্লাসফ্রেন্ড, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তনিমার উদ্দেশে সে বলে, “তুই তো সর্বস্ব দিয়ে বসে আছিস। জানিস ও-সব ভক্তিবাদের দিন শেষ। এখন প্রেমবাদ। কাছাকাছি হও, ভালোবাসা দাও, নাও সমানে সমান” (পৃষ্ঠা: ২৫)। ভার্সিটি জীবনে কণিকা প্রেমে জড়ায় বরুণের সঙ্গে। কিন্তু এই সম্পর্ক বেশি দিন টিকে না। কেননা কণিকার জীবনে একদা কৈশোর প্রেমের জোয়ার এসেছিল। সহপাঠি সুলতানার বড় ভাই ইমনের প্রেমে পড়েছিল সে। সেই প্রেমাষ্পদ আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন সে তেজি যুবক। পুলিশ ইন্সপেক্টর। কণিকা ও ইমন আবার গভীর ও নিবিড় হয়ে ওঠে।...উৎসবের মা মারা যান। সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তনিমা ওকে সেবা-যত্নে সুস্থ করে তোলে। প্রয়াত ডাক্তার বাবার পছন্দের পাত্র নিলয়কে ফিরিয়ে দেয়। ওর বড় মামার মেয়ে মনীষার সঙ্গে বিয়ে হয় নিলয়ের।...ইমন এতদিন জানত ওর মা কল্পনা হিন্দু আর বাবা শমসের মুসলমান। কিন্তু আসল বিষয়টা সে জানতে পারে। জানতে পারে রানাঘাটের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের সন্তান সে। তার গর্ভবতী মাকে একদিন তার পিতা তাড়িয়ে দিয়েছিল। ওর মায়ের সেই অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে এসেছিল তার কলেজ জীবনের বন্ধু শমসের—যাকে ইমন বাবা হিসেবে জানত। ইমন তার জন্মদাতা পিতা—যিনি বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত—তাকে শাস্তি দেয়। ক্রাইম ট্রাইবুনালের হাতে তুলে দেয়। আত্মপরিচয় আর মায়ের আত্মগ্লানির প্রতিশোধ নেয়। অতঃপর কণিকা ও ইমনের বিয়ে হয়। বিয়ে হয় তনিমা উৎসবেরও।...ইন্টারন্যাশনাল জিওলজিক্যাল কংগ্রেসে যোগ দেয় উৎসব। সেখানে সে ‘সাংবাদিতায় জিওলজিক্যাল সার্ভে’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করে ভীষণ প্রশংসিত হয়।...জিওলজি মাইনিংয়ের শিক্ষার্থী তনিমা ও কণিকা চাকরি পেয়েছিল আগেই। সেই সূত্রেই তনিমার পোস্টিং হয় ভুবনেশ্বর এবং কণিকার কলকাতা নিউ টাউনে। উৎসবও অফিসের কাজ করে ভুবনেশ্বরে বসেই।...কণিকার ওপর হামলা হয়। সে প্রতিরোধ করলেও গুলিবিদ্ধ হয়। কিডনাপ করে ওকে আটকে রাখা হয়। ইমন ওকে উদ্ধার করে ঠিকই কিন্তু নিজেও আহত হয়। আর এইসব কিছুই ছিল সুবিনয়বাবুর নখদর্পণে, যিনি পেশাগত জীবনে বেস্ট ইনফর্মার ও কণিকার বাবা।...ভুবনেশ্বর থেকে আবার কলকাতায় ফিরে আসে তনিমা। সে গর্ভবতী হয়। বাসায় গৃহকর্মী মিনতির দুটি বাচ্চাকে রাখে। ওদের দেখে ইমনের মনে শিশুদের জন্য আশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা জাগে। সেটি বাস্তবায়ন শুরু হয় সেই দুটি শিশুকে নিয়েই।...ফ্রান্সের এক জার্নাল মুখপাত্রের আমন্ত্রণে উৎসব প্যারিস যায়। ওঠে বন্ধু দম্পতি আমিরুল আরহাম ওরফে আনন্দ এবং আকবরি বেগম ওরফে প্রাপ্তির বাসায়। আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করে প্রবন্ধ। এর বিষয়ভিত্তিক আলোচনার প্রেক্ষাপট ছিল-হিউম্যান রিসোর্স, ভূ-সম্পদ, জল সম্পদ, খনিজ সম্পদ, সম্পদের সুষম বণ্টন, বিশ্ব মানবাধিকার...। উৎসবের প্রবন্ধটি বেশ সাড়া জাগায়। কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপাতালে যায়। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সরকারি তত্ত্বাবধানে ফিরে আসে কলকাতায়। উৎসবকে সুস্থ করার জন্য ভালোবাসার পরশ, নবজাত শিশুর কান্না আর মিউজিক থেরাপির আশ্রয় নেয় তনিমা। কিন্তু এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে উৎসবের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। অনেকটা কোমার কাছাকাছি। সেই রাতে যম ও তনিমার যুদ্ধ চলে। উৎসব মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে।

উপন্যাসটি পাঠকদের ভালো লাগবে, আগেই উল্লেখ করেছি প্রেম, মানবতা ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। তিনি সবার উপরে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। ধর্মকে নয়। ইমন ও সুলতানা তাই এক্ষেত্রে প্রতীকী হয়ে ওঠে, এবং তাদের মা কল্পনাও। ফোনে সুলতানা ও তার পরিবারকে নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতে গিয়ে তনিমা বলে, “কল্পনা মাসিমা আমাদের দেশ, তার সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম। ভারতবর্ষ এবং পৃথিবী, একই মায়ের কোলজুড়ে দুটি সন্তান, একটা হিন্দু একটা মুসলমান” (পৃষ্ঠা: ২১১)। 

উপন্যাসটিতে কয়েকটি অসংগতি রয়েছে। যেমন, শুরুতে পাঠকেরা বরুণের প্রেমিকা হিসেবে কণিকার সঙ্গে পরিচিত হয়। তখন বরুণের সরকারি দলের রাজনীতি করাকে কণিকা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ (পৃষ্ঠা: ২৫) হিসেবে উল্লেখ করে। কণিকার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, “সবাই দামি দামি গাড়ি বাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। আমি তো অত কিছু বুঝি না। রাজনীতি করবে করো, নিজেরটুকু বুঝে নাও। সরকার পড়লে কে দেখবে তোমাকে” (পৃষ্ঠা: ২৬)? অথচ পরে কণিকার মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। ইমনের প্রেমিকা হিসেবে কণিকার মধ্যে এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করে পাঠকেরা।

উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে ফোনে তনিমার খোঁজখবর নিতে গিয়ে তার মা বলেন, “সব শুনেছি, কণিকার ব্যাপারটা, খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। যাক বেঁচে ফিরেছে সেই অনেক” (পৃষ্ঠা: ২৪৪)। এখানে তনিমার মা কণিকার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয়টি বলছে। অথচ ঘটনাটি ঘটেছে তিন বছর আগে।
সম্পাদনায় ত্রুটি রয়েছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইমন ও কণিকার কথোপকথন:
কী করে যে কী হয়ে গেল। থাক, আমার ভাগ্যটা ভালো।
কীসে ভালো?
কেন বলছি। এমন একটা গুন্ডি মেয়ের হাতে পড়লাম, শেষে জীবনটাই না হারাতে হয়। 
না হারাতে হয়। (পৃষ্ঠা: ৪০)

শেষের ‘না হারাতে হয়’ হলো পুনরাবৃত্তি, ইমনের কথার, যা আগের বাক্যেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এবার একটি ইন্টারেস্টিং বিষয় উল্লেখ করি, ২৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে—ভার্সিটি জীবনে উৎসবসহ চারজন ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা নিজেদের অন্য নাম দিয়েছিল: তৃপ্তি, আনন্দ, শান্তি, প্রাপ্তি। বিষয়টা জেনে এদেশের প্রবীণ পাঠকদের মনে পড়ে যেতে পারে জিয়া হায়দারের প্রতীকী নাটক ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’-এর কথা। 

সবশেষে আমরা কামনা করি, এ পৃথিবীর সর্বত্র প্রেমারণ্যে জনারণ্য হোক। কেননা প্রেম বা ভালোবাসাই পারে মানুষকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে। 

জনারণ্যে প্রেমারণ্য। লেখক: চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস। প্রকাশক: আগামী, ১এ, কলেজ রোড (তৃতীয় তলা), কলকাতা-৯। প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৪। প্রচ্ছদ: শ্রীময়ী দত্ত। মূল্য: ৩৯৯ রুপি। 
 

Leave a Reply

Your identity will not be published.