ভ্যান গঘের তুলিতে আবহমান বাংলার রূপ!

ভ্যান গঘের তুলিতে আবহমান বাংলার রূপ!

গুগল ম্যাপ থেকে মনে হচ্ছিল জলাশয়ের ওপর বসানো পুরো শহর। তাতে জমির আইলের মতো উঁচু মাটির ঢিবি, পাশেই খাল। জলাশয়টিতে মাটি ভরাট করে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর উঁচু করা হয়েছে। যেখানে গড়ে ওঠেছে বসতি, আর নিচু অংশ রয়ে গেছে খাল হিসেবেই। নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম শহরের আসল চিত্রটা অনেকটা এমনই।

খালের ধার দিয়ে সড়ক বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ডানে বাঁক নিয়ে সেতু পার হয়ে খালের ওপারে যেতে হবে। সেতুতে ওঠার মুখেই গাড়ি থেমে গেল ট্রাফিক সিগনালে। মোবাইলের স্ক্রিনে তখন আমার চোখ। ‘সামনে তাকাও, না হলে মিস করবে।—আমিনের কথায় সামনে তাকাই। ‘ওমা! এ দেখি ব্রিজ উঠে যাচ্ছে ওপরে! এও সম্ভব?’- আমার বিস্ময় কাটে না। ঘটনা আসলে তাই, খাল দিয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য ব্রিজটি উপরে উঠে গেল। সেতুর নিচ দিয়ে জাহাজ চলে যাওয়ার পর আবার ঠিক আগের জায়গায় আগের মতোই সেট হয়ে গেলো ব্রিজটি। আমরা সেই ব্রিজে গাড়ি চালিয়েই খালের ওপারে গেলাম। আমি তখনো ঘোরের মধ্যে। জলজ্যান্ত পুরোদস্তর ব্রিজের উপরে উঠে যাওয়া, আবার নিচে নামার ঘটনা বাস্তবে প্রথম দেখি। আমিন জানালো, আমস্টারডামের অনেকগুলো খালের ওপরেই রয়েছে ভার্টিক্যাল বা উল্লম্ব লিফট যুক্ত ব্রিজ। ইউরোপে এমন ব্রিজ প্রায়ই দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে মনে হয় ভারতে প্রথম এমন ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে। দেশটির তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলার মণ্ডপ থেকে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মাঝে অবস্থিত পামবান দ্বীপ পর্যন্ত ব্রিজটি বিস্তৃত। দীর্ঘ এই রেল ব্রিজটি ‘পামবান ব্রিজ’ নামে পরিচিত।

তবে সেতু নিয়ে বিড়ম্বনা কম না আমস্টারডামেও। রটারডামের ‘ডি হেফ’ নামের একটি সেতু ভেঙে ফেলতে হচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষকে। সমালোচকরা বলছেন, ঐতিহাসিক এই সেতুটি ভাঙা ঠিক হবে না। সেতু ভাঙার কারণটিও মজার। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ধনকুব জেফ বেজোসের শখ হয়েছে বিলাসবহুল প্রমোদতরীর। তার ফরমায়েস মতো সেটি তৈরি করেছে ডাচ সংস্থা ওশানকো। কারণ, ওশানকোর এই কারখানাটি ডি হেফ ব্রিজের কাছাকাছি এলাকায়। প্রমোদতরী বানালেই কী হবে, সেটি সাগরে ভাসাতে হবে না? ঝামেলা তৈরি হয় ৪১৭ ফুট জাহাজের উচ্চতা নিয়ে, যেখানে ব্রিজের উচ্চতা আরও কম। বিপত্তিতে পড়েন জাহাজের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। বিপদ উদ্ধারে তারা গিয়ে পড়েন নগর কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে। ‘আপাতত বাবা ওদের জাহাজটা বিদায় করে দেই। পরে না হয় ডি হেফের কাছে নতুন আর আরও আধুনিক সেতু তৈরি করে দিব’- ওশানকোর এমন আশ্বাসে রাজি হয়ে যায় নগরের কর্তারা। তাতে কী আর সমাধান মিলে? বাধ সাধেন সমালোচকরা, ‘১৮৭৭ সালে তৈরি এই সেতুর রয়েছে কত ইতিহাস। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ইস্পাত সেতুটি। এটি কি ভাঙা ঠিক হবে?—সমালোচকদের এমন দাবীও যে যৌক্তিক। কেননা, প্রথম দিকে সেতুটিকে সবদিকেই ঘোরানো যেত। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে তৈরি হয় কত ঝামেলা। ১৯২৭ সাল থেকে এটিকে কেবল লিফট ব্রিজ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। আবার, এই তো কয়েকবছর আগে যখন সেতুটি এক্কেবারে অকেজো হয়ে গেল, তখন ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত—তিন বছর সেতু দিয়ে যান চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই সময় নগর কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই স্মারককে কীভাবে যে ভেঙে ফেলি? সেই কর্তৃপক্ষই এখন আবার বলছে, ভেঙে নতুন করে গড়ার এই প্রক্রিয়ায় কিছু লোকের অন্তত নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। অর্থের যোগান আসছে তাদের কাছ থেকেই। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ রাজনীতিক সকাল বিকাল কথায় বগি দিতে ওস্তাদ। এদের কাছ থেকে কথা পাল্টানোর কৌশলটা শিখে গেলেই আমস্টারডাম কর্তৃপক্ষের ঝামেলা চুকে যায়!

আবার ২০২১ সালের মাঝামাঝি থ্রিডি সেতু নিয়ে আমস্টারডামে ঘটে যায় তুঘলকি কাণ্ড। ঘটনাটি আমরা আমস্টারডাম যাওয়ার মাসখানেক আগে, মধ্য আমস্টারডামের আওডাজাইডস আক্টারবার্গবাউ খালের ওপর। সাড়ে চার টন ইস্পাত দিয়ে একটি সেতু তৈরি করা হয়েছে থ্রিডি ডিজাইনে। এমনিতে থ্রিডি ডিজাইনে বাচ্চাদের কলম থেকে শুরু করে আস্ত জাহাজও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেতুর মতো বিরল উপকরণ এই প্রথম। ‘এমএক্সথ্রিডি’ নামের প্রতিষ্ঠানটি কঠিন কাজটি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

প্রায় ৪২ হাজার বর্গকিলোমিটার নেদারল্যান্ডের অর্ধেকই তো সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি, মাত্র এক ফুট উঁচুতে। আর চারভাগের একভাগ সমুদ্র সমতলের নিচে। সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক উঁচুতে থাকা সত্ত্বেও যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের ডুবে যাওয়ার শঙ্কা! জলবায়ু ইস্যুতে বছরজুড়ে কত আলোচনা! সেখানে জলের মধ্যে থেকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দারুণভাবে এগিয়ে এই ডাচরা। ২২০ বর্গকিলোমিটারের আমস্টারডামে খাল রয়েছে ১৬৫টি। উঁচু মাটির ঢিবির মতো ছোট-বড় দ্বীপের সংখ্যা ৯০ এর মতো। যেগুলো প্রায় হাজারখানেক সেতু দিয়ে একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। খালগুলোতে ময়লা আবর্জনামুক্ত পানির প্রবাহ। খালের পাড় ঘেঁষে কোথাও রাস্তা, কোথাও বাড়িঘর, সাইকেল রাখার স্ট্যান্ডও রয়েছে কোথাও কোথাও। মাঝে মাঝেই পেতে রাখা হয়েছে বসার বেঞ্চ। ক্লান্ত পথচারী সেখানে বসে বিশ্রাম নেন। তরুণ-তরুণীদের বসে গল্প করার মতো নিরিবিলি পরিবেশ। অথচ লোকজন যে খুব একটা বসে আছে তেমন নয়। তরুণ, বয়স্ক—সবাই ব্যস্ত জীবনের টানে। এখানে আড্ডার সময় বের করাই মুশকিল। অথচ রাজধানী ঢাকায় প্রায় তিন কোটি মানুষের আবাস। কাজকামহীন কত মানুষের অখণ্ড অবসর। তাদের জন্য গল্প করা বা আড্ডার দেওয়ার জায়গার বড়ই অভাব। সেই দিক থেকে পুরো আমস্টারডাম শহরটাই রোমান্টিক মুডের।

গাড়িতে করে ঘুরছি। জেলে বসতি থেকে আজকের আধুনিক শহরে রূপান্তরের বাস্তব বিস্ময়। উঁচু দালানকোঠার শহর। শহরের মধ্যে চার বা দুলেনের রাস্তা। চওড়া হয়ে গিয়ে ঠেকেছে কোথাও ছ’ লেনেও। ঝকঝকে সড়কে কার, বাসের পাশাপাশি চলছে ট্রাম। রয়েছে সাইকেলের জন্য আলাদা একটা লেন। বাধাবিপত্তি ছাড়াই হেঁটে চলার জন্য পথচারীদের জন্য রয়েছে চওড়া ফুটপাত। সড়কের পাশ ধরেই স্বচ্ছ পানির খাল। খাল পারাপারের জন্য রয়েছে অসংখ্য সেতু। সেতু দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে খালের দুপাশের যোগাযোগ। যা জালের মতো ছড়িয়ে পুরো শহর জুড়ে। লেকভর্তি জলযান। যাত্রী চলাচলের যান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পণ্যবহনের স্টীমার, লঞ্চও। স্পিডবোট, ওয়াটার বাসে চড়েও চলাফেরা করা লোকের সংখ্যা কম নয়। 

২০২১ সালের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম নেদারল্যান্ডের উত্তর সাগরের উপকূলবর্তী শহর হেগে। সেখান থেকে সড়ক পথে ৬৪ কিলোমিটার দূরত্বে আমস্টারডাম। খালের শহর ভেনিস এখনো দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু কাছাকাছি এসে তাই দ্বিতীয় ভেনিস নামে খ্যাত আমস্টারডাম ঘুরে বেড়ানোর লোভ সামলানো কঠিন হয়ে গেল। হেগের বাসিন্দা আমিন মিয়াকে নিয়ে সঙ্গী করে যাত্রা শুরু আমস্টারডামের পথে।

কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে বের হয়েছি। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি। যেখানে ইচ্ছে হচ্ছে, গাড়ি পার্ক করে নামছি। হাঁটছি, ছবি উঠাচ্ছি। করোনার কারণে রাস্তায় লোকজনের চলাচল কম। যারা আছেন, তাদের মুখে মাস্কের কোনো বালাই নেই। ইউরোপের একটা অংশজুড়ে প্রথম থেকেই মাস্কবিরোধী আন্দোলন দেখা গেছে।

শহরে ঢোকার পর থেকেই বাইসাইকেল একটি পরিচিত দৃশ্য হয়ে ঠেকলো। শপিং মলের সামনে, খালের ধারে, কফি শপ এলাকায়—সব জায়গায় সাইকেলের সমাহার। ঢাকা শহরে যেমন রিক্সা, তেমনি আমস্টারডামে সাইকেল। ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড়, বৃদ্ধ-তরুণ—সবাই এই শহরে সাইকেল চালায়। কেননা, সাইকেল তাদের কাছে নিরাপদ যান। নিরাপদে আবার সাইকেল চালানোর জন্য প্রতিটি রাস্তায় রয়েছে চওড়া ভিন্ন ভিন্ন লেন। শহরের ঠিক মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খাল, তাতে জলযান। আর খালের পাশের রাস্তা ধরে সাইকেলের বেলের টুংটুং শব্দ বাজতেই আছে, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। শহরটিতে লোকসংখ্যা সাড়ে ১১ লাখের মতো, আর সাইকেল রয়েছে সাড়ে আট লাখ। এখন অবশ্য মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা কম। মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এর আগে চারবার। সেই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ পার্ক করে রাখা সাইকেলগুলো তুলে নিয়ে ভাগাড়ে রেখে দেয় নগর কর্তৃপক্ষ। যাতায়াতের জন্য এই নগরীর ৮০ শতাংশ লোকই সাইকেল ব্যবহার করে।

 

আমাদের গাড়ি এসে থামে জাদুঘর এলাকায়। ভ্যান গঘ জাদুঘরের সামনে খোলা প্রান্তর। বিশাল মাঠ সবুজ ঘাসে ঢাকা। স্বাভাবিক সময়ে এদিকে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। অন্য সময়ে পার্কিং করতে হয় ফি দিয়ে। করোনার কারণে পুরো এলাকাজুড়ে গা ছাড়া একটা ভাব। এদিক-সেদিক তাকিয়ে রাস্তার ধারে নির্ধারিত পার্কিংয়ের জায়গায় রেখে দিলেই হলো।

আগে এই এলাকায় অন্তত শখানেক কফির দোকান ছিল। এখন খোলা আছে ১০-১২টা দোকান। কফি নিয়ে আকাশ দেখি। আমস্টারডামের নীল আকাশ। সাদা মেঘের দৌড়াদৌড়ির ফাঁকে নীল আকাশের বিশাল ক্যানভাস। তাবৎ দুনিয়ার সব আকাশের চিত্র মনে হয় একই রকম।

মাঠের শেষ প্রান্তে উঁচু ভবনের সারি। আমস্টারডামের প্রতিটি খালের ধারে একই সাইজের বাড়িঘর। চাইলেই যে কেউ ইচ্ছেমতো বাড়ি বানাতে পারে না এই শহরে। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কোড। এই কোডের আওতায় বাড়ির ধরন, সাইজ, ভেতর-বাইরের রংসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু ঠিক করা থাকে। তাই তো কয়েক  শ’ বছর ধরে বাড়িঘর রয়ে গেছে একই রকম। কফি শেষ করে জাদুঘরের ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই।

আমস্টারডামের সঙ্গে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের নামটা পাকাপোক্তভাবেই জড়িয়ে। তাই এবার আমাদের গন্তব্য ভ্যান গঘের জাদুঘর। তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবিগুলো সাজানো প্রত্যেকটা গ্যালারি। পুরো গ্যালারিটা চারটা তলায় সাজানো। নিজের ফ্লোরে রয়েছে তার নিজের আঁকা পোট্রেট। এসব পোট্রেটে লাল, নীল, কমলা, আকাশী, ধূসরসহ নানান রঙের ছাপ। তাঁর কিশোরকালের বিভিন্ন ছবি স্থান পেয়েছে এই গ্যালারিতে। ভ্যান গঘের ছবি আঁকার প্যালেটও রয়েছে একই ফ্লোরে। তার সামনে রয়েছে বিভিন্ন রঙের টিউব। মনে হচ্ছে এই বুঝি আঁকা শেষে উঠে গেলেন চিত্রকর।

চিত্রকলায় তাঁর অনবদ্য অবদান আজও স্মরণীয়। ক্যারিয়ার নিয়ে শুরুতে খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন ভ্যান গঘ। তবে শেষ পর্যন্ত শুরু করেছিলেন ২৭ বছর বয়সে। তার ছবি আঁকার মূল সময় ছিল ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সাল। ড্রইং, পেইন্টিং, জলরঙে আঁকা ছবি, স্কেচসহ চিত্রকলার সব ক্ষেত্রেই রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। এক দশকে এঁকেছেন দুই হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম। এখনো তাঁর চিত্রকর্ম রেকর্ডসংখ্যক দামে বিক্রি হচ্ছে।

জীবনের অধ্যায়গুলো সুখের গল্পে ভরে ওঠে নি ভ্যান গঘের। খাপছাড়া আর এলোমেলো ঘটনা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বেশিরভাগ সময়। আর্ট ডিলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু তাঁর। এখানে বেশিদিন মন টিঁকে নি। শিক্ষকতা, ধর্মপ্রচারণাতেও থিতু হতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত ওই চিত্রকরের জীবনই বেছে নিতে হয়। এসবের মাঝে পার হয়ে যায় কয়েক বছর, গঘের জীবনে ঘটে যায় সুখ-দুঃখের নানা ঘটনা। জীবনপ্রবাহের নানা সমীকরণ রং-তুলির মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। জীবনযাপনের প্রতিবিম্ব দর্শকের চোখে ধরা পড়ে দ্বিতীয় গ্যালারিতে। এখানে রয়েছে একটি পারিবারিক ছবি। দিনশেষে খাবার টেবিলে পরিবারের সদস্যরা। ডাইনিং টেবিলে ঝুলানো সাধারণ বাতির আলোয় পরিবারের পাঁচ সদস্য। এক্কেবারে সাদাসিধে কৃষক পরিবারের রাতের খাবারের গল্প। আলু, বেকন আর কফির সঙ্গে ব্যস্ত পরিবারের আপনজনেরা। এই ছবির সাথে উঠে আসে সেই সময়ের পুরো ইতিহাস। ‘পট্যাটো-ইটার্স’ নামের এই ছবিটা আজ চিত্রজগতে স্মরণীয় এক চিত্রকর্ম। প্যারিসের দিনযাপনের চিত্রগুলো খণ্ড খণ্ডভাবে উঠে এসেছে পরের গ্যালারিতে। এখানে রয়েছে তাঁর স্বপ্নের প্রতিবিম্ব। ভ্যান গঘ স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর বিশাল একটি বাড়ি হবে। এই বাড়িটি চিত্রশিল্পীদের জন্য হবে আড্ডার জায়গা। তরুণ কিন্তু কাজের প্রতি যাদের রয়েছে আগ্রহ, তারা এখান থেকে সবধরনের সুযোগসুবিধা পাবে। বাড়িটি হবে হলুদ রঙের। তাঁর স্বপ্ন বাস্তব হয় নি পুরোটা। তবে প্যারিসের সেই ছোট্ট বাড়িকে ধরে আঁকা ছবিটা যে ইতিহাসের বড় একটা অধ্যায়ে রূপ নিয়েছে। হলুদ রঙের বাড়িতে ছোটখাটো একটা খাট, দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল। টেবিলের ওপরের জানালাটা বন্ধ। ঘরের সবগুলো উপকরণই তো হলুদ রঙের। এ যেন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেরই এক প্রতিচ্ছবি। সত্যি বলতে, মাত্র দুই দশক আগেও এমন একটা ঘরের স্বপ্নে কতটা বিভোর ছিলাম! নাটোরের অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম আমার। তখনো পাকা রাস্তা ছিল না। টিনের চালায় শনের বেড়া। ঘরের বেড়াগুলো মাটির প্রলেপ দিয়ে লেপে দেওয়া হতো। বৃষ্টির পানিতে খসে পড়ত কাদামাটির প্রলেপ, বের হয়ে আসত আস্তো শনের আস্তরণ। ঝড়ো বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যেত টেবিলে রাখা সুকান্তের হার না মানা উদ্যম আর জীবনানন্দের শ্যামল বাংলার মুখ। ভিজে চুপসে যাওয়া বইয়ের মতো চুপসে যেত মনও। কতবারই প্রিয় বই হারানোর কষ্টে হৃদয়টা হাহাকার করে উঠেছে। বাবা সেই সময়ে বলতেন, ‘আগামী ধানের মৌসুমে পাকা একটা ঘর করে দিবেন। যেখানে ছোট্ট একটা টেবিল থাকবে। তাতে থরে থরে সাজানো থাকবে রবি ঠাকুর, নজরুল থেকে শুরু করে শেক্সপিয়র পর্যন্ত। মাঝারি সাইজের খাটে থাকবে নরম তোষক। যেন আয়েশ করে খাটের দেয়ালে হেলান দিয়ে বই পড়া যায়। যেহেতু দু’ ভাই, ভাগাভাগি করে শুতে হবে বলে মাঝারি সাইজের খাট।’ সুনীলের মতো আক্ষেপ আমারও, আমার বাবা কথা রাখতে পারেন নি। আজ এতগুলো বছর পর যখন সেই ছোট্ট পড়ার টেবিল চেয়ারের আবেদনটা ফুরিয়েছে, তখন বিলাসী উপকরণে ছেয়ে গেছে বসতি। প্যারিসে ভ্যান গঘের ছোট্ট সেই টেবিলের সামনে আমি অসাড় হয়ে যাই। নাটোরের সেই হাটগোবিন্দপুর গ্রামের জীর্ণশীর্ণ ঘরের ছবিই যেন সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরের আমস্টারডামে।

ভ্যান গঘের জীবনের শেষের করুণা বিধুর ছবি দিয়ে সাজানো শেষ গ্যালারিটা। হাসপাতালের বেড থেকে জানালার বাইরের দৃশ্য, দূরে দাঁড়িয়ে লম্বা গাছপালা, ফুলের বাগান এসব। প্রকৃতিতে উজ্জ্বল সূর্য রঙের প্রতিচ্ছবি, সঙ্গে সবুজের আধিক্য। ক্যানভাসে ফুটে ওঠা জীবন্ত অবয়ব। মনটা ভারী হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.