আগামী ২০ ডিসেম্বর (২০১৯) মুক্তি পাচ্ছে সাদাত হোসাইন পরিচালিত প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গহীনের গান’।
এ সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইনের কাছে জীবন ও গল্প একাকার। তার মতে, জীবন জুড়ে যেমন গল্প থাকে, তেমনি গল্প জুড়েও থাকে অসংখ্য জীবন। এই গল্পই তিনি বলেছেন নানা মাধ্যমে। চলচ্চিত্রও তেমনই একটি মাধ্যম। বলাই বাহুল্য, চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেই তার। গল্প-উপন্যাসের মতো এ ক্ষেত্রেও তিনি জীবনের দিকেই হাত বাড়িয়েছেন এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিখেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা কৌশল। অর্থাৎ তিনি একজন স্বশিক্ষিত চলচ্চিত্রকার।
‘গহীনের গান’ চলচ্চিত্রটি একটু ভিন্ন ধরনের। এটি একটি গাননির্ভর চলচ্চিত্র। অবশ্য গানকে প্রাধান্য দিয়ে আগেও এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে সেইসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে ‘গহীনের গান’-এর পার্থক্য হলো, আগের ছবিগুলোতে গল্পের প্রয়োজনে গান ব্যবহৃত হয়েছিল আর এ ছবিতে গানের প্রয়োজনে গল্প সাজানো হয়েছে।
ব্যতিক্রমী এই চলচ্চিত্রটি এবং এর পরিচালক সাদাত হোসাইনকে ঘিরে এবারের প্রচ্ছদ রচনা।
চলচ্চিত্রবোধ ও সাদাত হোসাইন
কেউ যদি চলচ্চিত্রকার হতে চায়, তাহলে তার মধ্যে দুটি গুণ থাকতে হবে: ১. নান্দনিক এবং দর্শনগত ভাবনা ২. টেকনিক্যাল বা কারিগরি জ্ঞান। নান্দনিক বা দর্শনগত ভাবনাটি গড়ে ওঠে সেই চলচ্চিত্রকারের পড়াশুনা এবং জীবন এবং চারপাশের মানুষ ও পারিপার্শ্বিকতাকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতার ভিত্তিতে। অবশ্য এর সঙ্গে পড়াশুনাকেও সম্পৃক্ত করতে হয়। বলাই বাহুল্য, নান্দনিক বা দর্শনগত বিষয়টি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শেখা যাবে না। আর কে না জানে জীবন ও জগতকে দেখার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিই একজন সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারের পুঁজি! এ তাকে ঋদ্ধ করে। অন্যদিকে টেকনিক্যাল বা কারিগরি জ্ঞান একজন চলচ্চিত্রকার শিখতে পারেন কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বা কোনো প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকারের কাছ থেকে, তার সহকারী হিসেবে তার নির্মিত কোনো ছবিতে সহকারী হিসেবে যুক্ত থেকে।
সাদাতও নান্দনিক ও দর্শনগত চেতনা লাভ করেছেন নিজের জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে; মানুষ এবং জগতকে দেখা ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকে। এ প্রসঙ্গে সাদাতের ছোটবেলার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক।
সাদাত মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামের মানুষ। এই গ্রামে বাইশ বছর আগে, সাদাতের ছোটবেলায় শুরুতে কোনো সংবাদপত্র পাওয়া যেত না, কারও বাড়িতে কোনো টেলিভিশন ছিল না। তাই সাদাতদের এক প্রতিবেশী যখন একটি চোদ্দ ইি সাদা-কালো টিভি কিনে আনলেন, তখন গ্রামের মানুষ ভিড় জমালো তাদের বাড়িতে টিভি অনুষ্ঠান দেখার জন্য। বিশেষত শুক্রবার দুপুরে প্রদর্শিত বাংলা ছবি দেখার প্রতি তাদের আগ্রহ একটু বেশিই ছিল। সেই বাড়ির মানুষেরা অবশ্য বড়দের ছবি দেখাতে কার্পণ্য করত না । কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে হিসাবি ছিল তারা। এক্ষেত্রে সেইসব বাচ্চাকেই তারা ছবি দেখার সুযোগ দিতেন, যারা তাদের গৃহের টুকিটাকি কাজ করে দিত। এটিই ছিল ছবি দেখার টিকিট। তো সাদাত ছবি দেখার জন্য বৃহস্পতিবার এলেই সেই বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতেনÑযদি কোনো প্রকারে বাড়ির কর্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তার কোনো ফুট-ফরমায়েশ খেটে ছবি দেখার টিকিট পাওয়া যায়! একদিন সাদাতের ভাগ্য প্রসন্ন্ হলো, বাড়ির কর্ত্রীর নজরে পড়লেন তিনি। কর্ত্রী জানালেন, তাদের গাছের সুপারি পেড়ে দিলেই সাদাত শুক্রবারে ছবি দেখার সুযোগ পাবে। শুনে সাদাত তো খুশিতে আত্মহারা! তিনি সুপারি পাড়তে গাছে উঠলেন। কিন্তু এ যে ভীষণ কঠিন কাজ। সংগত কারণেই সাদাত ব্যর্থ হলেন। প্রতিবেশী মহিলাটি অসন্তুষ্ট হলেন। মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘ছবি দেখার জন্যই তোর যত লাফ-ঝাঁপ। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।’ কথাটি শুনে সাদাত আঘাত পেলেও পর দিন দুপুরে টিভিতে ছবি দেখার জন্য ওই বাড়িতে হাজির হলেন। বসলেন টিভির ঘরের মেঝেতে। এক সময় অনুভব করলেন, নরম হাতের পরশ। তাকিয়ে দেখেন সেই বাড়ির কর্ত্রী। তিনি ওর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সাদাত তো আপ্লুত। তিনি বললেন, ‘বাবা, তুমি এখানে মেঝেতে বসেছো কেন ?’ শুনে সাদাত জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো কোথায় বসব ?’ মহিলাটি মৃদু হেসে বললেন, ‘কেন? পিঁড়িতে। যাও, রান্নাঘর থেকে পিঁড়ি নিয়ে এসে বসে দেখো।’ তো তার কথা শুনে সাদাত ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাইরের রান্নাঘর থেকে পিঁড়ি নিয়ে এসে সেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা হয়েছে। সাদাত বুঝতে পারলেন, মহিলাটি প্রতিশোধ নিয়েছেন। তারপরেও সাদাতের মনের মধ্যে ছবি দেখার অদম্য সাধ জেগে উঠল, যেন বিনা যুদ্ধে না দেব সূচাগ্র মেদেনী! তিনি বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছবি দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু টিভিটি যে জায়গায় রাখা ছিল এবং সাদাত যে অ্যাঙ্গেল থেকে দেখার চেষ্টা করছিলেন, তার মধ্যে গরমিল ছিল। তাই সাদাত টিভিটা দেখতে পারছিলেন না। তখন তিনি শব্দ ও সংলাপ শুনে কল্পনা করতে লাগলেন দৃশ্যাবলি সম্পর্কে। পরে এই বিষয়টি সাদাতের কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। এভাবেই সাত শিল্পের সমাহার যে চলচ্চিত্র সেই চলচ্চিত্রের শব্দ ও ছবির মেলবন্ধন সম্পর্কে একটি ধারণা সাদাত নিজের মনের মধ্যে তার গড়ে তোলেন। আর টেকনিক্যাল বা কারিগরি জ্ঞান সাদাত আহরণ করেন কাজ করতে করতে এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে। ইউটিউবের বদৌলতে তিনি সম্পাদনার কৌশলও শিখেন।
আলোকচিত্র থেকে চলচ্চিত্র
সাদাত হোসাইন চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন আলোকচিত্রশিল্পে প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখার পর। বিষয়টি খুলে বলা যাক।
আমরা জানি যে, ছোটবেলা থেকেই সাদাত লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অন্য কথায়, লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক ছিল। একসময় আলোকচিত্রের প্রতিও তিনি ঝুঁকে পড়েন। ফটোগ্রাফার হিসেবে একটি পত্রিকায় কাজ করতেও থাকেন। তার তোলা কিছু ছবি ছিল ভীষণ ইন্টারেস্টিং। তাই পত্রিকার সম্পাদক একদিন তাকে এ ধরনের ছবি তোলার পাশাপাশি সেইসব ছবির নেপথ্য গল্পও লিখতে বলেন পত্রিকায়। সাদাত তা-ই করেন। আর সেইসব লেখা নিয়ে সাদাতের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। ‘গল্পছবি’ শিরোনামের সেই বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বনামধন্য প্রয়াত চিত্রগ্রাহক এবং আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন। তিনি সাদাতের আলোকচিত্র পছন্দ করতেন। তার তোলা ছবির কম্পোজিশনেরও প্রশংসা করেছেন তিনি নানা সময়ে। সাদাতের আালোকচিত্র পছন্দ করতেন স্বনামধন্য আলোকচিত্রী প্রয়াত রশীদ তালুকদারও। তিনি সাদাতের আলোকচিত্রের একটি প্রদর্শনী দেখে সেইসব ছবির প্রশংসা করেছিলেন। তবে একটি ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আরও ভালো হতে পারত’। কথাটি শুনে সাদাত ভালো ক্যামেরা না-থাকার কথা জানালে তিনি সাদাতের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভালো ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা নয়, মাথা ও চোখ লাগে। তোমার সেটি আছে। তাই ক্যামেরা নিয়ে চিন্তা করো না।’
রশীদ তালুকদারের কথাটি সাদাতের মাথায় গেঁথে যায়। আর তাঁর ও আনোয়ারের প্রশংসাও তাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ভাবেন, ‘তাহলে আমি কি সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি? সিনেমা বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি?’
এই পর্যায়ে সাদাতের জুনিয়র একটি ছেলে, নেয়ামুল, বস্তির এক বাচ্চা ছেলের অসম্পূর্ণ গল্প বলে এবং সেই গল্প নিয়ে তাকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাতে বলে। সাদাত তাকে জানালেন, তিনি সিনেমাটোগ্রাফি করতে জানেন না। নেয়ামুল সাহস এবং অর্থ জোগালে সাদাত ছবি তৈরিতে হাত দেন, নেয়ামুলের গল্পে কিছু বিষয় সংযোজন এবং গল্পটি সম্পূর্ণ করেন। নির্বাক ছবি। কেননা তখনো সাদাত শব্দ ধারণ করতে জানতেন না। তবে ক্যামেরা তিনিই চালিয়েছিলেন, এক ক্যামেরাম্যানের সামান্য সাহায্য নিয়ে। ছবিটির নাম ‘বোধ’।
সাদাত ‘বোধ’কে অনলাইনে ছাড়েন আর নির্বাক ছবির ভাষা যেহেতু সর্বজনীন সেহেতু বিশ্বব্যাপী এটি জনপ্রিয় হয়। ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলের একটি রিয়েলিটি শো-তে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। বিশ্বখ্যাত সাইট ব্রাইট সাইডে ছবিটির ভিউ কোটির উপরে। এছাড়াও নানান একাউন্ট, গ্রুপ, পেজ থেকে লক্ষ লক্ষবার ছবিটি শেয়ার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবে। ‘বোধ’-এর জন্য সাদাত পেয়েছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড ২০১৩।... সাদাতের দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্যা শ্যুজ’। এখানেও সাদাত এদেশের দরিদ্র এক শিশুর গল্প বলেছেন, যে নাকি ডাস্টবিনের মাথায় ঝোলা জুতাকে পরিষ্কার করে। এর জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকার পুরস্কার। এটির প্রযোজক জাহিদ নামের এক ব্যক্তি, সাদাত যাকে ‘বড়ভাই’ বলে ডাকেন। তিনি ফেরৎ পাবার আশা না করেই এতে অর্থলগ্নী করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯ মিনিটের ‘দ্য শ্যুজ’ও ছিল নির্বাক।...সাদাতের তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘প্রযত্নে। এটির প্রযোজক ছিল বাংলাঢোল লিমিটেড। আর এটি ছিল একটি সত্যিকারের শব্দ ও নৈঃশব্দের গল্প।
গান ও বাংলা চলচ্চিত্র
বাংলা চলচ্চিত্র জন্মলগ্ন থেকে গানের সঙ্গে বিজড়িত। নির্বাক যুগে অনেক প্রেক্ষাগৃহেই যন্ত্র সংগীতের পাশাপাশি দু’একটা গান শোনা যেত। আর ১৯৩১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হওয়ার পর পরই এ মাধ্যমটি গানের তালে তালে এগিয়েছে। অবশ্য সেই সময়ের ‘চণ্ডিদাস’বা ‘বিদ্যাপতি’তে গানের ব্যবহার ততটা অসংগত নয়, তবে বেশির ভাগ ছবিতেই গানের যত্রতত্র ব্যবহার দেখা গেছে, যা ছিল আরোপিত। বলা যায়, গান ব্যবহারের বিষয়টি বাতিকের পর্যায়ে তখন চলে গিয়েছিল। ফলে আড়ষ্ট বাংলা সত্ত্বেও কুন্দনলাল সায়গল হয়েছিলেন নায়ক।
শুরুতে ডিরেক্ট টেকিং-এর যুগে অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই স্বকণ্ঠে গান গাইত এবং তৎসঙ্গে অভিনয় করত। পরে, ১৯৩৫ সালে, ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির মাধ্যমে প্লেব্যাক পদ্ধতি চালু হয়। এটি হচ্ছে, গান রেকর্ডিং করে তা ফিল্ম নেগেটিভে সংযোজনের পর নাগারা মেশিনে চালিয়ে বা বাজিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীর লিপ মুভমেন্টের সঙ্গে মেলানো। এ পদ্ধতিতে গান গাইত একজন এবং সেই গানে ঠোঁট মিলিয়ে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করত অন্যজন। অবশ্য কোনো কোনো ছবিতে কণ্ঠশিল্পী এবং অভিনয়শিল্পী একজনই থাকত। তবে তার গান আগে রেকর্ড হতো, পরে তিনি নিজের গাওয়া গানেই নিজে ঠোঁট মেলাতেন।
গত শতকের চল্লিশ দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে গানের সঠিক প্রয়োগ দেখা যায়। অন্য কথায়, সেই সময়ের অনেক ছবিতে গান শুধু গানের জন্যই গাওয়া হতো না, চলচ্চিত্রটির গল্পের অঙ্গ হিসেবে রাখা হতো। আর প াশের দশক এবং তৎপরবর্তী সময়ে গানের শৈল্পিক ব্যবহার লক্ষণীয়। বিশেষত সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার প্রমুখের চলচ্চিত্রে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে শুরুতে গানের জন্যই গানের ব্যবহার ছিল। অবশ্য জহির রায়হান, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত প্রমুখের ছবিতে সঠিক সিচুয়েশনে গান ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য ‘রূপবান’, ‘গুনাই বিবি’, ‘বেহুলা’ ইত্যাদি ছবিতে গানের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এইসব ছবিতে গান অনেক ক্ষেত্রে সংলাপের কাজ করেছে। গানবহুল এমন চলচ্চিত্র নিকট অতীতেও দেখা গেছে।
প্রসঙ্গ গহীনের গান
‘গহীনের গান’-এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাংলাঢোল। এটি তাদের প্রযোজিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
বাংলাঢোলের এদেশের সুষ্ঠু সংস্কৃতি বিকাশে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং তারা এ কাজটি করে চলেছে আর্থিক বিষয়টি অনেক সময় উপেক্ষা করেই। তাদের উদ্যোগেই এ দেশের কয়েকজন কিংবদন্তি শিল্পীর গান ডিজিটাল ফর্মেটে রক্ষিত হয়েছে। যেমন সৈয়দ আবদুল হাদী, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ...। সৈয়দ হাদী এবং তপন চৌধুরীর গানের মিউজিক ভিডিওটি নির্মাণ করেছেন সাদাত হোসাইন স্বয়ং, বাংলাঢোলের ব্যানারে। বলাই বাহুল্য, কাজ দুটি প্রশংসিত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা জোটে যখন সৈয়দ আবদুল হাদীর আত্মজৈবনিক প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য লিজেন্ড সৈয়দ আবদুল হাদী’ বানান সাদাত। ঢাকা ক্লাবে সেটি প্রদর্শিত হওয়ার পরে দর্শক সারি থেকে উঠে এসে সাবিনা ইয়াসমিন জড়িয়ে ধরেন সাদাত হোসাইনকে। তিনি বলেন, ‘তুমি জানো না তুমি কী অসাধারণ কাজ করেছ!’ আর এইসব কিছুর জন্যই সাদাত সমস্ত কৃতিত্ব দিতে চান বাংলাঢোলের এনামুল হককে। তিনিই ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে কাজ করার জন্য সাদাতকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা, তুমি শুধু বইয়ের মাধ্যমেই গল্প বলতে পারো না। তুমি ভিজ্যুয়াল মাধ্যমেও গল্প বলতে পারবে। আমি চাই, তুমি এই জগতে আসো। কাজ করো।’
‘গহীনের গান’ নির্মাণেরও পেছনেও একটি গল্প আছে। সেটি হলো, এই ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার আগে বাংলাঢোল একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে মিউজিক্যাল ফিল্ম নির্মাণ করেছিল, কুমার বিশ্বজিতের কয়েকটি গান নিয়ে। ‘সারাংশে তুমি’শিরোনামের এই ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন আশিকুর রহমান। গান লিখেছিলেন স্বনামধন্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী প্রমুখ। এই ছবিতে একটি গানের সঙ্গে আরেকটি গানের লিংকেজ হিসেবে কাজ করেছে কবিতা এবং দুই মডেলের নানা অভিব্যক্তি। এটি সাদাতকে দেখানোর পরে বাংলাঢোলের কর্ণধার এনামুল হক তার মতামত জানতে চাইলে সাদাত মন্তব্য করেছিলেন, ‘যদি গল্পের মাধ্যমে গানগুলোকে গাঁথা যেত, তবে আরও ভালো হতো।’
সাদাতের মন্তব্যটি যে এনামুল হকের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, তার প্রমাণ হলো তিনি একদিন সাদাতকে স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের কয়েকটি জনপ্রিয় গান নিয়ে তাকে একটি চিত্রনাট্য লিখতে বলেন। পরে তিনি আবার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। জানালেন, আসিফ আকবরের একেবারে নতুন গান নিয়ে ছবিটি নির্মিত হবে। পুরোনো একটি গান, ‘বন্ধু তোর খবর কী’, সেটি অবশ্য থাকবে। তো সাদাত ‘গহীনের গান’-এর চিত্রনাট্য লিখলেন। সেটি পড়ার পরে এনামুল হক বললেন, ‘সাদাত, ছবিটি তোমাকেই বানাতে হবে।’ এরই ফলশ্রুতিতে সাদাত নির্মাণ করলেন জীবনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। উল্লেখ্য, ‘গহীনের গান’ শুধু সাদাতের প্রথম ছবি নয়, এটি আরও কয়েকজনের প্রথম ছবি। যেমন চিত্রগ্রাহক বিদ্রোহী দীপন, শিল্প নির্দেশক অর্ণব, কস্টিউম ডিজাইনার জান্নাত মৌরি, সম্পাদক ও কালার গ্রেডার লিয়ন রোজারিও, শব্দ পরিকল্পক সাকিরুজ্জাম্মান পাপ্পু এবং অভিনেতা ও কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের এটি প্রথম ছবি। আর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাংলাঢোলেরও যে এটি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, সেটি তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
‘গহীনের গান’ গাননির্ভর চলচ্চিত্র। তবে এখানে গল্পের প্রয়োজনে গান আসে নি, গানের প্রয়োজনে গল্প এসেছে।
ছবিতে গান রয়েছে নয়টি। গানগুলো হলো, ‘এক যে ছিল রাজার মেয়ে’, ‘তোমাদের শহরে আমি বড়ো অসহায়’, ‘ও বাবা, আমার হাতটা একটু ধর’, ‘এমন বরষায়’, ‘সাধারণ মানুষ’, ‘তোমার জন্য’, ‘তুমি এক রূপকথা’, ‘বন্ধু তোর খবর কী রে’, ‘তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব’। সবগুলো গানই গেয়েছেন আসিফ আকবর। সাতটি গান লিখেছেন তরুণ মুন্সী। ‘বন্ধু তোর খবর কী রে’র গীতিকার রাজীব আহমেদ এবং ‘তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব’ গানটি লিখেছেন সাদাত হোসাইন। সুরকার তরুণ মুন্সী এবং পল্লব সান্যাল। সংগীত পরিচালক পার্থ মজুমদার ও তরুণ মুন্সী।
এই নয়টি গানের মালা হলো ‘গহীনের গান’। আর এখানে সুতো হিসেবে কাজ করেছে গল্প। সেই গল্প ছবিতে কীভাবে এসেছে তা এবার দেখা যাক।
ছবিতে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ‘এক যে ছিল রাজার মেয়ে ভীষণ অভিমানী/ যখন তখন মন ভেঙে দেয় এমন পাষাণী’। এই গানটি প্রসঙ্গে দর্শকরা ছবিটির শুরুতেই দেখতে পাবে আসিফ আকবর এবং তানজিকা আমিনকে। স্বামী-স্ত্রী। স্বামী আসিফ আকবর জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। স্ত্রীকে তেমন সময় দিতে পারেন না। এ নিয়ে স্ত্রীর অভিযোগ রয়েছে; রয়েছে স্বামীর প্রতি অভিমান। তানজিকার মান ভাঙাতে স্বামী আসিফ তাই এক পর্যায়ে গেয়ে ওঠেন ‘এক যে ছিল রাজার মেয়ে...’। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? সেটি দেখানো হয় এবং শোনা যায় ‘তোমাদের শহরে আমি বড়ো অসহায়’ গানটি।... পরের গানটি হলো ‘ও বাবা, আমার হাতটা একটু ধর’। এর জন্য আবার নতুন গল্প এবং নতুন চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে। আসিফ স্ত্রী তানজিকাকে তখন একজন বৃদ্ধের গল্প বলে। বৃদ্ধটি নিঃসঙ্গ। স্ত্রী মারা গেছেন বহু আগেই। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। তারা বৃদ্ধ বাবার খোঁজ নেয় না। অথচ জ্বর-কাতর তিনি সেই ছেলেমেয়েদেরই সঙ্গ কামনা করেন। হৃদয়ের আর্তি ব্যক্ত করেন করুণ ভাষায়: ‘ও বাবা, আমার হাতটা একটু ধর’। এই বৃদ্ধ লোকটি এক সময় যুবক ছিল। তার সেই যৌবনে তাঁর পাশে ছিল মমতাময়ী স্ত্রী, জীবনে ছিল গভীর ভালোবাসা। সেই যুবক আর তরুণী স্ত্রীকে দেখতে পায় দর্শকরা; দেখতে পায় তাদের আদরের ছোট সন্তানদের। এই পর্যায়ে একটি প্রেমের গান শুনতে পাবে দর্শকরা।...ঘটনাচক্রে বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয় এক তরুণীর। তাকে নিজের জীবনের কথা খুলে বলে বৃদ্ধটি। আর নিজের জীবনের সঙ্গে বৃদ্ধের জীবনের মিল খুঁজে পেয়ে তরুণীটিও তার কথা বলে, নিজের জীবনের পাতা মেলে ধরে বৃদ্ধের কাছে। বলে প্রেম ও প্রতারণার গল্প। তরুণীটির গল্পের সূত্রে এই পর্যায়ে প্রেম-বিরহের কয়েকটি গানও শুনতে পাবে দর্শকরা।
ছবির সংলাপ দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করবে। যেমন- গায়ক আসিফের স্ত্রী বলে, ‘আমি তো তোমার জীবনের প্রয়োজন, প্রিয়জন নয়।’ শুনে আসিফ বলে, ‘না, তুমি আমার প্রিয়জন।’ ‘তাহলে গান কী?’ স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তরে আসিফ তখন বলে, ‘গান আমার জীবন।’ স্ত্রী তখন বলে, ‘জীবনে যদি অনেক গল্প থাকে, তার একটি পার্ট আমি। তাহলে তো আমি প্রয়োজন ছাড়া কিছু নয়।’ অন্যদিকে বৃদ্ধের সঙ্গে তরুণীটির পরিচয় হলে পরে বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার জীবনের গল্প কী?’ তরুণীটি বলে, ‘পৃথিবীর সকল গল্প তো একই। অপেক্ষা এবং উপেক্ষার, ভালোবাসা এবং ঘৃণার। আনন্দের এবং বেদনার।’এভাবেই জীবনের গল্প, সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প, শিল্পসত্তা আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের সংঘাত, একাকিত্বের যন্ত্রণা, সম্পর্কের অলিগলি খোঁজা কিছু একান্ত মুহূর্তের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে ছবির গল্প। কিছু অনুভব, কিছু অনুভূতির কথাও জানানো হয়েছেÑযা দীর্ঘ দিন ধরে ছিল অব্যক্ত। আসলে ‘গহীনের গান’-এ এটাই দেখানো হয়েছে যে আমরা যতই ভালোবাসার কথা বলি না কেন— শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই নিঃসঙ্গ। তাই ছবির শেষে এই পরম সত্যটি উচ্চারিত হয়Ñ‘আমরা সবাই কাছাকাছি থাকি, পাশাপাশি থাকি না। আমাদের বুকের গহীনে যে গান বাজে, সেই গানটি শোনা হয় না আর।’...‘গহীনের গান’-এ অবশ্য দর্শকদের জন্য একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। সেটি কী? তা প্রেক্ষাগৃহে গিয়েই দর্শকরা জানুন।
ছবিটির মূল সাতটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৈয়দ হাসান ইমাম (বৃদ্ধ), আসিফ আকবর (স্বনামধন্য গায়ক), তানজিকা আমিন (গায়কের স্ত্রী), কাজী আসিফ রহমান (বৃদ্ধের যুবক বেলার চরিত্র), তুলনা আল হারুন (বৃদ্ধের তরুণী স্ত্রী), তমা মির্জা (তরুণী) এবং আমান রেজা (তরুণীর প্রেমিক)। এ ছাড়া শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করছে আরশ এবং মুগ্ধতা।
বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা
বৃষ্টির প্রতি সাদাত হোসাইনের প্রবল ভালোবাসা রয়েছে। তার বড়ো সাধ এটি দেখার যে একটানা সাত-আট দিন অবিরাম বৃষ্টি হবে। সেই প্রবল বর্ষণ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মজার বিষয় হলো, বৃষ্টি সাদাতের প্রিয় বিষয় হলেও বৃষ্টিতে ভিজতে তিনি পছন্দ করেন না। তিনি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করেন। যা হোক, ‘গহীনের গান’-এ নিঃসঙ্গ মানুষের বেদনা রূপায়িত করার জন্য সাদাত বৃষ্টিকে ব্যবহার করেছেন বহুবার।
ঘটনা-দুর্ঘটনার গল্প
‘গহীনের গান’ নির্মাণের কিছু ঘটনা আছে; কিছু দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ের ওপর এবার আলো ফেলা যাক। শুরুতে শুটিংয়ের গল্প।
একদিন বসিলায় শুটিং হচ্ছিল। গাড়িতে আসিফ আকবর এবং তানজিকা আমিন। সামনে কার রিডের সঙ্গে বাঁধা ক্যামেরা। পেছনের সিটে লুকিয়ে ছিলেন পরিচালক সাদাত হোসাইন এবং ক্যামেরাম্যান বিদ্রোহী দীপন। হঠাৎ একটি মিনিবাস পেছন থেকে ধাক্কা মারে গাড়িটিকে। পেছনের অংশ মুহূর্তে ভেঙেচুরে যায়। কিন্তু কপাল গুণে ক্যামেরা অক্ষত থাকে।
আরেক দিন বৃষ্টির মাঝে শুটিং করতে গিয়ে এ ছবির প্রবীণ অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন; তাঁর পুরো শরীর নীল বর্ণ ধারণ করে। সবাই ভয় পেয়ে যায়। পরিচালক তাই শুটিং আর করতে চান না। কিন্তু হাসান ইমাম বিবেচক মানুষ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এতে বাজেট বেড়ে যাবে। তাই তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব করেন। সে অনুযায়ী দেখানো হয় যে হাসান ইমাম ও তমা মির্জা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক পর্যায়ে কাছের একটি বাড়ির বারান্দায় গিয়ে উঠেন এবং সেখানে বসে কথা বলতে থাকেন। সংগত কারণেই এই সিকোয়েন্সে দর্শকরা একটি ভুল আবিষ্কার করবেন। সেটি হলো এই যে, সৈয়দ হামান ইমামের ভেজা কাপড় এবং কিছুক্ষণ পরে তার শরীরে অন্য পোশাক এবং তা শুকনো।
ডাবিংয়ের সময়েও কম সমস্যা হয় নি। একদিন ছিল তানজিকা আমিনের ডাবিং। আর সেদিন তিনি পুবাইলে একটি নাটকের শুটিং করছিলেন। সেখান থেকে তার ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। তখন আবার অন্য বিপদ। শুরু হয় তুমুল ঝড়। বিদুৎ চলে যায়। এ অবস্থায় সংগত কারণেই পরিচালক ভাবেন, আজ আর তানজিকার পুরো ডাবিং শেষ করা যাবে না। কিন্তু ঘণ্টা খানেক পরে ঝড় থেমে গেলে বিদুৎ চলে এলে তানজিকা অল্প সময়ের মধ্যে ডাবিং শেষ করেন। আর সেটি তিনি করেন এক টেকেই। পরিচালক মুগ্ধ হন। বুঝতে পারেন, ডাবিংয়ে তানজিকা অসাধারণ।
আরেকদিন ছিল তমা মির্জার ডাবিং। আবদ্ধ একটি ঘরে, সচরাচর যা হয়ে থাকে, তমা মির্জা বসে কাজ করছিলেন। বাইরে বসে ছিলেন পরিচালক সাদাত হোসাইন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, তমা মির্জা মূর্তির মতো বসে আছেন। সাদাত মাইক্রোফোনে বললেন, ‘তমা, হ্যালো তমা, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ?’ কিন্তু তমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সাদাত তখন দরজা খুলে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখতে পেলেন, তমার হাতে ‘গহীনের গান’-এর স্ক্রিপ্ট। আর তার দু’ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত অশ্রু। কেন তমা মির্জার এমন কান্না ? পরিচালক জানেন না। হয়তো সেই সিকোয়েন্সের সংলাপ বলতে গিয়ে তমা মির্জার অতীতের কোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, যা বেদনাদায়ক, অশ্রু জাগানিয়া।
শেষ কথা
একটি নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র ‘গহীনের গান’। গানের ছন্দে, গল্পের আনন্দে এবং জীবনের গন্ধে ভরপুর। ছবিটি বিনোদন প্রত্যাশী এবং সংবেদনশীল দর্শকদের ভালো লাগবে। আর যারা গানপ্রেমিক তারা শুধু কথা আর সুরের মাঝেই অবগাহন করবেন না, চমৎকার অভিনয় ও গভীর অনুভূতির সংলাপেও তারা হবেন মুগ্ধ। আমরা আশা করি, এই ব্যতিক্রমী ছবিটি দেখতে বহু দর্শকই আবার হলমুখী হবে।
সাক্ষাৎকার ১ : সাদাত হোসাইন
মোমিন রহমান : ‘গহীনের গান’ একটি গাননির্ভর চলচ্চিত্র। ভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে এটি আপনার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। এ বিষয়ের আপনার অনুভূতি জানতে চাইছি।
সাদাত হোসাইন : এটা খুবই এক্সপ্রেরিমেন্টাল কাজ। প্রথাগত চলচ্চিত্র নয়। এখানে দেখা যায় গান ও সংলাপ; সংলাপ ও গান। এটা কারও কাছে বোরিং মনে হতে পারে। আবার কারও কাছে মনে হতে পারে, ছবিতে যে কথা বলা হয়েছে সেটা তার জীবনের কথা। প্রথম ছবি হিসেবে এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও এটা আমার কাছে সারা জীবনের শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।
মোমিন রহমান : বাংলা চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন থেকেই দর্শকরা ছবিতে গল্প শুনতে বা দেখতে ভালোবাসে। গাননির্ভর এই চলচ্চিত্রে দর্শকেরা গল্প খুঁজে পাবে কি? একটি চলচ্চিত্র দেখার পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাবে কি?
সাদাত হোসাইন : এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। ছবিটি দর্শকরা কীভাবে নিবে—এটা দর্শকদের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই। তবে আমার মনে হয়, হ্যাঁ তারা এ ছবিতে গল্পের স্বাদ পাবে।
মোমিন রহমান : ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন কি?
সাদাত হোসাইন : অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। বড় একটি কাজ করতে গেলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এটাই স্বাভাবিক। এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সমস্যা মানেই শিক্ষা।
মোমিন রহমান : চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে সাহিত্যের কথা ভাবেন কি কিংবা উপন্যাস লিখতে গিয়ে চলচ্চিত্রের কথা ?
সাদাত হোসাইন : একদম। আমার ক্ষেত্রে এ কথাটি পুরোপুরি খাটে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে অনেক কিছু আমি ভিজ্যুয়ালি দেখতে পাই। আবার চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখতে গিয়ে মনে হয়, সেটি সিনেমাটিক হয়ে গেল।
মোমিন রহমান : পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে কি? সম্পূরক প্রশ্ন, আলোকচিত্রী সাদাত হোসাইনের কাছে কি চলচ্চিত্রকার সাদাত হোসাইন ঋণী?
সাদাত হোসাইন : অনেক কাজে লেগেছে। এ প্রসঙ্গে ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়ে বলব, প্র্যাকটিস ম্যাচ ছাড়া যেমন মূল ম্যাচ খেলা যায় না, তেমনি ছোটখাটো চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করা যায় না, অন্তত আমার ক্ষেত্রে এমনটি হয় নি। আর পরের প্রশ্নের উত্তরে বলব, শুধু ঋণ নয়, আমি চলচ্চিত্রকার সাদাত হোসাইন আলোকচিত্রী সাদাত হোসাইনের কাছে অনেক বেশি ঋণী।
মোমিন রহমান : আপনার আগামী ছবির কথা বলুন।
সাদাত হোসাইন : আগামীতে আমি একটি ডিটেকটিভ ছবি বানাতে চাই। আমার একটি ডিটেকটিভ উপন্যাস আছে, ‘ছদ্মবেশ’, এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ছবিটি বানাতে চাইছি। আর প্রধান চরিত্র রেজাউল হকের ভূমিকায় নিতে চাইছি সিয়ামকে। অবশ্য বিষয়টি নির্ভর করছে প্রযোজকের ওপর।
সাক্ষাৎকার ২: আসিফ আকবর
মোমিন রহমান : বাংলা ছবি তৈরি হবে অথচ গান থাকবে না এটা হয় না। গানের সঙ্গে বাংলা সিনেমার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সাধারণত সিচুয়েশন অনুযায়ী গান তৈরি করা হয় সিনেমায়। অথচ ‘গহীনের গান’ সিনেমায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন জিনিস। সেটা হলো আগে গান তৈরি তারপর গল্প। এমন সিনেমা বাংলাদেশে দেখা যায় নি। মিউজিক্যাল ফিল্ম বাংলাদেশের দর্শক আগেও দেখেছে। কিন্তু এটা একটু ভিন্ন ধরনের। নয়টি গান নিয়ে গাননির্ভর চলচ্চিত্র। এই ছবি দেখে কি দর্শকরা পরিপূর্ণ সিনেমার স্বাদ পাবে?
আসিফ আকবর : আমার এখানে কিছু করণীয় নেই। আমার শুধু গানটা গাওয়ার দায়িত্ব ছিল। বাকি কাজগুলো করেছেন গীতিকার, সুরকার, কম্পোজাররা। আমার মাথায় কখনো আসে নি এই গানগুলি এভাবে এধরনের গল্পে বিশেষ করে সাতটি চরিত্রের সঙ্গে গানগুলি এডজাস্ট করা সম্ভব। প্রথমত আমি গায়ক চরিত্রে এসেছি। তারপর বাবা, ছেলে, ছেলের বৌ, বান্ধবীসহ কয়েকটি চরিত্র চলে এসেছে। এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা কঠিন কাজ। সাদাত সেটা অনায়াসে করেছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্য কোথাও হয়েছে কিনা মনে হয় না। গানের ওপর নির্ভর করে একটা ফিল্ম তৈরি।... এটা আসলে মানুষের জীবনের গল্প। সিনেমা সবসময় জীবনের গল্পই বলে। যারা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখবে, যাদের ধৈর্য থাকবে, যাদের সাহিত্যের প্রতি একটু টান আছে, গল্পের প্রতি টান আছে, যারা নিজেকে খুঁজতে চায় গানে ও গল্পে—তারা এই সিনেমাটা দেখে মজা পাবে।
মোমিন রহমান : অভিনয় তো আপনার কাছে নতুন না।
আসিফ আকবর : না, অভিনয় আসলেই আমার কাছে নতুন। আমি আগে মিউজিক ভিডিও করতাম না। মিউজিক ভিডিও করছি শেষ আড়াই বছর যাবৎ। আমার মিউজিক ভিডিওর যারা পরিচালক তারা বেশিরভাগই সিনেমা থেকে আসা। গল্পের প্রয়োজনে অভিনয় করতে হয়েছে। যেহেতু আমি অভিনয়ে খুব একটা পারদর্শী না। আমার হাতে সময়ও কম। মিউজিক ভিডিও ফিল্মের মতো না। অনেক সময় ধরে হয় না। একটা দিনের মধ্যে শেষ করতে হয়। না হলে বাজেট বেড়ে যাবে। এখানে আমি চেষ্টা করেছি পরিচালকের নির্দেশ মানতে, ওরা যেভাবে চেয়েছে আমি সেভাবে করার চেষ্টা করেছি; যেন বারবার করতে না হয়, দ্রুত কাজ শেষ হয়ে যায়। টোটাল ক্রেডিট পরিচালকের।
মিউজিক ভিডিও আর সিনেমাতে বিস্তর ফারাক। সিনেমায় আমার অনেক ডায়লগ রয়েছে, যা মিউজিক ভিডিওতে সাধারণত দেখা যায় না। ডায়লগগুলি খুবই কাঠখোট্টা টাইপের। আমি ডাবিং আর্টিস্ট নই, কখনো ডাবিং করি নি। এই প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আমার। আমি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ডাবিং করেছি। সেক্ষেত্রে এটা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতাই।
মোমিন রহমান : অভিনয়ের বিষয়টি কীভাবে ম্যানেজ করেছেন ?
আসিফ আকবর : আমার কোআর্টিস্ট ছিলেন তানজিকা আমিন। তিনি আমাকে খুব সহযোগিতা করেছেন। এক্সপ্রেশন, ডায়লগ— সব দিক থেকে। তার অভিনয়ে যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষতা রয়েছে। তিনি কোচের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সরাসরিভাবে সাদাতের কিছু নির্দেশনা ছিল।
মোমিন রহমান : এই ছবির নয়টি গান আপনিই গেয়েছেন। তাই গানগুলি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাচ্ছি।
আসিফ আকবর : প্রত্যেকটা গানেই দর্শক-শ্রোতা গল্প খুঁজে পাবে। ‘বাবা’ গানে বাবার একাকিত্বের গল্প, নিঃসজ্ঞতার গল্প। আবার কোনো গানে রয়েছে প্রেমের অনাকাক্সিক্ষত ফাটল। গীতিকার খুব সুদক্ষভাবেই সেটা তুলে ধরেছেন।
মোমিন রহমান : সিনেমায় আপনি যে চরিত্রটা করেছেন সেটি একজন গায়কের। আপনি এই চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান কি? কোনো বিষয়ে মিল রয়েছে?
আসিফ আকবর : মিল তো থাকবেই। মানুষ মানেই প্রেমবিরহের মধ্যে বড় হওয়া। কখনো সফল হই, কখনো বা ব্যর্থ হই। এখানে শুধু আমি না, প্রত্যেক দর্শক যারা সিনেমাটা দেখবে, যারা উপভোগ করবে, তাদের প্রত্যেকেরই গল্প রয়েছে এখানে। যে গল্প খুঁজে পাবে না সেও গল্প খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। কোনো না কোনো মিল খুঁজে পাবে তার জীবনের সাথে।
মোমিন রহমান : অভিনয় এবং সিনেমা নিয়ে আর কোনো ভাবনা আছে?
আসিফ আকবর : আমার কাছে অনেকেই বাণিজ্যিক সিনেমার অফার দিয়ে রেখেছে। পেমেন্ট অনেক লোভনীয়। আসলে এই কাজটা আমার না, অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত না সিনেমার জন্য। আড়াই তিন ঘণ্টা হলে মানুষকে ধরে রাখা সহজ ব্যাপার না।
মোমিন রহমান : সাদাত আগে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি বানিয়েছে। এই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যরে ছবি বানালো। আর তার নির্দেশনায় আপনি কাজ করলেন। পরিচালক হিসেবে সাদাত সম্পর্কে আপনি কী বলতে চান?
আসিফ আকবর : সাদাতকে আমি পরিচালক বলব না। আমি বলব সে একজন মেন্টর। সে বোঝাতে পারে শিল্পীকে সে আসলে কী চায়। ভেতর থেকে আসা বক্তব্যগুলি, জীবনের নানা টানাপোড়েন উপলব্ধি করার ব্যাপারটা। এই বিষয়ে সাদাতের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.