উতল হাওয়া (সপ্তম পর্ব)

উতল হাওয়া (সপ্তম পর্ব)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব...]

শেখ মুজিব বললেন, আপনারা ভালো করে জানেন এটা আবেগের সময় না। পাকিস্তানি সোলজার আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। আমার একটা ভুল, একটা ভুল বক্তব্যের কারণে হাজার হাজার মানুষের জান চলে যাবে। স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা সোলজাররা ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি পাকিস্তানিদের সেই সুযোগ দিতে রাজি না। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া যাবে না, তাহলে ওরা একটা অজুহাত পেয়ে বসব।

মুজিব ভাই, আমরা সবাই জানি স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নাই। দুইদিন আগে আর পরে ওদের সাথে আমাদের থাকা হবে না। কিন্তু ওরা আমাদের এত সহজে স্বাধীনতা দেবে না। ওরা আর্মি নামিয়ে শেষ চেষ্টা করবে। টিক্কা খানকে এ জন্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়েছে।

কিন্তু প্রধান বিচারপতি তো ওকে শপথ পাঠ করায় নি।

ইয়াহিয়া এসবের তোয়াক্কা করে না মুজিব ভাই!

কামাল হোসেন বললেন, কিন্তু ওরা এখনো আলোচনা চালিয়ে যেতে চাইছে।

মুজিব বললেন, শোনো কামাল, ওদের আলোচনা পুরোটাই একটা ধাপ্পাবাজি। আলোচনার নাম করে ওরা সোলজার নিয়ে আসছে। আমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কামারুজ্জামান বললেন, ওদের উদ্দেশ্য আমাদের আর বুঝতে বাকি নাই। এখন কথা হলো আমাদের প্রস্তুতি কী হবে? আমাদের নেতা-কর্মীদের অবস্থান কী হবে?

নজরুল ইসলাম বললেন, আমরা সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাব।

তাজউদ্দীন বললেন, আক্রমণের প্রথমেই ওরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরই ধরবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে হলেও ওরা মাস কিলিংয়ে যাবে। আমরা হয়তো পালাবার সুযোগ পাব না। যা ভাবার, যা করার এখনই করতে হবে। যেভাবেই হোক আমাদের পাকিস্তানি সোলজারদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে হবে। সারা দেশের মানুষ আমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকবে সঠিক নির্দেশনার জন্য।

মুজিব বললেন, যদি সেই রকম পরিস্থিতি আসে তাহলে তোমরা হাইকমান্ড সবাই ইন্ডিয়া চলে যাবে, ছাত্র-যুবকদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী তৈরি করে ওদের সাথে যুদ্ধ করবে। আমি ইন্ডিয়ার হাইকমিশনের সাথে যোগাযোগ করে দিল্লিতে মেসেজ দেওয়ার ব্যবস্থা করব। যদি প্রয়োজন মনে হয় আমাদের বার্তা নিয়ে মনি, তোফায়েল দিল্লিতে যাবে। তোমাদের কাজ হবে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করা।

তাজউদ্দীন ধরা গলায় বললেন, মুজিব ভাই, আমরা সবাই তো আপনার সাথে আছি। আপনার নেতৃত্বেই আমরা দেশ শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনব।

আমি হয়তো সেই সুযোগ নাও পেতে পারি। আক্রমণের প্রথমেই ওরা আমাকে ধরবে। এরপর ভাগ্যে কী আছে জানি না।

কামরুজ্জামন বলল, আপনার কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না মুজিব ভাই।

নজরুল ইসলাম, কামাল হোসেনও একই কথা বলল, যে-কোনো মূল্যে আপনার ধরাপড়া চলবে না।

এবার তাজউদ্দীন মুখ খুললেন, মুজিব ভাই, আপনি এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা, আমাদের নেতা। আপনার জীবনের পুরোটাই আপনি উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্যে। এই শেষ সময়ে, কঠিন সময়ে, আপনার ধরা পড়া চলবে না। সব সংকট আমরা একসাথে মোকাবেলা করব।

কিন্তু ওদের মেইন টার্গেটই হলাম আমি।

সেটা জানি, কিন্তু আপনার নির্দেশ ছাড়া এত বড় দল পরিচালনা করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

কেন, তুমি তো দলের সাধারণ সম্পাদক, তুমিই তো সব দেখভাল করবে!

তবুও মুজিব ভাই আমি, আমরা সব সময় আপনার পাশেই আছি কিন্তু সংকটে সবাই আপনাকে খুঁজবে; আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

কামাল হোসেন বলল, এই বিষয়টি না হয় আমরা পরে আলোচনা করি। আমরা কালকের ভাষণটি ঠিক করি।

শেখ মুজিব বললেন, আমি জানি সারা দেশের মানুষ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। স্বাধীনতা আসবে, তাকে আসতেই হবে। কিন্তু এজন্যে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাই। আনফরচুনেটলি আমেরিকা সমর্থন করছে ইয়াহিয়াকে। একটা ডেমোক্রেট রাষ্ট্র কী করে সামরিক জান্তাকে অন্ধ সমর্থন দেয় আমি বুঝি না!

কামরুজ্জামান বলেন, সবই স্বার্থের খেলা মুজিব ভাই।

যতই স্বার্থ থাক ওরা সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবিদাওয়াগুলো দেখবে না? হারামজাদারা মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, ভেতরে ভেতরে আসলে ওরা হিটলারের প্রেতাত্মা। এশিয়ায় আমেরিকার পলিসি অনুযায়ী ওরা ইয়াহিয়াকেই সাপোর্ট করবে। আমাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াকে ওরা আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই দেখবে।

তাজউদ্দীন বললেন, আমার ধারণা ইউরোপ আমাদের সাপোর্ট করবে। তবে সে জন্যে আমাদের অনেক ক্যাম্পেইন করতে হবে।

খন্দকার মোশতাক বললেন, বিদেশে আমাদের যত বাঙালি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সবাইকে সেই ক্যাম্পেইনে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব আমি নিলাম।

মুজিব বললেন, এসব পরে দেখা যাবে। এখন ভাষণের ব্যাপারটি কী করা যায়? তোমরা তো জানো আমি কখনো দেখে বক্তৃতা দিতে পারি না…

ঠিক এ সময় কেয়ারটেকার বিশালদেহি আরজ আলী অপরাধী মুখ করে শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন লোককে নিয়ে ঢুকল। লোকটাকে দেখে সবাই চমকে গেল! লোকটি দেখতে রবীন্দ্রনাথের কার্বন কপি! আশ্চর্য, এমন মিল হয় মানুষের!

আরজ আলী জানে হাইকমান্ডের মিটিং চলাকালে কোনো আগন্তকের ভেতরে ঢোকা একেবারেই নিষেধ। কিন্তু এই দীর্ঘদেহি বয়স্ক মানুষটির দরবেশের মতো বেশভুষা আর চোখের আত্মমগ্ন দৃষ্টি দেখে আরজ আলী তাঁকে নিষেধ করতে পারে নি।

লোকটিকে দেখে খন্দকার মোশতাক ছাড়া সবাই উঠে দাঁড়াল। তার সাদা দাড়ি, আলখেল্লা আর হাতের ছড়িটি আভিজাত্যের প্রতীক বহন করছে। আর চোখে এমন এক দার্শনিক দৃষ্টি! যেন পৃথিবী থেকে বহু দূরে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ।

সবাইকে উঠে দাঁড়াতে দেখে লোকটি নিজেই বিব্রত হলেন। কাছে এসে খুবই বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি অত্যন্ত লজ্জিত এই অসময়ে এখানে এসে পড়েছি। আমি দু’ থেকে তিন মিনিট সময় নেব, এর বেশি নয়...আমার নাম সদানন্দ মুখার্জি। আমার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। আমি একজন গান্ধিবাদী। আমার এক ছেলে ছিল। সে আর তার স্ত্রী বার্লিনে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় পনের বছর আগে। ওদের এক ছেলে, আমার নাতি, অমিত মুখার্জি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বহুদিন ধরে তার কোনো খোঁজ পাই না। দুদিন ওর হোস্টেলে অপেক্ষা করলাম, পেলাম না। আজ চলে যাচ্ছি।

লোকটি এই বলে থামল। তারপর শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবলাম যাওয়ার আগে বাংলার সিংহপুরুষটিকে দেখে যাই।

আপনি ভেতরে বসুন, আমি চা-নাশতার ব্যবস্থা করছি।

না না আমি বসব না, আমি জানি আজকের দিনটি আপনাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে দুটো কথা বলেই বিদায় নেব। আপনাদের হাতে সময় খুব কম। পাকিস্তান আর্মি ৩০ লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিকে মারবে। এ মাসের শেষেই ওরা অপারেশন শুরু করবে।

কী বলছেন এসব?

না না আমি কোনো গোয়েন্দা নই, জ্যোতিষিও নই। এ সবই আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি। তবে বাঙালি রুখে দাঁড়াবে। এই দেশ খুব দ্রুতই স্বাধীন হবে, সেটা কেউ আটকাতে পারবে না। তবে আপনারা সবাই খুব সাবধানে থাকবেন। দক্ষ নাবিক ছাড়া জাহাজ যেমন কূল খুঁজে পায় না তেমনি আপনাদের দক্ষ নির্দেশনা ছাড়া এই আন্দোলন, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে। শেখ সাহেব, আপনি খুবই সরলপ্রাণ মানুষ। এই সরলতা একদিন আপনার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

তাজউদ্দীন এগিয়ে এসে বলছেন, আপনি এসব কী বলছেন! আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আপনি তো বুদ্ধিমান মানুষ তাজউদ্দীন সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনি হলেন যুধিষ্টির, আপনি আপনার লক্ষ্য জানেন। একটি অনুরোধ- আপনি কখনো শেখ মুজিবকে ছেড়ে যাবেন না।

না না, তা কেন হবে?

রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসক দরকার হয়। আকবরের দরবারে একজন বৈরাম খাঁ না থাকলে আকবর প্রাসাদষড়যন্ত্রে অকালেই মৃত্যুবরণ করতেন।

মোশতাক উঠে এসে বিরক্তি নিয়ে লোকটিকে বললেন, আপনি অনেকক্ষণ ধরেই অযথা বকবক করে যাচ্ছেন। আমরা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি।

লোকটি অতি বিনয়ে হাত জোড় বললেন, আমি অত্যন্ত লজ্জিত মোশতাক সাহেব, এই অসময়ে আপনাদের সভায় ঢুকে পড়েছি। আপনার জন্যে একটা সাজেশন ছিল।

বলুন কী বলতে চান।

মোশতাক সাহেব, আপনি গোঁফের পেছনে অযথা সময় নষ্ট করেন। কুটিল লোক গোঁফ নিয়ে ভাবে। সুকুমার রায়ের গোঁফ নিয়ে একটা কবিতা আছে... গোঁফকে বলে তোমার-আমার, গোঁফ কি কারও কেনা? গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা। হা হা হা.. আমি বিদায় নিচ্ছি। তাজউদ্দীন সাহেব, এই কাগজটায় আমার নাতিটির নাম-ঠিকানা লেখা আছে। আপনি কাউকে দিয়ে একটু খবর পাঠিয়ে বলবেন ২৫ মার্চের আগেই যেন সে আর তার বন্ধুরা হোস্টেল ছেড়ে যায়।

তারপর শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, মুজিব সাহেব চলি, আপনার ভাষণ শুনে যেতে পারলাম না। ওদিকে আমার স্ত্রীর শরীরটা বিশেষ ভালো না, না গেলেই নয়। ভাষণ নিয়ে বেশি ভাববেন না! আপনি সরলপ্রাণ মানুষ, মনে যা আসে তাই বলবেন। যে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে নেতা হিসেবে এ যুদ্ধ পরিচালনায় আপনাকে দরকার। আপনি যেন কিছুতেই পাকিস্তানিদের কাছে ধরা দেবেন না। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা বড় কঠিন কাজ! আজ চলি, আপনার সাথে আবার আমার দেখা হবে। জয় বাংলা।

(চলবে...)

Leave a Reply

Your identity will not be published.