মায়ের ভালোবাসা, মায়ের ছবি

মায়ের ভালোবাসা, মায়ের ছবি

মা ও শিশুর সম্পর্ক এক অনিবার্য বন্ধন। মানব সভ্যতায় মায়ের ভালোবাসা এবং মা-শিশুর বন্ধন কখনো পুরোনো হয় না। এ বন্ধন নিত্য—এ বন্ধন চিরকালের। মানব সভ্যতায় যত বন্ধন—যত সম্পর্কের দেখা মিলে—তার মধ্যে মা ও শিশুর বন্ধন অন্যতম। আরও স্পষ্ট করে বললে, মা ও সন্তানের বন্ধন। মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন নিয়ে শিল্পীরা এঁকেছেন ছবি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মা ও শিশুর চিত্রকর্ম মানেই ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’। এ বিষয়ে প্রাচীনতম নিদর্শনের একটি হলো সপ্তদশ শতাব্দীতে আঁকা একটি খোদাইচিত্র। এ ছবিতে কোলে বসে আছেন শিশু জেসাস খ্রিস্ট।

মা ও সন্তানের চিরকালের অটুট বন্ধনের কথাও আছে মানুষের জীবনে। এছাড়াও আছে শিল্পের নমুনায়—লোকশিল্প, আলোকচিত্র, ভাস্কর্যসহ নানা শিল্পমাধ্যম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশু-সন্তানের সম্পর্কের রূপ বদলেছে। শিল্পীরা সেটি অনুভব করে এঁকেছেনও নানাভাবে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় মা-শিশুর মুখে মাস্ক—এমন ছবিও দেখা যায়। তবে এই সম্পর্ক এখনো সর্বজনীন—অনাবিল। তারপরও বছর ঘুরে মা দিবস আসে। সময়ের দাবিতে শুধু দিনটি মাকে উৎসর্গ করা। উল্লেখ্য, মা ও সন্তানের সম্পর্কে বিভিন্ন চিত্র নিয়ে লিখতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

ইতালীয় রেনেসাঁর শিল্পী রাফায়েল তার আঁকা অসংখ্য ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’-এর জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ১৫০৭ সালে তিনি এঁকেছিলেন ‘ম্যাডোনা অব দ্য পিঙ্কস’। দুনিয়াজুড়ে এই চিত্রকর্মটি বহুল পরিচিত। এ চিত্রকর্ম অবলম্বনে ফরাসি শিল্পী জ্যাঁ মরিন আঁকেন একটি খোদাইচিত্র, আনুমানিক ১৬৪০ সালে। একটু ভিন্নতা থাকলেও এই দুই চিত্রকর্মেই মা ও সন্তানের স্বভাবজাত সম্পর্ক দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতীয়মান।

মা ও সন্তান নিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ‘দ্য ম্যাডোনা অব দ্য কার্নেশন’ চিত্রকর্মটি তেলরঙে এঁকেছিলেন, আনুমানিক ১৪৭৩ সালে। চিত্রে দেখা যায় মাদার মেরি কার্নেশন ফুল ধরে আছেন। এ ফুলটির বিষয়ে আকর্ষণ অনুভব করে শিশু যিশুকে একটি কুশনের ওপর বসে থাকতে দেখা যায় চিত্রকর্মটিতে। মাদার মেরির পোশাকটি খুবই অলংকৃত—প্রচুর রঙের সমাহারে একজন রানির পোশাকের মতো।

এরপর নানা দেশের শিল্পীরা মা, শিশু ও সন্তান নিয়ে নিয়মিত নানা চিত্রকর্ম এঁকেছেন। ১৮৮১ সালে ‘মা ও শিশু’ শিরোনামে তেলরঙে চিত্রকর্মটি আঁকেন পিয়ের-অগাস্টে রেনোয়ার। এতে এক অভিজাত বাড়ির ঘরে এক মা এবং তার শিশুকে স্তন্যপান করার দৈনন্দিন ও স্বাভাবিক দৃশ্য চিত্রিত করেছেন তিনি বর্ণিল রঙে। গোলাকার গড়ন, বাঁকা রেখা এবং সুন্দর মুখ রেনোয়ার শিল্পশৈলীকেও চিহ্নিত করে এ চিত্রকর্মটি।

ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত এ চিত্রকর্মে রেনোয়া এঁকেছেন দৈনন্দিন জীবন ও প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপন। মায়ের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও স্নেহ প্রতিফলিত হয়েছে এ চিত্রে। এর মাধ্যমে মা ও সন্তানের অটুট বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয় আমাদের।

রেনোয়া দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য, বিশেষ করে ফরাসি বুর্জোয়াদের জীবন আঁকার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। যার মাধ্যমে তিনি দৈনন্দিন মুহূর্তের পরিবেশ ও ঔজ্জ্বল্য ধারণ করতে চেয়েছেন। রেনোয়ার ‘মা ও শিশু’ চিত্রকর্মটি ইম্প্রেশনিস্ট শৈলীর এক নিখুঁত দৃষ্টান্ত।

 ১৮৮৫ সালে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ আঁকেন ‘মা ও শিশু’ চিত্রকর্মটি। বসে থাকা এক নারীর কোলে আছে একটি শিশু—এটাই এই চিত্রকর্মের প্রতিপাদ্য। মা ও শিশু একটি শাল দিয়ে ঢাকা। এর মধ্য দিয়ে চিত্রে তৈরি হয়েছে অন্তরঙ্গ ও সুরক্ষামূলক দৃশ্য। বাদামি ও কালো রঙের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে এ চিত্রে রয়েছে হালকা হলুদ রঙের ছোঁয়া। ঘন তলে—রঙে তুলির শক্তিশালী আঁচড় এ ছবিতে যোগ করেছে গভীরতা। মাতৃস্নেহের অনন্য উদাহরণ এই চিত্রকর্মটি। মা ও সন্তানের মধ্যে অনন্য সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের মাঝে সংবেদশীল শ্রদ্ধাবোধের অনুভূতি তৈরি হয় এই চিত্রকর্মটি দেখার মাধ্যমে।

আধুনিক চিত্রকলায় পাবলো পিকাসো বিভিন্ন শৈলী ও বিষয় নিয়ে নিয়মিত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন—যা এককথায় অনবদ্য। এর মাধ্যমে সময়ের বৈশিষ্ট্য ও তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে একসঙ্গে প্রতিফলিত করেছে তার আঁকা চিত্রকর্ম। ১৯০১ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত তার ‘নীল পর্ব’ গভীর বিষণ্নতায় নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ের ছবি এই পর্বে তিনি আঁকলেও মাতৃত্ব বিষয়কে উপেক্ষা করেন নি।

১৯০১ সালে প্যাস্টেলে গভীর নীল রঙে পিকাসোর আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মা তার সন্তানকে গভীর মমতায় আঁকড়ে রেখেছেন। এক গভীর আবেগের মাতৃত্বের গভীর স্বাদ ও ভালোবাসা নীলরঙে প্রকাশিত হয়েছে গভীরভাবে এই চিত্রকর্মে। স্মৃতি ও বিষণ্নতার সঙ্গে আবেগ আর ভালোবাসার যুগল অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয় এই সৃষ্টি।

গুস্তাভ ক্লিমট ‘মা ও শিশু’ চিত্রকর্মটি আঁকেন ১৯০৫ সালে। এ চিত্রকর্মটি ‘থ্রি এজেস অব ওম্যান’ সিরিজের অংশ। এই সিরিজে একজন নারীর জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তুলে ধরেছেন ক্লিমট। ‘মা ও শিশু’ অংশে দেখা যায়, একজন যুবতী মা বিছানায় শুয়ে আছেন এবং তার সন্তান তার পেটের ওপর রয়েছে। মায়ের নগ্ন শরীর আর শিশুটি সাদা কাপড়ে মোড়ানো।  এছাড়া যত্নের সঙ্গে সোনালি, রুপালি ও বাদামি রং প্রয়োগ করা হয়েছে। এ চিত্রে আরও আছে আর্ট নুভোর নান্দনিকতা ও আলংকারিক মোটিফের সংযত উপস্থাপনা।

এর মাত্র ১০ বছর পর ১৯১৫ সালে ‘মা ও দুই সন্তান’ চিত্রটি আঁকেন ইগন শিল। ভার্জিন মেরি ও যিশুর চিরাচরিত চিত্রায়ণকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এই শিল্পী। তবে ইগন শিল মা চরিত্রকে শান্ত চেহারার পরিবর্তে উদ্বিগ্ন রূপে এঁকেছেন। প্রকাশবাদী শৈলীতে আঁকা এই পেইন্টিং মানব ভাগ্যের করুণ প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে।

১৯২১ সালে ক্যানভাসে প্রধানত হালকা নীল ও গোলাপি রঙে মাতৃত্বের ছবি আঁকলেন সালভাদর দালি। এমন রং ব্যবহারে ক্যানভাসে সৃষ্টি হয়েছে শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ। মাতৃত্বের অনুভূতি—মাতৃত্বের দৃশ্যই ফুটে উঠেছে এই পেইন্টিংয়ে। মাতৃস্নেহের প্রতি উৎসর্গীকৃত হয়েছে এই সৃষ্টি।

 চিত্রটির সম্মুখভাগে একজন মাকে তার সন্তানকে স্নেহভরে দোলাতে দেখা যায়। শিশুটি একটি সাদা চাদরে মোড়ানো এবং সে মায়ের বাহুতে রয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। এর পেছনে একটি জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি দৃশ্য, যা চিত্রপটে শান্তিপূর্ণ আবহ তৈরি করে। চিত্রটির গঠন অত্যন্ত গতিশীল, যেখানে বাঁকা রেখাগুলোতে সুরেলা আবহ সৃষ্টি করে। বাস্তববাদ ও জীবনের ছাপ একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে এ চিত্রে।

মা ও শিশুর সঙ্গে আরও অনেক বিষয়কে অনুষঙ্গ করে এক ভিন্ন ধরনের ছবি এঁকেছেন মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলো। ‘আমার দাদা-দাদি, আমার মা-বাবা এবং আমি’ শিরোনামে এই চিত্রকর্মটি আঁকেন ১৯৩৬ সালে। এই চিত্রে শিল্পী বলছেন তার পরিবারের গল্প। এর মাধ্যমে এই চিত্রকে পারিবারিক বৃক্ষের উপস্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

ফ্রিদা কাহলোকে এখানে একজন শিশু হিসেবে নগ্ন অবস্থায় একটি লাল ফিতা ধরে থাকতে দেখা যায়। যা তার পারিবারিক বংশের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। দাদা-দাদি ও মা-বাবার বিয়ের ফটোগ্রাফের ওপর ভিত্তি করে এই চিত্রকর্মটি এঁকেছেন শিল্পী। মা ও সন্তানের সম্পর্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে এই চিত্রের মধ্য দিয়ে। প্রাণবন্ত রঙে পরাবাস্তববাদ ও সারল্যের সংমিশ্রণে এ চিত্র হয়ে উঠেছে আরও জীবন্ত।

 প্রায় কাছাকাছি বিষয় নিয়ে আরেকটি ছবি এঁকেছেন ডেভিড হকনি। ‘আমার মা-বাবা এবং আমি’ শিরোনামে এই চিত্রকর্মটি শিল্পী এঁকেছেন ১৯৭৫ সালে। অসমাপ্ত তেলচিত্র এটি। তারপরও ক্যানভাসে শিল্পী তার মা লরা হকনি ও বাবা কেনেথ হকনির দৈনন্দিন জীবনের অন্তরঙ্গ দৃশ্য চিত্রিত করেছেন। এরসঙ্গে তিনি আত্মপ্রতিকৃতি যোগ করেছেন। মা ও সন্তান ভাবনার সঙ্গে এই চিত্রটির সরাসরি যোগ নেই। তবে মায়ের ভালোবাসা ও স্নেহই এই ছবির প্রতিপাদ্য। চিত্রকর্মটি অসমাপ্ত হলেও ২০২০ সালে এটি প্রথমবারের মতো লন্ডনে প্রদর্শিত হয়।

 মা ও শিশুকে প্রতিপাদ্য করে যে ধারা শিল্পীরা তৈরি করেছিলেন সেটি উনিশ-বিশ শতকে পরিবর্তিত হতে থাকে। বিভিন্ন উপাদান ও সম্পর্ক যোগ হতে থাকে এইসব চিত্রে। তবে এসব সৃষ্টির প্রেরণায় রয়েছে মা ও শিশু এবং মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। কেইথ হারিং-এর ‘রেডিয়েন্ট বেবি’ তেমনই একটি আইকনিক চিত্রকর্ম। পর্প আর্ট শৈলীর আদলে মাথার চারপাশে সূর্যের রশ্মিসহ একটি স্টাইলাইজ শিশুকে চিত্রিত করা হয়েছে—যা একইসঙ্গে জীবন, আনন্দ ও ভবিষ্যতের আশার প্রতীক। ১৯৯০ সালে আঁকা এই চিত্রটি মা ও শিশুর সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব না করলেও এক শিশুর চিত্রের সঙ্গে মাতৃত্ব ও মাতৃস্নেহ যুক্ত থাকে প্রবলভাবে।

বিশে^র অন্য দেশের শিল্পীদের মতো বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরাও মা ও শিশু-সন্তানকে নিয়ে এঁকেছেন ছবি। কামরুল হাসান গতিশীল রেখায় দিয়েছেন মা ও সন্তানের গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত। এই সম্পর্ক ও ভালোবাসা যে চিরকালের সেটি অনুভূত হয় তার চিত্রমালায়। মুর্তজা বশীর এঁকেছেন ফ্লোরেন্সের রাস্তায় শিশুসহ মায়ের ব্যস্ত জীবন।

জয়নুল আবেদিন-এসএম সুলতান-কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রপটে মা-শিশুর চিরকালের কথা এসেছে। মা এবং মা-সন্তান নিয়ে এই অলঙ্ঘনীয় চিরকালের সম্পর্কের কথা চিত্রপটে এভাবে আসবে আগামীতেও।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.