হারিয়ে যাচ্ছে টমটম

হারিয়ে যাচ্ছে টমটম

এক সময় ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়িতে কেবল রাজা-বাদশা কিংবা জমিদাররাই চড়তে পারত। পরবর্তীতে এটি পরিণত হয় ধনাঢ্য পরিবারের মানুষের বাহন হিসেবে। এ যুগের ছেলেমেয়েরা বাস্তবে কেউ রাজা-রাজপুত্র দেখে নি, তবে প্রবীণদের কাছ থেকে রাজা-রাজকুমারের ঘোড়ায় চড়ার অনেক গল্প শুনেছে।

রূপকথার গল্পের রাজকুমার আসে ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্য বাস্তবে আমাদের কেউ না দেখলেও, কিছু ঘোড়ার গাড়ির আধুনিক সংস্করণ এখনো আমাদের দেশের অনেক জায়গায় দেখা যায়। বিজ্ঞানের কল্যাণে যান্ত্রিক গাড়ির আধিক্যে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮৩০ সালে পুরান ঢাকায় সর্বপ্রথম ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। আর্মেনীয়দের ব্যবসার মাল টানার কাজে ব্যবহৃত হতো এটি। এরপর নবাবি শাসনামলে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। ঢাকার রাস্তাগুলো ইট, চুনসুরকি কিংবা পীচ দিয়ে ঢালাই করে ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ঘোড়ার গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আমাদের ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বহুলভাবে ব্যবহৃত হতো ঘোড়ার গাড়ি। মালামাল পরিবহনের কাজে আমাদের দেশের চর অঞ্চলসহ উত্তরবঙ্গের বহু স্থান, নড়াইল, টাঙ্গাইল, যশোর, দিনাজপুরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন এখনো রয়েছে।

ঘোড়ার গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট। আগেকার দিনে ঘোড়ার গাড়ি বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। একটি বাঁশের দুই পাশে দুটি বড় মাপের চাকা থাকত। আর চাকার ওপরে বিছানো থাকত বসার জায়গা। কোনো কোনো গাড়ির বসার জায়গার ওপরে ছাউনি দেয়া থাকত। গাড়ির সামনের দিকে থাকত একটি পুরু বাঁশ, যার নাম ‘জোয়াল’। সেই জোয়ালের দুই পাশে দুটি ঘোড়া গাড়িটি টানত। ঘোড়ার লালনপালন ব্যয়বহুল হওয়ায় গাড়ির সামনের অংশের পরিবর্তন করে একটি ঘোড়া দিয়ে গাড়ি টানার ব্যবস্থা করা হয়েছে অনেক জায়গায়। এই গাড়ির সামনের অংশে বসেন চালক। যার নাম গাড়োয়ান বা গাড়িয়াল। আর গাড়ির পেছনের অংশে বসেন যাত্রী।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বই থেকে জানা যায় যে, ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিল অন্যতম প্রভাবশালী ও বণিক সম্প্রদায় এবং ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেন। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-তে নানা ধরনের ঘোড়ার গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে, যাতে ঢাকায় চলাচলকারী গাড়িগুলোকে ‘ক্রাহাঞ্চি’ বা ‘ক্রাঞ্চি’ গাড়ি (‘কারাচি গাড়ি’) বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার নবাবরা ইংরেজ শাসনামলে বৈধভাবে ঢাকার রমনা মাঠে সপ্তাহের প্রতি শনিবার আকর্ষণীয়  ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার  প্রবর্তন করেন। এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। আমি নিজে বড়দের সাথে বহুবার রমনার মাঠে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছি। স্বাধীনতার পরে সরকার এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেয় এবং রমনা মাঠের নাম পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করা হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘোরদৌড়ের উন্নত জাতের ঘোড়াগুলোর ভাগ্যে পরবর্তী সময়ে কী ঘটেছিল তা অবশ্য জানা যায় নি। 

একসময়ে শুধু রাজা-বাদশাহ, অভিজাত শ্রেণি ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করলেও পরে সাধারণ মানুষ এর ব্যবহার শুরু করে। ফলে রাজকীয় এই বাহনটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে দুই শত বছর পার করেছে। বর্তমানে গুলিস্তান, সদরঘাট, ফুলবাড়িয়া, গোলাপশাহ মাজার, বঙ্গবাজার, বকশীবাজার ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় ১৫-২০টি ঘোড়া গাড়ি চলাচল করে।

পুরান ঢাকার সদরঘাটের কলেজিয়েট স্কুলের সামনে থেকে গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনো চলছে নবাবি আমলের প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি। সূর্যোদয়ের পর পর মানুষের হাঁকডাক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার টকাটক টকাটক শব্দে চলতে থাকে পেশিশক্তির এই বাহন। স্থানীয়দের কাছে ‘টমটম’ নামে পরিচিত এই ঘোড়ার গাড়ি। ঢাকায় প্রচলন শুরুর সময়ে এটি ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। আগে ঘোড়ার গাড়ি নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও আধুনিকতার জোয়ারে ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে কমে গেছে এর যাত্রীও।

পুরনো ঢাকার স্থানীয় কোচোয়ানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই ঘোড়ার গাড়িগুলো। একেকটি গাড়ি প্রতিদিন সর্বোচ্চ ছয়বার সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে যাওয়া-আসা করে। একটি টমটম গাড়িতে সর্বোচ্চ ১৫ জন যাত্রী বসতে পারে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। তবে বিশেষ দিনগুলোতে প্রত্যেক যাত্রীর ভাড়া হয়ে যায় ৫০ টাকা। বর্তমানে সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে ১৫-২০টি ঘোড়ার গাড়ি চলে। অথচ স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে খোদ ঢাকা শহরের বেশ কিছু রুটে কয়েক শ’ ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করত। সেই আমলে হাতেগোনা কিছু মুড়ির টিন মার্কা গাড়ি সদরঘাট থেকে রামপুরা পর্যন্ত চলাচল করতকোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে। চাহিদার তুলনায় এই গাড়িগুলো অপ্রতুল হওয়া সাধারণ মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদুড় ঝোলা হয়ে চলাচল করত এইসব গাড়িতে।

টমটম গাড়িগুলো আকারে বড় হওয়ার কারণে ঢাকা শহরের অলিগলিসহ সব জায়গায় এগুলো চলাচল করতে অক্ষম। চাহিদার সাথে মিল রেখে ঢাকা শহরে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। দ্রুত কমতে থাকে পেশিশক্তির চার চাকার বাহন ঘোড়ার গাড়িগুলো। আগে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে সকল শ্রেণির যানবাহনকে নবাবপুর রোড দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতো। ১৯৮৭ সালে ঢাকার গোলাপ শাহের মাজার থেকে প্রশস্থ ইংলিশ রোড নির্মাণের পরে নবাবপুর রোডকে ওয়ান ওয়ে করে দেয়া হয়। তখন থেকে টমটম গাড়িসহ সকল শ্রেণির যানবাহন ইংলিশ রোড দিয়ে চলাচল শুরু করে। বাসের ভাড়া ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় বেশির ভাগ  মানুষ বর্তমানে বাসে চলাচল করা পছন্দ করতে। ফলে টমটমগুলো যাত্রী হারাতে শুরু করে এবং বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। ভাড়া বেশি লাগলেও ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল অনেক নিরাপদ ও আরামদায়ক।  ঘোড়ার গাড়িতে আগের মতো এখন যাত্রীদের ভিড় নেই। অধিকাংশ যাত্রী শখের বশে বা নবাবি আমলের আভিজাত্যের স্বাদ নিতে টমটম গাড়িতে ওঠে। আমি এখনো গুলিস্তান থেকে সদরঘাটের দিকে গেলে শখ করেই  ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসি। অযান্ত্রিক এই ঐতিহ্যের ঘোড়ার গাড়িগুলোতে ফাঁকা রাস্তায় ভ্রমণ করতে অনেক ভালো লাগে। নবাবি একটা ভাব মনের ভেতর চলে আসে। বছর আট আগে আমার এক ভাতিজার বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক টাকায় ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ঢাকা লেডিস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিয়ের বরযাত্রার জন্য পুরনো ঢাকাবাসীরা সুসজ্জিত ঐতিহ্যের ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করার রেওয়াজ এখনো ধরে রেখেছেন। বরযাত্রার সময় সম্মুখভাগে থাকে সাদা রঙের বিশেষ পোশাকধারী ব্যান্ড পার্টি। সিনেমা কিংবা নতুন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজেও ঘোড়ার গাড়ি টমটমের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাছাড়া পুরনো ঢাকাবাসীরা জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদ্যাপন করতে ঐতিহ্যের ঘোড়ার গাড়ির মিছিল নিয়ে দলবেঁধে আনন্দ উৎসব পালন করে।

আমাদের দেশের ‘দোস্ত দুশমন’ ছায়াছবির ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ এই জনপ্রিয় গানটি টমটম গাড়ি চালানোকে কেন্দ্র করে চিত্রায়িত হয়েছে। আগেকার দিনে ঢাকা শহরের ঘোড়ার গাড়িগুলো কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। এর মধ্যে পর্দানশীন মহিলাদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনের ঘর আকৃতির টমটম গাড়ি দেখা যেত। বর্তমানে অধিকাংশ টমটম গাড়িগুলো আকর্ষণীয় নকশাকার লোহার তৈরি। এই গাড়িগুলো বানাতে বর্তমান বাজারে প্রায় দুই লক্ষ টাকা খরচ পড়ে। এরসাথে এক জোড়া বলিষ্ঠ আকারের ঘোড়া কিনতে আরও দুই লক্ষ টাকা লেগে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘোড়ার প্রধান খাবার খৈল, ভূষি, ঘাস ও ছোলা বুটের দাম মাত্রারিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় টমটমের ঘোড়াগুলো ঠিকমতো তিনবেলা খাবার খেতে পায় না। ফলে ঘোড়াগুলো দিনে দিনে দুর্বল ও ক্ষীণকায় হয়ে পড়ছে। প্রায়ই ঘোড়া অসুস্থ হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে গেলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তারা শুধু ওষুধ লিখে ছেড়ে দেন, অন্য কোনো পরিচর্যার ব্যবস্থা নেই।

অস্তিত্ব সংকটে পড়া পুরোনো ঢাকার পেশাদার কোচোয়ানদের সন্তানেরা এই পেশাকে ধরে রাখতে বর্তমানে খুব একটা ইচ্ছুক নয়। ওরা লেখাপড়া শিখে অন্য পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ইচ্ছে পোষণ করছে। অথচ যে কেউ এই কোচোয়ানের কাজ করতে পারে না। একজন দক্ষ কোচোওয়ান হতে হলে দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণের দরকার পড়ে। এই নাজুক অবস্থা চলতে থাকলে দক্ষ কোচোওয়ানের অভাবে আমাদের পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যের টমটম গাড়িগুলো ধীরে ধীরে একসময়  হারিয়ে যাবে। 

প্রতিটি টমটমে একজন করে কোচোয়ান-হেলপার থাকে। কোচোয়ানরা ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করেন। হেল্পাররা মালামালসহ যাত্রীদের গাড়িতে উঠতে সহায়তা করেন। কোচোয়ানদের পারিশ্রমিক ও ঘোড়ার খাদ্য খরচ বাদে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয় ঘোড়ার গাড়ির মালিকদের। সদরঘাটের ঘোড়ার গাড়ির একজন কোচোয়ান জানান, এই গাড়ি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্য। আগে নিত্যদিন যাতায়াত করলেও এখন মানুষ শখের বশে ওঠে। এই রুট ছাড়াও মানুষের বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে টমটম ভাড়া নেয়া হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য নেয়া হলে ভাড়া দূরত্ব অনুযায়ী ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। আগে রাস্তায় ৫০টির মতো ঘোড়ার গাড়ি ছিল। রিকশা-মোটরযান বেড়ে যাওয়ায় এখন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আগের দিনে অনেক ট্রিপ দিতে পারত। জ্যাম বেড়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয় না। তবে ছুটির দিনগুলোতে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকে, দিনে আট-নয়বার আসা-যাওয়া করা যায়।

টমটমের মালিক জনৈক সালাহ উদ্দীন বলেন, ‘ঘোড়ার গাড়ি আমাগো ঢাকাইয়াগো ঐতিহ্য। আগের লাহান ঘোড়া ঢাকায় নাই। এখন রাস্তায় গাড়ি বাইরা যাওয়ায় ঘোড়ার গাড়ি চালানোটাই অনেক হাঙ্গামা। আর জায়গা তো নাই, ঘোড়ার যতœ নিমু ক্যামনে?’

আমাদের ঢাকা শহরের ঐতিহ্যের ঘোড়ার গাড়িগুলো বিভিন্ন কারণে এখন বিলুপ্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে। টমটমকে আমার কাছে অমানবিক মনে হয়। দুটো ঘোড়া সারা দিন ১৫/২০ জন করে মানুষসহ বিশাল আকৃতির গাড়িকে যানজটপূর্ণ ঢাকা শহরের রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়াবে- এটা মন থেকে মেনে নেয়া যায় না। আমরা এই অসহায় পশুগুলোর প্রতি যেন সব সময় মানবিক আচরণ করি। অবদানের কথা আমরা কখনো যেন ভুলে না যাই।  

Leave a Reply

Your identity will not be published.