আসাদুজ্জামান নূর এ দেশের সর্বজননন্দিত মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের অসামান্য অভিনয়শিল্পী। অনুবাদক, আবৃত্তিশিল্পী। তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবনের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত উঠে এসেছে, এসেছে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও।
আসাদুজ্জামান নূরের বাসায় নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ্ নাসের ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সিরাজুল কবির চৌধুরী। ধারণযন্ত্র থেকে সাক্ষাৎকারটি লিপিবদ্ধ করেছেন রাজীব প্রামানিক। আলোকচিত্র: এস এম নাসির ও সংগ্রহ।
আনিসুজ্জামান: আমার ওপরে ভার পড়েছে আসাদুজ্জামান নূরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার। তাঁর পরিচয় তো নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। নূর, আপনার জন্ম ও পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাই।
আসাদুজ্জামান নূর: আমি সাধারণত সবার সাক্ষাৎকার নিই। আপনারও সাক্ষাৎকার নিয়েছি দেশ টিভির ‘বেলা অবেলা সারাবেলা’ অনুষ্ঠানের জন্য। আপনি আমার সাক্ষাৎকার নেবেন— এটা আমি ভাবতেই পারছি না।
আমার জন্ম ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। এটি আমাদের দেশের বাড়ি ছিল। আমার দাদার বাবা ওখানেই বসবাস করা শুরু করেন। সে হিসেবে আমরা জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। দেশভাগের পর আমরা চলে আসি এখানে, নীলফামারিতে, ১৯৪৮ সালে। আমি তখন খুবই ছোট। কথাগুলো মা-বাবার মুখে শুনেছি। শুনেছি তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। আমার বাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না এদিকে আসার। তিনি কিছুটা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আনিসুজ্জামান: আপনার বাবা পেশায় কী ছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: তখনো আসলে বাবা পেশাজীবনে প্রবেশ করেন নি। শিক্ষাজীবন শেষ করে কী করবেন এটা নিয়ে ভাবছিলেন। আবার ওদিকে বামপন্থী রাজনীতির পাশাপাশি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গেও ছিলেন। আমি তাঁকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে কী জন্য যুক্ত ছিলেন? তখন তাঁর যুক্তিটা এরকম ছিল যে, অধিকাংশ জমিদার ছিল হিন্দু আর মুসলমানেরা ছিল কৃষক। তাঁর একটা ধারণা হয়েছিল যে হয়তোবা পাকিস্তানে মুসলমানেরা ভালো থাকবে। জমিদারের অত্যাচারটা কমবে। জমিজমা ছিল, তাই হয়তো তাঁর চাকরির তাগিদও ছিল না ওই মুহূর্তে।
জলপাইগুড়িতে আমরা যে বাসায় থাকতাম, তার পাশের বাসায় থাকতেন আমার বাবার ফুপা। তিনি ছিলেন পেশায় পেশকার। তাঁদের পরিবারটা দাঙ্গায় নিহত হয়, ১৯৪৮ সালে। ওই পরিস্থিতিতে আর থাকার সাহস পান নি বাবা। চলে আসেন এই দেশে। এত বড় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পরেও আমার মা-বাবা দুজনেই অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন স্কুলে।
আনিসুজ্জামান: ভাইবোন ক’জন?
আসাদুজ্জামান নূর: আমরা দুই ভাই, এক বোন। ছোটভাইকে আপনি চেনেন। আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। আমার বোনকেও আপনি দেখেছেন। কাওসার আফসানা।
আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, আমি দুজনকেই ভালো করে চিনি। আপনি স্কুলে পড়েছেন কোথায়?
আসাদুজ্জামান নূর: নীলফামারীতে। প্রাইমারি স্কুলে আমার খুব একটা পড়া হয় নি। একেবারে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছি। আমার ভাইও পরে আমাকে অনুসরণ করেছে। আমার ছোটবোনও একেবারে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে।
আনিসুজ্জামান: নীলফামারীতে কতদূর পড়লেন?
আসাদুজ্জামান নূর: বিএ পর্যন্ত। মাঝখানে অবশ্য আমি দুই বছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছি। এখানে পড়ার এক কাহিনি আছে স্যার। আমি নীলফামারী কলেজেই ভর্তি হয়েছিলাম, আমাদের নীলফামারীর যাঁরা মুরব্বি, আমার বাবাও ছিলেন, তাঁরা সবাই মিলে সেই কলেজটা করেছিলেন। তাঁদের সবারই একটা চেষ্টা ছিল যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা যেন ওখানেই পড়ে। তখন তো এরকম বড় বড় নামকরা কলেজে পড়ার প্রবণতা ছিল না। সব জায়গায় মোটামুটি ভালো শিক্ষক ছিলেন। আমাদের নীলফামারী কলেজে ওই সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন এমাজউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলারও হয়েছিলেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে বেশ ভালো ছিলেন। কিন্তু কলেজে কী হলো না হলো জানি না। কমিটির মধ্যে হয়তো কোনো গণ্ডগোল হয়েছিল, সেই গণ্ডগোল কলেজ পর্যন্ত গড়ালো। এমাজউদ্দিন সাহেবকে কলেজ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। তখন আমরা যারা এমাজউদ্দিন সাহেবের খুব ভক্ত ছিলাম তারা প্রতিবাদস্বরূপ সিদ্ধান্ত নিলাম এই কলেজে পড়বই না আর। আমি চলে গেলাম রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। কারমাইকেল কলেজে গিয়ে যেটা হলো, হোস্টেলে থাকতাম, মুক্ত জীবন, সিনেমা দেখা আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। লেখাপড়ার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নেই আর কি। ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলো। বাবা বললেন, ফিরে এসো। নীলফামারীতে কলেজে ভর্তি হলাম আবার। ওইখানে গিয়েও রাজনীতির সঙ্গে জড়ালাম। ওখানেও ছাত্রসংসদ নির্বাচন করলাম। নির্বাচনে জয়ী হয়ে জেনারেল সেক্রেটারি হলাম।
আনিসুজ্জামান: তারপরে নীলফামারী কলেজ থেকে ঢাকায় এলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: ঢাকায় আসি ১৯৬৬ সালে। এখানে ল’ পড়লাম। কেননা বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন ল’ পড়ি।
আনিসুজ্জামান: কোথায় পড়লেন?
আসাদুজ্জামান নূর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনের বেলার পাশাপাশি সন্ধ্যাবেলায়ও আইনের ক্লাস হতো। আর তখন ডিন ছিলেন নূরুল মোমেন সাহেব। তিনি আমার ইন্টারভিউ নিলেন। আমার রেজাল্ট দেখে বললেন, তোমার এমন উত্থান-পতন কেন? আগেই বলেছি, আমার ইন্টারমেডিয়েটের রেজাল্ট খুবই খারাপ হয়েছিল। যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। নূরুল মোমেন সাহেবের নির্দেশনায় নাটকও করেছিলাম।... ল’ পড়ার ইচ্ছেটা আমার একেবারেই ছিল না। তবে ওই সময় একটা ব্যাপার ছিল যে বড় বড় পলিটিশিয়ানরা সবাই ল’ইয়ার ছিল। ওই চিন্তা থেকেই বাবার ইচ্ছা ছিল আমি যেন আইন পড়ি। পরে পলিটিক্যাল সাইন্সে ভর্তি হয়েছিলাম।
আনিসুজ্জামান: ল’ প্র্যাকটিস করার কোনো ইচ্ছে ছিল না?
আসাদুজ্জামান নূর: না। করিও নাই। যা’হোক আবার ছাত্র থাকার জন্য পলিটিক্যাল সাইন্সে ভর্তি হলাম। পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা দিয়ে পাসও করলাম। কিন্তু সেকেন্ড পার্ট আর দেওয়া হয় নি। তখন তো যুদ্ধ বেধে গেল। তাই যুদ্ধে চলে গেলাম। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আর পড়াশোনা হলো না। পড়াশোনায় যে খুব মনোযোগ ছিল তাও না।
আনিসুজ্জামান: সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন নীলফামারী থেকেই?
আসাদুজ্জামান নূর: কমবেশি ওখান থেকেই। স্কুলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তো ছিলই। তখন আমরা স্কুলের কমপাউন্ডের ভেতরেই থাকতাম। ওটা মেয়েদের স্কুল। মা-বাবা দুজনেই গার্লস স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সকালে স্কুল শুরুই হতো গান দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গান, দেশাত্মবোধক গান। মা-বাবারও এদিকে আগ্রহ ছিল। স্কুলে প্রায়ই নাটক এটা-সেটা লেগে থাকত। পরে আস্তে আস্তে আমার নিজের ভেতরেও আগ্রহ তৈরি হলো।
আনিসুজ্জামান: তখন থেকেই কি আপনি আবৃত্তি করতে আরম্ভ করেন?
আসাদুজ্জামান নূর: আবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ি অনেক পরে। আসলে আবৃত্তি করতাম বাবার জন্য। তারচেয়েও বেশি আমার আরেক শিক্ষকের জন্য। তাঁর নাম সুনীল রতন ব্যানার্জী। তিনি ছিলেন স্কুলের খেলাধুলার শিক্ষক। কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও আগ্রহের সঙ্গে করতেন। তিনিই আমাকে দিয়ে আবৃত্তি করাতেন। তবে তখন ওভাবে নিয়মিত আবৃত্তি করার বিষয়টি ছিল না।
আনিসুজ্জামান: ঢাকায় এসে?
আসাদুজ্জামান নূর: ঢাকায় এসেও আবৃত্তি করি নি। আবৃত্তি করা শুরু করেছি আসলে স্বাধীনতার পর।
আনিসুজ্জামান: স্বাধীনতার সময়ে আপনি কোথায় ছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: তখন আমি ভারতে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পরে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে যার যার এলাকায় গিয়ে সবাইকে সংগঠিত করতে। আমি তখন চলে গেলাম নীলফামারীতে, গিয়ে ছাত্রসংসদের সবাই মিলে থানা দখল করলাম, ১৪ মার্চ। এরপরে, তারিখটা ঠিক আমার মনে নাই, সীমান্ত থেকে তখনকার ইপিআর, যারা বিদ্রোহ করেছে পাকিস্তানিদের মেরে, ওরা দিনাজপুর সীমান্তের দুই দিক দিয়েই সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। একটা দল দিনাজপুরে দশমাইল বলে একটা জায়গা আছে, ওখানে একটা ঘাঁটি করে, আরেকটা দল দেবীগঞ্জ দিয়ে এসে নীলফামারীতে একটা ঘাঁটি করে। আমরা ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে যেটা হলো যে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মি ট্যাঙ্ক নিয়ে আসে ৮ এপ্রিল। ৭ এপ্রিল আমি আবার ভারতে গিয়েছিলাম। কারণ আমাদের ইপিআর-এ যারা ছিলেন, তাদের গাড়িতে পেট্রোল ছিল না। তখন এস.ডি.ও ছিলেন মুয়ীদ চৌধুরী (ব্র্যাকে ছিলেন অনেকদিন)। তাঁর গাড়ি নিয়ে আমরা চলে যাই ভারতে, পেট্রোল নিয়ে আসার জন্য। তখন তো বর্ডার মোটামুটি খোলা ছিল। আমরা গেলাম জলপাইগুড়িতে। এদিক দিয়ে আগে দার্জিলিং মেইল যেত। ৮ এপ্রিল যখন আবার ফিরে এলাম, তখন দেখলাম শহরে গোলাগুলি চলছে। মানুষজন ছোটাছুটি করে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। ইপিআর-এর একজন সৈনিকের পায়ে গুলি লেগেছিল। ওকে আমরা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে আবার ভারতে চলে গেলাম। জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম। পরে অবশ্য আর সেই হাসপাতালে যাওয়া হয় নি।
আনিসুজ্জামান: আপনাদের পুরো পরিবার চলে গেল?
আসাদুজ্জামান নূর: না, আমি একা। পরিবারের সঙ্গে প্রায় আড়াই-তিন মাস কোনো যোগাযোগ ছিল না।
আনিসুজ্জামান: আপনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
আসাদুজ্জামান নূর: যেহেতু বাবা একটু রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেহেতু আমারও আগ্রহ ছিল। নীলফামারীতে যারা ছাত্ররাজনীতি করতেন, তারা আমাকে একটু টানাটানি করে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। প্রথম প্রথম যা হয় আর কী। যাহোক একটু যাওয়া-আসা করতে করতে আমার ভেতরেও তখন একটু আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করল। পরে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিলাম এবং ইলেকশনও করলাম নীলফামারী কলেজ থেকে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ইলেকশন করেছিলাম। তখন তো পার্টির নামে ইলেকশন হতো না। অন্য নামে—প্রগতি, অভিযাত্রী— এইসব নামে হতো। আমাদেরটার নাম ছিল প্রগতি। কলেজের নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলাম। ঢাকায় এসে আবার ছাত্র ইউনিয়ন করা শুরু করলাম। এখানে সম্ভবত ’৬৮ কিংবা ’৬৯ সালে আমি সেন্ট্রাল কমিটির কাউন্সিল সেক্রেটারি হলাম। আবার সংস্কৃতি সংসদের সভাপতিও হলাম। আবুল হাসনাত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। পরের কমিটিতে আবুল হাসনাত সভাপতি আর মাহফুজ আনাম (ডেইলি স্টারের সম্পাদক) হলেন সাধারণ সম্পাদক।
আনিসুজ্জামান: মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ভারতে কাটল?
আসাদুজ্জামান নূর: হ্যাঁ আমরা প্রথমে যে জায়গায় গিয়ে উঠলাম, সেটা একেবারে অজ পাড়াগাঁ। সীমান্তে দেওয়ানগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে, কুচবিহারের, সেখানে গিয়ে উঠেছিলাম।
পরে ঘুঘুডাঙা নামে এক গ্রামে ক্যাম্প করা হলো। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে প্রশিক্ষণে বাছাইকরা ছেলেদের পাঠানো হতো। আবার ফিরে এসে গেরিলা অপারেশনে যেত। একেবারে সীমান্তের সঙ্গে। দেওয়ানগঞ্জ গ্রামটির কথা আমার এখনো মনে হয় এইজন্য যে, হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করেছিল একদম সহায় সম্বলহীন। দেওয়ানগঞ্জের মতো একটা ছোট্ট গ্রাম, সেখানকার মানুষ তখন যেভাবে সাহায্য করেছিল সেটা অভাবনীয়। অথচ এই কথাগুলো কখনো লেখা হয় না।
আনিসুজ্জামান: মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি রয়েছে?
আসাদুজ্জামান নূর: কোন স্মৃতি নিয়ে বলব! অনেক স্মৃতি আছে। একটা তো বললাম। আরেকটা ঘটনার কথা বলি। এটা সবার জানা উচিত। সেটা হলো আমরা ৭ এপ্রিল ইন্ডিয়া গেলাম বর্ডার ক্রস করে। কিন্তু ৮ এপ্রিল ঢুকতে পারি নি বাংলাদেশে। আমি পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে ছিলাম। তখন আমাদের ছোট শহরগুলিতে লুঙ্গি পরা চল ছিল। বরং পায়জামা পরলে লোকজন ঘুরে তাকাত—ওরে বাবা পায়জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এরকম একটা ব্যাপার ছিল। আমার পকেটে ছিল আট টাকা। ব্যাপারটা আমার মনে আছে। আমার মার খুব অ্যাসিডিটির প্রবলেম ছিল। সিভিকো নামে একটা ওষুধ পাওয়া যেত লিকুইড আকারে। বিদেশ থেকে ইমপোর্টেড হতো। আট টাকা এক বোতল। আট টাকা তখন অনেক টাকা। ওই টাকাটা আমার পকেটে ছিল। ওই টাকা নিয়ে আমি সীমান্ত অতিক্রম করি। প্রথম দিকে একদিন দুইদিন খাবার চলেছে। আট টাকা দিয়ে শুধু আমি একা চলি নি, সবাই ভাগাভাগি করে যার কাছে যা আছে সেটা দিয়ে খাবার কিনে খেয়েছি। তারপর তো একেবারে খারাপ অবস্থা। এমন সময় আমরা খবর পেলাম জলপাইগুড়িতে মশিউর রহমান যাদু মিয়া এসেছেন। তাঁর বাড়ি কিন্তু আমাদের সীমান্ত এলাকায়। ডিমলায়। গ্রামের নাম খগাখড়িবাড়ী। সেখানে যাদু মিয়ার পৈতৃক বাড়ি। ওঁদের এখনো জমিজমা আছে। তখন পর্যন্ত ওই জায়গায় পাকিস্তানি আর্মি যায় নি। ইপিআর-এ যেসব অবাঙালি ছিল তারা তো কেউ বেঁচে নেই। সীমান্ত আসলে খোলা ছিল। তো আমরা গিয়ে যাদু মিয়ার সঙ্গে দেখা করলাম। আমার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতারাও ছিলেন। আমার বাবার পরিচয় দিলাম। যেহেতু বাবা ভাসানী ন্যাপপন্থী ছিলেন। উনি চিনলেন, বললেন, কী ব্যাপার ? আমরা তখন খাবারের সংকটের কথা জানালাম। আমরা তখন জানিও না, বুঝতেও পারছি না, কী করব। কারণ তখন তো কারও সঙ্গেই যোগাযোগ হচ্ছে না। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ি গিয়ে গরুর গাড়িতে করে তোমাদের জন্য কিছু চাল-ডাল পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমরা থাকো। তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করছি। তাঁর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আমরা তখন অপেক্ষা করতে লাগলাম। কয়েকদিন পর খবর পেলাম, তিনি রংপুরে গিয়ে জনসভা করছেন পাকিস্তানের পক্ষে। তারপর তো পুরোটা সময় পাকিস্তানেই ছিলেন। ভারতে ছিলেন ৭ থেকে ১০ দিন। যাদু মিয়ার এই ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাস এখন কেউ বলে না। তাঁর এলাকার লোকজন এখনো ঠিকমতো জানে না তাঁর এই ঘটনার কথা। অথচ তাঁর নামে সেখানে কলেজ হয়েছে। মশিউর রহমান কলেজ। যাই হোক তিনি তো আমাদের এইভাবে ধাপ্পা দিলেন। গরুর গাড়িতে করে আর চাল-ডাল এল না। তারপর তো আমরা সংগঠিত হলাম।
এখানে সেই সময়ের গ্রামের ছেলেদের সাহসের কথা বলি— যেটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। নিরক্ষর কৃষকের ছেলে, নিজেও প্রায় নিরক্ষর, সে যুদ্ধে চলে গেছে। আঠারো বছর, কুড়ি বছর, বাইশ বছর বয়স। তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ক্যাম্পে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা কেন যুদ্ধে যাচ্ছ? তারা বলেছে যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যুদ্ধে যেতে। এই কথাগুলো এক শ’ ভাগ সত্য। তারা আরও বলল, বঙ্গবন্ধু বলছে দেশ স্বাধীন হলে এই দেশে আর গরিব মানুষ থাকবে না। কারণ ওই সময় গরিবি বিরাট সমস্যা ছিল। মানুষেরা ছিল হতদরিদ্র। তেভাগা আন্দোলন তো ডিমলা অঞ্চল জুড়েই হয়েছিল। এই যাদু মিয়া গুলি চালিয়েছিল মণিকৃষ্ণ সেনের ওপরে। এটা নিয়ে গানও আছে। একটা বইয়ে আছে এই গানটি। ...বলছিলাম গ্রামের ছেলেদের কথা। একাত্তরে ওদের অসম সাহস দেখেছি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল। দশটা মাত্র গুলি থাকে। এটা নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে। ভাবা যায় না।
আরেকটা ঘটনা বলি। তখন আমরা একটা জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাব। যে আমাদের পথ দেখাচ্ছে সে পথ ভুল করে। দেখা গেল রাতের মধ্যে ওই জায়গায় আর পৌঁছতে পারব না। সকাল হয়ে যাবে। কী করা যায়? তখন আমাদের দলেই একজন ছিল। সে জানাল, তার পরিচিত একজনের বাড়ি আছে ওখানে। সে-ই গিয়ে খবর নেয়। ফিরে এসে জানায় এখানে থাকা যাবে। এই যে একটা বাড়িতে থাকলাম, পুরুষদের কথা বাদ দিলাম। সেই বাড়ির মহিলাদের দেখে মনে হলো যে ব্যাপারটা যেন স্বাভাবিক, কোনো কিছু ঘটে নি, এতগুলো মানুষ রয়েছে অস্ত্রশস্ত্রসহ, এগুলি তেমন কোনো ব্যাপারই না। তারা তাদের দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে। গরুর খাবার দিচ্ছে, মুরগির খাবার দিচ্ছে, রান্নাবান্না করছে। তারা সবাই স্বাভাবিক। এটা ভাবতে আমার এখনো অবাক লাগে।
আনিসুজ্জামান: এটা কি আপনাদের অঞ্চলে?
আসাদুজ্জামান নূর: হ্যাঁ আমাদের অঞ্চলে। একটু ভুল হলে, কোনোভাবে সংবাদটা প্রচার হয়ে গেলে কত বড় বিপদ ঘটতে পারত। আমাদের কথা বাদই দিলাম। ওদেরও তো পাকিস্তানি আর্মি শেষ করে দিত। এরকম অনেক স্মরণীয় ঘটনা আছে। আসলেই এটা জনযুদ্ধ ছিল। এই যে যত ইনফরমেশন, খবর সংগ্রহ— এগুলো অল্প বয়সের বাচ্চারাই করত। আমাদের এখানে এমনও ঘটনা আছে যে ব্যাগের মধ্যে গ্রেনেড নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে ওরা।
আনিসুজ্জামান: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনি আবার নীলফামারীতে চলে এলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: আমরা নীলফামারীতে ঢুকলাম ১৪ ডিসেম্বর। নীলফামারী সেদিন স্বাধীন হয়েছে। তখনো আমরা ঢাকার খবর পাই নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার খবরও জানি না। তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড় ওই দিক দিয়ে তো ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকল ট্যাঙ্ক, অস্ত্রশস্ত্র সবকিছু নিয়ে। আর আমরা ঢুকলাম এদিক দিয়ে। আমাদের কমান্ডার একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন। নাম ইকবাল রশীদ। সে ছিল আমাদের কমান্ডে।
আনিসুজ্জামান: তারপর ঢাকায় এলেন কবে?
আসাদুজ্জামান নূর: ঢাকায় এসেছি অনেক কষ্ট করে। কারণ তখন তো রাস্তাঘাট একেবারে ভাঙাচোরা। আমার মা যেহেতু স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন, ওই স্কুলের একটা মাইক্রোবাস ছিল। সেই মাইক্রোবাসে চড়ে।
আনিসুজ্জামান: আপনার পরিবার তো ভারতে চলে গিয়েছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: না। প্রথমদিকে প্রায় মাসখানেক শহরের বাইরে ছিল। পরে চলে আসে।
আনিসুজ্জামান: মাসখানেক তারা কোথায় ছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: গ্রামেই। তারপর তারা আবার বাড়ি ফিরে আসেন। আমার মা-বাবার একটা সুবিধা ছিল যে, তাঁদের কাছ থেকে সবাই উপকার পেয়েছেন বলেই হয়তো তাঁদের কোনো বিপদ হয় নি! আর আমার এক বন্ধু ছিল অবাঙালি। শহরের উপকণ্ঠে ওরা থাকত। সে আমার পরিবারকে মোটামুটি প্রটেকশন দিয়ে রেখেছিল। ও ছাত্র ইউনিয়ন করত। ওকে নিয়ে দুঃখজনক গল্প আছে। ওর বাবা খুবই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাঁকে কখনো আমি শার্ট পরা অবস্থায় দেখি নি। কখনোই কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। কৃষিকাজ করতেন। দেখতাম সারাক্ষণ খেতের মধ্যে নিড়ানি দিচ্ছেন, কাজ করছেন। লেখাপড়া জানতেন না। খুব দরিদ্র একটা পরিবার। সেই পরিবারের ছেলে আমার বন্ধু লতিফ। অবাঙালি কিন্তু আমাদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করত। এই যে সৈয়দপুরের রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া, গাছ কাটা—সবকিছুই আমাদের সঙ্গে করত। ইপিআর যখন নীলফামারীতে ঢুকল, লতিফের বাবাকে মারল। এটা আমাদের জন্য একটা পেইনফুল এক্সপেরিয়েন্স ছিল। কিন্তু লতিফের গ্রেটনেসটা হলো, সে তো এটার প্রতিশোধ নিতে পারত, কিন্তু সে কোনো অঘটন ঘটায় নি। বরং আমাদের পরিবারকে লতিফই দেখে রেখেছে। যার ফলে স্বাধীনতার পর লতিফের কোনো অসুবিধা হয় নি। ছিল আমাদের সঙ্গেই। বছর দুয়েক হলো লতিফ মারা গেছে।
আনিসুজ্জামান: ঢাকায় এসে আপনি কীভাবে জীবন আরম্ভ করলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টিতে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যোগ দিলাম। কিন্তু যখন বাকশালে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, আমি এটার বিরোধিতা করলাম। আমি বললাম, এটাতে আমি একমত না। তখন মতপার্থক্য হলে আমি পার্টির সঙ্গে একেবারে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। ফরহাদ ভাইয়ের (কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ) সঙ্গে এটা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা হয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম, আপনারা আমাদের সারা জীবন শেখালেন একধরনের রাজনীতির কথা। এখন দেখছি আরেক ধরনের। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কেননা মুক্তিযুদ্ধের শক্তি একসঙ্গেই থাকে। মুক্তিযুদ্ধের আগেও আমরা একসঙ্গে ছিলাম আন্দোলন-সংগ্রামে। সেই একইভাবে আমরা থাকতে পারতাম। কিন্তু এভাবে থাকার ব্যাপারে আমি একমত ছিলাম না। আমি যখন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করি, সত্যি কথা বলতে কী আমি তখন সর্বক্ষণ থাকতে পারি নি। কারণ তখন ফ্যামিলি প্রেসারটা বেড়ে গিয়েছিল। মানে সংসার চালানোর ব্যাপারটা। ‘বিটপী’তে আমি চাকরি নিলাম। বিটপীর ‘বারিধি মুদ্রায়ন’ বলে একটি ছাপাখানা করেছিল তোপখানা রোডে। ওই ছাপাখানায় আমার কাজ। সামান্য বেতনের চাকরি। তারপরে ওখান থেকে আমি দেড় বছর পরে সোভিয়েত এম্বাসির প্রেস ডিপার্টমেন্টে যোগ দিলাম। শামসুদ্দিন ভাই সেখানে ছিলেন। আমার ডিরেক্ট বস ছিলেন শহীদ কাদরী। হাই ভাইও ছিলেন। তখন খুব ভালো একটা সময় কেটেছিল শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। শহীদ ভাই অফিস করতেন না ঠিকমতো। আটটার অফিস আসতেন এগারোটায়। এসে ডায়েরিটা টেবিলের ওপর ছুড়ে দিতেন। তার তো মুখ ভালো ছিল না। অশ্রাব্য গালাগালি দিতেন চাকরির কথা উল্লেখ করে। তারপর এক-দুই ঘণ্টা থেকে হাই ভাইকে বলে চলে যেতেন। এটা নিয়ে দু-একজন ক্ষুব্ধ ছিল। তারা অভিযোগ জানাল। ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের বস তখন কোলবেতস্কি। তার কাছেই নালিশ দিয়েছিল। তিনি নাকি অনেকক্ষণ শুনে তারপর জবাব দিয়েছেন, ওয়েল হি ইজ এ পোয়েট। যদিও কথাটি আমার নিজ কানে শোনা না। যা হোক শহীদ কাদরীর সাত খুন মাফ। ওই সময় শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে শহীদ ভাই তো দেশের বাইরে চলে গেলেন।
আনিসুজ্জামান: এর মধ্যে আপনার অভিনয়জীবন শুরু হলো?
আসাদুজ্জামান নূর: আমি যখন ছাপাখানায় কাজ করতাম, তখন আজাচৌ (আহমেদ জামান চৌধুরী) আসতেন। চিত্রালীর তৎকালীন সহকারী সম্পাদক। কপি লিখতেন। রামেন্দুদাও ছিলেন। আমি বললাম, আমিও দু-একটা কপি লিখি। তা কপি লিখলে আমারও দু-একটা গ্রহণ করতেন। এখানে আজাচৌ’র সঙ্গে আমার বেশ একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। তিনি বললেন, তুমি এক কাজ করো, চিত্রালীতে লেখ। তিনি আমাকে চিত্রালী অফিসে নিয়ে গেলেন। এসএম পারভেজ তখন সম্পাদক। পারভেজ ভাই বললেন, এখন তো বাংলাদেশে নাটক হচ্ছে (তখন টিএসসিতে কেবল দু-একটা নাটক হচ্ছে)—এটা ১৯৭২ সালের শেষের দিকের কথা। আমাকে পারভেজ ভাই বললেন, তুমি কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নাও। কয়েকজনের নাম দিলেন—আলী যাকের, বজলুল করিম, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং লায়লা সামাদ। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিলাম। সেই সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম— প্রথমবার যখন তিনি বাংলাদেশে সস্ত্রীক এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছবিও আছে আমার। যা হোক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আলী যাকেরের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আলী যাকের আমাকে বললেন, আমরা তো ‘বাকী ইতিহাস’ বলে একটি নাটকের মহড়া করছি। এই নাটক দিয়ে আমরা নিয়মিত মঞ্চে কাজ করা শুরু করব টিকিট বিক্রি করে। আপনি রিহার্সেল দেখতে আসেন, সাংবাদিক হিসেবে। আলী যাকের তখন থাকেন রাজারবাগে। আমি রিহার্সেল দেখতে গেলাম একদিন। গিয়ে দেখি আতাউর রহমান, আবুল হায়াত, গোলাম রব্বানী, তামান্না—এরা সবাই বসে আছে। এছাড়া আরও ছিলেন ড. ইনামুল হক, লাকী ইনাম। এঁদের তো আমি চিনি আগে থেকেই। কারণ স্বাধীনতার আগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে যে নাটকগুলোর আয়োজন করেছি, তখন তো বিভিন্ন জায়গা থেকে সবাইকে ডেকে এনে নাটক করতে হতো, তখন থেকে ওঁদের সঙ্গে পরিচয়। আবুল হায়াতও ছিলেন। আমাকে দেখে সবাই বলল— এই যে প্রম্পটার পাওয়া গেছে। তখন আমাকে প্রম্পটিং-এ লাগিয়ে দিল সবাই মিলে। ইতিমধ্যে আমি রামেন্দুদার সঙ্গে থিয়েটার পত্রিকা বের করছি। সেটির আমি সহ-সম্পাদক ছিলাম। একদিন আমাকে আলী যাকের বললেন, আপনি গ্রুপে জয়েন করেন। তখন আমি রামেন্দুদার কাছে গেলাম। কারণ তিনি আমাকে বলেছেন তাঁরা নাটকের দল শুরু করতে যাচ্ছেন। আমি রামেন্দুদাকে বললাম, আমাকে ওই দলে যোগ দিতে বলছে, আমি কী করব ? রামেন্দুদা বললেন, না না তুমি আমাদের নাটকের দলে যোগ দেবে। ফেরদৌসী আপা তখন বললেন, কেন তুমি ওকে আটকাচ্ছো? তুমি কবে দল শুরু করবে সেটা পরের ব্যাপার। ও করুক না ওখানে কাজ, তাতে কী অসুবিধা! ফলে আমি চলে গেলাম নাগরিকে। এভাবে নাগরিকে আমার যাত্রা শুরু হলো।
আনিসুজ্জামান: প্রথম অভিনয় কোন নাটকে?
আসাদুজ্জামান নূর: প্রথম অভিনয় করলাম আবুল হায়াতের নাক ফাটার কল্যাণে। সেটা ছিল ‘তৈল সংকট’ নাটক। রশীদ হায়দারের লেখা। তখন তো কেরোসিন তেলের সংকট ছিল, সেটি নিয়ে নাটক। একটা মারামারির দৃশ্য ছিল। ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাদল রহমানের (মারা গেছেন) ঘুষি লেগে আবুল হায়াতের নাক ফেটে গেল রিহার্সেলের সময়, এমনভাবে নাক ফেটে গেল যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। অথচ একদিন পরেই নাটক। এখন কী করা যায়? বিজ্ঞাপন চলে গেছে পত্রিকায়। আলী যাকের পরিচালক বললেন, নূরকে নামিয়ে দেওয়া হোক। ও প্রম্পট করে, ওর নাটকটি মোটামুটি মুখস্থ আছে। প্রধান নারী চরিত্রে ছিলেন সুলতানা কামাল লুলু। ফলে আমি দিনরাত রিহার্সেল করে নেমে গেলাম মঞ্চে। এভাবে আমি নিয়মিত অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেলাম। তখন ১৯৭৩ সাল। এর আগে— স্বাধীনতার আগে—সংস্কৃতি সংসদেও নাটকে অভিনয় করেছি। যেমন ‘রক্তকরবী’ নাটকে আমি কিশোরের ভূমিকায় ছিলাম। বাংলা একাডেমিতে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। তারপর ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’ করা হয়েছিল। সেটাতেও ছিলাম। তবে আমি যেহেতু সাংগঠনিক কাজ করতাম সেহেতু বড় চরিত্র আমাকে দেওয়া হতো না। আমিও সিরিয়াসলি অভিনয়ের কথা ভাবতাম না।
আনিসুজ্জামান: আপনি আবৃত্তি করতেন না?
আসাদুজ্জামান নূর: না। আবৃত্তি শুরু হলো এভাবে যে, ১৯৭২ সালে কলকাতায় একটা মৈত্রী মেলা হয়েছিল। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী মেলা। সেখানে আমাদের অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক গিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতি সংসদের টিম নিয়ে আমরাও গিয়েছিলাম। সেখানে একটি গীতিনাট্য ছিল। আবুল হাসনাতের লেখা। ধারাবর্ণনাটা আমি করেছিলাম। এটা করার পরে একটা স্বীকৃতির মতো পেলাম যে আমি আবৃত্তি করতে পারি। তখন থেকেই আবৃত্তির ব্যাপারটি একটু একটু শুরু হলো।
আনিসুজ্জামান: আপনি নাগরিকের হয়ে নাটক আরম্ভ করলেন, তারপর অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে আর কিছু পারফর্ম করলেন কি?
আসাদুজ্জামান নূর: না, মঞ্চনাটক যা করেছি সব নাগরিকের। আর পাশাপাশি টেলিভিশনে কাজ শুরু করলাম, ১৯৭৪ সালে।
আনিসুজ্জামান: টেলিভিশনে প্রথম নাটক কোনটা?
আসাদুজ্জামান নূর: ‘রঙের ফানুস’। আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক। ছোট্ট একটা চরিত্র ছিল। দুই-আড়াই মিনিটের। এই দিয়ে শুরু।
আনিসুজ্জামান: আর সিনেমায়?
আসাদুজ্জামান নূর: সিনেমায় প্রথম শর্টফিল্মে। নাম ‘হুলিয়া’। পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার চলচ্চিত্ররূপ।
আনিসুজ্জামান: তারপর?
আসাদুজ্জামান নূর: ‘হুলিয়া’র পর করলাম সম্ভবত ‘দহন’। শেখ নিয়ামতের ছবি। এতে আমি আর ফরিদী ছিলাম। এরপর করলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’। তারপরে অনেকদিন সিনেমাতে অভিনয় করি নি।
আনিসুজ্জামান: ‘শঙ্খনীল কারাগার’ করতে গিয়েই কি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ?
আসাদুজ্জামান নূর: না। হুমায়ূনের সঙ্গে যোগাযোগ টিভি নাটক করতে গিয়ে। প্রথমে একটা নাটক করলাম। সেটা এক পর্বের নাটক ছিল। এটা দিয়েই শুরু। তারপর হুমায়ূন আহমেদের যত টিভি সিরিয়াল হয়েছে বিটিভিতে, আমি তার প্রতিটিতেই ছিলাম। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’— এগুলি বিটিভির প্রযোজনা ছিল। পরে যখন ওর নিজের প্রযোজনায় বিটিভিতে দেখিয়েছে যেমন, ‘আজ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’ এগুলোতেও ছিলাম। তারপর ওর ছবি করলাম ‘আগুনের পরশমণি’, ‘চন্দ্রকথা’। ‘দারুচিনি দ্বীপ’-এর অতিথি চরিত্রেও অভিনয় করেছি।
আনিসুজ্জামান: আপনি তিন মাধ্যমে অভিনয় করছেন। আপনার নিজের কাছে কোন মাধ্যম বেশি পছন্দ?
আসাদুজ্জামান নূর: মঞ্চ এক নম্বরে। দুই নম্বরে টেলিভিশন, তিন নম্বরে সিনেমা। সিনেমা নিয়ে আমার একটা নার্ভাসনেস আছে। আমি তো পাঁচ ফুট পাঁচ, তাই আমার মনে হয়, অত বড় একটা স্ক্রিনে আমাকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আনিসুজ্জামান: আপনার অভিনয়জীবনের একটা বড় অংশ টেলিভিশনে।
আসাদুজ্জামান নূর: সাধারণ মানুষ আমাকে টেলিভিশন থেকে চেনে। কিন্তু আমি নিজে মনে করে থাকি যে, অভিনয় যদি ভালো করে থাকি সেটা মূলত মঞ্চেই করেছি।
আনিসুজ্জামান: আপনার নিজের প্রিয় মঞ্চনাটক কোনটি?
আসাদুজ্জামান নূর: কয়েকটা আছে, স্যার। ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ আমার নিজের প্রিয়। তা ছাড়া ‘ওয়েটিং ফর গডো’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’।
আনিসুজ্জামান: টেলিভিশনে?
আসাদুজ্জামান নূর: টেলিভিশনে নিজের পছন্দ ‘অয়োময়’। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’। মানুষের কাছে এখনো জনপ্রিয় সেই নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি। কিন্তু আমার নিজের কাছে ‘অয়োময়’— যেটি স্ক্রিপ্ট, চরিত্র সবদিক থেকেই পারফেক্ট— ‘অয়োময়’-এর জমিদারের চরিত্র যখন করলাম তখন টেলিভিশনের একজন সিনিয়র প্রডিউসার আমাকে বললেন, ‘তুমি যে নাটকটা করতে যাচ্ছ, তাতে জমিদারের চরিত্রে তোমাকে মানাবে না। জমিদার হবে গোলাম মুস্তাফা, আলী যাকের-এর মতো লম্বাচওড়া মানুষ।’ আমি খুব টেনশনে পড়ে গেলাম। এ রকম সিনিয়র প্রডিউসার বলছেন এ কথা! বসে বসে চিন্তা করতে লাগলাম, জমিদারদের জীবনটা কেমন ছিল? খুব অনিয়ম, উশৃঙ্খলতায় ভরা ছিল। প্রচুর মদ্যপান করতেন, রাত জেগে বাইজিদের গান শুনতেন। এদের তো স্বাস্থ্য ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। আমি হুমায়ূনের সঙ্গে এটা নিয়ে আলাপ করলাম। হুমায়ূন যে চরিত্রটা তৈরি করেছিল, ওই লোকটা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে যেত। আমি তখন পরে, বিটিভির সেই সিনিয়র প্রডিউসারকে বললাম, একজন জমিদারকে লম্বাচওড়া হতে হবে কেন? বললাম, নেপোলিয়নের উচ্চতা কত ছিল? এত বড় যোদ্ধা তৈমুর লঙ কত লম্বা ছিল? তার তো পা-ই খোঁড়া ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমি একটু অসুস্থ, একটু খেয়ালি, একটু জেদি এ রকম একটা চরিত্র তৈরি করার চেষ্টা করলাম ‘অয়োময়’-এ।
আনিসুজ্জামান: বাকের ভাইয়ের চরিত্রে যে এত সাড়া পেলেন— এটা কি প্রত্যাশা করেছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: না। শুরুতে এতটা ভাবি নি আসলে।
আনিসুজ্জামান: ওই যে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে মিছিল করেছে লোকজন।
আসাদুজ্জামান নূর: এই বাকের ভাইয়ের চরিত্র যখন করি তখনো আমাকে একজন সিনিয়র প্রডিউসার বলেছেন, না, এটা তো তোমাকে দিয়ে হবে না। তোমার চেহারা হলো সফট। স্ক্রিনে এলে ভদ্রলোকের চেহারা মনে হয়। এ দিয়ে মাস্তান হবে না। ...আমি স্যার টেলিভিশনে চেষ্টা করেছি সব ধরনের চরিত্র করার। আমি একদম বাড়ির চাকর থেকে শুরু করে মাস্তান, ডাকাত, খুনি, চোর— নানান ধরনের চরিত্র করার চেষ্টা করেছি।
আনিসুজ্জামান: হিমু?
আসাদুজ্জামান নূর: হ্যাঁ। হিমুও করেছি।
আনিসুজ্জামান: হিমুও তো খুব জনপ্রিয় ছিল?
আসাদুজ্জামান নূর: হিমু যখন শুরু করলাম, তখন হিমুর বয়সটা আরেকটু কম হওয়া দরকার ছিল। তাই হিমু দুটোর বেশি করি নি। টেলিভিশনে নানান ধরনের চরিত্র করে নিজেরও ভালো লাগত।... সব চরিত্র নিয়ে কিছু না কিছু চিন্তা করতে হয়। একটা না একটা অভিজ্ঞতা মাথার ভেতর কিছু না কিছুই থাকেই। সেগুলিই ঘষে মেজে কাজে লাগিয়েছি। বাকের ভাই লোকটাকে আমি দেখেছি। আমি যখন কারমাইকেল কলেজে পড়ি, ইন্টারমিডিয়েটে, তখন সিনেমা দেখার প্রচণ্ড নেশা ছিল। ওখানে ওরিয়েন্টাল সিনেমা নামে একটা হল ছিল। ওই সিনেমা হলের সামনে প্রায়ই একজন ভদ্রলোককে দেখা যেত—একদম রুপালি চুল ঘাড় পর্যন্ত, গায়ের রঙ গোলাপি, চেহারাটা পাঠানদের মতো। পোশাকও পরতেন পাঠানদের মতো। ইজিচেয়ারের ওপর বসে থাকতেন, শুয়ে থাকতেন। সবাই তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, সালাম দিচ্ছে। তিনি সালাম নিচ্ছেন। কারও সঙ্গে কথাও বলছেন। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি ইউসুফ গুণ্ডা। তিনি তো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না। কিন্তু তাকে সবাই ভয় পায়। তার ইয়াং বয়সে ডিসির মেয়ে তার সঙ্গে পালিয়েছিল। এখন বৃদ্ধ বয়সেও হ্যান্ডসাম। আমি ভদ্রলোককে কৌতূহলবশত খেয়াল করলাম। যখনই আমি সিনেমা দেখতে যেতাম, আমি ভদ্রলোককে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। এই পর্যবেক্ষণের বিষয়টি কিন্তু আমার মধ্যে ছিল। মাস্তান মানেই যে সারাক্ষণ হম্বিতম্বি করছে এরকম নয়, মাস্তানদের চরিত্র অন্যরকমও হতে পারে। আমি সেভাবেই চেষ্টা করেছি ওই চরিত্রটা করার জন্য।
আনিসুজ্জামান: আপনি যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রায় সবগুলোতেই খুব অনায়াস সাবলীল একটা ভঙ্গি, কথা বলছেন তার মধ্যে নাটকীয়তা নেই, এটা কি আপনি নিজে থেকেই উদ্ভাবন করে নিয়েছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: আসলে আমার মনে হয় এই জায়গাগুলোতে কিছুটা ভালো ভালো ছবি দেখার প্রভাব রয়েছে। অভিনয় তো আসলে স্বাভাবিক রাখাই উচিত, তাই যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় সেই চেষ্টাই করি।
আনিসুজ্জামান: মানে অসম্ভব পরিমিত।
আসাদুজ্জামান নূর: আমি সেভাবেই চেষ্টা করেছি। তবে চরিত্রের একটা স্টাইল একেকসময় একেকরকম হয়েছে। যেমন বাকের ভাই যখন করেছি তখন একরকম স্টাইল, জমিদার যখন করেছি তখন আরেক রকমের স্টাইল। ভয়েস কোয়ালিটিও দুইটায় দুই রকম ছিল। জমিদারটার ভয়েস সব সময় একটু গম্ভীর, একটু নিচে থাকত। খুব কম হাসতাম। হাসতামই না প্রায়। আমার হাতে একটা আংটি ছিল। সেই আংটিটাকে ব্যবহার করতাম নানাভাবে। এরকম কতগুলো ম্যানারিজমের মধ্যে চরিত্রটা তৈরি হতো। আবার বাকের ভাইয়ে গিয়ে আরেকটা— কথাগুলো রাফ, প্রমিত বাংলায় কথা বলি নি, একটু ভাঙাচোরা, একটু দ্রুত উচ্চারণ করেছি। এইভাবে আর কি। চলাফেরার ভঙ্গির মধ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছি। নাটকের জন্য কিছু কিছু জিনিস করেছি। সবকিছুর পেছনে কিছু না কিছু চিন্তাভাবনা থাকে আর কী।
আনিসুজ্জামান: আপনি যে ধরনের অভিনয় করেছেন, তার আদর্শটা নিজের মনে তৈরি করে নিয়েছেন নাকি এটা স্বাভাবিকভাবেই চলে এসেছে?
আসাদুজ্জামান নূর: না, তৈরি করতে হয়েছে। চিন্তাভাবনা করে তৈরি করতে হয়েছে।
আনিসুজ্জামান: আপনার আবৃত্তির ক্ষেত্রেও ওই কথাটি প্রযোজ্য, যেটা আপনি সহজভাবে করেন।
আসাদুজ্জামান নূর: স্যার, আবৃত্তির পেছনে আমার কিন্তু নাটকের প্রভাবটা থেকেই যায়। একটা নাটকীয়তা আসলে বোধহয় থাকে।
আনিসুজ্জামান: সেটা তো কবিতার দাবি।
আসাদুজ্জামান নূর: আমি যেভাবে করি অন্যেরা কিন্তু সেভাবে করে না। এটা সম্ভবত যেহেতু আমি মঞ্চের লোক সেহেতু এটার সঙ্গে নাটকটা যুক্ত হয়ে গেছে। অন্যরা যখন করে তখন নাটকটা থেকে বিযুক্ত হয়ে করে। এটাকে আলাদা কবিতা হিসেবে পড়ে। আবৃত্তি করার সময় আমার ওই ধরনের এক্সপ্রেশন চলে আসে। একটা নাটকীয় এক্সপ্রেশন, আবেগের জায়গাগুলোতে। যেমন সাতই মার্চের নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটা। ওটা যখন আমি পড়ি, তখন ভিজ্যুলাইজ করি, যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমি তো আসলেই দেখেছি। এখনকার আবৃত্তিকার তো দেখে নি। ওগুলোর একটা প্রভাব মনের মধ্যে পড়ে। ওই যে কবিতার মধ্যে আছে যে বৃক্ষে ফুলে ঢাকা, বেঞ্চ ছিল না, পার্ক ছিল না, আসলেই তো তখন কিছু ছিল না। এখন তো শিশুপার্ক হয়েছে, এই হয়েছে, সেই হয়েছে, দোলনায় শিশু দোল খাচ্ছে। এটা তো আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে। ফলে ওইগুলো আমার মধ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলে।
আনিসুজ্জামান: মঞ্চনাটকে আপনার অভিনীত প্রিয় চরিত্র কোনটা?
আসাদুজ্জামান নূর: কোপেনিকের ক্যাপটেন সবচেয়ে প্রিয় আমার। আব্বাসও আমার প্রিয় চরিত্র।
আনিসুজ্জামান: টেলিভিশনে?
আসাদুজ্জামান নূর: অয়োময়ের জমিদার। এক পর্বের একক নাটকে একটা খুনির রোল করেছিলাম। প্রফেশনাল কিলার। চরিত্রটা ছিল নান্দাইলের ইউনূস। নাটকটার নাম ছিল ‘পিঞ্জিরার মধ্যে বন্দী হইয়া রে’। ওই চরিত্রটা আমার প্রিয় ছিল। আর ‘নিমফুল’ বলে একটা নাটক ছিল, ওখানে একটা চোরের রোলও পছন্দের।
আনিসুজ্জামান: আর ফিল্মে?
আসাদুজ্জামান নূর: সিনেমায় খুব যে ভালো কাজ করেছি আমার মনে হয় না। তারপরেও ‘আগুনের পরশমণি’র চরিত্রের কথাটা মোটামুটি বলা যেতে পারে।
আনিসুজ্জামান: হুমায়ূন আহমেদকে আপনি পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন। তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
আসাদুজ্জামান নূর: আমার নিজের ধারণা (এখন হুমায়ূন থাকলে আর বলা যেত না। খুবই রাগ করত) যদি পরিচালক ও লেখক হিসেবে তুলনা করি, তাহলে লেখক হিসেবে হুমায়ূন অনেক উপরে। পরিচালক হিসেবে ঠিক অতটা উপরে নয়। তবে ‘আগুনের পরশমনি’-তে পরিচালক হিসেবে অনেক ভালো কাজ করেছে। বরং পরবর্তীকালে নাটকে এসে এমন অনেক নাটক করেছে, যেগুলো আমার মনে হয়েছে করা উচিত হয় নি, না করলেও হতো। এটার অবশ্য কারণও আছে। ওর আসলে পরের দিকে মনোযোগ ছিল না। ধৈর্য থাকত না। একটা নাটকের শুটিং করে বলত, ‘আজ আর শুটিং হবে না। চলেন এখন আড্ডা মারি।’ কাজ তো এভাবে হয় না। যে কাজটা একদিনে হওয়ার কথা, সেই কাজটা হতে পাঁচ দিন লেগেছে। এভাবেই কাজ করত।
আনিসুজ্জামান: আপনি তো নাটকের অনুবাদও করেছেন। এটা কি আকস্মিকভাবে নাকি কারও দাবিতে?
আসাদুজ্জামান নূর: দাবিতেই। যখন আমরা নাগরিকে কাজ করি তখন নাগরিকের একটা প্রোডাকশন কমিটি ছিল। প্রোডাকশন কমিটি ঠিক করে দিত যে কোন নাটকটা হবে বা কে পরিচালনা করবে। সাধারণত যিনি নাটকটা করবেন তিনিই প্রস্তাবটা নিয়ে আসেন আলোচনা করার জন্য। প্রোডাকশন কমিটিতে আমি ছিলাম। ওখানে সবাই মিলে বলল যে নূরকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হোক। কী দায়িত্ব দেওয়া হবে? আলী যাকেরই পরামর্শ দিলেন বের্টোন্ট ব্রেশটের নাটকটির অনুবাদের দায়িত্ব নূরকে দেওয়া হোক। তাই আমাকে নাটকের অনুবাদ করতে দেওয়া হলো। আমি অনুবাদ করলাম ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’। এটাই আমার প্রথম অনুবাদ নয়। এর আগে আমি ফেরেঙ্ক মোলনারের একটা নাটক, ‘লিলিয়ম’, যেটা বাংলায় হয়েছিল...। এটা আমি আতা ভাইয়ের সঙ্গে করেছিলাম যৌথভাবে। এটাই প্রথম ছিল।
আনিসুজ্জামান: ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ অসাধারণ।
আসাদুজ্জামান নূর: এটা তো আসলে সবাই মনে করে বাংলাদেশের নাটক।
আনিসুজ্জামান: ব্রেখ্টের নাটক খুব ব্যবহার করা যায় অন্য ভাষায়। কিন্তু আপনি যেভাবে করেছেন মনেই হয় না এটা কোনো বিদেশি নাটক অবলম্বনে রচিত। এরকম সিদ্ধি কী করে লাভ করলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: এগুলো হয়ে গেছে স্যার। এরপর আর হয় নি তো।
আনিসুজ্জামান: অভিনয়ের সময় স্ক্রিপ্ট খুব বদলাতে হয়েছিল?
আসাদুজ্জামান নূর: খুব বেশি না। তবে সিনিয়র অভিনেতারা অনেক সময় নিজের সুবিধার্থে একটু এদিক-ওদিক করেন। এটা নাটকে সব সময় হয়। এটা হক ভাইয়ের নাটকেও হয়েছে। যেমন—আমি শুনেছি, শেক্সপিয়রের নাটকেও নাকি হয়েছে।
আনিসুজ্জামান: ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ তো আপনার খুব জনপ্রিয়।
আসাদুজ্জামান নূর: ওটা আমার নিজেরও খুব পছন্দের চরিত্র।
আনিসুজ্জামান: পরে আপনি ওটা অভিনয়ের বাইরেও ব্যবহার করেছেন?
আসাদুজ্জামান নূর: বহুবার। বিশেষ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। ওটা তো আমি জনতার মঞ্চে, পথে-ঘাটে সর্বত্র ব্যবহার করেছি।
আনিসুজ্জামান: ওটা মানুষ খুব পছন্দ করে। এই যে আপনার সিদ্ধি—এটা আপনার জন্য কীরকম আত্মতৃপ্তি এনেছে?
আসাদুজ্জামান নূর: নাটকটা চালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো আর কি! মনে হয় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়স হয়ে গেলে তখন যে ম্যাচুয়েরিটিটা আসে অভিনয়ের ক্ষেত্রে, সেই সময়ে আমি রাজনীতিতে চলে এলাম।
আনিসুজ্জামান: আপনি রাজনীতি ছেড়ে দিলেন ১৯৭৫ সালে। তারপর আবার ফিরলেন কখন?
আসাদুজ্জামান নূর: ফিরলাম তো এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তখন আমার সঙ্গে নেত্রীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এমনিতে তিনি নাটক দেখতে আসতেন। টেলিভিশনে আমার নাটক খুব পছন্দ করতেন। সে রকম একটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ওই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পরে রাজনৈতিকভাবে যোগাযোগটা বাড়ল।
আনিসুজ্জামান: নির্বাচন করবেন এটা কোন সময় ঠিক করলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: ১৯৯৮ সালে। কারণ ১৯৯৬ সালে নেত্রী আমাকে নমিনেশন দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিই নি। এ রকম ঘটনাও ঘটেছে, সুধাসদন থেকে উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, কোথাও জনসভা করবেন। আমার হাতে নমিনেশন পেপারটা দিয়ে বললেন যে, আর কোনো কথা শুনতে চাই না, এটা ফিলআপ করে নিয়ে আসেন। আমার পেছনে ছিলেন জেনারেল নুরুদ্দিন। তিনি বললেন, এই কাগজের জন্য আমরা ঘুরে বেড়াই, আর আপনাকে দিয়ে যাচ্ছেন? আর আপনি নির্বাচন করবেন না? আমি বললাম যে, বাড়ি যাই না, এলাকার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ওখানে যারা এতদিন ধরে আওয়ামী লীগ করে, তারা আমাকে কীভাবে নেবে? এতকিছু ভেবে আর করা হয় নি। না করে অবশ্য ভুলও হয়েছে একটা। কারণ ওই নির্বাচনটা করলে হয়তো আমি জিতেই যেতাম। জিতলে পরে যেটা হতো সংখ্যাগষ্ঠিতার জন্য কারও সঙ্গে সমঝোতা করতে হতো না। এটা নিয়ে পরে আমার মনটা খুঁতখুঁত করেছে। তারপরে ১৯৯৮ সালে আমি একদিন গিয়ে নেত্রীকে বললাম, এলাকায় যাওয়া-আসা শুরু করেছি। উনি খুবই খুশি হলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৮ সালে দলে যোগ দিলাম। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল— নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এলাকায় তন্নতন্ন করে কাজ করা শুরু করে দিলাম।
আনিসুজ্জামান: এলাকায় আওয়ামী লীগের ওরা আপনাকে স্বাভাবিকভাবে নিল?
আসাদুজ্জামান নূর: প্রথমদিকে একটু সমস্যা তো ছিলই। ২০০১ সালের নির্বাচনে ঘরে-বাইরে দুইদিকেই আমাকে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আনিসুজ্জামান: এলাকার সঙ্গে আপনার ও রকম যোগ ছিল না?
আসাদুজ্জামান নূর: আওয়ামী লীগের সিনিয়র লিডারস, তাঁরা আমাকে সহজভাবে নেয় নি। কিন্তু সাধারণ কর্মী ও সাধারণ মানুষেরা আমাকে নিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি অনেক কাজ করেছিলাম। আমি স্ট্র্যাটেজিটাই নিয়েছিলাম, দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াব। আমি গেলামই তো ১৯৯৮ সালে। তখন যে বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যার রিলিফ নিয়ে। ত্রাণ বিতরণের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমি এখন পর্যন্ত ওই স্টাইলটাই বজায় রেখেছি। সেটা হলো যে, ত্রাণ দেওয়া, ওষুধপত্র দেওয়া, বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া, সাইকেল কিনে দেওয়া, রিকশা দেওয়া—এই কাজগুলো করা।
আনিসুজ্জামান: আপনি তো তিনবার নির্বাচিত হলেন— ২০০১, ২০০৮, ২০১৪।
আসাদুজ্জামান নূর: ২০০১ সালটা কঠিন সময় ছিল। আমরা ক্ষমতায় যেতে পারলাম না। বিরোধী দলে চলে গেলাম। ৬১ জন এমপির মধ্যে আমি একজন। আমার ওখানে আরেকটা সমস্যা হলো যে আমার বিরুদ্ধে সব সময় প্রার্থী থাকে শুধু জামাত থেকে। বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। বিএনপি সব সময় জামাতকে সমর্থন দিত। ফলে ফাইটটা ওদের সঙ্গে হয়।
আনিসুজ্জামান: আপনাদের এলাকা যে মঙ্গাপীড়িত এলাকা বলে পরিচিত ছিল, এটার বদল কীভাবে হলো?
আসাদুজ্জামান নূর: এটা তো রিসেন্ট ফেনোমেনা। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, ২০০৪ সালে, আমাদের এলাকায় লোক মারা গেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, নবকান্ত রায়, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন অভাবে। এ রকম ঘটনা ঘটেছে। এটার পরিবর্তন শুরু হলো র্যাডিকালি ২০০৮ সাল থেকে। আমি দল করি বলে বলছি না। এটা কিন্তু একেবারে বাস্তবতা। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে নেত্রী প্রথম যেখানে হাত দিলেন, সেটা হলো আমাদের ইপিজেড। এই ইপিজেডটা একটা ফ্যাক্টরি দিয়ে উনি শুরু করেছিলেন ২০০১ সালে, ক্ষমতা ছাড়ার আগে। তারপরে বিএনপির আমলে এটাতে দ্বিতীয় কোনো ফ্যাক্টরি যোগ হয় নি। ইনফ্যাক্ট ওরা এটা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা করেছেন তাই বন্ধ করে দিতে হবে—এ রকম একটা ব্যাপার ছিল। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, ওরাও কিছু করে নি। ২০০৮ সাল থেকে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট শুরু হলো। এখন ওখানে ত্রিশ হাজার মানুষ কাজ করে। এটা আমার নির্বাচনী এলাকা। ত্রিশ হাজারের মধ্যে সত্তর ভাগ হলো নারী। সকালে যদি আপনি যান দেখবেন যে হাজার হাজার মেয়ে সাইকেলে করে যাচ্ছে।
আনিসুজ্জামান: এই কর্মসংস্থান হলো কীভাবে?
আসাদুজ্জামান নূর: ফ্যাক্টরি বেড়ে গেল আস্তে আস্তে। এগুলি সব বাইরে থেকে ইনভেস্টমেন্ট। কারণ প্রথমে সেখানে কেউ যেতে চাইছিল না। কারণ ওখানে তো গ্যাস নাই। বিদ্যুতের খরচ বেশি। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে ওরা দেখতে পেল যে ওখানে লেবার কস্ট কম। সাভার বা চট্টগ্রামে লেবার কস্ট অনেক বেশী। আমাদের ওখানে সেই তুলনায় কম। যারা ব্যবসা করে তারা তো ব্যবসা বোঝে। ওই ধরনের ফ্যাক্টরি করল যেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার কম। হাতের কাজ বেশি। যেমন— একটা ফ্যাক্টরির আছে, যেটা সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরি। ওরা পরচুলা তৈরি করে। ফ্যাশন উইগ। এগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হয়। মূলত মহিলাদের নানান ধরনের উইগ। এত রকমের উইগ হতে পারে—এটাই তো জানা ছিল না। এই উইগগুলো মেয়েরা সবচেয়ে ভালো তৈরি করতে পারে। ওরা তো হাতের কাজে এক্সপার্ট। ছেলেরা হাতের কাজে অতটা দক্ষ হয় না। মেয়েরা যতটা সহজে সেলাইয়ের কাজ করতে পারে ছেলেরা তা পারে না। ফলে অধিকাংশ মেয়ে এখানে কাজ করে। এটা একটা বড় ব্যাপার হয়েছে। আরেকটা হচ্ছে এগ্রিকালচার। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের ওখানে বিপ্লব ঘটে গেছে। আগে আমাদের এলাকায় বছরে দুটো ফসল হতো। এখন একেবারে চোখ বন্ধ করে চারটা ফসল হয়। শাকসবজি তারমধ্যে তো আছেই। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়াতে পরিবহন সুবিধা বেড়ে গেছে। সহজেই শাকসবজি ঢাকাতে পৌঁছে যায়। আগে তিন দিন লাগত আসতে। আসতে আসতে অর্ধেক পচে যেত। এখন তো রাতারাতি চলে আসে।
আনিসুজ্জামান: মন্ত্রী হওয়াটা কীভাবে হলো?
আসাদুজ্জামান নূর: এটা তো প্রধানমন্ত্রী করলেন। সেভাবেই হলো।
আনিসুজ্জামান: আপনাকে আগে উনি কি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আপনার কথা চিন্তা করছেন নাকি সরাসরি বললেন?
আসাদুজ্জামন নূর: না। আমাকে একদিন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, আজ আপনাকে শপথ নিতে হবে।... আমার ওপর যে হামলাটা হলো— এটা আমার শেয়ার করা উচিত। হামলাটার সময় যদি নেত্রী স্টেপ না নিতেন তাহলে আমার পক্ষে ওখান থেকে বের হওয়া সম্ভব ছিল না। উনি তখনই খবরটা পেয়েছেন এবং আমাকে ফোন করেছেন। আমি তখন মাইক্রোবাসের মধ্যে আটকা। আমার দলের ছেলেরা কোনোভাবে আমাকে প্রটেকশন দিয়ে রেখেছে। নেত্রী ইন্টারফেয়ার করার পর বিশ মিনিটের মধ্যে বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) চলে আসে। মজার ব্যাপার হলো, আমার সামনে পেছনে কিন্তু পুলিশের গাড়ি। কিচ্ছুই করছে না। অবাক কা- আর কী! যাহোক, বিজিবির দুটো গাড়ি চলে আসে। ওরা এসে ব্লাঙ্ক ফায়ার করা শুরু করল। তারপর আস্তে আস্তে ছত্রভঙ্গ হওয়া শুরু হলো। পুলিশ সারপ্রাইজড হয়ে গেল। সেই ওসিকে পরে অবশ্য ট্রান্সফার করা হয়।
আনিসুজ্জামান: তারপর যে একটা জটিলতা হলো—যারা আপনাকে আক্রমণ করেছিল—তাদের ওপর আবার অ্যাটাক হলো।
আসাদুজ্জামান নূর: ওরা আমাদের দলের চারজনকে মেরে ফেলেছিল।
আনিসুজ্জামান: এটা নিয়ে আপনাকে একটু বিব্রত হতে হয় নি?
আসাদুজ্জামান নূর: পরে ওদের মধ্যে যে কয়েকজন ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজন মারা পড়েছিল। এটা নিয়ে আমাদের ওই এলাকায় ওইভাবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি। সাধারণ মানুষ তো এটার সঙ্গে জড়িত ছিল না। তারা ভেবেছে বেশ হয়েছে। কারণ ওদের যে কয়েকজন মারা গেছে তারা আসলেই খুব ট্রাবলমেকার ছিল। যে হাটে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেখানকার লোক পরে আমাকে বলেছিল যে, ওই দিন অনেক অপরিচিত লোক আমরা দেখেছি। কারণ হাটে যারা আসে, সবাই সবাইকে চেনে। গ্রামের হাট তো। তারা বলেছিল ওই দিন অনেক মানুষ দেখেছি যারা এই এলাকার না। তার মানে আশপাশের এলাকা থেকে ওরা সংগঠিত করে নিয়ে এসেছিল। একদমই পূর্বপরিকল্পিত একটা বিষয় ছিল।
আমাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছে যেদিন, তার একদিন আগেই সেখানে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ওই ইউনিয়নটির পরের ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি। সেখানে রাতে হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ করে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি যারা ছিল তাদের বাড়িতেও আগুন দিয়েছিল। যাই হোক পরে আওয়ামী লীগ কোনোরকম প্রটেকশন দিয়ে রেখেছে। আমি কিন্তু গিয়েছিলাম রিলিফের সামগ্রী নিয়ে ওখানে সাহায্য করতে এবং দেখতে যাওয়া যে ওরা কে কী রকম আছে। ওটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ফিরে আসার সময় আমাদের ওপর হামলা হয়। ওরা জানত যে ওইদিন আমরা যাব। এটা আগে থেকেই ঘোষণা করা ছিল।
আনিসুজ্জামান: আপনি তো বলা যেতে পারে আকস্মিকভাবেই মন্ত্রিত্ব লাভ করলেন। কাজেই এটার জন্য আপনার পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর কী করবেন তা পরিকল্পনা করতে আপনার কতদিন লেগেছিল?
আসাদুজ্জামান নূর: এটা তো সত্যি যে তাৎক্ষণিকভাবে মনের মধ্যে কিছু পরিকল্পনা চলেই আসে। কারণ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা দীর্ঘকালীন, ফলে এখানে সমস্যা কী কী আছে সে বিষয়ে আমার তো একটা ধারণা ছিল। সেটা মাথায় ছিল। আর প্রধানমন্ত্রীও শুরু থেকে আমাকে নানাভাবে গাইড করেছেন। ওঁর এত বছরের অভিজ্ঞতা। মাথায় প্রচুর পরিকল্পনা। এত পরিকল্পনা যে এগুলো বাস্তবায়িত করা একটা বিরাট ব্যাপার। ফলে ওঁর কাছ থেকেও গাইডলাইন পাওয়া গেছে। সেগুলি ধরে আমরা উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজটা শুরু করেছি। আমরা অনেকসময় বলেছি, যে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করব এটা চর্চা করার জন্য লোক লাগবে। শিল্পী যদি না থাকে, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যদি না থাকে, এটা চালাবে কে? উনি বললেন, আপনি আগে তো করেন, দেখবেন লোকের অভাব হবে না। প্র্যাকটিক্যালি কিন্তু তাই হচ্ছে। মানে সেন্টারটা করার পরে এখন আস্তে আস্তে লোকও হচ্ছে। এখন প্রতিটি জেলায় কালচারাল অফিসার নিয়োগ দিচ্ছি। আগে যেটা হয়েছে যে ডিসি অফিসের হয়তো কোনো কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকতেন। কিন্তু ডিসি অফিসের কর্মকর্তার তো নিজেরই একশোটা কাজ।শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন? এখন কালচারাল অফিসার দেওয়ার কারণে শিল্পকলা একাডেমি জেলা পর্যায়ে অনেক অ্যাকটিভ হয়েছে। এখন আমরা উপজেলা পর্যায়ে কালচারাল অফিসার চেয়েছি। হয়তো পেয়েও যাব। এটি পেলে উপজেলা পর্যায়েও সাংস্কৃতিক কর্মকা- আরও বাড়বে বলে আশা করি।
আনিসুজ্জামান: মন্ত্রণালয় থেকে আপনার বড় পরিকল্পনা কোনটা?
আসাদুজ্জামান নূর: মন্ত্রণালয় থেকে আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা এই সময়ের মধ্যে ঠিক ওভাবে হলো না। সেটা হলো যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতিচর্চা। বেশির ভাগ মানুষের একটা প্রত্যাশা থাকে যে আমরা কতগুলো ভবন তৈরি করলাম, কতগুলো শিল্পকলা একাডেমি, কতগুলো পাঠাগার। আমরা মনে করি যে এটার পাশাপাশি চর্চাটা বাড়াতে হবে। সেটা যদি স্কুল পর্যায় থেকে শুরু হয় তাহলে ভালো হয়। আমরা দুই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসেছি কয়েকবার (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা)। এমনিতেই দুই মন্ত্রী খুব উৎসাহী এই ব্যাপারে। তাঁরা সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমরা নিজেদের উদ্যোগে শুরু করেছিলাম। এখন প্রায় এক শ’ স্কুলে এই কার্যক্রম চলছে। আগামীতে বাড়ানো হবে। আমরা সেখানে বাদ্যযন্ত্র দিয়েছি। আমাদের জেলা পর্যায়ে শিক্ষক যারা আছে, তাদের আমরা নিয়োগ দিয়েছি বাড়তি সম্মানী দিয়ে। সপ্তাহে একদিন ওইসব স্কুলে গিয়ে তারা প্রশিক্ষণ দেবেন। কিন্তু কিছু কিছু স্কুল থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকেরা দায়িত্ব নিতে রাজি না। ওঁরা মনে করছেন যে এটা একটা বাড়তি ঝামেলা। এরকম একটা সমস্যা হচ্ছে।
আনিসুজ্জামান: তার মানে ওঁদের এদিকে আনতে সময় লাগবে।
আসাদুজ্জামান নূর: তবে বাড়ছে। এখন তো প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রতিযোগিতা হয়। তারপর যে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ, বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ— ছেলেদের স্কুল এবং মেয়েদের স্কুলের জন্য। এই দুটো এখন বিরাট সাড়া ফেলেছে। খেলাটা কিন্তু এখন একেবারে গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে। সংস্কৃতিচর্চাটা এখনো ওইভাবে হয় নি। কিন্তু এটাও আস্তে আস্তে হচ্ছে।
আনিসুজ্জামান: সরকারি দায়িত্বের বাইরে আপনার আরও প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ আছে—মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে, বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশনের সঙ্গে। এইসব কাজের অভিজ্ঞতা কীরকম?
আসাদুজ্জামান নূর: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে তো প্রতিষ্ঠার আগে থেকে, যখন পরিকল্পনা চলছিল, তখন আমি প্রথম কয়েক বছর একদম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আমি মোটামুটি সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। অনেক সময় দিয়েছি। মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে আর আগের মতো সময় দিতে পারছি না। এমপি থাকাকালীনও দিয়েছি। এখন ট্রাস্টের বৈঠকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। গত সপ্তাহেও একটা মিটিংয়ে গেলাম। আর এখন তো নাট্য উৎসব হচ্ছে। সেটাতেও মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ সহায়তা দিয়েছি। এভাবেই চলছে।
আনিসুজ্জামান: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তো নতুন বাড়িতে গেছে। অনেক সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এর যে আবর্তক আয়, সেটা তো খুব বেশি বাড়ে নি।
আসাদুজ্জামান নূর: না। সেটা বাড়ে নি। কিন্তু ব্যয়টা বেড়েছে। ব্যয় অনেক। সেটা নিয়েই এখন আমাদের দুশ্চিন্তা। একটা সরকারি অনুদান আমরা পাই ঠিকই কিন্তু সেটা দিয়ে তো পুরোটা চলে না। এই ভবন নির্মাণের পেছনে তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় অনুদান আছে। উনিই একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, মনে হয় উদ্বোধনের দিন, এটার তো অনেক খরচ। দেখি আপনাদের একটা ফান্ড করে দিতে পারি কি না। উনি সম্ভবত একটা ফান্ড করে দেবেন। যেটা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে রেখে দিলে ওই টাকা দিয়েই চলবে। এখন আপাতত মোটামুটি এদিক-ওদিক করে চলছে আর কি! কিন্তু একটা প্রফেশনালিজম ডেভেলপ করা দরকার। কারণ আগে আমরা আটজন ট্রাস্টি যাইহোক আমাদের মতো চালিয়েছি। কিন্তু এখন জাদুঘর এত বড় হয়ে গেছে যে আমরা ট্রাস্টিরা সময় দিতে পারি না। আসলে সম্ভব হয় না। আমরা মনে করি যে জাদুঘর চালাতে যাদের প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা রয়েছে, প্রশাসনের সেই ধরনের মানুষ নিয়েই আমাদের চালাতে হবে। কারণ জাদুঘরটির জনবল বৃদ্ধি পেয়েছে। সবমিলিয়ে জাদুঘর সংগঠিত করা, মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া—সেই কাজগুলো আগের তুলনায় বেড়েছে।
আনিসুজ্জামান: আর আবৃত্তি ফেডারেশন?
আসাদুজ্জামান নূর: আবৃত্তি ফেডারেশনে তেমন কিছু করতে হয় না। সেখানে আহকাম আছে। আহকামের সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে। ওরা যথেষ্ট সক্রিয়। ওরাই আয়োজন করে। আমি হয়তো টুকটাক মাঝেমধ্যে যাই। সহায়তা করি কিছু।
আনিসুজ্জামান: সবশেষে আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলেন।
আসাদুজ্জামান নূর: এটা তো আপনি জানেনই। আপনি সবাইকে চেনেন।
আনিসুজ্জামান: কিন্তু পাঠকেরা তো জানে না, তাদের জন্য বলুন।
আসাদুজ্জামান নূর: আমার স্ত্রী শাহীন আখতার। পেশায় ডাক্তার। মেয়ে সাংবাদিক। মেয়ের জামাই বিদেশি। নাম টিমথি গ্রীন। বাংলাদেশেই আছে। আর ছেলে, ছেলের ঘরে নাতনি আছে। পাঁচ বছর হতে চলল। এই মে মাসের ৩০ তারিখে ওর পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। আর আমার ছেলে আপাতত একটা এনজিওতে কাজ করছে। ওর রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে একটা প্যাশন আছে। প্রায় সাত-আট বছর ধরে ওদের নিয়ে কাজ করছে। ওটা নিয়েই সে আছে। পাশাপাশি অন্যকিছু করার চিন্তাভাবনা করছে এখন। আর ছেলের বউ তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। জার্নালিজমে।
আনিসুজ্জামান: আমরা তো মনে করি, আপনি খুব সফল জীবনযাপন করেছেন। সবক্ষেত্রেই। আপনার কি কোনো খেদ আছে?
আসাদুজ্জামান নূর: আমার কোনো খেদ ওভাবে নেই। একটাই খেদ আছে। আমি বলি অনেক সময়, আমার ছেলেমেয়েদের। আমার নিজের সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা হলো যে আমার বাবা ষাট বছরে মারা গেছেন। সেই সময় আমি খুব স্ট্রাগল করছিলাম এবং আমার বাবা চাকরি করতেন না। তাঁর শরীর খারাপ ছিল। আমার মা তখন একাই চাকরি করতেন। মা’র চাকরিও তখন শেষের দিকে। আমার ভাইবোনেরও লেখাপড়া শেষ হয় নি। আমার চাকরিও ছোট চাকরি। বেশি পয়সা পাই না। আমরা যখন একটু একটু করে সচ্ছলতার মুখ দেখলাম, সেই সময় যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তাহলে খুব ভালো লাগত। মা মোটামুটি সবকিছু দেখে গেছেন।
আনিসুজ্জামান: মা আপনাদের সফলতা দেখেছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: হ্যাঁ, নাতি-নাতনির মুখ দেখে গেছেন। মা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। সেটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় ছিল। বাবা যখন মারা গেলেন, তখন হয়েছে কী আমরা হার্টের অসুখের ব্যাপারটা বুঝতাম না। ঢাকায় তখন ও রকম কোনো ডাক্তারও ছিল না।
আনিসুজ্জামান: বাবা কখন মারা গেলেন?
আসাদুজ্জামান নূর: উনি মারা গেলেন ১৯৮১ সালে। তখন হৃদরোগ ইন্সটিটিউট বুঝি কেবল চালু হচ্ছে বা হবে এ রকম ব্যাপার। তখন আমরা বাবাকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাচ্ছি। গুলশানে আখতারুজ্জামান বলে একজন ডাক্তার ছিলেন, তাঁকে দেখাতাম। তিনিও এভাবে কিছু বলেন নি যে আরও সিরিয়াসলি এটা দেখা দরকার। তখন ভারতে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গতিও ছিল না। ওই একটাই আমার কষ্টের জায়গা।
আনিসুজ্জামান: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এখানেই শেষ করি। আর কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
আসাদুজ্জামান নূর: অনেকেই জিজ্ঞেস করে যে আপনার নাটকের জীবন ভালো না রাজনীতির জীবন ভালো? অভিনয় ছেড়ে রাজনীতিতে ঢুকলেন কেন? এক্ষেত্রে আমার কোনো আফসোস নেই। এখন নাটক দেখতে যাই আর নাগরিক-এর সঙ্গেও অল্পবিস্তর জড়িত আছি। কিন্তু আমার নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা, মানুষের জন্য কিছু করতে পারা, এলাকায় কিছু উন্নয়নের কাজ করতে পেরেছি— এগুলি নিয়ে মোটামুটি একটা ভালোলাগার ব্যাপার আছে। একটা সন্তুষ্টি আছে। তৃপ্তি আছে।
অন্যদিন ম্যাগাজিনে পূর্বপ্রকাশিত
Leave a Reply
Your identity will not be published.