‘তিতাস একাট নদীর নাম’ একটি অনন্যসাধারণ চলচ্চিত্র। এটি ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্স-এর প্রথম চল্লিশটিতে ঠাঁই পেয়েছে। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এ ছবির স্রষ্টা। প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান। ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছিল এবং ভারতে ১৯৯১-এ।
‘তিতাস একাট নদীর নাম’ একটি এপিকধর্মী চলচ্চিত্র। এটি একটি নদী তীরবাসী কিছু মানুষের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতনের রূপময় আলেখ্য। তিতাসের ওপর নির্ভরশীল মালো সমাজের সমস্ত দ্বন্দ্বের রূপায়ণ।
‘তিতাস একাট নদীর নাম’ সেই কিশোর নামের মানুষের গল্প, যে নাকি ভিন গ্রামের এক নারীকে স্পর্শ করে বলে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। আর সেই বউকে হারিয়ে পাগলে পরিণত হয়। এটি সেই নারী তথা কিশোরের স্ত্রী, রাজার ঝি অর্থৎ অনন্তের মা’র গল্পও। বহু বছর পর যে স্বামীর খোঁজে তার গ্রামে যায় এবং ঘটনাচক্রে একদিন তার স্বামী ও সে মৃত্যুবরণ করে। ‘তিতাস’ এক বিধবা নারীর গল্পও। বাসন্তী নামের এই নারী অনন্তকে লালন-পালন করে সন্তানের মতো, পরে অনন্ত তাকে আঘাত দিয়ে চলে যায়। সর্বোপরি এ হলো একাট নদীর গল্প, যে নদীটির নাম ‘তিতাস’। তিতাস ছবির নিয়ন্ত্রণী শক্তি, রক্ত-মাংসের চরিত্রের মতো পরিবর্তিত হয়, কখনো প্রাণদাত্রী কলস্বিনী, সংবরিত স্রোত-উদাসিনী। এই নদীর ওপর মালো সমাজের জীবন-মরণ বাঁধা ছিল। ফলে নদী যখন শুকিয়ে গেল, তখন মালোদেওরযৌথ জীবনও ভেঙে গেল। অবশ্য ছবিটি শেষ হয়েছে নতুন জীবনের ইংগিতে।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কীভাবে নির্মিত হলো, এবার সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এ ছবির প্রযোজক, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হাবিবুর রহমান খান। তার স্বপ্ন ছিল এটাই যে, ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে একটি ছবি বানাবেন, সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন হলো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এ প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান খানের ভাষ্য হলো, ‘১৯৬৪ সাল থেকে আমি ঋত্বিক ঘটককে সন্ধান করা শুরু করেছি। প্রডিউসার হিসেবে আমি তখন থেকে ঋত্বিক ঘটককে একরকম খোঁজা শুরু করি। আমার সেই তরুণ বয়সেই তার লেখা ও ছবির কথা শুনে আমার বারবার মনে হয়েছে, একজন ক্রিয়েটর কীভাবে এমনভাবে তাঁর শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন! আমি কিন্তু সেই চৌষট্টি সালে মনে মনে ঠিক করি, যদি কোনোদিন ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে ছবি বানাতে পারি, তাহলেই ছবি বানাব। আমার ওই বয়সে এই ভাবনাটা কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবের কাছে হাস্যকর ছিল এবং তাদের অনেকেই কিন্তু আমাকে পাগল বলেও আখ্যায়িত করত। এমনকি ঋত্বিক-প্রীতি থাকার জন্য আমাকে ইন্ডিয়ান এজেন্টও বলত। আর অনেকেই এটা অবাস্তব মনে করত এই জন্য যে, ঋত্বিক ঘটক পাকিস্তানে এসে ছবি করবেন, এটা অসম্ভব। আমি বলতাম আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা আমি অবশ্যই করব। আর আমি সেই সময়ই জোর গলায় বলতাম, ঋত্বিক ঘটক অবশ্যই এই ভূমিতে এসে ছবি বানাবেন। তিনি পাকিস্তানে নয় বরং নতুন দেশে এসে ছবি বানাবেন।’
এই যে হাবিবুর রহমান খান বন্ধুদের বলেছিলেন যে, ঋত্বিক ঘটক স্বাধীন দেশে এসে ছবি বানাবেন; এই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন এই জন্য যে কলেজে পড়ার সময়ই তিনি সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি ছাত্রলীগ করতেন। সিরাজুল আলম খানের স্নেহভাজন ছিলেন। সেই সময় যে রাজনৈতিক শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন, তাতে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে বৈশিষ্ট্যের জন্য পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল তা কখনোই টিকে থাকতে পারে না, সেটা ভাঙবেই।
হাবিবুর রহমান খান, তার স্বপ্নের মানুষ ঋত্বিক ঘটককে প্রথম দেখেন স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে পল্টন ময়দানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটক। হাবিবুর রহমান খান আয়োজকদের পক্ষে সত্যজিৎকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন না যে ঋত্বিকও আসছেন। ফলে ঋত্বিক ঘটক যখন প্লেন থেকে নামলেন, হাবিবুর রহমান খান চমকে গেলেন। পাশাপাশি স্বপ্নের মানুষের ভাঙাচোরা চেহারা দেখে তার কান্নাও পেল। বলা যায়, প্রিয় মানুষ ঋত্বিক ঘটককে প্রথম দেখে হাবিবুর রহমান খানের খুব কষ্ট হয়েছিল। যা হোক, সত্যজিতের সঙ্গে বরুণ বক্সি নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি হাবিবুর রহমান খানের কাছে জানতে চেয়েছিরেন, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছবি করবেন কি-না। তখন হাবিব জানিয়েছিলেন, সত্যজিৎ নয়, তিনি ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে ছবি নির্মাণ করবেন। তখন বরুণ বক্সি বলেছিলেন, তিনি কলকাতায় গিয়ে ঋত্বিককে খুঁজে হাবিবকে জানাবেন। বরুণ বক্সি কথা রেখেছিলেন। তার ফোন পেয়ে হাবিব কলকাতায় ছুটে যান এবং বরুণ বক্সির বাসায় ঋত্বিকের দেখা পান বিধ্বস্ত, মলিন অবস্থায়। সংগত কারণেই তখন হাবিবের খারাপ লেগেছিল। তিনি যখন তার স্বপ্নের কথা, ছবি বানাবার কথা ঋত্বিককে বললেন, ঋত্বিক জানালেন তিনি অদ্বৈত মল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবি বানাতে চান। [ঋত্বিকের ‘তিতাস’ করার কারণ হলো, তাঁর ভাষায়, তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ড জীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দু’ বাংলাতেই) এই রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্র্রোতব্য বহু প্রাচীন সংগীতের টুকরো; সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়, আমার মনে হয়েছিল, তাই এটা করছি। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল, সুযোগ পেয়েছি, ধরেছি।] কিন্তু উপন্যাসটির স্বত্ব ছিল পুঁথিঘর লিমিটেড নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার কাছে। তারা এ ক্ষেত্রে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছিল। সত্যজিৎ রায় ছিলেন অন্যতম টাস্টি। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, ‘তিতাস’ অবলম্বনে ছবি করবেন ঋত্বিক, তখন সত্যজিৎ পুথিঘর কর্তৃপক্ষকে বলেন, ‘সাবজেক্টটা ঋত্বিকের। উনি যদি এ উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে চান তাহলে দিয়ে দেন’। ফলে খুবই সামান্য একটা অর্থ দিয়ে উপন্যাসের স্বত্বটা নিয়েছিলেন হাবিব।
আট-দশ দিন পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেন হাবিব। তখন তার মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা। চলচ্চিত্র নির্মাণ তখন তার কাছে দেশ গড়ার একটা অনুষঙ্গ মনে হয়েছিল। বন্ধু-বান্ধবদের বিষয়টি জানালে তারা সবাই রাজি। তাদের মধ্যে ছিলেন আকন্দ সানোয়ার মুর্শেদ, ‘তিতাস’-এর কার্যনির্বাহী প্রযোজক; তমিজউদ্দিন রিজভী, সহকারী পরিচালক। আকন্দ সানোয়ারের ভাষ্য হলো, “হাবিবের যে উন্মাদনা ছিল তার ফলেই ‘তিতাস একাট নদীন নাম’ ছবিটি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একজনের শুধু টাকা থাকলেই এমন ছবি করা সম্ভব নয়। হাবিবের উন্মাদনার সাথে সাথে আমরা সবাই দুলেছিলাম। হাবিব এ ছবিটি করার জন্য প্রায় এক বছর ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুতেই মন দিতে পারে নি। তখন তার ধ্যান ও জ্ঞান ছিল ছবিটি সুন্দরভাবে শেষ করা।” তমিজ উদ্দিন রিজভী বলছেন, “হাবিব ভাই মুক্তিযুদ্ধ করার পর আরেক যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। আর তা হচ্ছে, ঋত্বিক কুমার ঘটককে দিয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তৈরি করা। হাবিব ভাইয়ের ডাকেই আমরা তখন এক হয়ে একই পরিবারের সদস্য হয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ছবিটার কাজে নেমে পড়লাম।”
ঋত্বিক বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। শুরুতে তিনি ঢাকাতে থাকেন নি। তাকে রাখা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন ঢাকেশ্বরী মিলের গেস্ট হাউজে। সেখানে বসেই তিনি ছবিটির একটি চিত্রনাট্য লিখেন। তবে এটা ঠিক থাকে নি। শুটিংয়ের সময় সেই চিত্রনাট্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। ছবিটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, চলচ্চিত্রে উপস্থিতি অনুসারে, নুপূর, রওশন জামিল, শিরিন, গোলাম মুস্তাফা, প্রবীর মিত্র, ঋত্বিক কুমার ঘটক, চানু ভট্টাচার্য, নারায়ণ চক্রবর্তী, মালতী দেবী, কবরী চৌধুরী, কে মতিন, শেখ ফজলু, বনানী চৌধুরী, এ মতিন, মেসবাহ আহমেদ, রোজী সামাদ, রাণী সরকার, শফিক ইসলাম. অরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলাজ মল্লিক, সুপ্রিয়া গুপ্তা, রহিমা খাতুন, সুফিয়া রোস্তম, ফরিদ আলী, মহিব্বুর রহমান, সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, খলিল খান, ফারুক খান, সাগরিকা, ফখরুল হাসান বৈরাগী, শামসুল হুদা, সিরাজুল ইসলাম, শহীদ, অমিতা বসু, তমিজ রিজভী, রবিউল হোসেন, সুনীল, আমিন, জয় ইসলাম ও অন্যান্য। অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, গোলাম রব্বানী, দিলীপ চক্রবর্তী, জাহাঙ্গীর জাকলাদার। লক্ষণীয়, এই শিল্পী তালিকায় সুপরিচিত ও জনপ্রিয় শিল্পী যেমন ছিলেন তেমনই ছিলেন নতুন মুখ। ঋত্বিকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্পীকে তার কাছে হাজির করা হয়েছিল এবং তিনিই তাদের নির্বাচিত করেছেন।
ছবিটির নায়ক অর্থাৎ কিশোরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র। তিনি অবশ্য ফার্স্ট চয়েজ ছিলেন না। সরকার কবীরকে প্রথমে ভাবা হয়েছিল কিশোরের ভূমিকায়। কিন্তু তিনি যেহেতু তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন এবং ছুটি পান নি সেহেতু অভিনয় করতে পারেন নি। অগত্যা প্রবীর মিত্রকে ভাবা হয়। তিনি চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের লালমাটিয়ার বাসায় গেলেন, সেখানেই ঋত্বিক ছিলেন, ড্রয়িংরুমে। তখন তিনি ডাবল সোফায় শোয়ার ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে একটি বই পড়ছিলেন। তৎসঙ্গে বিড়িও ফুঁকছিলেন। পাশের টি টেবিলে ছিল আরও কয়েকটি বই, একটি লিকারের বোতল। সেই ড্রয়িংরুমে ঢোকার পর একজন বলল, ‘দাদা, ইনিই প্রবীর মিত্র।’ বাকিটা প্রবীর মিত্রের জবানিতে শোনা যাক, “দেখলাম, ঋত্বিক দা আমার দিকে একটা লুক দিয়ে নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন। নিজের কাজ মানে, নভেল পড়া, বিড়ি ফুঁকা, মাঝে মাঝে লিকার খাওয়া আর গায়ে যে কাঁথাটি জড়ানো ছিল, সেটা একটু ঠিক করে নেওয়া। আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। অন্যরা সব বাইরে এবং ওরা সব বাইরে থেকেই ইংগিত করছে, আমি যেন তাকিয়ে থাকি। এর মধ্যে কয়েকবার দাদার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। শুধু দেখলাম, কী প্রবল আর তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। মনে হচ্ছিল আমার অন্তর্দেশ ভেদ করে চলে যাচ্ছে। তখন গোধূলি বেলা। সূর্যের নরম আলো ঘরে ঢুকছে। হঠাৎ দাদার কণ্ঠস্বর শুনলাম। তিনি আমাকে বিভিন্ন দিকে মুভ করালেন, ক্লোজলি দেখলেন। তারপর বসতে বললেন। আমি তার সামনে বসলাম। তারপর তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার অভিনয়জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমার তখন এমন এক অবস্থা যে আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। তার চোখটা ছিল অন্য রকম। তীক্ষè আর উজ্জ্বল। একটা সময় লক্ষ করলাম, উনি ঘনঘন বিড়ি ফুঁকছেন। লিকার খাচ্ছেন আর বইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ দরজার বাইরে কার দিকে যেন তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ দিয়ে শুধু বললেন, এই কণ্টাক্ট হিম। অমি সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এসে যে ফর্ম এগিয়ে দিলেন সেখানেই সই করে ফেললাম।” এভাবেই ছবির অভিনয়শিল্পীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন।
‘তিতাস’-এর মূল শুটিং হয়েছিল ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ ঘাটে, যে জায়গা ও মানুষের জীবন নিয়ে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ তাঁর উপর্নাস লিখেছিলেন্। এ প্রসঙ্গে কার্যনির্বাহী প্রযোজক আকন্দ সানোয়ার মুর্শেদ বলছেন, ‘আমরা প্রথমে তিতাসের লোকেশন দেখার জন্য গোকর্ণ ঘাটে গেলাম। দাদা আমাদের সবাইকে লোকেশন ও চিত্রগ্রহণের বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরত আসলেন এবং আর্ট ডিরেক্টর মুনশী মহিউদ্দিন, আমি আর দু’ একজন থেকে গেলাম সেট তৈরির জন্য। আমাদেন সেট বানানো শেষ হলে ঢাকা থেকে অন্যান্যরা একটি লঞ্চ, একটি পাঁচ মণি নৌকা ও একটি জেনারেটর নিয়ে এলেন। বেশ কয়েকজন বাই রোডে গাড়িতেও এসেছিলেন। একটা মহা কাণ্ড তখন শুরু হয়ে গেছে।’
গোকর্ণ ঘাট ছাড়া ছবিটির শুটিং হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনপুরা, নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যার বাজার, আরিচাঘাট, পাটুরিয়া এবং এফডিসিতে। উল্লেখ্য, আউটডোর লোকেশনে শুধু গোকর্ণ ঘাটের পাশে একটি বাড়ির সেট তৈরি করা হয়েছিল। তবে বলাই বাহুল্য, ঋত্বিক ঘটকের কাজের ধরন ছিল আলাদা। শুটিং-এর ব্যাপারটা গোছানো ছিল না। পরের দিন কী শুটিং করবেন তা আগের রাতে ঠিক করতেন, এমনকি লোকেশনে গিয়েও সিদ্ধান্ত নিতেন। কখনো শট ডিভিশন করতেন না।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মহরত হয় ১৯৭২-এর ১৪ জুলাই। ১৬ জুলাই শুটিং শুরু হয়। সাভারের একটি বটগাছের নিচে। ৩৪ নং দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণের মাধ্যমে। প্রয় এক’শ দিন শুটিং হয়েছিল। তবে ছবির পুরা কাজ শেষ হতে হতে ১৯৭৩ সালের জুলাই লেগে গিয়েছিল।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সেই কিশোর নামের মানুষের গল্প, যে নাকি ভিন গ্রামের এক নারীকে স্পর্শ করেছিল বলে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। আর সেই বউকে হারিয়ে পাগলে পরিণত হয়। এটি সেই নারী তথা কিশোরের স্ত্রী, রাজার ঝি অনন্তের মা’র গল্পও। বহু বছর পরে যে স্বামীর খোঁজে তার গ্রামে যায় এবং ঘঁটনাচক্রে সে এবং তার স্বামী মারা যায়। ‘তিতাস’ এক বিধবা নারীর গল্পও। বাসন্তী নামের এই নারী অনন্তকে লালন-পালন করে সন্তানের মতো। পরে অনন্ত তাকে আঘাত দিয়ে চলে যায়। সর্বোপরি এ হলো একটি নদীর গল্প, যে নদীর নাম ‘তিতাস’। তিতাস ছবির নিয়ন্ত্রণী শক্তি। সে রক্তমাংসের মানুষের মতো পরিবর্তিত হয়, কখনো প্রাণদাত্রী কলস্বিণী, কখনো সংবরিত স্রোত উদাসিনী। এই নদীর ওপর মালো সমাজের জীবন-মরণ বাঁধা ছিল। ফলে নদী যখন শুকিয়ে গেল. তখন মালোদের যৌথ জীবনও ভেঙে গেল। অবশ্য ছবিটি শেষ হয়েছে নতুন জীবনের ইংগিতে, ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে একটি শিশুর দৌড়ানোর মধ্য দিয়ে তা মূর্ত হয়ে ওঠে। ছবির শেষাংশটুকু চিত্রনাট্য থেকে তুলে ধরা যাক-
দৃশ্য ৭৭ (শেষাংশ)
লং শট-এ তিতাসের বালুর চর। বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে বাসন্তী। ক্লোজআপ-এ বাসন্তীর পা বালিতে ঢুকে যায়। অনেক কষ্টে চলতে থাকে সে। ক্যামেরা টিল্ট আপ হয়। হেঁটে চলে যায় বাসন্তী।
লং শট-এ বালির চর দিয়ে দূর থেকে হেঁটে আসে বাসন্তী। হাঁটতে তার কষ্ট হয়।
ক্লোজআপ-এ বাসন্তীর মুখ। বাসন্তী এদিক-ওদিক তাকায়। বুকে আঁকড়ে ধরা ঘটি। একসময় বসে পড়ে। ক্যামেরা সঙ্গে সঙ্গে টিল্ট ডাউন হয়। বাসন্তী ঘটিটা বালিতে রেখে দুই হাত দিয়ে বালি সরানো শুরু করে। তার ক্লান্ত মুখের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। অনেক খোঁড়ার পর সুরঙ্গের মতো তৈরি হয়। একটু পানি পাওয়া যায়। ঘটি দিয়ে ভেজা বালিসহ পানি তুলে আনে। প্রাণ বের হওয়ার আগে শেষ পানি মুখে ঢালে। পানি গড়িয়ে পড়ে ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে। বাসন্তী ঢলে পড়ে বালিতে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাঁশির (ভেঁপু) শব্দ ভেসে আসে। চোখ মেলে বাসন্তী দেখার চেষ্টা করে। লং শট-এ ক্ষেতের আইল দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দৌড়িয়ে চলে একটি স্বাস্থ্যবান শিশু।
ক্লোজআপ-এ বাসন্তীর নিষ্প্রভ মুখ।
মিডশট-এ ছেলেটির ধানের ক্ষেতের ভেতর দিয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য।
ক্লোজআপ-এ বাসন্তীর হাসি ফুটে ওঠা মুখ।
মিডশট-এ ছেলেটির লাফিয়ে চলার শব্দ। ঘুঙুরের আর বাঁশির আওয়াজ।
ক্লোজআপ-এ বাসন্তী হাত বাড়িয়ে দেয় ছেলেটির দিকে। চেহারায় কষ্ট ফুটে ওঠে বাসন্তীর। লং শট-এ ছেলেটি দৌড়ে চলে যাচ্ছে। হোঁচট খায় ছেলেটি।
ক্লোজআপ-এ চলে যাওয়া ছেলেটির দিকে বাসন্তী হাত বাড়িয়ে দেয়। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নিজের হাত নিজেই আঁকড়ে ধরতে চায় বাসন্তী।
প্রায় আঁকড়ে ধরা হাত, অবিন্যস্ত চুল ও বিধ্বস্ত মুখের ক্লোজআপ-এ ফ্রিজ হয়ে যায় ক্যামেরা।
এই যে প্রাণপ্রবাহ, এর ইঙ্গিত দেওয়ার উদ্দেশ্যে চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক মৌল প্রতীকের প্রবল শক্তিকে চলচ্চিত্রে ঠাঁই দিয়েছেন। আদিমাতা বা মহিয়সী মাতাকে মা ভগবতী হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। এখানে ‘মা’ হচ্ছে ভালোবাসা ও সংযুক্তির প্রতীক। এ প্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের ভাষ্য হলো : ‘আমি মা-কে ব্যবহার করি কাব্যিক দ্যোতনায়, কোনো ধর্মীয় অর্থে নয়।’ আর শিশু-প্রতিমার ব্যবহার প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘আমার বক্তব্য হলো নিজেদের ভবিষ্যতকে দেখো, আর তাই ও ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত শিশুর প্রতীকই দেখা দেয়। তার তাৎপর্য এই যে ঘোর পাপ আর পতনের মধ্যেও, যা আমি দেখিয়েছি, উত্তরণের মধ্য দিয়েই মানুষ আগামীর দিকে এগোবে এবং একদিন না-একদিন সংসারকে সুখময় করে তুলবে।... চেখভের মতো আমিও ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা রাখি।’
ছবিতে ব্যবহৃত গানগুলো হলো- ওরে নৌকার ওপার গঙ্গা বুঝায়, লীলাবালী লীলাবালী, রাই জাগো, রাধা-কৃষ্ণের মিলন হইলো, কোরানেতে প্রমাণ তার, ও তোর আপন দোষে সব হারাইলি। গানগুলো গেয়েছেন রথীন্দ্রনাথ রায়, নীনা হামিদ, আবিদা সুলতানা, ধর্মীধান বড়ুয়া। চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম। সম্পাদক বশীর হোসেন। সংগীত ভাবনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ঋত্বিক কুমার ঘটক।
Leave a Reply
Your identity will not be published.